ই ন্দ্র নী ল ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস
চোরাবালি
পর্ব তিন
এ এলাকাটায় তুলনায় গাছপালা বেশী। সাইকেলটা নিয়ে নন্দিতাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই হাল্কা কাঁঠালি চাঁপার গন্ধ টের পেলো দেবু। এটা নন্দিতাদের বেশ পূরানো বনেদি বাড়ি। ওর কাকারা এক দিকে থাকে নিচের তলার বাঁদিকের অংশটায় ,ওরা থাকে উপরে। নিচের একটা ডানদিকের বড় ঘর ওদের ভাগে পড়েছে। এই ঘরটাকে নন্দিতারা বৈঠকখানা হিসেবেই ব্যাবহার করে। একসময় নাকি ওর দাদু এখানে ব্রীজ খেলার বিশাল আসর বসাতেন, এই শহরের উকিল থেকে ডাক্তার, নেতা থেকে ব্যাবসায়ী অনেকেই আসতেন। তখন ডাক্তারদের আলাদা আড্ডা, উকিলদের আলাদা ক্লাব – এসব ছিল না। শিক্ষিত, নানা দিকে প্রতিষ্ঠিত ভদ্রজনেরা একসাথেই আড্ডা-টাড্ডা মারতেন। এসব নন্দিতার কাছেই শোনা দেবুর।
গেট পেরিয়ে কিছুটা ফাঁকা জায়গা, ইতিউতি অগোছালো ভাবে কিছু ফুলের গাছ পরিচর্যাহীন বেড়ে উঠেছে। গোলাপি মুসান্ডা, সাদা জবা, একটা টগর গাছ তো বৃক্ষ হয়ে গেছে প্রায় …বাউণ্ডারি পাঁচিলের গোড়ায় বেশ আগাছা রয়েছে। বেশ ভারী দেখতে বড় কালচে খয়েরি রঙের কাঠের দরজার পাশে উপর নিচে দুটো কলিং বেল লাগানো। এতো মুশকিলে পড়া গেলো! কোনটা টিপবে দেবু! আন্দাজের উপর ভর করে উপরেরটা টিপে ধরলো দেবু …
“কে!…বেলটা ছাড়ো কেটে যাবে এবার…!” দেবু গলার স্বর অনুসরন করে উপরে তাকাতেই দেখলো একজন বৃদ্ধা গলা বাড়িয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে। একটু লজ্জায় পড়েই তাড়াতাড়ি হাতটা নামিয়ে নিলো দেবু, একটু বেশীক্ষনই টিপে ধরেছিলো দেবু! আসলে অনেক বাড়িতে বেল দিলে ভিতরে বেলের শব্দটা শুনতে পাওয়া যায়, কিন্তু এক্ষেত্রে দেবু কিছুই শুনতে পায়নি, তাই হয়তো… বৃদ্ধা সম্ভবত নন্দিতার সেই বিখ্যাত আদরের ‘গ্র্যানি’ বা ঠাকুমা!
“নন্দিতা আছে ঠাকুমা?…আমি দেবু , দেবব্রত…”
“ সেতো বুঝলাম না হয় … তা কি মনে করে এই ভরদুপুরে!!”
“ একটু দরকার ছিল …মানে…”
“আর মানে মানে কত্তে হবেনা বাপু …তিনি এখন চান কত্তে ঢুকেছেন … ওনার আবার একটু দেরী হয় …দাঁড়াও জিজ্ঞেস করি …”
বৃদ্ধা বেশ টরটরে, ফাজিল টাইপ …দেবু শুনেছে। তখনকার দিনের এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেওয়া স্বদেশী আন্দোলনে নিজের বিলিতি পুতুল, সাধের কাঁচের চুড়ি আগুনে দেওয়া চরম আত্মবিশ্বাসী এই বৃদ্ধা নন্দিতার অনেকটা জুড়ে রয়েছেন।
“যাও … নিচের ঘর খুলে দেওয়ার হুকুম হয়েছে ওখানেই বসো আপাতত …এই বিশে এ এ …দোরটা খুলে দে রে হাঁদারাম …”
দেবুর সামনের ভারি দরজাটা খুলে যায়। একটা বছর ৪৫-৫০ এর লোক, চোখে পুরু চশমা পড়ে সামনে দাঁড়িয়ে। “এসো ভাই এদিকে”… বলে দেবুকে ডানদিকের একটা বেশ বড় ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো।
কিছুক্ষণ পরেই নন্দিতা এলো। ভিজে চুলে তখনও ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছে। একটা অরেঞ্জ কুর্তি পরেছে পায়জামার ওপর। নন্দিতার সঙ্গে সঙ্গে একটা মৃদু মিষ্টি গন্ধ চলে এসেছে ঘরে, দেবু বেশ টের পাচ্ছে । চুলের জল গড়িয়ে নন্দিতার কুর্তির কাঁধ ভিজে উঠেছে। অদ্ভুত স্নিগ্ধ–মোহময় লাগছে নন্দিতাকে, কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল দেবু নন্দিতার দিকে। এভাবে কোনোদিন নন্দিতাকে দেখেনি , সদ্য স্নাতা আর্দ্র নন্দিতা মুগ্ধতা আচ্ছন্ন করেছে দেবুর অজান্তেই।
“কি রে ! কি মনে করে?” নন্দিতার কথায় দেবুর মুহূর্তের আচ্ছন্নতা ভেঙে যায়…
“তোর কেসটা কি?…কদিন কলেজ এলি না! ”
“ওঃ…এমনি শরীর ভালো ছিল না …তাছাড়া…” নন্দিতা যেন কিঞ্চিৎ গম্ভীর হয়ে যায়।
“তাছাড়া! …কি !”দেবু কথার সূত্র ধরে …
নন্দিতা চুপ করে থাকে, কোনো উত্তর দেয় না। অকারণে উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ায়। দেবুও উঠে গিয়ে দাঁড়ায় নন্দিতার পাশে।
“তাছাড়া আবার কি ! … বাবার ওই এক কথা …ফাইনাল পরীক্ষা হলেই বিয়ে …কাল ওঁরা এসেছিলেন …” নীরবতা ভাঙে নন্দিতা।
“কারা!”
“কারা আবার! বাবার বন্ধু আর বন্ধুর স্ত্রী! আবার কারা! …হাঁদা …” একটু বিরক্ত হয়েই উত্তর দেয় নন্দিতা। দেবু কিছু না বলে ফিরে এসে বেতের চেয়ারটায় বসে যেখানে বসে ছিলো। সেই মুহূর্তে সেই পুরু চশমা পরা লোকটা আবার ঘরে ঢুকলো হাতে একটা ট্রে নিয়ে। ট্রেতে একটা কাপ আর একটা প্লেটে কিছু নোনতা বিস্কুট নিয়ে।
“বনিমা তোমার জন্য আনবো?” নন্দিতাকে জিজ্ঞেস করে। ‘বনিমা’! …তার মানে নন্দিতার বাড়ির নাম বনি! বেশ মজা পায় দেবু।
“না … এসময় আমি চা খাই !” অকারনে ঝাঁজিয়ে উঠে জবাব দিলো নন্দিতা। চশমা পরা বিশু নামের লোকটা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে নিঃশব্দে। দরজার কাছে গিয়ে ওদের কেমন আড়চোখে একবার দেখে গেল । কি জানি দেবুর তো তাই মনে হল।
“শুধু শুধু লোকটাকে মেজাজ দেখালি! ”
“বাজে বকিস না তো… এতদিন আছে বিশুকাকা তাতেও বুদ্ধি হল না…” দেবু বুঝল মেজাজ বিগড়ে আছে নন্দিতার। অতিথিকে চা দিলে ঘরের লোককে প্রয়োজন না থাকলেও জিজ্ঞেস করাটাই রেওয়াজ এটা না জানার কথা নয় নন্দিতার। কিন্তু এখন নন্দিতার মুড বেশ বিগড়ে আছে যার ঝাল কিছুটা বিশুদার উপর দিয়েও গেলো আর কি।
“যাই বলিস ‘বনি’ নামটা কিন্তু বেশ …”
“ব্যাস হয়ে গেলো আর কি! গোটা কলেজে এবার রটিয়ে দাও!” বড় বড় চোখ করে দেবুর দিকে তাকিয়ে বলে নন্দিতা। দেবু হেসে ফেলে।
“তা তুই কি ভাবছিস! … রাজি তো নাকি! ”
“তোর মজা লাগছে না! …তোরা বুঝবি না …ছেলেরা কোনদিনই বুঝবে না। কারন তোদের তো বলির পাঁঠা করা হয় না… যত্তকিছু মেয়েদের উপর …”
“আঃ … এতো রেগে কিছু হবে! বোস এখানে এসে, বাড়িতে কথা বল খোলামেলা। বল আমি পোস্ট গ্র্যাজুয়েশান করব, চাকরি করব…”
“হবে না… পোস্ট গ্র্যাজুয়েশান… এ বাড়িতে নিষেধ…”
“ কেন?” বেশ অবাক হয়ে যায় দেবু একথা শুনে। “কারন কবে আমার কোন এক পিসি পোস্ট গ্র্যাজুয়েশান করতে কলকাতা গিয়েছিল। হস্টেলে থাকত তারপর এক মুসলমান ছেলের সঙ্গে প্রেম করে বাড়ির অমতে বিয়ে করে। বাবারা কেউ তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি। সেদিন থেকেই নিয়ম হয়েছে এ বাড়িতে মেয়েদের দৌড়… ঐ গ্র্যাজুয়েশন অবধি বেঁধে দেওয়া হবে! …” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে নন্দিতা থামে। ধীর পায়ে এসে বসে দেবুর সামনের চেয়ারটায়।
“আর তোর গ্র্যানি কি বলছে?”
“ঠাকুমা এসব পছন্দ করে না, কিন্তু এখন কে আর ঠাকুমার কথা শুনছে …”
“তাজ্জ্বব! তোদের বাড়িতে এরকম …আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না !শিক্ষিত পরিবার তোদের …”
“ওরকম মনে হয় বাইরে থেকে …আসলে আগে আমরা উচ্চকুলশীল ব্রাহ্মণ ,তারপর শিক্ষিত …বুঝলি!”
দেবু চুপ করে বসে থাকে, নন্দিতাও। বাইরে বেলা বেড়েছে। এবার ওঠা উচিত দেবুর। ‘আকাশ ফাউন্ডেশান নিয়ে যা বলতে এসেছিল তার এখন প্রয়োজন আছে কিনা দেবু বুঝতে পারে না। পড়ে থেকে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চা টা একচুমুকে শেষ করে একমুঠো নোনতা বিস্কুট তুলে নেয় দেবু। ব্যাগ থেকে প্রসপেক্টাসটা বের করে টেবলে রাখে।
“এনেছিস! গুড …” নন্দিতার চোখ এই প্রথম চকচক করে ওঠে। দ্রুত প্রসপেক্টাসটা তুলে নিয়ে উল্টাতে থাকে।
“মূলত এই জন্যেই আসা। আর…আর তোর খবর নেওয়া …দু-তিন দিন যাসনি তাই ভাবলাম…”
“বাবা! …সে কি রে! …দুদিন যাইনি বলে দেবব্রত সানাবাবুর মন কেমন করছিল বুঝি! …কেন অন্য কেউ পাত্তা দিচ্ছে না, নাকি !… দেখিস আবার! আমার প্রেমে টেমে পড়লি নাকি…! হাহাহাহা… বেশ একটা কৌতুক ভরা কটাক্ষ নিয়ে নন্দিতা তাকায় হাসতে হাসতে দেবুর দিকে …।
“প্রেমে! তোর! …আমায় কি পাগলা কুকুরে কামড়েছে! …তার উপর যা শোনালি!…”
দুজনেই এবার হাসতে থাকে বড় ঘরটার নিস্তব্ধতা ভেঙে। জানালার ধারে একটা মানি প্ল্যান্টের গাছ লতিয়ে উঠেছে, তার পাতাগুলো্র মসৃণতায় প্রথম দুপুরের রোদ এসে পড়েছে। দূরে …আরও দূরে কোনো একটা বাড়ির ছাদে মোবাইল টাওয়ারের আটকে থাকা ঘুড়ি এলোমেলো হাওয়ায় পতপত করে মুক্ত হওয়ার আপ্রান চেষ্টায় এদিক ওদিক করছে।
দেবু নন্দিতাদের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসার ঠিক একটু আগে নন্দিতার মা এলেন। বেশ বনেদি চেহারা। একসময় বেশ সুন্দরী যে ছিলেন তার রেশ এখনও দেখলে টের পাওয়া যায়। খুব আন্তরিক ভাবেই দেবুকে আর একদিন আসতে বললেন। কলেজের টুকটাক খোঁজ খবর নিলেন। দেবু বুঝলো এসব খোঁজ নিতান্তই যুবতী মেয়ের মায়ের সাধারণ কৌতুহল, অভ্যাসের অনুসন্ধিৎসা। দেবু যতই বন্ধু হোক, ছেলে বন্ধু তো!
পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করা যাবেনা! কারন… নাঃ দেবুর মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। এও সম্ভব! কি উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা! আরে বাবা অজাতের ছেলের সঙ্গে পালাতে চাইলে এখনো কি পারে না নন্দিতা! কে আটকাবে?…নাকি আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে বিপদ বাড়বে, এখানে তাও একটা গন্ডির মধ্যে রয়েছে। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশান তো করতে পারে নন্দিতা। কে বলতে পারে তার আগেই এস এস সি লাগিয়ে ফেলতে পারে বা অন্য কিছু। তা হলে! দেবুর নন্দিতার কথাগুলো সব প্রথম থেকে সাজিয়ে ভাবতে লাগল। নাঃ কোথাও একটা গোলমাল ঠেকছে ওর! হয় নন্দিতা ওকে মিথ্যে বলছে, না হয় অন্য কোন কারণ রয়েছে যা নন্দিতাও ঠিক জানে না।
ফেরার পথে বি সি রোড হয়ে রাধা নগরের ভিতর দিয়ে রাস্তা ধরল দেবু। দুপুরে খুব একটা জ্যাম নেই এখন। দোকান গুলো খুচরো দু একজন খদ্দের, বেশীরভাগই খালি পড়ে আছে। একটা ঝিম মেরে আছে অসম্ভব জমজমাট বি সি রোড সংলগ্ন বাজার দোকান পাট। সদর থানাটা পেরিয়ে যেতে যেতে দেখলো একটা ভিড় বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে রয়েছে থানার বাউন্ডারির ভিতর। এখানে সব সময় একটা ভিড় থাকে লক্ষ্য করেছে দেবু। সদর থানা বলে কথা ! কত লোকের কত সমস্যা। রোজই কিছু না কিছু হচ্ছে চারিধারে। এই তো কালই ইদিলপুর ইরিগেশান বাংলোর কাছেই বালির চরে একটা জোয়ান ছেলের লাশ পাওয়া গেছে। লোকে বলছে বালি পার্টি মেরে ফেলে রেখে গ্যাছে। নিজেদের মধ্যে লেগেই আছে ওদের গ্যাং ওয়ার। এসব রজতের কাছে শুনেছে দেবু।
“মাস্টার …ও মাস্টার …আছো নাকি” স্টাইল টেলরের সামনের সাইকেলে বসেই হাঁক দিলো দেবু। মাস্টারের দোকান খোলা, অথচ তাকে দেখা যাচ্ছে না।
“এই যে…” পিছনের একটা খুপড়ি চালাঘর রয়েছে। ওটাই মাস্টারের আস্তানা। একাফালি তক্তপোশ। একটা এলপিজি স্টোভ, টুকিটাকি জিনিস নিয়ে মাস্টারের একার সংসার। মাস্টার দুপুরের খাওয়া সেরে এই উঠলো। দেবু সাইকেলটা দোকানের গায়ে ঠেকিয়ে রেখে উঠে এল।
“তা আজ কি মেনু মাস্টারদা?”
“আর মেনু… ভাত আর ডিম আলুর ঝোল…তা এই ভরদুপুরে কোথা থেকে?”
“এই গেছিলাম একটু কাজে…” বান্ধবীর বাড়ি–একথাটা দেবুর মনে হল বলাটা তেমন জরুরী নয়, উচিৎও নয়। কে জানে মাস্টার আবার কি মানে করবে।
“তা খাওয়া দাওয়া হয়েছে?”
দেবু ঘাড় নাড়ে হ্যাঁ সূচক, যদিও এবার একটু ক্ষিদে যে পাচ্ছে না এমন নয় নন্দিতাদের বাড়ির চা-বিস্কুট কখন হজম হয়ে গেছে। সকাল বেলাতেই একপেট ভাত খেয়ে বেরোনো ওদের বাড়ির নিয়ম। আজও নিয়মের অন্যথা হয়নি। মাস্টার একটা টুল এনে দেয় দোকানের ভিতরে দেবুর বসবার জন্য। মাস্টারের একটা শাগরেদ মেঝেতে মাদুর পেতে দিব্যি ঘুম মারছে। মাস্টার লুঙ্গির কোঁচড় থেকে বিড়ি–দেশলাই বের করে ধরায়।
“একটা বিড়ি হবে নাকি দেবু বাবু!” বিড়ি বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে মাস্টার। দেবু বিড়ি একদম খায় না এমন নয়। তবে সিগারেটই বেশী খায়। হাত বাড়িয়ে নেয় বিড়ি…
দুপুরে তেলিপুকুর ফাঁকা। মাঝে মাঝে রুটের বাস গুলো যাচ্ছে। যাত্রী কম। রাস্তার উলটো দিকে একটা বিরাট বিল্ডিং উঠছে। ঢালাই পিলারের দৈত্যাকৃত কাঠামোটা দাঁড়িয়ে। এদিকে এখন বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে গত কয়েক বছরে।
“মালটার আসার কথা এলো না এখনো!” দাঁড়িয়ে বিড়িতে জোর শেষ টানটা দিয়ে বলে উঠল মাস্টার দূরে কলেজ মোড়ের বাস স্ট্যান্ডের দিকে তাকিয়ে।
“কার আসার কথা?”
“আরে…সেদিন বললাম না! …খোকন…ইন্দাসের…সেই লরি এক্সিডেন্ট করে কেটেছে…”
“ও, হ্যাঁ…ও আসবে ! পুলিশ ধরবে না?” দেবু বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করে।
“ধুর ধুর…ওসব কবে ধামাচাপা হয়ে গেছে…পুলিশ! পুলিশ তো ওদের ঘরের লোক…কবে সান্টিং হয়ে গেছে সব। ” মুচকি হেসে জবাব দেয় মাস্টার।
“আর বাড়ির লোক যদি ধরতে পারে বা পাব্লিক?”
“পাবলিকের মেমরিকার্ডে অত জায়গা আছে নাকি! কত মরছে রোজ…ও দুদিন পর সব ভুলে যায়! আবার নতুন কেস নিয়ে মাতে…আর বাড়ির লোক এখানে কিছু করতে পারবে না, খুঁটির জোর লাগবে…বুঝলে দেবুবাবু!”
ওদের কথার ফাঁকেই কখন একটা রোগা ঢ্যাঁঙা লোক দোকানের দাওয়ায় উঠে এসেছে ওরা খেয়ালই করেনি!
“কি হে মাস্টার! আমায় নিয়ে মস্করা কচ্চো নাকি?”
“আরে…খোকন যে!…কোন দিক দিয়ে এলে! আমি তো ভাবলাম বাসে নামবে!”
মাস্টার ব্যস্ত হয়ে দোকানের বাইরে বেড়িয়ে আসে। দু হাত দিয়ে খোকন নামে লোকটাকে জড়িয়ে ধরে। দেখে বেশ আন্তরিক সম্পর্ক বলেই মনে হলো দেবুর। এরকম চেহারার একটা লোক লরি চালায় বিশ্বাস করা কঠিন।
“না হে, তোমায় নিয়ে মস্করা! বলতে পারলে এ কথা!… একটু চা বলি?”
“তা বলতে পারো…নাঃ বাসে এলাম না, ঘাটে একটু কাজ ছিলো, মিটিয়ে একজনের মোটরসাইকেলের পিছন ধরে নিলুম… সেই নামিয়ে দিয়ে গেলো।” খোকন শোকেসের ফাঁক গলে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠল। দেবু আপাদমস্তক লোকটাকে জরিপ করতে লাগলো, নাঃ হাবেভাবে কোনোভাবেই বোঝা যাচ্ছে না ক’দিন আগেই এই লোকটাই দুজনকে পিষে দিয়েছে লরির চাকায়। যে লরি দুজন জল জ্যান্ত মানুষকে পিষে মেরে চলে যায় তার চালকের অভিব্যক্তি কেমন হওয়া উচিৎ জানে না দেবু কিন্তু এই লোকটার মধ্যে লেশমাত্র হেলদোল রয়েছে কিনা অকারনেই অনুসন্ধান করতে লাগল দেবু। দেবু এর আগে সামনে থেকে কোনও লরি ড্রাইভারকে দেখেনি যে মানুষ মেরেছে, হয়তো সেইজন্যেই। দেবুর ইন্দ্রিয়গুলো সচেতন হয়ে উঠলো তীব্রভাবে। লোকটা আড় চোখে টুলে বসা দেবুকে দেখে নিয়ে ধপাস করে বসে পড়ল মেঝের মাদুরে।
“আরে ভুলেই গেছি…এ হচ্ছে দেবু…কলেজে পড়ে, আমার কাস্টমার…বন্ধুও বলতে পারো …” মাস্টার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ঢঙে খোকনকে বলে।
“কলেজ!” বলে এবার খোকন ভালো করে দেবুর দিকে তাকায় কয়েক মুহূর্ত দেবুকে জরিপ করে নেয়। শুকনো ঠোঁটের ফাঁকে হলদে দাঁতের একটা যেন ঝিলিক দেখা যায়।
“তা আর কি করা হয়?” দেবুকে এবার সরাসরি জিজ্ঞেস করে খোকন নামে লোকটা। দেবুর মনে বিরক্তি লাগে, আচ্ছা উজবুক তো! শুনলো কলেজে পড়ে, তারপরেও জিজ্ঞেস করছে কি করি!
“কি আবার করবে! পড়াশুনা করছে…পাশ করে তবে তো ধান্দাপানিতে লাগবে!” দেবুর হয়ে জবাবটা মাস্টারই দিয়ে দেয় খোকনকে। খোকন কোনো উত্তর দেয়না।
চায়ের দোকানের হাফ প্যান্ট আর তেলচিটে গেঞ্জি পরা ছেলেটা চা দিয়ে যাওয়ার সময়ে বলে যায় “পাঁচটা”
“হ্যাঁ হ্যাঁ …যা তোর মালিক তো আমার পয়সাতেই বড়লোক হয়ে গেল রে, শালা…কাল নিবি” মাস্টার ঝাঁজিয়ে উত্তর দেয়। ছেলেটা উত্তর না দিয়ে ফিক করে হেসে যেমন এসেছিল চলে গেল। ওদের এসব গা সওয়া হয়ে গেছে। বাজার পট্টির রোজনামচার এইসব প্রাত্যহিক আপাত রূঢ় সংলাপেই প্রচ্ছন্ন থাকে দৈনিক দেওয়া নেওয়ার আড়ালে এক রকম ভালোবাসা–একথা ওই সাড়ে চার ফুটের ছেলেটিও জানে।
মাস্টার আর খোকনের মধ্যে নানান বার্তালাপ চলতে থাকে। দুজনার পেশায় কত অসুবিধা, কত ঝামেলা, এইভাবে ক’দিন চলবে – এই সব। দেবু খুব সামান্যই অংশগ্রহণ করে ওদের কথাবার্তার মাঝে, চুপ করেই থাকে বেশীর ভাগ সময়। কিছু বলারও রয়েছে এমনও মনে হয় না দেবুর। বাইরে রোদ মরে এসেছে। দেবুর মনে হচ্ছে এবার ওর ওঠা উচিত, কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছে না। এখানে বসে থাকতেও যে খুব ভালো লাগছে এমন নয়। মাস্টার লোকটাকে দেবুর ভালো লাগে, বেশ খোলামেলা লোক। প্রথম থেকেই দেবুর সঙ্গে বেশ আন্তরিক। আসলে দেবু বুঝতে পারে লোকটা এ রকমই! কিন্তু এই খোকন লোকটাকে ঠিক বুঝতে পারছে না! বোঝার কথাও নয় এত অল্প সময়ে। কিন্তু মাস্টারে সঙ্গে বেশ খোশমেজাজেই গল্প করছে। ওদের কথা বার্তায় দেবু জানতে পারে খোকনকে ওর মালিক আপাতত লরি থেকে নামিয়ে দিয়েছে, এখন ও ট্রাকটার-ট্রলি চালাচ্ছে, লোকালে মাল ডেলিভারি করছে। ওর বউ আবার পোয়াতি হয়েছে ,ন’মাস চলছে।
কত লোকে কত কিছুই না করছে! কেউ ড্রাইভার, কেউ টেলার, কেউ চায়ের দোকান চালাচ্ছে, কেউ অফিসে চাকরী করছে, আবার কেউ ব্যাগ কাঁধে করে ফেরী করছে। পৃথিবীতে কত রকমেরই না পেশা! সবই কিন্তু পেটের দায়। বেশীরভাগ লোকেই পেটের চিন্তাই করে, ভরে গেলেই সন্তুষ্ট, বড় জোর একটা ছাদ ব্যাস…যেমন দেবুর বাবা। আবার অভয় সামন্তের মতো লোকও রয়েছে, কি নেই! চালকল, দুটো ট্রাকটর , একটা হার্ভেস্টর , অন্তত ৪০ বিঘে ধানিজমি নিজস্ব, পাকা তিনতলা বাড়ি… তবুও তার আশ মেটে না, সারাদিন ছুটছে পয়সার পিছনে। দেবু জানে, পয়সা শুধু প্রয়োজনের নয় নেশারও…তবে সবার সে নেশা ধরে না। এই যে খোকন নামের লোকটা এখন ট্রাকটর চালাচ্ছে এরও কি নেশা আছে? আছে হয়তো…
“এবার উঠি হে মাস্টার, কিছু কেনা কাটা করতে হবে বি সি রোড থেকে তারপর বাড়ি যাব ভাবছি…”
“আরে এখুনি! কবে আসছো আবার?”
“আরে আসব আসব…গুছিয়ে একদিন প্রোগ্রাম বানাও দেখি , তুমি রেঁধেটেধে রাখবে, জলের দায়িত্ব আমার…”
“করে ফেল একদিন, আমার আবার পাঁজি দেখার সময় নেই…হা হা হা হা…শুধু আগে জানিও তাহলে এবেলায় দোকান বন্ধ রাখব।”
খোকন হাত নেড়ে এগিয়ে গেল কলেজ মোড়ের দিকে। দেবু এবার উসখুস করতে লাগলো, ওকেও উঠতে হবে এবার। শুধু শুধুই অনেকটা বেলা হল।
“মাস্টারদা আমিও কাটি…”
“আরে ধূর…বোসো বোসো…আর এক রাউন্ড চা বলি। তোমার কে আছে হে! বউ নাই ছেলে নাই….তাড়া কিসের? ”
“আরে না সে সব না…আসলে একটু বেশী দেরী হয়ে গেলে বাবা আবার ইন্টারভিউ নিয়ে নেবে…”
“হা হা হা হা হা ….তা বটে, গাঁ গেরামের মানুষ এখনও কিছু শেকল-বাকল মানে , তাছাড়া তুমি এতটা যাও , চিন্তাও রয়েছে …”
এক রাউন্ড চা হল, চায়ের পর মাস্টার বিড়ি বের করতেই দেবু ইসারায় রাখতে বলে সিগারেট নিয়ে এলো দুটো। ‘স্টাইল’ টেলরের মাস্টারের স্যাঙাৎটা সেই যে বেরিয়েছে এখনও ফেরেনি। মাস্টার তার নাম করে বিড়বিড়ি করে বেশ কিছু কাঁচা গালাগাল দিল, শুনে দেবু একচোট হেসে ফেলল।
“আর বোলো না!…এ হারামি গুলো এরকমই… আরে শালা মন দিয়ে কাজ শিখলে তোরই লাভ! তাই কিনা বলো? তা নয় …তা তোমার চলে টলে একটু আধটু?
বুঝতে কয়েক মুহুর্ত সময় লাগে দেবুর মাস্টার কি বলতে চাইছে…নাঃ মদ তেমন খায় টায় না দেবু, সত্যি বলতে কি তেমন সুযোগ হয় না। তাছাড়া বাড়ির ভয়, বিশেষ করে বোনটা ডেঞ্জারাস! এই তো ফাল্গুনেই মাঠ রান্নার দিন লুকিয়ে দেবুতে আর রজতে মিলে একটা বিয়ার খেয়েছিল মনসাতলার পিছনের ঝোপটায় বসে। মণি ঠিক গন্ধ পেয়ে গেছিল ! খুব জোর সামলেছিল সে বার। মাস্টারের কথায় হ্যাঁ না কোনো উত্তর দেয় না দেবু, মুচকি হাসে শুধু।
“একদিন জমিয়ে প্রোগ্রাম করি চলো…একা একা হেজে গেছি বুঝলে কিনা!…এই তোমরা আসো, একটু সময় কাটে…বেশী নয় এই তুমি আমি খোকন…রজতভাইকে ডাকবে নাকি?”
“দেখি , রজতকে না হয় বলব…আমার আবার…বুঝতেই পারছো”
“আরে রাতে এখানে থেকে যাবে না হয়! বাড়িতে কিছু একটা বলে…”
“দেখি…” বলে উঠে দাঁড়ায় দেবু। হাত পা টান টান করে ছাড়িয়ে নেয়। নেমে আসে ‘স্টাইল’ এর দাওয়া থেকে। মাস্টার কে নিঃশব্দে ঘাড় কাত করে বিদায় জানিয়ে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেয়। অন্যদিনের মতো আজ সাইকেল ছোটাতে ইচ্ছে করছে না, ধীর গতিতেই ফ্লাই ওভারের নিচের গহ্বরটায় প্রবেশ করে দেবু। চারিদিক হলুদ আলোয় আলোকিত। শুধু ফ্লাইওভারের নিচেটুকু একটু যা অন্ধকার, ওপর দিয়ে বাইপাশ গেছে, হুস হুস করে দ্রুত গতির গাড়িগুলো পেরিয়ে যাওয়ার শব্দ কানে যায় দেবুর। কত গতি হবে এই গাড়ি গুলোর! ১২০ কিমি! ১৫০ কিমি! … উল্টোদিকে বেড়িয়ে আসতেই আবার হলুদ আলো এসে ছড়িয়ে পরে দেবুর উপর। বাঁদিকে কিছু দূরে অতিকায় পূর্তভবনের আটতলা বাড়িটা অন্ধকার দাঁড়িয়ে, ডান দিকে কিছু দূরে একটা পেট্রলপাম্প ও ধাবা। এই এলাকায় বাইপাশের ধারে বেশ কয়েকটা হোটেল হয়েছে। মুলতঃ মদ খাওয়ার জন্যেই। কোনোটা আগে ধাবা ছিলো, এখন ‘এফ এল অন সপ’ ছাড়পত্রে রমরমিয়ে চলছে। বেশ সাজনো গোছানো, কাঁচের ঘেরাটোপ। বাইরে ঝলমল করছে আলোর বোর্ড নানা ইংলিশ মদের ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন। বেশ ভিড় হয় সন্ধ্যার দিকে, লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নানান মডেলের বাইক। ১৮ থেকে ৪৮ নানা বয়সের লোকে গমগম করে চত্বর, ভেসে আসে নানান উপদেয় রান্নার গন্ধ। কাচের ভিতর দিয়ে দেখা যায় কারিগর রুমালি করছে নিঁখুত দক্ষতায়, শিকে ঝুলে রয়েছে কাবাব…
এই তো জীবন! একদম মস্ত লাইফ! যারা যায় তারা কি অন্যের পয়সায় খায়! কামায় তাই খায়, সারাদিন খাটে-কাঁচা পয়সা কামায়, সন্ধ্যায় একটু মস্তি করে… ব্যাস! দেবু কোনদিন চৌকাঠ পেরোয়নি, সাহস হয়নি। রজত প্রায়ই যায়, ওকেও জোর করেছে ,বলেছে “আবে চ…কেউ দেখবে না, আর দেখলেই বা কি! আজকাল ৯৯% লোক মাল খায় বুঝলি!… ওটা কোনও ব্যাপার না , লাইফটা এনজয় করতে শেখ…” দেবু পারেনি, মাস্টার বাবার ছোট থেকে ওর মস্তিষ্কে কেটে দেওয়া গন্ডিটা পেরিয়ে যেতে।
ব্রীজের উপর এসে দেবু প্যাডেলে এবার জোর দেয়, ছুটতে থাকে সাইকেল। অল্প ঠান্ডা বাতাসে বেশ আরাম লাগছে দেবুর। আজকের সারাদিনের ঘটনা মনে মনে সাজাতে থাকে দেবু, সেই সকাল থেকে, নন্দিতাদের বাড়ির বেল বাজান, ঠাকুমার মুখ বাড়ান, নন্দিতার সঙ্গে কথাবার্তা…নন্দিতা ফস করে ওরকম কেন ইয়ার্কি মারল! ইয়ার্কিই মারল…তবু এরকম করে এর আগে তো কোনোদিন বলেনি! মাস্টারের দোকানের আড্ডা, মদের আসরের নেমন্তন্ন…সব একসাথে ভিড় করতে লাগল দেবুর চিন্তায়। দূর থেকে নিউ ব্যানার্জি ফার্মেসীর আলো দেখতে পাচ্ছে এবার, বাড়ি আর বেশী দূরে নয়। আজ না জানি বাবা আবার কি মুডে থাকে, মণি নিশ্চয়ই মায়ের সঙ্গে বসে সিরিয়াল দেখছে। বেশ গতিতেই বাঁক পেরিয়ে যায় দেবু, আজ আর দাঁড়াবে না। এমনিতেই দেরী হয়ে গেছে।
আগের পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকটিতে