আমার জন্মের কোলাহল, বার্ধক্যের প্রশান্তিঃ নীতা বিশ্বাস

স্মৃতিকথায় অন্যগদ্য  
  
           আমার জন্মের কোলাহল, বার্ধক্যের প্রশান্তি
                  
                               নীতা বিশ্বাস
                                                                                                     ছবিঃগৌতম মাহাতো

আমার শহরকে স্নেহ-মমতায়-ভালোবাসায় ঘিরে রেখেছে এক নদী আর একগুচ্ছ পাহাড়। আমি সেই নদীর দুপারের বেলাভূমির নাম রেখেছি সোনাবেলা।  আমি রূপকথা শোনাচ্ছি না! বিশ্বাস কর! ওই নদীর বালুতে সোনাকুচি মিশে থাকতো! বালু আর সোনা। দুজনের কেউ নিজেদের জাত বিচার করে স্পর্শ বাঁচিয়ে চলার কথা ভাবেইনি কোনোদিনও! সোনাকুচি মেশানো বালু! হ্যাঁ, সেই নদীর নাম যে সুবর্ণরেখা! জন্মসুত্রে সে আমার মা। আর পাহাড়টি! সারাশহরটা নিজের চুড়োয় চুড়োয় ঘিরে রেখেছে যে পাহাড়, তার নাম দলমা। নদী-পাহাড় ঘেরা আমার এই প্রিয় শহরের মর্মে রয়েছে এক শিল্পীর সোনাঝরা শিল্পের দুর্দান্ত ক্যানভাস। পারস্য দেশের সেই সুর্য-উপাসক শিল্পীমানুষটির বিশ্ববিখ্যাত নাম জামশেদজী নসরবানজী টাটা।  আমাদের প্রিয় ‘টাটা বাবা’। আর শিল্পটির  শিরোনাম ‘টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি। আর এই শিল্পকর্মটি ঘিরে যে বসতি গড়ে উঠেছে, সে আমার ভালোবাসার  শহর   জামশেদপুর। গাঁ-গেরামের লোকেরা বলে টাটাবাবার শহর। তা তিনি যেন এক বাঁশিওয়ালা। একশো বছর আগে  আমার পূর্বপুরুষদের কেউ কলকাতা থেকে, কেউ ঢাকা, খুলনা ফরিদপুর বরিশাল থেকে এই শহরে সসম্মানে তাঁর কারখানায় জীবন-জীবিকার সুযোগ পেয়েছিলেন। তারপর পাহাড় অরণ্যানী সুবর্ণরেখা নদী বেষ্টিত এই প্রান্তিক জনপদের প্রেমে পড়ে বসতি গড়ে তুলেছিলেন।
কপোতাক্ষের পার থেকে বাবা কলকাতায় পড়তে এসেছিলেন। পড়াশোনা সেরে গ্রামের বাড়ি ফেরবার আগেই টাটাবাবা এসে যেন হাতটি ধরে ভালবেসে তাঁর কারখানার কাজে বসিয়ে দিলো (বাবার ভার্সন ঠিক এই ছিল)।  তারপর ৩৫বছর ধরে সেই কারখানাটি বোধহয় বাবার ঘরবাড়ি হয়ে গেল। এত ভালোবাসা এই গ্রামের মাটিতে বাতাসে নিসর্গে! হ্যাঁ তখন তো এ এক গ্রামই ছিল। নাম ছিল কালিমাটি। কালিমাটিকে সোনামাটি করেছিলেন জামশেদজী। দেখিয়ে দিয়েছিলেন, লোহাও সোনা বিয়োতে পারে। একটা পরাধীন দেশের একটি অখ্যাত গ্রামে সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে দেশীয় কৃৎকৌশলে ও এদেশের মানুষদের ভরসায় গড়ে তুলেছিলেন এই শিল্পসাম্রাজ্য। এই পাহাড়-জঙ্গলে তিনি মঙ্গলের সুচনা করেছিলেন হাজার হাজার মানুষের জীবননির্বাহের পথ দেখিয়ে। টাটাবাবাকে নিয়ে ভূমিপুত্রেরা গান বাঁধতো।
একটা সত্য ঘটনা বলি! জামশেদজী আর স্বামী বিবেকানন্দ একবার এক জাহাজের যাত্রী ছিলেন। এই দেবদুর্লভ মানুষটির ব্যাক্তিত্ব জামশেদজী টাটাকে আকৃষ্ট করে। তাঁর সঙ্গে অনেকরকম অলোচনা প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ বঙ্গসন্তানদের বাবুগিরি করে সময় ও বুদ্ধি নষ্ট না করে ব্যাবসা ও শিল্পপত্তন করে দেশকে সমৃদ্ধশালী করে তোলার কথা বলেছিলেন। এই সৎ পরামর্শ J.`N.Tata নামক সৎ মানুষটির  মনে  প্রেরণাস্বরূপ হয়ে ওঠে। আর কালিমাটি নামের গ্রামটিকে তাঁর শিল্পভাবনার ভিত্তিভূমি করে তোলেন। আর একজন বিশিষ্টব্যাক্তি, বিখ্যাত জিওলজিষ্ট, শ্রী প্রমথ নাথ বসু এই গ্রামের বিভিন্ন স্থানে আকরিক লোহার সন্ধান দেন তাঁকে। এসব বৃত্যান্ত আমার বাবার মুখে শোনা। সেই ছোট্ট কালিমাটি গ্রামটি ক্রমে ক্রমে একটি শিল্পনগরী নামে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয়। প্রচুর কর্মসংস্থানের আধার এই গ্রামটির শ্রীবৃদ্ধি হয়, টাটার পরিকল্পিত সড়কনির্মাণ ও সৌন্দর্যায়নের হাত ধরে। গড়ে ওঠে সুপরিকল্পিত শ্রমিক-আবাসন। দেশের  প্রচুর মানুষের গ্রাসাচ্ছনের ব্যাবস্থা করে জামশেদজি প্রকারান্তরে দেশসেবার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। ঝাড়খন্ডের ভূমিপুত্ররা অনিশ্চিত জীবনযাপন ছেড়ে নিশ্চিন্ততার আরাম পেয়েছে।             
★★
সুবর্ণরেখার কাছেই আমার বাবার অফিস-কোয়াটার্স। আমার জন্মঠিকানা। তখন জামশেদপুরে কোন মাল্টিস্টোরিড হাইরাইজ বিল্ডিং ছিলনা। আমার শিশুসময়েও তেমন কংক্রিটের জঙ্গল দেখিনি। বেশিটাই ছিল খোলা প্রকৃতির অবাধ সঞ্চরণ। আমাদের বাড়িটির সামনের বারান্দায় দাঁড়ালে দেখা যেত ঢেউ-টলটল সুবর্ণরেখা আর এপাশে মস্ত এক সরোবর। নাম ‘বাগাকুদা লেক।’ আর শহর ঘিরে দলমা পাহাড়। সূর্যাস্ত-সূর্যোদয়ের ক্ষণে পাহাড়ের সাথে আকাশের মন দেওয়া-নেওয়ার খেলার অনন্য অপরূপ রূপ বিষ্ময়ে দেখি। মন করলেই ছুট্টে চলে যেতাম নদীর কাছে। বালু দিয়ে মন্দির বানাতাম। মায়ের কাছে বকুনি খেলে পাহাড়ি নদীটির বুকের ভেতর থেকে জেগে ওঠা মস্ত পাথরের ওপর উঠে বসে থাকা। বর্ষাকালে নদীর ঢেউয়ে মেঘ-রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলা! আহা! সে ছোটবেলা কেন ফেরৎ পাইনা আরেকবার!    
★★
যাপনের নিশ্চিন্ততা, অন্ন-বস্ত্রের নিশ্চিন্ততা থাকলে মানুষ  জীবনের অন্য প্রয়োজনের কথা ভাবতে  পারে। টাটাকোম্পানী সে আশ্বাস দিয়েছিল তার কর্মীদের। সমাজ ভাবনা, সংঘবদ্ধ নির্মল  আনন্দলাভের চিন্তা শুরু হতে পেরেছিল এই আশ্বাস থেকেই। প্রথমদিকে টাটাস্টিলে কাজ করতে আসা মানুষের বেশীরভাগই বাংলাভাষাভাষী ছিলেন। জামশেদপুর সেসময়ে পশ্চিমবাংলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। আমরা তো জানিই পাঁচজন বাঙালি একত্রিত হলে সেখানে সাহিত্য-সংস্কৃতি-সঙ্গীত-নাটক প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। ব’সে কবিতা-গল্প পাঠের আসর। ক্রমে ক্রমে এই সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক-সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে  শুরু করেছিল। বেঙ্গলক্লাব, মিলনী, সবুজ সঙ্ঘ, ঘাসি ক্লাব, রামকৃষ্ণ মিশনের মত সংস্থাগুলো এগিয়ে এসেছিল জামশেদপুরবাসী বাঙালিদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও শিক্ষার দিকটি নিয়ে। টাটার নিজস্ব অডিটোরিয়াম ছিল। কবি-সাহিত্যিকরাও তাঁদের সৃষ্টি দিয়ে মানুষের আত্মিক ঐশ্বর্যকে ভরিয়ে তুলেছিলেন। কারখানার কর্মসংস্কৃতি ও কর্মীদের আত্মিকসংস্কৃতি সমান্তরাল ভাবেই চলেছে। উভয়ের  মধ্যে কোনো বিরোধিতা নেই।
#
এ শহরের মাটিতে কান পাতলে শোনা যায় ড্রিলিং মেশিনের সেতারের আবহে আকরিক কঠিনের ধাতব স্পন্দন। ব্লাস্টিং এর পৌরুষ। পাশে মহুয়াসুন্দরীর নূপুরনিক্কণ। টাটাবাবার মোহন বৈতালিকে এখানে নামে ভোর। ফার্নেস ফেরৎ আয়রন-ওর রূপসী তরল আর আকাশ ছাওয়া স্মেলটিংএর পলাশমঞ্জরী দেখতে দেখতে সন্ধ্যের মুখে তুমি যে দেশে পৌঁছে যাও, তার নাম কবিতার দেশ। সে দেশে সন্ধ্যা নামে পাতা-নাচের ছন্দে। লাইমস্টোনের কষ্টিপাথরে যাচাই হয়ে অগ্নিপরীক্ষিত আকর  যখন তার অপবিত্র লজ্জাটুকু স্ল্যাগডাম্পিং পাহাড়ের গায়ে উপুড় করে ঢেলে দিয়ে পবিত্র হয়ে উঠছে, এ শহরের আকাশ তখন কিংশুক-আঁচলে মুখ ঢেকে দলমারেঞ্জের শ্যামল ওষ্ঠে রেখেছে সমর্পিত অধর। সে এক অধরা মাধুরী…
স্ল্যাগারুণ এয়োতিআকাশের সে রূপ চোখে না দেখলে কল্পনা করা যায় না! পায়ে চলা পথের ধারে পলাশ, শিমুল, গুলমোহর, সোনাঝুরি অমলতাস কৃষ্ণচুড়া সবুজ অরণ্যে যথেচ্ছো রঙ বুলিয়ে দেয়। সে রঙ লাগে কোলযুবতীর কালো-নয়নে-কপোলে। আলো হয়ে জ্বলে ওঠে তার যৌবনের ধামসা-মাদল! মহুয়ার গন্ধ মাখে প্রসোষ বাতাস।
রাত গভীর হয় শারহুল পরবের নেশামাখানো উচ্ছসিত নৃত্যে-সঙ্গীতে। সচকিত কবির ক্যানভাসে আঁকা হয়ে যায় রক্তশ্যামল প্রেমের ক্যামেলিয়া।
★★
মোহনবাঁশির সুরে ঘুমভাঙা ভোরে, কবি যায় ফার্নেসে কয়লার যোগানে। ড্রিলিং মেশিনে হাত রেখে কবি কান পেতে শোনে যন্ত্র আর  নিসর্গপ্রকৃতির অনন্য সহাবস্থানের ঐকতান।
এ শহর আমার শৈশবের আনন্দ, কৈশোরের রহস্য, যৌবনের ঝম-ঝম। বার্ধক্যেও এ শহর আমায় ছায়া দেবে আমি জানি।  
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *