কৃ ষ্ণা   মা লি ক-র হাট দর্শন লিখছেনঃ হাটের মানুষ-বাটের মানুষ(পর্ব-৪)

পরিচিতিঃ পূর্ব বর্ধমানের প্রত্যন্ত গাঁয়ের ধুলোমাটিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর। পায়ের তলার সরষেকে গড়িয়ে যেতে না দিয়ে জোর করে পিষে ফেলে ঘরে আটকে থাকা। কলমের কাছে মুক্তি চেয়ে নিয়েছিলেন। প্রকাশিত কবিতার বই কয়েকটি। একটি গদ্যের। এখন গদ্য দ্বিতীয় প্রেম। কৃৃৃৃষ্ণা, যাজ্ঞসেনী গুপ্ত কৃষ্ণা ছদ্মনামেও লেখেন। 

 

কৃ ষ্ণা   মা লি ক-র হাট দর্শন লিখছেন

 

হাটের মানুষ বাটের মানুষ(পর্ব চার)

চার

 

বাউল বিলাসিনী দাসী

চোখের সামনে চিন্তামণি তবু সে চিনতে পারে না তাকে। এই হাহারবে জীবনের একতারার বাঁধা তার ছিঁড়ে যায় ঝনন – টংকারে ধনুকটিও কাতরায়। দুপুর দহনে তখন, ভীড়ের অজস্র কথার জরাজাপ্টি তালগোলের ফোয়ারা সড়কে আছড়ে পড়ছে নির্ভার। বাস-লরী ট্রাক্টর টোটোর খুনচেপে ওঠা রোয়াবী দৌড় ও শব্দবমন কানের পর্দায় কড়া ফেলছিল। খঞ্জনী হাতে বাউলানি বিলাসিনী পথ কেটে চলেছিল ক্ষীণধারার মতো বকুলের ছায়ায় আলগা হয়ে বসে।
বিলাসিনীর সঙ্গে পরিচিত হয়ে একটা জিনিস গভীরভাবে বিশ্বাস করেছিলাম, যে হেটো-মেঠো লোক আধা স্বাক্ষর বা নিরক্ষর হলেও দার্শনিক হতে বাধা হয় না। সক্রেটিস কথিত মানবীয় জ্ঞান সে সহজভাবেই যেন আয়ত্ত করে ফেলেছে। সদমানুষ হিসাবে হয়তো সে এই সদগুন অর্জন করেছে, ঐশ্বরিক জ্ঞান অর্জন তো সাধনার বিষয়। জীবনের অভিজ্ঞতায় সহজ সত্যকেও সে সহজে চিনেছে। অন্তত ভালোর মোড়কে মন্দের চর্চা করে সহজে বাজিমাত করার আজকের রাষ্ট্রীয় শাসনপদ্ধতির যে কায়দা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা ছিঁচকে রাজনৈতিক নেতারা হরবখৎই করে থাকেন, সেই সত্যি জানাটুকু বোধে নিয়ে আসতে পারেন বিলাসিনীর মতো হেটো-মেঠো অনেক মানুষ। ঘরোয়া আর নিরাপদ (আপাত) বলয়ে মধ্যবিত্ত মানুষও যা অনেক সময় বুঝে উঠতে পারেন না।
তার কপালের রসকলি জীবনকে ঘুরিয়ে দিয়েছে বাঁকের মুখ থেকে সমান্তরাল রেখে পিছনে ততটাই। চোখের মণি ধূসর হতে বসেছিল তখনই, তা সত্ত্বেও সে চোখে দূর দিগন্তের ঝিলমিল। পা ছড়িয়ে বসা পিতামহীর মতো আদল আমার আঁতে টান লাগিয়েছিল। পায়ে পায়ে সুতো গুটিয়ে নিকট করি দূরকে।-মাসি! পাশে বসি। ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে একঢোঁক খেয়ে বাড়িয়ে ধরি তার দিকে। জলটুকু খায়। তারপর দুহাত তুলে – রাধে রাধে! আনমনে হাতের কত্তালও সঙ্গত করে ওঠে ক্ষণিক।
ঘর কোথায়? জিগ্যেস করলে আমিও যেন তত্ত্বের মোহে পড়ে যাই, বলি – কোথায় যে ঘর তা বলতে পারি না, মাসি। তবে থাকি এই গাঁয়েই গো! তা তুমি এলে কোথা থেকে? তোমাকে তো সেহারার হাটে আগে দেখিনি?
সে বলে, ও রাইধনি! আমি থাকি বটে বেলেতোড়, তবে আসছি বটে সোনামুখী থেকে।
সেটা কীরকম?
তুমি যেমন বললে ঘর কোথায় তা বলা মুশকিল? আমিও রহস্য করলুম গো! বলে একটু গুনগুনিয়ে নিলো মাসি। তারপর বলল, হাটে হাটে মাধুকরী করি, সোনামুখীর হাটের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এসে পড়েছি এখানে। তা যেখানে গুরু টানে সেখানেই যেয়ে পড়ি।
এমন করেই চেনাশোনা বিলাসিনী বাউলানির সঙ্গে। সেও হলো অনেকগুলো বছর। সে নিজেকে বাউল বলে, অথচ কথায় কথায় রাধা কৃষ্ণের নাম নেয়। মনে মনে ভাবি এ কেমন ধারা দোআঁশলা বাউল বটে?
একদিন জিগ্যেস করে ফেলেছিলাম কথাটা। বলল, গুরুনাম নিয়েছি বলে কি কৃষ্ণনাম নুব না? আমি কৃষ্ণকে জিভায় উচ্চারন করি, মাগো! তাই তাকে রেখেছি আমার দেহের ভেতর। আমরা দেহের ভেতর আরও দেহ ধরে রাখি। মনের তো কথাই নাই! মনের ভেতর রয়েছে মনের মানুষ। সে তত্ত্ব বাদ দিয়েও বলি, মনের ভেতর আমাদের অনেক মন, অনেক ঘর। এক একটা ঘরের ভেতর এক একজনার বাস। বলে মাসি গুনগুনিয়ে ওঠে। আমি বলি, ও মাসি ধরো দেখি কসে-! অমনি খসখসে অচর্চিত গলায় গেয়ে ওঠে খঞ্জনিতে তাল ঠুকে।-তোমার ঘরে বাস করে কারা, ও মন জানো না – তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা —
আমার কৌতুহলী মন তার জীবনের কথা শুনতে চাইত। রাখঢাক না করে সেও বলতে কসুর করত না। “অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল, তখন বয়স তের চোদ্দো হবে। স্বামীর বয়স আমার দু-গুণ। সংসারে মন বসত না। আর একটু বড়ো হতে কুটুমের সঙ্গে পালালুম, মনে হলো তাকে ছাড়া বাঁচব না। সেই কৃষ্ণের জীব – আমি মুখে গুরুর নাম নিই, কৃষ্ণের নাম নিই সেই কারণে এ মুখে গালাগাল দিই না। সে আমাকে একজনের কাছে বেচে দিলে। পালালুম আবার – !” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠে-কৃষ্ণ কৃষ্ণ – রাধে রাধে –।
কথার খেই ধরে বলে, তারপরই বাউলের সঙ্গে দেখা। বাড়ি ছিল চব্বিশ পরগণার দিকে। নিজের চেনা দেশ গাঁ ছেড়ে ভেসে চলেছি। গুরুর ইচ্ছায়, কেষ্টর ইচ্ছায় এখানে ওখানে – ।যেমন আজ এই হাট দেখব বলে চলে এসেছি? আর দ্যাখো, তোমার সঙ্গে কেমন দেখা হয়ে গেলো? পৃথিবী এক হাটই গো! বড়ো ছোট ওই হাট। মানুষ ভেসে চলেছে স্রোতের টানে। কেউ কূল পায়, কেউ অকূলে ভেসেই বেড়ায় সারাজীবন। ফিরে দেখা হয় কতক কতক মানুষের সঙ্গে। সেই কুটুমকেও দেখেছিলুম, বুঝলে মা?” বলে থমকে যায়। কী যেন মনের ভেতর কেঁচেগন্ডুষ করে। সেই কথাহীনতার ভেতর কুলকুল করে বয়ে যায় কিছুটা সময় আর না-কথার ভাবনা।
ভাবনার দরজা আমারও খুলে যায়। কত কত গুরুর কথা কানে আসে, কত বাউল-ফকির। এমন দর্শন ছোঁয়া তত্ত্বকথা কতজনই তো বলে। অথচ দেখা যায় সেখানে ভালোর মোড়কে মন্দের উপস্থাপনা। গুরুরা ধরা পড়েন বড়ো বড়ো অপরাধ করে, রাজনীতিকদের সাধারণত দু-কান কাটা হয়। ধরা পড়লেও তাদের “রিচ” কমে না। আর ছোটখাটো মানুষদের অপরাধও ছোটখাটো। তবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে তাদের তা করতে হয় অনেক সময়, মানে করে ফেলে আর কি! সক্রেটিসীয় মতানুযায়ী যদি তাদের দুটো মন্দের মধ্যে একটাকে বাছতে বলা হয়, তবে তারা কোনটাকে বাছবে তা অবশ্য বলা মুশকিল। তা ছোট অপরাধটিকে বেছে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে নিজের দরকার মেটানোর কথা ভাবলে বুঝতে হবে তারা মন্দ কামনা করে না। আবার হতে পারে অনেক সময় জেনেবুঝে মন্দ করে না, ভালো ভেবেই করে, তারও অর্থ হলো মন্দ তারা চায় না। অনেক সময় লাগাতার মন্দকে “ভালো ভালো”, তোমার ভালো হবে, অর্থ আসবে, ঘুচে যাবে সব অভাব” – এই ধুয়োয় পড়ে মন্দের স্বরূপটা তলিয়ে দেখে না।
যাইহোক, ইত্যবসরে বিলাসিনী ফিরে আসে তার কথায়, সে বলছিল, সোনামুখীর হাটে একদিন একটা জটলায় হৈচে দেখে কাছে গেলুম। সব সময় নির্বিকার থাকতে পারি না, সেই সাধনা আমার নাই, আমার বাউল সেই সাধনা করে। সবই মায়া, সবই অনিত্য এ কথা সে বলে। সে যাইহোক, আমি এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিলুম। হাত কুড়ি তফাৎ দিয়ে আমি তো চলেই যাচ্ছিলুম, গুরু আমায় সত্যের রূপ দেখাবে বলে নিয়ে গেল। দেখলুম কুটুকমে ঘিরে রেখেছে লোকজন। চড়-থাপ্পড় দু-চারটা আগেই পড়ে গেছে। লোককে জিগ্যেস করতে বলল, কাদের বাড়ির মেয়েকে নাকি বিয়ে করবে বলে ভোগ করে পালিয়েছিল মাস কতক আগে। আবার কী মতলবে এসেছিল কে জানে, বুঝতে পারেনি এতদিন পর ধরা পড়ে যাবে।
আমার একবার মনে হলো দিই বলে তার আমার সঙ্গে ঘটা কীত্তিখানা। তারপর নাককানে হাত দিলুম, রাধে রাধে—এ কী “পোবিত্তি” আমার? মানুষের পিতিশোধ নেবার কি শেষ আছে? সব যে রসাতলে যাবে? চুপচাপ সরে গেলুম। নাহলে সে হয়তো লোকের হাতে মার খেয়েই ইহলীলে সাঙ্গ করত সেদিন। কিন্তু আমি অন্যায়টা ঘটতে দিলুম না।”
“কিন্তু মাসি, অন্যায় করে পার পেয়ে যাবে? শাস্তি পাবে না?” মুখে আমি একথা বললেও সক্রেটিসীয় চিন্তা মাথায় এলো আবার। স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীও তাঁরই আলোয় স্পষ্ট করে বলেছিলেন, চোখের বদলে চোখ নীতি হলে পুরো দুনিয়া অন্ধ হয়ে যাবে। বিলাসিনীর উত্তর শুনব বলে আমার ওই প্রশ্ন।
উত্তরে তত্ত্ব আওড়েছিল, আমরা সামান্য মানুষ।শাস্তি দেবার আমরা কে? যিনি মালিক, তাঁর হাত থেকে নিস্তার নাই কারও।
আমি বললাম, পুলিশে জানাতে পারতে -?
“সে কথা আমি ভাবিনি, মা! তবে ওই যে বললাম, মানুষ শাস্তি দিতে পারে না”। এমনি করেই বিলাসিনী দাসীর সঙ্গে আমার জান-পহেচান।
তাহলে আমার হাট-দর্শনে ভুল নেই নিশ্চয়? নিরাসক্ত মনই সম্ভবত দার্শনিক হতে পারে। তো বিলাসিনীকে আমি ভুলিনি, আর সে-ও না। সেহারার হাটে এলে কখনও কখনও আমার বাড়ি সে চলে আসে। এখন তার বয়স আরও খানিকটা এগিয়েছে। তাকে পুরোপুরি যে আমি বিশ্বাস করি, সে যে ভালোর মোড়কে মন্দই বহন করছে না, তেমন নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আমি আসতে পারিনি আজও। এটা আমার নিজেরই সংকীর্ণতা কিনা জানি না। আসতে পারিনি তার চোখ দেখে। চোখ সত্যিই মনের আয়না কিনা, সর্বদা এই প্রবচন মেলে কিনা তার ফয়সালাও আমি করতে পারি না। তবে বিলাসিনীর চোখ মাঝে মাঝে পাল্টে যায়, সে চোখে চতুরালি ছায়া ভেসে ওঠে যেন মুহূর্তের জন্য, তখন তার প্রতি আমি ভালোবাসা অনুভব করতে পারি না। পরেই অবশ্য সেই আগের বিলাসিনী। তখন ভাবি, নিশ্চয় আমার দেখার ভুল। এত বছর ধরে কেউ ভান করে আসতে পারে নাকি? সে মেকি হতেই পারে না! মনে মনে বলি, তাই যেন হয়। অন্তত একটি মানুষ নিখাদ সোনা হয়ে থাক এই আমার অকিঞ্চিৎকর জীবনে।
ওই তো সে। আমার উঠোন জুড়ে ঘুরে ঘুরে একতারা বাজিয়ে নেচে নেচে গাইছে। অপূর্ব আনন্দিত মুখে রহস্যময় হাসি তার। দুঃখ বেদনা কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করে না। সব গুরুর আর কৃষ্ণের চরণে সঁপে দিয়েছে। গান বাজছে উঠোন জুড়ে, একটা সুন্দরের কম্পন ছড়িয়ে পড়ছে হাওয়ায়, ধুয়ো উঠছে তারই মতো আরও ক’জনার একই রকম গলার স্বরে – আমি কাঙাল, দয়ালগুরু আমার মন তো কাঙাল নয় —

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্বগুলি পড়তে নিচের লিংকে যান

“হাটের মানুষ বাটের মানুষ(পর্ব তিন)”–হাট দর্শন লিখছেন–কৃ ষ্ণা   মা লি ক

হাটের মানুষ বাটের মানুষ(পর্ব দুই) লিখছেন–কৃ ষ্ণা   মা লি ক

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *