রাজপুতানার খানাখাজানার ইতিহাস

সুকন্যা দত্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে যুক্ত। তথ্যমূলক লেখার প্রতি প্রবল আকর্ষণে কলম এ ফুটিয়ে তোলেন অজানাকে। লোক সংস্কৃতি,নানান দেশের খাদ্য,আচার আচরণ ও ভ্রমণমূলক লেখার প্রতি আগ্রত রয়েছে। বিভিন্ন স্থানের ইতিহাসের টানে চলে যান সেই মাটির কাছে। শৈশব থেকেই গান গাইতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি নাটকে তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।ইনিও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

রাজপুত রসোরা

 

পর্ব-১...

থর মরুভূমির রাজ্য রাজস্থান। পূর্বে এর নাম ছিলো রাজপুতনা অর্থাৎ রাজপুতনাদের রাজ্য কিন্তু স্বাধীনতার পর এই রাজ্যের নাম হয় রাজস্থান অর্থাৎ রাজাদের স্থান। বালির শহর,প্রাসাদময় যার আনাচে কানাচে রয়েছে ইতিহাস ও স্থাপত্যের নিদর্শন। রাজস্থানের খাবারের তালিকায় রয়েছে ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক,সামাজিক প্রভাব। উষ্ণ আবহাওয়া, জল সংকট,সবুজের অভাব ও পূর্ববর্তী অগনিত যুদ্ধ রাজস্থানের খাদ্যের তালিকাকে সেভাবে সাজিয়েছে।
রাজস্থানে জলের অভাব জনিত কারণে বিকানীর,যোধপুর, জয়সলমীর, বারমেরের বাসিন্দারা জলের পরিবর্তে বাটার মিল্ক, ঘি,দুধের ব্যবহার করে। এরফলে রান্না দীর্ঘক্ষণ টাটকা ও থাকে।রাজস্থানের মানুষরা মূলত রাজপুত হওয়ায় তারা শিকারে যেতো।তার ফলে শিকারের মাংস রান্নায় ধোয়া, কাটা বা তেমন প্রচলন ছিলো না।শিকার শেষে খাওয়ার জন্য তাবুতে রান্না করা হতো। জঙ্গলে রান্নায় ভিন্ন উপকরণের অভাবে মাখন,নুন,প্রচুর লাল লঙ্কার গুড়ো ও সামান্য মশলা দিয়ে ক্যাম্পের বাইরে রান্না করা হতো। এর নাম ছিলো লাল মাস(মাংস)। সালওয়ারের মহারাজা জঙ্গলী মাস বা জঙ্গলী মাংস তৈরি করতেন। শিকারের সাথে তাল মিলিয়ে রান্নার পদের সৃষ্টি করা হতো। শিকার কালে আর একটি বিখ্যাত পদ হলো পাঁঠার মাংসের পাকস্থলীর কাবাব৷ মাংসের পুর পাঁঠার পাকস্থলীর ভিতর ভরে আগুনে ঝলসে খাওয়া হতো। বাড়ীর পুরুষরা যুদ্ধ, শিকার বা রোজগারের জন্য বাড়ীর বাইরে যাওয়ার আগে বাড়ীর মেয়েরা তাদের জন্য সহজপাচ্য রান্না করে দিতো যাতে খাবার বহুদিন টাটকা থাকে।
রাজপুতদের খাদ্য তালিকায় চাটনীর আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। যার মধ্যে পুদিনা, ধনে,হলুদ,রসুনের চাটনী হলো বিখ্যাত।
রাজস্থানের একটি প্রধান উৎসব হলো শরৎ পূর্নিমা উৎসব। এই দিন চাঁদ পৃথিবীর খুব কাছে আসে বলে রাজস্থানের বাসিন্দারা সাদা বস্ত্র পরিধান করে পূর্নিমার আলোয় চাঁদের আলোর নিচে বসে সপরিবারে ভোজন করেন। পল পায়েস, ক্ষীর, গোলাপ কাঠবাদাম ক্ষীর,, মশলা দুধ,শীতল কোর্মা, গদম পোলাও, খেজুর মুকুটি প্রভৃতি দুগ্ধ শুভ্র পদ রান্না করা হয়।সারা বছরের ফলিত ফসলের আনন্দ পালন করার জন্য এই উৎসব পালন করা হয়। রাজপুতদের মধ্যে শিকারের চল থাকায় তাদের খাদ্য তালিকায় বণ্য হরিণ,খরগোশ, বন্য শূকর,হাঁস,নানান পরিযায়ী পাখি,উটের মাংসের প্রচলন লক্ষ্য করা যায়।
রাজস্থানের রান্নায় মুঘল ও ব্রিটিশদের খাদ্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। রাজস্থানী খাবারে বারবিকিউ এর প্রচলন হয়,পাঠানদের শাসনের পর।এগারো রকমের পদ্ধতিতে শূল-ধূম্র কাবাব বা বারবিকিউ এর মাংস রান্না হতো।
রাজস্থানের রান্নাঘর কে বলা হয় ” রসোওয়ারা”। সকালের জলখাবারে প্রায় দশ রকমের পদের উল্লেখ পাওয়া যায়। বড় বড় দামী ধাতুর পাত্রে এই রান্না পরিবেশন করা হতো।
এই রাজ্যের রঙিন পোশাকের সাথে খাবার রকমফের ও ইতিহাস তৈরি করেছে।আর সে সব খাদ্য প্রণালী তারা সিন্দুকে বন্দী করে রাখতো। এই প্রণালীর গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য তারা প্রাণ দিতে ও প্রস্তুত ছিলো।এদেশের স্ত্রী লোকেরা আমীষ খাবার তৈরি করতো না, কেবল পুরুষরাই আমীষ রান্না করতো। স্ত্রী লোকেরা মন্দিরের জন্য সাত্ত্বিক ভোজন প্রস্তুত করতো। রাজস্থানের রানী গায়ত্রী দেবী কোচবিহারে বড় হয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে অসংখ্য নদী ও জলাশয় থাকায় ওনার খাদ্যাভাসে মাছের প্রাধান্য ছিলো। গায়ত্রী দেবীর হাত ধরেই রাজস্থানের রাজপ্রাসাদের রান্নাঘরে প্রবেশ করলো মাছ।

 

 

পর্ব-২

ভারতের সংস্কৃতিকে কোনো সীমারেখায় বেঁধে রাখা যায় না। সভ্যতা ও ইতিহাসের মহাসাগর এই দেশ।বিভিন্ন ধর্ম, রাজার প্রভাব শিল্প ও খাদ্যে লক্ষ্য করা যায়।রাজস্থানে একই থালায় মাড়োয়ারি, মুঘলাই,ব্রিটিশ খাবার পরিবেশিত হয়।থর মরুভূমির এই দেশে প্রাসাদের আনাচে কানাচে, রাঠোরদের শৌর গাথায়,গানে এই দেশের মাটির গন্ধ পাওয়া যায়। রাজস্থানের মাড়োয়ার একটি বিশিষ্ট স্থান। ‘মাড়োয়ার” শব্দের অর্থ ‘ Land of Death’। মাড়োয়ারবাসীরা মাড়োয়ারি নামে পরিচিত। এরা মূলত নিরামিষভোজী। ‘ডাল- বাটি- চুরমা’ এ অঞ্চলের একটি বিখ্যাত খাবার। এই পদের পিছনে একটি ইতিহাস লুকিয়ে আছে।১৫৪৩ সালে শের শাহ শূরী ৮০,০০০ হাজার সৈন্য নিয়ে মাড়োয়ার আক্রমনে উদ্যত হলে,সে সময়ের রাজা মালদেব নিজে ও ৫০,০০০ হাজার সৈন্য নিয়ে প্রস্তুত হলেন। উভয়ের মধ্যে কঠিন লড়াই চলতে লাগলো। রাজপুতরা বাজরার রুটি,বাজরার বাটি খেয়ে শক্তিশালী ছিলো কিন্তু এক মাস পর শেরশাহ নিজের শক্তি হারাতে শুরু করলেন। এই ঘটনার জন্য শের শাহ বলেছিলেন,
” একমুঠো বাজরার জন্য আমি হিন্দুস্থানের আধিপত্য হারাতে বসেছিলাম “। তবে বাটি তৈরির সময় এর বহু পূর্বে।

কথিত আছে, মেওয়ারের রাজা বাপ্পা রাওয়ালের সৈন্যরা যুদ্ধে যাওয়ার আগে বাজরার তৈরি বাটি বালির তলায় রেখে যেতেন, বালির গরমে ও সূর্যের তাপে সেই বাটি সেঁকা হয়ে যেত। যুদ্ধ থেকে ফিরে তারা সেই বাটি গর্ত খুঁড়ে বের করে দই ও ঘি এর সাথে খেতেন

চুরমা তৈরি হয়েছিলো ভুল বশত। মেওয়ারের এক রাঁধুনি গুহিলত ক্লান রান্নার সময় ভুল করে বাটিতে আখের গুঁড় ঢেলে দিয়েছিলেন, এর ফলে বাটি নরম হয়ে তৈরি হয় চুরমা।পরবর্তীকালে যোধা বাঈ এর মাধ্যমে আকবরের আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের রান্না ঘরে পৌঁছে যায় ডাল বাটি চুরমা।
তবে এই বাজরা ২০০০ খ্রিঃ পূর্বাব্দে এসেছিলো আফ্রিকা থেকে।
রাজস্থানের মান্ডুর রাজা রাও যোধা পনেরো বছরের জন্য তার কেল্লা হারিয়ে ফেলেন। কিভাবে সে কেল্লা উদ্ধার করবেন,তা ভেবে পথে পথে ঘুরে বেড়ান। ক্লান্ত হয়ে সেই সময় এক জাঠের চাষের জমির একটি ছোট্ট ঘরে একটি বৃদ্ধার কাছে যান। বৃদ্ধা কে চিনতে না পেরেই তার আপ্যায়নের জন্য মাটির হাঁড়ি থেকে গরম গরম খিচ পরিবেশন করে রাজা কে খেতে দেন৷ রাজা গরম খিঁচ এর মাঝে হাত দিতেই তার হাত পুড়ে যায়। বৃদ্ধা তাকে বলেন,
তুমি তো রাজা রাও যোধার মতো,মাঝখান থেকে কেউ খায়? পাশ থেকে অল্প অল্প করে খেতে হয়”।
রাজা উপলব্ধি করেন,কেল্লা জয় করতে হলে কেল্লার আশপাশের এলাকা একটু একটু করে জয় করতে হবে।

মাড়ওয়ারের মাথানিয়া লঙ্কা জগৎ বিখ্যাত।কোনো এক রাজা যোধপুরের মাথানিয়া গ্রামে এই লঙ্কার বীজ এনে কৃষকদের বপন করতে দিয়েছিলেন।তবে ভারতে লঙ্কা আসে ১৬শ শতকে পর্তুগীজদের হাত ধরে,তার আগে রান্নায় ঝালের জন্য গোলমরিচের প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। এর উজ্জ্বল লাল রঙের জন্য এই লঙ্কা ” লাল বাদশাহ ” নামে পরিচিত।

১৮৬৯ সালে রাজস্থানে প্রবল দূর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সে সময় শস্য কাঁটা গাছ, ঝোপের পাতা খেয়ে পেট ভরতো সে দেশের মানুষ। এভাবেই এই দেশে ‘ খের শাগরি” র উদ্ভব হয়।

লেখা পাঠাতে পারেন

 

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *