গানের বাগান ও ঘরানার ঘর(পর্ব-৩)

সুকন্যা দত্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে যুক্ত। তথ্যমূলক লেখার প্রতি প্রবল আকর্ষণে কলম এ ফুটিয়ে তোলেন অজানাকে। লোক সংস্কৃতি,নানান দেশের খাদ্য,আচার আচরণ ও ভ্রমণমূলক লেখার প্রতি আগ্রত রয়েছে। বিভিন্ন স্থানের ইতিহাসের টানে চলে যান সেই মাটির কাছে। শৈশব থেকেই গান গাইতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি নাটকে তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।ইনিও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

গানের বাগান ও ঘরানার ঘর(পর্ব-৩)

সু ক ন্যা   দ ত্ত

আধুনিক ধ্রুপদ গানের চর্চা কখন থেকে শুরু হয় তা সঠিকভাবে বলা কঠিন।তবে রাজা মান সিংহ তোমর এর কথা বললে ও অনেকে সঙ্গীতজ্ঞ নায়ক গোপাল ও তাঁর সমসাময়িক নায়ক গোপাল ও তার সমসাময়িক বৈজুকে ধ্রুপদ গানের প্রবর্তক বলে মনে করেন।তবে রাজা মান সিংহ তোমরের স্ত্রী মৃগনয়নী ও ধ্রুপদ গানে পারদর্শী ছিলেন।

গায়ন বাণী

ধ্রুপদ গানে চার প্রকার বাণীর প্রচলন দেখা যায়, যথা শুদ্ধ বা গওহর বাণী, খান্ডার বাণী, ডাগুর বা ডাগর বাণী ও নওহার বাণী। আকবরের দরবারের চারজন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞের বাসস্থানের নামানুসারে এ বাণীগুলির নামকরণ করা হয়েছে। তানসেনের বাসস্থান গোয়ালিয়রে, তাই তাঁর রচিত ধ্রুপদের বাণীকে বলা হয় ‘গওহর বাণী’। এ বাণীর বৈশিষ্ট্য হলো এগুলি খুবই স্পষ্ট এবং সাধারণত ধীরগতিসম্পন্ন, গম্ভীর ও শান্ত রসপ্রধান। তানসেনের জামাতা বীণকার মিশ্রী সিং বা সম্মুখন সিং (পরে নৌবাৎ খাঁ নামে পরিচিত)-এর বাসস্থান খান্ডারের নামানুসারে তাঁর রচিত বাণীর নাম হয় ‘খান্ডার বাণী’। এ বাণীর গানগুলি অতি বিলম্বিত লয়ে চলে এবং গওহর বাণীর চেয়ে অধিক বৈচিত্র্যপূর্ণ। এ বাণীর গানে স্বরগুলি সরলভাবে না দেখিয়ে খন্ডখন্ডভাবে দেখানো হয়ে থাকে। সঙ্গীতসাধক বৃজচন্দের বাসস্থান ডাগুর গ্রামের নামানুসারে তাঁর রচিত ধ্রুপদ গানের নাম হয় ‘ডাগুর বা ডাগর বাণী’। এর বৈশিষ্ট্য হলো সহজ ও সরলতা। শ্রীচন্দের বাসস্থান নওহারের নামানুসারে তাঁর রচিত ধ্রুপদ গানের নাম হয়েছে ‘নওহার বাণী’। এক বা একাধিক স্বর অতিক্রম করে অপর স্বরে যাওয়া-আসা করা এ বাণীর বৈশিষ্ট্য। নওহার বাণীর ধ্রুপদ সাধারণত গতিবেগসম্পন্ন হয়ে থাকে। ধ্রুপদ গানের গায়ক ‘কলাবন্ত’ নামে পরিচিত।

ধ্রুপদ সঙ্গীতের ঘরানা,দ্বারভাঙ্গা ঘরানা….

এই চারটি গায়ন শৈলী থেকে ধ্রুপদ গানের চারটি ঘরানা গড়ে ওঠে। দ্বারভাঙ্গা ঘরানায় ‘গওহর বাণী’র গায়ন শৈলী লক্ষ্য করা যায়।১৮ শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে দ্বারভাঙ্গার নবাবের দরবারে রাধাকৃষ্ণ ও কর্তারাম নামের দুজন সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। এই দুজনই সম্ভবত এই ঘরানার প্রবর্তক বলে মনে করা হয়। এই ঘরানায় সাধারণত আলাপের পর গান শুরু করা হয়।দ্বারভাঙ্গা ঘরানার বিশিষ্ট গায়করা হলেন রামচতুর মালিক, বিদুর মালিক,অভয় নারায়ণ মালিক, প্রেম কুমার মালিক প্রমুখ।

তালওয়ান্দি ঘরানা….
তালওয়ান্দি ঘরানার বিস্তার মূলত উত্তর পশ্চিম ভারতে। বর্তমান পাঞ্জাবে এই ঘরানার অস্তিত্ব থাকলে ও অধিকাংশ গায়ক দেশভাগের পর পাকিস্তানের বাসিন্দা হয়ে গেছেন।অনেকের মতে, তালওয়ান্দি ঘরানাশ খান্দাহার বাণীর গায়ন শৈলী লক্ষ্য করা যায়। এই ঘরানার প্রবর্তকরা হলেন, নায়ক চাঁদ খান ও সুরজ খান। পূর্বে এই ঘরানায় ধ্রুপদী গান হিন্দু ধর্মের প্রভাব বর্জিত আল্লাকে সমর্পিত ছিলো। তবে বর্তমানে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বিষয়বস্তু এই নাটকে প্রকাশিত।এই ঘরানার গানে ছন্দের বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়।

বেট্টিয়া ঘরানা…..

১৯ শতকে বিহারের বেট্টিয়া নামক স্থানের রাজদরবারে এই ঘরানার উৎপত্তি হয়। মূলত পূর্ব ভারতে এই ঘরানার বিস্তার ঘটেছে। বাংলায় বিষ্ণুপুর ঘরানার পাশাপাশি এই ঘরানা ও নিজের একটি স্থান গড়ে তুলেছেন।নেপালের রাজদরবারের দুই বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ রহিমসেন ও করিমসেনের সুযোগ্য শিষ্য পন্ডিত শিবদয়াল মিশ্র বিহারের বেট্টিয়া রাজদরবারে
এলে ওনার হাত ধরে এই ঘরানা জন্মলাভ করে। উনি রাজ বংশের দুই ভাই আনন্দ ও নওয়াল কিশোর সিনহা কে সঙ্গীতের তালিম দেন, যারা সে সময়ের প্রসিদ্ধ গায়ক হয়ে ওঠেন।বেট্টিয়া ঘরানার সঙ্গীত মহারাজা- কবি-ধ্রুপদীয়া আনন্দ ও নওয়াল কিশোরের কবিতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।এই ঘরানার গানের সময় অলংকার ও ছন্দের যুগলবন্দী লক্ষ্য করা যায়।

ডাগর ঘরানা….

জয়পুরের রাজদরবারের সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ বেহেরাম খানের (১৭৫৩-১৮৭৮)তত্ত্বাবধানে ডাগর ঘরানা প্রসিদ্ধি লাভ করে। ডাগরের সূচনা পান্ডে ব্রাহ্মণদের মাধ্যেম। তবে ওনার পিতা বাবা গোপাল দাস পান্ডে তাঁর অসাধারণ সঙ্গীত পরিবেশের পর তৎকালীন দিল্লীর মুঘল সম্রাট মহঃ শাহ্ রঙ্গিলের চিবোনো পান খাওয়ার অপরাধে একঘরে হন। বাবা গোপালের দুই সন্তান হলেন হায়দার ও বেহরাম।হায়দার খানের অকাল মৃত্যু হলে ও বেহরাম খান আজীবন ডাগর ঘরানা কে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন।পরবর্তীকালে এই ঘরানা বংশ পরম্পরায় এগিয়ে চলতে থাকে।
★পরবর্তী পর্বে আমরা খেয়াল ঘরানার অন্দর মহলে প্রবেশ করবো।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *