“কুড়মিদের কাছিমনামা”

পরিচিতিঃ প্রকৃতি প্রেমের আরেক নাম।ভালোবাসার কোনও বাটখারা হয় না তা লেখকের সাথে না যাপন করলে বোঝা বড্ড দায়।মূলত রাকেশ একজন ছবিওয়ালা।আর তার চর্চার আধার সেই সব অবলা জীবজন্তু পশু পাখি।নিয়মিত লেখেন বিভিন্ন বানিজ্যিক পত্রিকায়।এই মুহূর্তে কাজ করছেন হাতি নিয়ে।বিভিন্ন “পরিবেশ বাঁচাও” সংস্থার সাথে জড়িয়ে ফেলেও তিনি নিরঙ্কুশ।একক।তিনি জানেন ভালোবাসতে ফেরৎ পেতে নয়।ইনি বাইফোকালিজম্-এর অন্যতম সদস্য।

 

“কু ড় মি দে র     কা ছি ম না মা”

লিখছেনঃ রা কে শ   সিং হ দে ব

জঙ্গলমহলের কুড়মি জনজাতির টোটেমবাদ ও কাছিম
রাকেশ সিংহ দেব

বছর তিরিশ আগে জঙ্গলমহলের এক প্রত্যন্ত গ্রামে এক পঞ্চাষোর্ধ বৃদ্ধ জমির কাজ তদারকি করছেন আর পাশে ঘাসের উপরে তাঁর প্রাথমিকে পড়া নাতি আপনমনে প্রজাপতি আর ফড়িং-দের সাথে ব্যস্ত। হঠাৎ মাঠে কাজ করা এক মজদুর, ‘জ্যাঠা একটা কচ্ছপ পাইছি’ বলে লাফিয়ে ওঠে। বৃদ্ধ দেখেন সামনের জলাশয় থেকে এক মাদি তিলা কাছিম ধীর গতিতে জমির উপর দিয়ে চলেছে। সাঁওতাল মজুরেরা কাছিমটি খাওয়ার জন্য ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতেই সেই বৃদ্ধ বলেন, ‘কুড়মির জমির লে তরা কাছুয়া লিয়ে যাবি, তদের সাহস ত কম লয়। ছাড় উটাকে।’ নাতিকে কাছে ডেকে বৃদ্ধ সস্নেহে বলে, ‘দাদু হামরা হলি কুড়মি কাছুয়া হামদের ঠাকুর বঠে। জানি লে কনদিন কন কাছুয়াকে মারবি নাঞ।’ এরপর নিজে সেই কাছিমটিকে জলাশয়ে ছেড়ে আসেন। সেদিনের সেই কুড়মি বৃদ্ধ পঞ্চভূতে বিলীন হয়েছেন বছর পাঁচেক আর তাঁর সেই শিশু নাতি আজ তাঁকে স্মরণ করে লিখছে ‘কুড়মি জনজাতির আপন কাছিমনামা’। কিন্তু, এই লেখা আমাদের কুড়মিদের জন্যই শুধু নয় বরং এই লেখা আপামর বাংলা ভাষাভাষী সমস্ত মনুষের জন্যও। তাই সংক্ষিপ্তভাবে কথায় তুলে ধরবার চেষ্টা করব আমাদের রাজ্যের জঙ্গলমহল সহ সমগ্র ছোটনাগপুর জুড়ে বসবাসকারী এই সুদীর্ঘকালের টোটেমিক উপজাতি প্রসঙ্গে। এই প্রচলিত সমাজে থেকেও তাদের ভিন্নতর সমাজ, ভিন্নতর ভাষা বৈভব ও সংস্কৃতি। তাদের নেগ-নেগাচার, আচার-বিচার, কথ্য অকথ্য সবকিছু নিয়ে কুড়মি ও কুড়মালি ভাবধারা। যারা আজও নিজেদের অক্লেশে সমর্পন করে প্রকৃতির কোলে। তাদের চোখে প্রকৃতির বাইরে কোনও কিছুই নয়, না দেব-দেবী না পরব তেওহার আর না নেগ-নেগাচার। তাই তাদের জীবন বোধ ও শৈলী আবর্তীত হয় এই একক কুণ্ডলি জুড়ে। এযাবৎকাল পর্যন্ত গবেষনাতে, সমীক্ষাতে প্রাক্‌বৈদিক যুগের কৃষিভিত্তিক সভ্যতার যতটুকু নিদর্শন পাওয়া গেছে তার প্রায় সবটুকু এখনও কুড়মি জনজাতির মানুষ তাদের আচার সংস্কৃতিতে ধারন করে রেখেছে। বহন করে চলেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের ধারায়।
কুড়মি জাতি অন্যান্য আদিম জাতির মতোই প্রকৃতির পূজারি (animist বা সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাসী) প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান বা রূপকে কুড়মিরা আজও দেবতা জ্ঞানে পুজা করে। কুড়মি জাতির মধ্যে গোত্রের প্রচলন নেই, রয়েছে গোষ্ঠীর প্রচলন। বৈদিক গোত্রগুলি যেমন বিভিন্ন মুনি ঋষির নামে হয়ে থাকে সেখানে কুড়মি গুষ্ঠি বা গোষ্ঠীগুলি বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি এবং উপাদানকে তাদের গোষ্ঠীর টোটেম বা প্রতীক রূপে গ্রহন করেছে। প্রত্যেক গোষ্ঠীর নির্দিষ্টি প্রতীক বা টোটেমগুলি তাদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। টোটেম হল সেই প্রতীক যা দিয়ে টোটেমিক আদিবাসীদের বংশ বা কুল চিহ্নিত হয়। কুড়মি জনজাতির মোট ৮১ টি গোষ্ঠীর জন্য নির্দিষ্ট টোটেমের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক এবং প্রাকৃতিক উপাদানের পাশাপাশি রয়েছে কাছিম বা কচ্ছপের উপস্থিতি।

টোটেমবাদীরা বলেন, কুড়মি – মাহাতরা কুর্ম বা কচ্ছপকে দেবতা হিসেবে মানে। তাইতো এই কয়েকদিন আগে আন্তর্জাতিক কচ্ছপ দিবসের আগের রাতে অন্ধকারে রাস্তার উপর কচ্ছপ পেয়ে নিকটবর্তী ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসে জমা দিয়ে আসেন গ্রামের কতিপয় কুড়মি মানুষজন। কাছিমের সংরক্ষণ বা বাস্তুতন্ত্রে এদের গুরুত্ব সম্পর্কে জঙ্গলমহলের এই দিন আনা দিন খাওয়া কুড়মিরা কতটা ওয়াকিবহাল তা জানা নেই তবে কুড়মি অধ্যুষিত এলাকায় আজও প্রকাশ্যে কচ্ছপ বা কাছিম কেনাবেচা হয়না। কচ্ছপ বা কাছুয়া যাদের গোষ্ঠীর টোটেম তারা কচ্ছপ বা কাছিম মারেনা বা খায়না। তবে শুধুমাত্র ঐ নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষেরাই নয়, সমস্ত কুড়মি জনজাতির মানুষ দেবতা হিসেবে কাছিমের শ্রদ্ধা করে। নিজের জলাশয় বা জমিতে কাছিম পেলে তাকে না মেরে তেল সিঁদুরের টিকা লাগিয়ে জলাশয়ে মুক্ত করে দেওয়া হয়। কুড়মি জনজাতির ‘হসতআর’ এবং ‘কাছুআর’ গোষ্ঠীর টোটেম অনুসারে কচ্ছপ মারে না বা খায় না। এরা ভক্তি শ্রদ্ধার সাথে কাছিমের পূজা করে থাকেন। উইলিয়ম ক্রুক হিন্দু দশাবতারদের টোটেম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি হিন্দু দেবতাদের বাহনকেও টোটেমবাদের প্রভাব হিসেবে বলেছেন। বৈদিক ঋষিদের অনেকের নাম মানবেতর প্রাণীর নামে নামাঙ্কিত, যা টোটেমের স্বাক্ষর বহন করে। যেমন: কাশ্যপ গোত্র এসেছে কচ্ছপ থেকে। পরবর্তীতে রচিত বৈদিক মতবাদের কারণে গোত্রগুলির টোটেমিক উৎস ঢাকা পড়ে যায়।
টোটেম-এর ধারণা মানুষের সাথে প্রাকৃতিক পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে যেভাবে সুষম যোগসূত্র রক্ষা করে তা আসলে টোটেমিক মানুষজনের মননের মধ্যকার ‘সর্বপ্রাণবাদ তত্ত্ব’-এর উপস্থিতির বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করে। এই ‘সর্বপ্রাণবাদ তত্ত্ব’-এর মূল বিষয়বস্তু হল আমরা সবাই প্রকৃতির সন্তান এবং প্রাকৃতিক সমস্ত কিছুর মধ্যেই অন্তর্নিহিত রয়েছে আত্মা এবং আত্মিক মেলবন্ধন। পরিশেষে বলতে হয় এই টোটেমিক বিশ্বাস শুধুমাত্র… কুড়মি জনজাতির সমাজ-সংস্কৃতি, ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের পরিচয় বহন করেনা এটা প্রকৃতির সাথে জঙ্গলমহলের মানুষের সুস্থ ও স্বাভাবিক সহাবস্থানের বার্তা দেয়।

 

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *