কলকাতার কথকতা(২য় পর্ব) কলমেঃ প্রা ন্তি কা  স র কা র

প্রান্তিকা সরকার কলা বিভাগে স্নাতক। বর্তমানে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে লেখালেখির মাধ্যমে তাঁর আত্মপ্রকাশ। সাহিত্য, বিশেষত কবিতার প্রতি তাঁর অনুরক্ততা গভীর। নিজেও কবিতাই লিখতে পছন্দ করেন। কিন্তু বাইফোকালিজম্-র আঙিনায় তিনি লিখে ফেললেন একটু অন্য রকম লেখা।কলকাতার কথকতা।লেখালেখি তার একটি নেশার মত। তবে অবসরে গান শুনতে ভীষণ ভালোবাসেন।

কলকাতার কথকতা(২য় পর্ব)

কলমেঃ প্রা ন্তি কা  স র কা র

আচ্ছা প্রকৃতি কেন এত খেয়ালি বলুন তো! য্যামন নদীর কথাই ধরুন, আজ যে পথে সে বইছে হয়তো একদিন তার খেয়াল হবে সে পথ ছেড়ে অন্য পথে প্রবাহিত হয়ে সাগরে মিলিত হওয়ার । হয়তো তাই কবি গুরু লিখেছিলেন,

“নদীতটসম কেবলি বৃথাই
প্রবাহ আঁকড়ি রাখি বারে চাই
একে একে বুকে আঘাত করিয়া
ঢেউগুলি কোথা ধায়। “

এই য্যামনটা আদিগঙ্গাকে খুঁজে পাই ইতিহাসের পাতায়। একসময় যে পথে ভরা যৌবন নিয়ে সে প্রবাহিত হতো , আজ তা মজে যাওয়া একটা খালে পরিণত হয়েছে। যদিও অনেকে বলেন আজও নাকি এই খালে গঙ্গার চোরা স্রোত বয়ে যায়। সে যাই হোক প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে চলবে। কথাতেই আছে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। তাছাড়া মানুষ কবেই বা প্রকৃতির খেয়ালের সাথে পেরে উঠেছে! তাইতো আজও প্রতি মুহূর্তে খুঁজে ফেরা প্রকৃতির ছেড়ে যাওয়া ইতিহাসকে। এই য্যামন প্রকৃতির খেয়ালেই একসময় আদিগঙ্গার দুধারের জীবন্ত কথাগুলো ইতিহাস হয়ে বেঁচে রইল গল্পকথায় , আর তার অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে পড়ে থাকলো কয়েকটি ভাঙাঘাট, প্রাচীন মন্দির, শ্মশান এবং একরাশ আক্ষেপ। যাইহোক আগের পর্বে বলেছিলাম এই পর্বে প্রাচীন মন্দির নিয়ে আলোচনা করবো। তাই এই পর্বে তুলে ধরছি প্রাচীন মহামায়া মন্দিরের ইতিবৃত্ত।

গড়িয়া স্টেশন থেকে অটো করে শীতলা মন্দির এবং সেখান থেকে আবার অটো ধরলেই দিব্যি পৌঁছে যাওয়া যায় মহামায়ার মন্দিরে। এই এলাকাটি অবশ্য বর্তমানে মহামায়াতলা নামেই পরিচিত সকলের কাছে। বঙ্গের প্রাচীন মন্দিরগুলোর মতো এই মন্দিরটিও অন্যতম একটি প্রাচীন মন্দিরের দাবিদার। যার সাথে গল্প আকারে জড়িয়ে আছে অনেক কাহিনী। সেগুলোর কথায় আসছি তবে তার আগে চলুন একটু ইতিহাসের গভীরে প্রবেশ করি। জানা যায় মধ্যযুগে দক্ষিণবঙ্গের একটি ঐতিহাসিক জনপদ ছিল রাজপুর। গৌড়বঙ্গের তুর্কিদের আক্রমণে রাজা লক্ষণ সেন যশোরে পালিয়ে যান এবং তাঁর পুত্র আদিগঙ্গা দিয়ে পৌঁছান এই রাজপুরে। সম্ভবত রাজাদের বসবাসের কারণেই এই অঞ্চলের নাম হয়েছিল রাজপুর। সুদূর অতীতে ত্রিপুরার রাজবংশ এখানে রাজত্ব করতেন বলেও জানা যায়। এই রাজবাড়ীর গৃহ দেবী ছিলেন ত্রিপুরাসুন্দরী, তাঁর কথা অন্য পর্বে তুলে ধরবো।

ধারণা করা হয় এই সেন রাজারা বৈদিক ব্রাক্ষ্মণদের বিশেষ প্রাধান্য ও মান্যতা দিতেন। তাই বৈদিক ব্রাক্ষ্মণদের যশোহর ও নবদ্বীপ থেকে এই রাজপুরে আনা হতো। সে সময় নবদ্বীপে চতুষ্পাঠীতে শাস্ত্র অধ্যয়ন চলতো। চতুষ্পাঠী বলতে চতুর্বেদ বা ব্যাকরণ, কাব্য, স্মৃতি ও দর্শন, এই চারটি শাস্ত্র কিংবা নানা ধরনের শাস্ত্র পড়ানো হয় এমন বিদ্যালয় বা টোলকে বোঝানো হয়। সুপ্রাচীন বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী মহামায়ার আশীর্বাদ নিয়েই সেখানকার বিদ্যাশিক্ষা শুরু হতো। তাই নবদ্বীপ থেকে আগত ব্রাক্ষ্মণরা সেই ধারা অক্ষুন্ন রাখতে চাইলে সেন রাজা সেই মহামায়ার অনুরূপ এক দারু মূর্তি নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠিত দেবীই হলেন মা মহামায়া।

জানা যায় পরবর্তীতে গঙ্গার গর্ভ থেকে দেবী মহামায়ার মূর্তিটি উদ্ধার করেন জমিদার দুর্গারাম কর চৌধুরী এবং পুরোহিত গোরাচাঁদ ঘোষাল। ষোড়শ শতাব্দীতে গৌড়েশ্বর হুসেন শাহের পুত্র গিয়াসউদ্দিন মহম্মদ শাহের থেকে রাজপুরসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জমিদারি লাভ করেছিলেন কান্যকুব্জ থেকে আগত বিখ্যাত শান্ডিল্য গোত্রীয় কায়স্থ হরিপলাশ দত্তের বংশধর কৃষ্ণদাস দত্ত। কৃষ্ণদাসের তৃতীয় পুত্র ছিলেন রাজপুরের রাজা। তাঁকে নিয়ে মধ্যযুগের বিভিন্ন কাব্য কাহিনীতে নানারকম কিংবদন্তীর খোঁজ মেলে। তাঁর পৌত্র দুর্গাচরণ রাজবাড়িকে সুরক্ষিত রাখার জন্য পরিখা নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। সম্ভবত সেইজন্য ও এই স্থানের নাম গড়িয়া হতে পারে। দুর্গাচরণের পুত্র রাজবল্লভ কোম্পানির সনদে রায়চৌধুরী হন। তাঁর সময়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূর্যাস্ত আইনের কারণে রাজপুর ও হরিনাভি গ্রাম দুটি নিলাম হয়ে যায়। ইংরেজ নিমকি মহলের দেওয়ান জনার্দন করের পুত্র দুর্গারাম কর চৌধুরী তা কিনে রাজপুরে জমিদারির সূচনা করেন। তিনি ছিলেন একজন দানশীল রাজা। প্রায় ৩৬৫ বিঘা জমি দেবোত্তর করে দেন তিনি। ঘোষাল পরিবারের হাতে দেবীর নিত্য পূজার দায়িত্ব তিনিই তুলে দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। সেই থেকে প্রায় ৩৫০ বছরের প্রাচীন এই মহামায়ার মন্দিরটি আজও তার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। এখানে দেবীকে শান্ত রূপেই পূজা করা হয়।

জানা যায় জমিদার দুর্গারাম কর চৌধুরী দেবীকে স্বপ্নাদেশে পেয়েছিলেন। তিনি স্বপ্নে এক বীনাবাদনরত দেবীর দর্শন পান। দেবী তাঁকে স্বপ্নে আদেশ করেন নদীবক্ষ থেকে দেবীকে উদ্ধার করে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। স্বপ্নের ঘোরে জমিদার দুর্গারাম জানতে পারেন যে , দেবী বারহাঁস ফরতাবাদের গঙ্গার ঘাটের কাছেই রয়েছেন। পরদিন সকালেই তিনি নৌকা নিয়ে সেই স্হানে উপস্হিত হন এবং সেখানেই তাঁর পরিচয় ঘটে পুরোহিত গোরাচাঁদ ঘোষালের সাথে, যিনি ঐ একই স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। গঙ্গাদিঘি খননকালে তাঁরা তিনটি বড় পাথরের টুকরো ও একটি নিম কাঠের খন্ড পেয়েছিলেন। ঐ নিমকাঠ থেকেই দেবীর নতুন বিগ্রহ তৈরী হয়। আবার কেউ কেউ বলেন তাঁরা গঙ্গাবক্ষে ডুব দিয়ে দেবীর মূর্তিটি তুলে আনেন এবং গঙ্গার পূর্ব তীরে বাগানের মধ্যে একটি অস্থায়ী মন্দিরে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করেন।

জানা যায় ১২১০ সালে শুভদিনে নবনির্মিত মন্দিরে দেবী মহামায়াকে প্রতিষ্ঠা করেন জমিদার দুর্গারাম কর চৌধুরী। এবার আসি প্রচলিত কিছু গল্পকথায়। শোনা যায় এই দেবীর আরও দুজন বোন আছেন। একজন হলেন বোড়ালের সেন রাজাদের মা ত্রিপুরাসুন্দরী এবং অপরজন হলেন টালিগঞ্জের সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের দেবী মা করুণাময়ী। কথিত আছে এই তিন দেবী একদিন গঙ্গার ঘাটে বসেছিলেন এবং এক শাঁখারিকে দেখে তাঁরা শাখা পরার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। শাঁখা পরার পর দাম চাইলে তাঁরা বলেন তাঁদের পিতা ঐ মহামায়া মন্দিরের পূজারী। মন্দিরের কুলঙ্গিতে কৌটোতে দাম রাখা আছে, ওনাকে বললেই উনি তা দিয়ে দেবেন। এই কথাগুলো যখন শাঁখারি ঘোষাল পরিবারের পুরোহিতকে বলেন তখন তিনি আবাক হন এবং কৌটো বার করতেই তাতে একটি রুপার মুদ্রা পাওয়া যায়। মায়ের মুখে তখন লেগে থাকা ছলনার মৃদু হাসি সবাইকে অবাক করে। মন্দিরের তুলসি মঞ্চের পাশে এখনও বড় দুটি পাথর খন্ডের দেখা মেলে যেগুলোকে সেই গঙ্গাবক্ষ থেকে উদ্ধার করা পাথর খন্ড বলেই লোকমুখে শোনা যায়।

জানা যায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে সম্মান জানিয়ে ২৩শে জানুয়ারি এই মন্দিরে বাৎসরিক উৎসব পালন করা হয়। সেই দিন বহু ভক্তদের সমাগম ঘটে এই মন্দিরে। আগে এই মন্দিরে বলিদান প্রথা থাকলেও বেশ কিছু বছর যাবৎ তা বন্ধ আছে। এখানে দেবীকে নিত্য অন্নভোগ দেওয়া হয়ে থাকে। এখানকার একটি বিশেষ পূজা হলে নীল পূজা। এই মন্দিরের কাছে অবস্হিত গঙ্গাদিঘির ধারে দুটি অতি প্রাচীন শিব মন্দির অবস্হান করছে। এখনো সেই মন্দিরে শিবলিঙ্গ পূজিত হয়। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই প্রাচীন আটচালা শিবমন্দির দুটি ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে চলেছে। জানা যায় এই মন্দিরের গায়ে একসময় অনবদ্য কিছু টেরাকোটার কারুকাজ ছিল, যা বর্তমানে নষ্ট হয়ে গ্যাছে। আজ তবে এ পর্যন্তই , পরবর্তী পর্বে আবার না হয় অন্য কোন মন্দিরের ইতিকথাকে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

প্রান্তিকার আগের পর্ব ও অন্যান্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন

কলকাতার কথকতা(গড়িয়ার ইতিবৃত্তঃ১ম পর্ব) কলমেঃ প্রা ন্তি কা  স র কা র

পুরানো সে সব দিনের কথা- কলমেঃ প্রা ন্তি কা স র কা র

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *