গয়না বড়ির ইতিহাস ও গোপন কিস্সা

সুকন্যা দত্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে যুক্ত। তথ্যমূলক লেখার প্রতি প্রবল আকর্ষণে কলম এ ফুটিয়ে তোলেন অজানাকে। লোক সংস্কৃতি,নানান দেশের খাদ্য,আচার আচরণ ও ভ্রমণমূলক লেখার প্রতি আগ্রত রয়েছে। বিভিন্ন স্থানের ইতিহাসের টানে চলে যান সেই মাটির কাছে। শৈশব থেকেই গান গাইতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি নাটকে তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।ইনিও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

গয়না বড়ির ইতিহাস ও গোপন কিস্সা

সু ক ন্যা   দ ত্ত

বড়ি যেমন বাঙালির নিজস্ব একটি খাদ্যদ্রব্য অন্যদিকে বড়ি প্রস্তুতকরণ একটি লোকশিল্পও বটে। যার উৎপত্তিস্থল ও সময়কাল সঠিকভাবে জানা কঠিন। সংস্কৃত ‘বটিকা’ শব্দ (যার অর্থ বিশেষ পদার্থ হতে প্রস্তুত ক্ষুদ্রাকার গোলাকৃতির কোন বস্তু) থেকে বড়া ও পরে পরিবর্তিত হয়ে বড়ি উদ্ভূত হয়েছে।
গহনা বড়ি বা গয়না বড়ি বহু শতাব্দী প্রাচীন একটি কুটির শিল্প যা সাধারণত বাড়ির মহিলারা প্রস্তুত করে থাকেন। বিউলির ডাল বা পোস্ত পিষে এই বড়ি দেওয়া হয়।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও  বলেছিলেন,
“গহনা বড়ি শুধুমাত্র দেখার জন্য, খাওয়ার জন্য নয়।”


নন্দলাল বসু গহনা বড়িকে বাংলা মায়ের গয়নার বাক্সের একটি রত্ন বলে বর্ণনা করেন। বড়িগুলির নকশায় ফুটে ওঠে স্বর্ণালঙ্কারের প্রভাব। মুকুট, নেকলেস, দুল, টায়রা, বাজুবন্ধ, লকেট, কানপাশা, মাকড়ি, ঝরোখা ইত্যাদির নকশা ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও নানাবিধ জ্যামিতিক নকশা, বিভিন্ন ধরনের কল্কা, শাঁখ, পদ্মফুল ও বিভিন্ন বশুপাখি যেমন বিড়াল, টিয়া, কাকাতুয়া, ময়ূর, পেঁচা, হাঁস ও প্রজাপতি নকশায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে।তবে এই বড়ি তৈরির পিছনে রয়েছে একটি করুন ও বিষাদান্তক কাহিনী। বহু পূর্বে বাংলায় এই বড়ি দিতো বিধবারা। বাল্য বিবাহ প্রথায় অল্প বয়সে মেয়েরা বিধবা হওয়ার পর তাদের বাড়ীর বাইরে সকলের থেকে পৃথক করে অন্য মহলে রাখা হতো। দশ বা বারো বছর বয়সী এই বিধবা বালিকাদের মাথা মুড়িয়ে দেওয়া হতো,তাদের পরিধেয় ছিলো সাদা থান শাড়ী। যেহেতু আমিষ খাওয়া বিধবাদের নিয়ম বহির্ভূত তাই শুক্তো বা নিরামিষ রান্নায় তারা বড়ি ব্যবহার করতো। প্রোটিন জাতীয় খাবারের ক্ষেত্রে বিধবা রমনীদের নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা এই উপায় করেছিলো।তবে বিধবা মেয়েরা বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য গয়না বড়ি তৈরি করতে শুরু করে। আসলে বিয়ের গহনার নক্সায় প্রস্তুত এই গয়না বড়ি তৈরি দুধের স্বাদ কিছুটা ঘোলে মেটানোর মতো ও বলা যায়। তাদের বৈধব্য দশায়, গয়না বর্জিত এই জীবনের কষ্ট লাঘবের উপায় পিছনে গহনা বড়ি তৈরির ইতিহাস লুকিয়ে আছে।

গহনা বড়ি তৈরী হয় শীতকালে। কার্তিক মাসের পোড়া অষ্টমীর দিন বড়ি দেওয়ার শুভ সূচনা হয়। বড়ি দেওয়ার দিন বাড়ির মহিলারার স্নান করে, পরিষ্কার কাচা কাপড় পরে শুদ্ধ হয়ে গহনা বড়ির প্রস্তুতিতে হাত দেন। তবে পরবর্তী সময়ে বনেদি হাতের নৈপুণ্যে গহনা বড়ি পরিচয় বিস্তার লাভ করে। পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক, মহিষাদল, কাঁথি এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমায় বনেদি বাড়ির গৃহিণীরা গয়না বড়ি তৈরি করতেন। ভারতে ব্রিটিশ আসার পর গয়না বড়ি প্রস্তুতিতে পোস্তর প্রচলন শুরু হয়। পলাশির যুদ্ধের পরে, ব্রিটিশরা বেআইনি আফিমের এক বিশাল বাজার আবিষ্কার করে চিনে। ব্রিটিশরা তখন বাংলার রাঢ় অঞ্চলের চাষীদের পোস্ত চাষে বাধ্য করে এবং তার থেকে বিপুল পরিমাণ আফিম নিষ্কাশন করে তা চিনে পাচার করতে শুরু করে। আফিম নিষ্কাশনের পর পোস্তর বীজ ফেলে দেওয়া হত। ক্রমে পোস্তর বীজ বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান ও মেদিনীপুর জেলার রান্নার উপাদান হয়ে ওঠে। সেই থেকে মেদিনীপুরে গয়না বড়িতে পোস্ত দানার ব্যবহার শুরু হয়।
আদি থেকে আধুনিক, বিভিন্ন পর্বের বাংলা সাহিত্যেই বড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়াও স্থানীয় লোকাচার, গাথা, ছড়ায় বড়ির উল্লেখ চোখে পড়ে। যেমন – “খুকুমণি কেন ভারি/পাতে নেই যে গয়না বড়ি”। বাঙলার বৈষ্ণবদের কাছে বড়ি সহজলভ্য ও বিকল্প প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য হওয়ায় বহুকাল থেকেই সমাদৃত। শোনা যায়, শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু বড়ির গুণে বিশেষ মুগ্ধ ছিলেন।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *