ইতিহাস আর ঐতিহ্যের পুজো(টাকী)

জন্ম – টাকি লেখাপড়া ও টাকি । কবে যে লেখা শুরু করেছিলাম সেই অর্থে মনে নেই। তবে 90s এর একজন কলমচি। লিখেছেন এপার বাংলা ওপার বাংলার নানান লিটল ম্যাগাজিনে।মূলত কবিতা চর্চাই করেন, তবে আজ বাইফোকালিজমের জন্য টাকীর ঐতিহ্য মণ্ডিত দুর্গাপুজো নিয়ে কলম ধরলেন।

ফিরে দেখা পুজো

ম ঞ্জু   ব্যা না র্জী   রা য়

পুজো এক আন্তরিকতার উৎসবের কথা মনে করিয়ে দেয়। আজ 2020 তে করোনা মহামারীর দাপটে পৃথিবী যখন অসুস্থ, অসহায়, রুজি রােজগার স্তব্ধ, বন্ধ, শিক্ষা ব্যবস্থা বেকারত্বের হাহাকার , আগুন দ্রব্যমূল্য শিশুর মুখে দুমুঠো ভাত, পরনে পােশাক তুলে দিতে ব্যর্থ পিতার বুকে হাহাকার , চোখে জল অনায়াসে বলে দেয় যে এই দুর্গাপূজা আর আগের মতাে উৎসব মুখরিত নয়। তবু আমরা ভালাে থাকার এবং ভালাে রাখার প্রয়াসে তিথি নক্ষত্র মেনে মাতৃ আরাধনায় আজও ব্রতী হই। ভারত বাংলাদেশ বর্ডার পশ্চিম বাংলার বসিরহাট মহকুমায় অবস্থিত টাকি শহর শিক্ষা সংস্কৃতি কৃষ্টি ঐতিহ্যে ভরপুর জমিদার প্রধান ছােট শহর। ছােটবেলার সেই সব দিন আজও মনের মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করে। খুব বেশি দূর যাওয়া হতাে না। বাড়িতে আত্মীয় স্বজন , শরতের পেঁজা তুলাে উঠোন ভর্তি শিউলি , আর সাদা পায়জামা পাঞ্জাবিতে ভরে যেতাে টাকির পথঘাট আর বাজার। বেশির ভাগ পরিবার আলােকিত হয়ে উঠতাে বিদেশ বিভূমে বসবাসকারী আত্মীয় সমাগমে। সারাবছরের এক বুক অপেক্ষায় আলােড়িত হতাে টাকির দুর্গোৎসব। তখন প্রসাধনের এতাে চাকচিক্য ছিল না। এটা কি বড়জোর দুটো জামা তেই ষষ্টি থেকে দশমী কাটতাে। কিন্তু এই 2020 তে পৃথিবী বড় অসহায়। কোরােনা মহামারী পৃথিবীর সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য ,পেটের ভাত এমনকি প্রাণ কেড়ে নিতে ও কুণ্ঠা করছে না। লকডাউনে বিপর্যস্ত জনজীবন এরই মাঝে মুখে মাস্ক হাতে গ্লাভস পরে কলম বেরিয়ে পড়েছে টাকির ঠাকুর দেখতে। 1984 সাল পর্যন্ত পাঁঠা বলি হতাে তারপর থেকে চাল কুমড়াে বলি হয়ে আসছে। বলি বন্ধ হওয়ার কারণ অমিয় দাদু 1984 সালে মারা যান। বর্তমানে ওনার ছেলে দেবকুমার চট্টোপাধ্যায় ভক্তি নিষ্ঠার সাথে পুজো করে আসছেন। মায়ের সাথে অষ্টমীর পুজো দিতে যেতাম। তারপর দুপুরে গিয়ে ভােগ আনতাম মায়ের জন্য। ওনাদের বাড়ির সন্ধি পুজোর ভােগ প্রসাদ ঢাক ঢোল বাজিয়ে বিশাল বেলি থালায় যা দুজন মাথায় করে এখনাে আমাদের বারুজ্যে বাড়িতে আসে। সেই প্রসাদ দেখার মতাে সুন্দর সাজানাে। বর্তমানে পুজো দেওয়া এবং প্রসাদ গ্রহণ করেন প্রয়াত অর্ধেন্দু শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছােট পুত্র শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। আমরা আমাদের পাড়ার পুজোতে “টাকি মিলন সমিতির পুজো” ঘােষ বাবু পাড়ায় )ফল কাটা, ফুল তােলা এই সব কাজে অংশ নিতাম। টাকি মিলন সমিতি স্থাপিত 1930 সালে। বর্তমানে সােমনাথ মুখার্জী (পৌর প্রধান) সম্পাদক সমস্ত দায়িত্ব নিয়েই পুজো করে চলেছেন। অষ্টমীর অঞ্জলী তে পাড়ার নতুন বস্ত্রে মা ঘােষ বাবু বাড়ির দালানে। কাকিমাদের সমাগমে পুজো প্যান্ডেল মুখরিত হতাে এক আনন্দঘন মুহূর্ত। মিলন সমিতির অষ্টমীর ভােগ রাঁধতাে পাড়ার ব্রাহ্মণ ছেলেরা। সেই ভােগ পাড়ার সব পরিবার পেতাে। এখনাে ওই একই ভাবে পুজো হয়ে আসছে। আমরা পুজোর ওই পাঁচ দিন আনন্দে মেতে থাকতাম পাড়ার প্যান্ডেলে আর ঘােষবাবু বাড়ির পুজো শুরুর সঠিক সাল আজ আর জানা যায় না সেকারণে বিভিন্ন মত উঠে আসে। তবে নবাব সিরাজ দৌলার রাজত্ব কাল ১৭৫৬ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত। আর নবাব সিরাজউদ্দৌলার জজ ছিলেন প্রয়াত হরিনারায়ণ ঘােষ মহাশয়। উনি ঘােষবাবু বাড়ির দূর্গা পুজো শুরু করেন। সেই প্রেক্ষিতে বলা যায় এ বছর ঘােষবাবু বাড়ির দুর্গাপুজো আনুমানিক ২৬৪ তম পুজো। ইতিহাস বলে টাকিতে জমিদার বাড়ির মধ্যে প্রথম পুবের বাড়িতে দূর্গাপুজো শুরু হয়। এই বছর পুবের বাড়ির পুজো ২৯৮ তম পুজো। এই প্রেক্ষিতে ও ঘােষবাবু বাড়ির পুজো আনুমানিক ২৬৪ তম পুজো বলে পরিগণিত হতে পারে।

ওনাদের জমি জায়গা জমিদারি যশাের জেলায় তেই বেশিরভাগ ছিল। ঘােষ বংশধর প্রয়াত শচীন্দ্রনাথ ঘােষ, হিরণ চন্দ্র ঘােষ ও প্রতীক চন্দ্র ঘােষ , প্রসূন ঘােষ মহাশয়রা এক বছর অন্তর পালা করে শাক্ত মতে পাঠা বলি দিয়ে পুজো করতেন। পরবর্তীতে ঘােষ বংশধর প্রয়াত মতিলাল ঘােষ মহাশয় বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করায় বৈষ্ণব মতে আখ ও চাল কুমড়াে বলি আজ ও প্রচলিত। মতিলাল বাবু বিখ্যাত ছিলেন টাকির লাঠি খেলায় আর অত্যন্ত সাহসী ছিলেন। তিনি একাই ডাকাত দের সাথে যুদ্ধ করে ছয় সাত জন ডাকাত কে বেঁধে টাকিতে নিয়ে এসেছিলেন। সেখান থেকে একটি প্রবাদ শােনা যেতাে , টাকির লাঠি, সাতক্ষীরার মাটি আর গোবরডাঙ্গা হাতি সুপ্রসিদ্ধ। 1974 সাল থেকে যৌথ ভাবে পুজো হয়ে আসছে। ঘােষবাড়ির বংশধররা সবই প্রায় কলকাতা আর বিদেশ বিভূমে থাকেন। বর্তমানে প্রয়াত সুবােধ ঘােষ মহাশয়ের স্ত্রী শ্রীমত্যা অন্নপূর্ণা দেবী ই একমাত্র টাকি তে বসবাস করেন। পুজোয় সব আত্মীয় স্বজন রা একত্রিত হয়ে সমস্ত নিয়মবিধি মেনে আজও পুজো করে আসছেন। ঘােষ বাড়ির পুজোর আর একটি বিশেষ রীতি আছে অষ্টমীতে কুমারী পুজো। যেটি শুরু করেছিলেন এবং আজও করে আসছেন প্রয়াত সুভাষ ঘােষ মহাশয়ের স্ত্রী শ্রীমত্যা সুচিত্রা দেবী। বর্তমানে , বংশধর সুপ্রভাত ঘােষ, প্রদীপ ঘােষ (বাবলু দা), দিলীপ ঘােষ (ছুটু দা) এবং আত্মীয় সঞ্জীব ঘােষ, ও সজল ঘোষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমস্ত নিয়ম নিষ্ঠার সাথে সুন্দর ভাবে পুজো করে চলেছে।ঘােষবাবু বাড়ির পুজোর সাথে আমাদের শৈশব কৈশাের এতটাই জড়িয়ে আছে যে হয়তাে বহুবছর যাওয়া হয় না তবু আজও চোখ বন্ধ করেও সেই এক চালা মাতৃমূর্তি চোখে ভাসে। একটি বিশেষ মনকাড়া ঘটনা বলতেই হয় এই ঘােষবাবু বাড়িতে পৌরসভার একটি অস্থায়ী কার্যালয় ছিল যেখানে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর পদার্পন ঘটেছিল। নেতাজী কে আমন্ত্রণ করে আনার উল্লেখ যােগ্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন প্রসূন ঘােষ, অর্ধেন্দু শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, নানু ঘােষ, সত্য কৃপা বিশ্বাস ও অন্যান্য টাকির বাসিন্দা গণ। ছােট বেলায় আমাদের পুজো শুরু হয়ে যেতাে রথের দিন থেকে। ঘােষবাবু বাড়ির দালানে ওই দিন থেকে কাঠামো পুজো করে এক চালার নির্দিষ্ঠ মাপে ঠাকুর গড়া শুরু হতাে। আর আমরা সাক্ষী থাকতাম একটু একটু করে শিল্পীর ছোঁয়ায় গড়ে উঠতাে সুন্দর এক চালার মাতৃমূর্তি। দালানের ঝাঁক ঝাঁক পায়রা একরাশ নীরবতা কাটিয়ে আমাদের সাথে সামিল হতাে লুকোচুরি খেলাতে। আজ ভাবলেও খুশিতে মন টা ভরে ওঠে আর একই সাথে বিষন্নতায় মন কেঁদে ওঠে এখনকার প্রজন্ম কত শত সুখ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করে ফেলেছে। এখনাে দালানে সেই ভাবেই মূর্তি তৈরি হয় কিন্তু আজ আর লুকোচুরি খেলার সঙ্গী নেই, সঙ্গীদের খেলার সময় নেই। এই নেই পৃথিবীতে তাদের হাতে উঠেছে মুঠোফোন। ওই নিয়েই তারা আজ ব্যস্ত , তারা জানতেই পারলাে না, সুন্দর সেই সব দিনগুলাে। আসুন জেনে নিই আমার মামার বাড়ির পুজো। মায়ের মুখে শােনা আবছা স্মৃতি উস্কে দিলাে এই বাড়ির মেয়ে শ্রীপর্ণা। জোড়া মন্দির সংলগ্ন মুখার্জী বাড়ির পুজো শুরু হয়েছিল ১২০৮ সালে। প্রথমে বসিরহাটের ওপারে বাজিত পুরে পুজো শুরু করেন হরিরাম বিদ্যাবাগিস (মুখুজ্যে)। একবার পুজোর আগে ভীষণ বন্যা হওয়ায় মায়ের তৈরি মূর্তি নৌকা করে ইছামতির বুকে ভেসে যেতে থাকে। তখনাে জানা ছিল না কোথায় ঠাই হবে। এমন দৃশ্য দেখতে পান তৎকালীন দক্ষিণ বাড়ির রায় চৌধুরী জমিদার। তিনি তার লােকজন নিয়ে নৌকা পাড়ে ভেড়ান এবং জোড়া মন্দির সংলগ্ন জমিতে দুর্গাপুজো করার অনুরােধ করেন। কিন্তু তখনকার আমলে ব্রাহ্মণদের ওই জমি দান করার ধৃষ্টিতা তিনি দেখাতে সাহস পান নি। সেকারণে তখন ওই রায়চৌধুরী জমিদার মুখুজ্যে দের গুরু মানেন। এবং গুরু দক্ষিণা স্বরূপ ওই জমি নিবেদন করেন। সেখান থেকে আজও পুজো হয়ে আসছে। আমার মা প্রয়াত কল্পনা বন্দ্যোপাধ্যায় এর পিতা প্রয়াত ক্ষিরােদ কৃষ্ণ মুখার্জী (আমার দাদু) জমিদার রায় হরেন্দ্র নাথ চৌধুরীর গুরুদেব ছিলেন। এই বাড়ির বিশেষত্ব হলাে , ষষ্টি থেকে দশমী পর্যন্ত দুবার করে ভােগ নিবেদন হয়। সকালে বাল্য ভােগ হয় ও সেই ভােগ বিউলির ডালের খিচুড়ি, পাঁচ রকম ভাজা চাটনি ইত্যাদি। বর্তমানে বিউলির ডালের পরিবর্তে মুগের ডালের খিচুড়ি প্রচলিত আছে। দুপুরে আলাদা ভােগ ও রাতে লুচি ভােগ হয়। আগে ইছামতি র নৌকায় ঠাকুর বিসর্জন হতাে কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির জন্যে আর নৌকায় ওঠে । বাড়ির মেয়েরাও এই পুজোয় সামিল হয়। বর্তমানে অধীর কৃষ্ণ মুখার্জী, মুকুল কৃষ্ণ, সত্যব্রত, সুব্রত, কৌশিক, গৌতম ও প্রিয়ব্রত মুখার্জী পুজো করে আসছেন।
আমরা একদিন ঠাকুর দেখতে বেরোবে। কলেজ মােড় পেরিয়ে আমাদের এস. এল গার্লস স্কুলের কোল ঘেঁষে তেজপাত তলা পার করে পৌঁছে যেতাম “রক্ত রবি “র পুজো প্যান্ডেলে।1951 সালে স্থাপিত এই ক্লাব। বর্তমানে সম্পাদক শ্রী দীনবন্ধু চ্যাটার্জী। ওই প্যান্ডেল গড়ে উঠতাে ছবি কুন্ডু নামে এক তান্ত্রিক সাধুর আখড়ার গা ঘেঁষে। সেকারণে মুখেমুখে প্রচলিতছিল, ছবিকুল্ডুর ঠাকুর দেখেআসি এমনি। গ্রাম বাংলার সরলতা বয়ে যেতাে এই প্যান্ডলে। জলজ্বলে বিরাট মাতৃ মূর্তির সামনে দাঁড়ালে কখন যে হাত দুটো জড়াে হয়ে যেতাে তা বুঝে উঠতে পারতাম না। সন্ধ্যা আরতির শিখায় শিখায় এঁকে যেতাে এক রাশ মুগ্ধতা। তারপর ভবনাথ স্কুলের পাশ দিয়ে চলে যেতাম পুরােনাে বাজারে যুবগোষ্ঠী পুজো। যুব গােষ্ঠী স্থাপিত 1967 সালে। বর্তমানে সভাপতি পঙ্কজ কুমার দাস , সম্পাদক অভিজিৎ দাস প্রতি বছরের ন্যায় এ বার ও পুজোয় ব্রতী হয়েছেন। টাকি পৌর ক্লাব সমন্বয় কমিটির সম্পাদক সুব্রত মুখার্জী র থেকে কলম যে সব দূর্গা পূজার খোঁজ পেলাে। টাইগার ইউনিট স্থাপিত 1995। ক্লাবের পুজো শুরু করেছিলেন প্রয়াত দুলাল দাশ, প্রয়াত জয়দেব মন্ডল। বর্তমান সভাপতি কেষ্ট দাশ সম্পাদক সুজিত বর্মন। ইউ. সি. ক্লাব উত্তরপল্লী স্থাপিত 1928 সভাপতি নিমাই দাস, সম্পাদক দেবাশীষ দাস। মহাসমারােহে পুজো করে আসছে। টাকি সঙ্ঘশ্রী ক্লাব স্থাপিত 1957। বর্তমান সভাপতি গণেশ চন্দ্র দাশ, সম্পাদক সুমন দাশ। থুবা ব্যায়াম সমিতি স্থাপিত 1932 সালে। বর্তমান সভাপতি ডঃ সৈকত মন্ডল সম্পাদক কমল ঘােষ। থুবা ষ্টেশন পাড়া সমিতি স্থাপিত ১৩৫৩ সালে। বর্তমানে সভাপতি প্রশান্ত মিত্র, সম্পাদক সুমন রায় চৌধুরী। বাগপাড়ায় বাগপল্লী জনকল্যাণ সমিতি স্থাপিত 1990 সালে। বর্তমান সভাপতি সন্দীপ দাস, সম্পাদক অনল কান্তি দাস। নবারুণ সঙ্ঘ বেলতলা স্থাপিত 1982 সালে। সভাপতি দীনেশ চন্দ্র মন্ডল। সম্পাদক রাজু নাথ। সৈদপুর পল্লী মিলন সমিতি ক্লাবের দুর্গা পুজো হয়। ব্যাওকাটি চারাবাড়ি রেড ইউনিট ক্লাব স্থাপিত 1969 সালে। বর্তমান সভাপতি অনুপ ঘোষ সম্পাদক নাড়ুগােপাল সরকার। টাকি একাদশ… স্থাপিত 2000সালে ।সভাপতি বিকাশ রায়, সম্পাদক মৃণাল পাল। আমলানী সম্মিলনী স্থাপিত 1954 সালে। সভাপতি অমিতাভ বিশ্বাস সম্পাদক অরুণ মন্ডল। লিবার্টি ক্লাব ও দুর্গাপুজোয় ব্রতী হয়েছে। কলম উকি দিয়েছিল এই মুঠোফোনের জগতে এক বাচ্চা ছেলের শিল্পী স্বত্তায় । শ্যামল ব্যানার্জী, বনানী ব্যানার্জীর নাতি ঋতঙ্কর ছয় সাত বছর থেকে কখনাে বােতলে , কখনাে সােলার ঠাকুর গড়তাে। 2018 থেকে নিজে সম্পূর্ণ সাজ সহ সুন্দর মাতৃমূর্তি তৈরি করে নিজেই পুজো করে। ঋতঙ্কর 2021 এ মাধ্যমিক দেবে। আমরা আশাবাদী ঋতঙ্কর পড়াশুনার সাথে সাথে তার শৈল্পিক ভালােবাসা কে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ছােট বেলা থেকে দেখে আসছি বিপ্লবী সঙ্ঘের পুজো। 1968 সাল থেকে ঐতিহ্যের সাথে এই পুজো হয়ে আসছে। বর্তমান সম্পাদক সৌমেন বিশ্বাস দুর্গাপুজোয় ব্রতী হয়েছেন।


টাকি জমিদার প্রধান শহর হলেও বাড়ির পুজো , ক্লাবের পুজো মহাসমারােহে হয়ে আসছে। কুন্ডু পাড়ার পুজো শুরু হয়েছিল 1931 সালে। আজও পুজো হয়ে আসছে। দত্ত পাড়ায় বিবেকানন্দ স্পাের্টিং ক্লাব স্থাপিত 1962 সালে। বর্তমান সম্পাদক অভিজিৎ ঘােষ। 1992 সালে স্থাপিত অর্কিড ক্লাব বিভিন্ন সামাজিক কাজে যুক্ত এবং দুর্গা পুজো করে আসছে। বর্তমান সম্পাদক কৌশিক কুন্ডু। অগ্রদূত ক্লাব বহু পুরােনাে এই ক্লাব। স্থাপিত 1966। মূলত শ্যামা পূজায় মহা ধুমধামের সাথে করে আসছে। কয়েক বছর দুর্গাপূজায় ব্রতী হয়েছে। বর্তমান সভাপতি তীর্থঙ্কর গাঙ্গুলী, যুগ্ম সম্পাদক অভিষেক ঘােষ ও সতীর্থ গাঙ্গুলী। দক্ষিণরাড়ি পাড়া সার্বজনীন স্থাপিত 2000 সালে। বর্তমানে সভাপতি পীযুষ কান্তি সরকার, সম্পাদক অরিন্দম মজুমদার। মা কালী নাট্য সমাজ টাকির সব থেকে পুরােনাে ক্লাব। জাগ্রত কুলেশ্বরী কালীবাড়ি পাড়ায় এই ক্লাব 1914 সালে স্থাপিত। বর্তমান সভাপতি প্রবীর চক্রবর্তী, সম্পাদক সন্দীপ চক্রবর্তী মহা ধুমধামের সাথে আজও দুর্গাপুজোর ঐতিহ্য বহন করে চলেছেন। টাকি রামকৃষ্ণ মিশনের পাশ দিয়ে পৌঁছে গেলাম টাকি লাহিড়ী পাড়ায়। প্রথম পুজো শুরু হয় 1989 এ প্রদীপ লাহিড়ীর বাড়ির সামনে। উদ্যোগতাদের মধ্যে ছিলেন প্রয়াত প্রিয় সাধন বিশ্বাস, প্রয়াত হিরন্ময় লাহিড়ী ও শ্রী প্রদীপ লাহিড়ী, শ্রী প্রবীর লাহিড়ী, শ্রী তিলক ভঞ্জ। কয়েক বছর প্রয়াত সত্য কৃপা বিশ্বাস মহাশয়ের বাড়িতে পুজো হবে। বর্তমানে পুজো হচ্ছে বিশ্বজিৎ লাহিড়ী বাড়ির সামনে। কলম পৌঁছে গেছিল রজিপুর ব্রাহ্মণ পাড়ায়। ৭৮ বছর ধরে নিয়ম নিষ্ঠার সাথে পুজো হচ্ছে রজিপুর ব্রাহ্মণ পাড়ায়। আন্তরিকতা, আত্মীয়তার মেলবন্ধনে সব পাড়া যেন একটা পরিবার। এই পুজো শুরু করেছিলেন জিতেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় , অহিন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়। বাইরে থেকে কোনাে চাদা তােলা হয় না।পাড়ার পরিবার মিলে পুজোর সমস্ত ব্যয়ভার বহন করে। পরিবারের সদস্যরাই পুজোর কাজ করেন। এবার পুরােহিতের দায়িত্বে আছেন সঞ্জয় মুখার্জী। রজিপুরে আর একটি পুজো হয় রজিপুর বাস্তু তলা কল্যাণ সমিতি ।2017 সালে স্থাপিত। বর্তমানে সভাপতি সুদীপ্ত মুখার্জী , সম্পাদক দীপক কুমার দাশ। মতিঝিল বি বা দি সংঘ ক্লাব স্থাপিত 2000 সালে। সভাপতি মৃণাল কান্তি দাস , সম্পাদক যদুনাথ দাস পূজা কমিটি সম্পাদক কমল বসু ।প্রতি বছরের ন্যায় এ বছর ও দুর্গাপুজোয় ব্রতী হয়েছেন। ইন্দ্রনীল সংঘ স্থাপিত 1968 সালে। বর্তমান সভাপতি তপন ঘােষ , সম্পাদক চিত্তরঞ্জন দাস দুর্গাপুজোয় ব্রতী হয়েছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান কর্মকর্তা প্রাক্তন , শঙ্কর রায়চৌধুরী র বাড়ির ( টাকি সৈদপুর) পুজো শুরু হয় 1706 সালে যশাের জেলায়। আগে মহিষ বলি হইলেও এখন আর হয় না। এই বাড়ির পুজোর বিশেষত্ব হলাে সব সম্প্রদায়ের মানুষ এই পুজোয় অংশ নেয়। মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ জন দেব মন্দিরে উঠলেও ফুল এনে ফল এনে নানাবিধ পুজোর কাজে যুক্ত হয়। এ বছর ৩১৪তম পুজো হচ্ছে। টাকিতে পূব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ জমিদার বাড়ি থাকলেও একমাত্র পুবের বাড়িতে সুভাষ রায় ও তপন রায় মহাশয়ের হাত থেকে মালিকানা হস্তান্তর হলেও আজ ২৯৮ বছরের পুজো 2018 সাল থেকে বহাল রেখেছেন আত্মীয় অনুপ ঘােষ ও শর্মিষ্ঠা ঘােষ। পুবের বাড়ির পুজো ওপার বাংলায় শুরু হয়। পুবের বাড়ির বংশধর সুভাষ রায় গত বছরের পুজোতে এসেছিলেন।। নবমীতে মহিষ বলি দেখতে প্রচুর মানুষ বাইরে থেকে টাকিতে যেতেন। বর্তমানে অনুপ ঘােষ ও শর্মিষ্ঠা ঘােষ মহিষ বলি বন্ধ করে আখ ও চাল কুমড়াে বলি র প্রচলন করেন। নির্দিষ্ট মাপে এক চালার ডাকের সাজে বিশাল মাতৃমূর্তির দুপাশে বিশালাকায় হাত পাখার বাতাস দেয়ার রীতি এখনাে চালু আছে। পুবের বাড়ির দূর্গা প্রতিমায় চক্ষু দান করা হতাে মহালয়ার দিন। সেটি বন্ধ হয়ে গেছিল। কিন্তু ওই চক্ষুদান মহালয়ার দিনে আবার প্রচলন করেন শর্মিষ্ঠা দেবী। পুবের বাড়ির পুজোর একটি বিশেষত্ব হলাে সন্ধি পুজোর আগে এক প্রসাদী ডালা দিয়ে পুজো দেওয়া হয় কুলেশ্বরী কালি বাড়িতে। আগে যেটি হতাে না, অন্ন ভােগ এখন প্রতিদিন সেটি র প্রচলন করেছেন শর্মিষ্ঠা দেবী। বিজয়ার দিন মা পান্তা ভাত, কচু শাকের ঘন্ট ও চালতার চাটনি খেয়ে কৈলাসের উদ্যেশে রওনা হন এবং সিঁদুর খেলায় যাঁরা অংশ নেন তারা ওই দালানে বসে প্রত্যেকে ওই ভােগ খান। টাকির সব পুজোর ঠাকুর বিসর্জন হয় ইছামতী নদীতে। প্রথম , কাধে করে পায়ে হেঁটে পুবের বাড়ির ঠাকুর ইছামতির নৌকায় ওঠেন। তারপর আর অন্যান্য ঠাকুর ইছামতির নৌকায় ওঠে। ওপারে বাংলাদেশ, এই দিন বর্ডার খােলা থাকতাে। এপার ওপার মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতাে। নিরাপত্তা র কারণে এখন ইছামতি লােহার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। প্রকৃতির নিজস্ব রূপ হারিয়েছে। পাড় সেজে উঠেছে অথিতি নিবাসে। আমরা যারা ইছামতী তে পা ডুবিয়ে খেলা করেছি বিসর্জনের মন খারাপ আজ ও করে।

পরিবেশ পরিস্থিতি মানিয়ে নেয়া যেখানে শিক্ষার অঙ্গ সেক্ষেত্রে কলমের আবেগ অনুভূতি ভালােবাসা নীরবে নিভৃতে থাকা কাম্য। গর্বের টাকি, শিক্ষার টাকি, সংস্কৃতির টাকি ঐতিহ্যের টাকি পরিস্থিতির পরিপেক্ষিতে একটু ফিকে হয়ে এলেও আমরা আশাবাদী। টাকি আমাদের গর্বের। বিজয়া দশমীর ইছামতীতে নৌকায় বিসর্জন এক অভিনব দর্শন। বাইরে থেকে বহু মানুষ আজও ভিড় জমায় ইছামতির কোলে।আমাদের ছােটবেলা কেটেছে বিজয়ার প্রণাম , কোলাকুলি , নারকেল নাড়ু, ঘুগনি , বোঁদে , কুচো নিমকি আর টাকির বিখ্যাত মালপাে দিয়ে। কালীপূজা পর্যন্ত চলতাে এই রেশ।হলুদ পােস্টকার্ড হারিয়ে গেছে বিজয়ার প্রণাম জানাতে। পৃথিবী হোক সুস্থ , সুন্দর , কোভিড মুক্ত। এই শুভ কামনা, রইল শারদীয়ার প্রীতি শুভেচ্ছা ও ভালােবাসা।

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *