মনোতোষ আচার্য-এর কবিতাগুচ্ছ

 
  মনোতোষ আচার্যএর কবিতাগুচ্ছ

                                                   

                         গোপন মুদ্রার ঢঙে

     

                     

এক.

নিভৃত চাঁদের দেশে তুমি যেন থিয়েটারি ভাষা
 গোপন মুদ্রার ঢঙে অক্ষরের মায়াবী বাঁধন
ধানের হলুদ বিভা মাঠ জুড়ে শস্যচর্যাগীতি   
এসেছো জীবন জুড়ে রাখালিয়া নাট্য-সংস্কৃতি 

মুখোশের দিন রাত্রি… দুচোখের কিশোরী আকাশ
গোপন জলের কাছে  রেখে গেছে আপদ উদ্ধার 
ফেলেছে অনার্য ঋণ  উদবাস্তু হরিতকী বনে 
সতেজ দুর্বায় ছোঁয়া দুঃখগাথা সহজিয়া ধ্যানে 

গন্তব্যপ্রাচীন মেঘে ভেসে আসা বর্ষার ছুটি
মুছে নেয় রোদ্দুরের ধুলোট সংসার রাজপাট
পুষ্পশালিনী লতা আশ্রয়ের বিচিত্র বয়ন
এসো আজ হাতে হাত রেখে খুঁজি নয়ন লোভন 

শালের মঞ্জরী দিয়ে সনাতন আপ্যায়ন রীতি
ভূর্জপাতায় মোড়া স্বল্পতম আমান্ন প্রস্তুতি… 
            

 দুই.

লিখেছি গোপন চিঠি শুদ্ধস্বরের মাত্রা লয়ে
খুঁজেছি ভাস্কর্য ভাষা তোমার শরীরী প্রতিমায়
ক্রমশ সংকীর্ণ পথ আমাদের বেগবতী রথ
যাকে বলো সভ্যতা আমি দেখি আদিভূতা থান

শীতের রাস্তার মতো কুয়াশায় অস্পষ্ট প্রাচীন
মাগধী অপভ্রংশে কীর্তিগাথা দলিত লিখন
এ-ই সেই জনপদ প্রতিদিন খরচ খাতায়
দুর্মর আশায় বেঁচে আজ যেন প্রজ্ঞাপারমিতা…

শিল্পের স্বপ্ন দেখে আমাদের একঘুমে ভোর
পথময় বারোয়ারি এঁকে দিল সোনালি হৃদয়
 কবিতার অলিগলি দর্শনীয় অরন্য মুগ্ধতা
অশনির ইশারায় জ্বলে ওঠে ক্লান্ত নীরবতা

তবু্ও বেসেছি ভালো তবু্ও করেছি শত ভুল
পলাশের শীর্ষচূড়ে শ্বাস ফেলে গান্ধর্ব বকুল


তিন.

আমাকে পড়োনি শুধু করে গেছো পড়ার ছলনা
মায়াবী লণ্ঠন আলো প্রথাসিদ্ধ তার দীর্ঘোপমা
স্মরণীয় অন্ধকারে উন্মুক্ত কবরী বন্ধন
নিপুণ স্বরলিপি আর শরীরিণী চৈতি পবন

সহসা গোধূলি রঙ অনার্য কুটোয় বাঁধা দিন
ভূমিজ আলোয় আঁকা প্রতিজ্ঞার পরম্পরা ঋণ
ভিতরে হিংসার দেবী  বাহিরে প্রবুদ্ধ উচ্চারণ
নিষিদ্ধ ইঙ্গিতে জাগে ক্ষমতার রজঃ শিহরণ…      

বাতাসের কানে কানে রেখে যাই প্রমিত অক্ষর
কপালে এঁকেছি দুঃখ সারা  গায়ে কবিতার জ্বর 
নীরব কান্নার ধ্বনি উবে গেছে হৃদয়ের ঝড়ে
নেপথ্যে বিপ্লব ছিল উল্লোকিত দৃষ্টির ভিতরে

পথবাতি জ্বালো তুমি হে আমার রঙ্গাবতার 
শেখাও সংগীতকলা খুলে দাও শোকে ভাঙা দ্বার…

চার.

নিকুঞ্জ নিবাসী ছায়া আলো আর দয়িত পুরুষ
কথা শোনে চারিদিকে অনঙ্গের অতিচারী দূতী
মাটির পাঁচালি ঘিরে পাতা ছিল আদিম সংসার
জীবনে জীবন মেশে উর্ধমুখী কমনীয় জ্যোতি

পাতালছায়ায় বাঁধি খড়কুটো উপচার ভ্রম
গর্ভাঙ্কে আবহ বাজে পেশাদারি নম্র বিনোদন
দেহলি আবেশ জাগ শ্রুতিসুখ  ধানকাটা গান
অচলস্বরের ধুন মেঘবতী মল্লার বাদন… 

গরজি গরজি উঠে দেশময় কুহকিনী ঘোর
তোমার আঁচলে পাই মোহমুক্ত অঘ্রাণের ঘ্রাণ
জলদগম্ভীর রেখা ভেসে যায় জগৎ সংসার
অনাবৃত সুদৃশ্য গোলক আর রম্য জলযান 

তেপান্তরের নদী  দৃশ্যপটে আমলকি বন
সবুজ শ্লোগান চোখে ভুলে যায় দুঃখ দহন।           
        
  পাঁচ.

বিকেল রোদ্দুরে আঁকা অভিমানী অপাঙ্গ শাসন
আমি তার বোধগম্য করতে পারিনি এলোকেশী
ক্ষুধার সমুদ্রে ঢেউ স্বাবলম্বনের বালুচরি সুখ
আঁচলের ছলাকলা এ হৃদয় নিষ্ফল আলেয়া  

তুমি কি বেসেছো ভালো নিভৃত গোপন বল্কল
আহ্বানের ডালপালা নির্ভার জলের অক্ষরে
ভিজিয়ে দিয়েছে কতবার নির্মাণের শতধারা  
সারল্যের বনভূমি দু’চোখেই পবিত্র আঁধার…   

বিরুদ্ধ মতের দেবী সব আলো নিভিয়ে এবেলা
হ্রীং মন্ত্রে জেগে উঠে আবার ঝিমিয়ে জাগতিক 
তন্দ্রাঘোরে একাকিনী স্বাদব্রহ্ম অখিল বিস্তার   
আপদ উদ্ধার গর্ভগৃহে রাতময় সাঁঝবাতি কথা

তুলোট পুথির লিপি পড়ে পাওয়া মন্দ্রসপ্তক
চেতনার কাছাকাছি মাটি আর জলের যোটক…
     

 ছয়.

আদিগন্ত আলোবুক নরম জ্যোৎস্নায় আঁকা রাত
চিরস্থায়ী শূন্যতায় আমি যেন আগ্রাসী নিবিড়
মায়াবিনী করতালি বেজে ওঠে চাঁদের প্রহরে
মালিকের গালাগাল খুঁটে নিই শখের থেটারে

লঘু লৌকিকতাগুলি প্রতিদিন জন্মদোষে গাঁথা
সেই সন্ধে আলোছায়া কলহমুখর সন্তরণ
উঠোনে আশ্চর্য মায়া আঁকাবাঁকা মৃতসঞ্জীবনী
ভোগের ওপিঠে ভোগ জোনাকিস্পন্দিত মেহগনি

তুমি সেই নাথবতী যৌবনপ্রখরা লাস্যময়ী  
মন্দিরা ঝংকৃত মুদ্রা দেবদাসী অনার্য মেহন  
কপোলে ঠুমকি ভঙ্গি কটিতটে কুহকের দ্যুতি 
নিবেদিত বালুচর কাঙ্ক্ষিত প্রণয়ে ভানুমতী

জিজ্ঞাসার সদুত্তর জীবনের কাছে খুঁজে জ্যোতি 
আপন সত্তার কাছে সিদ্ধি পেয়ে তুমি সত্যবতী। 

সাত.

কুশলী যাপন শেষে নেমে আসা অক্ষরপ্রসূতি
নীরব ধ্বনির কাছে স্বচ্ছতোয়া তূর্ণি স্রোতস্বিনী   
নিহত সংলাপে কাঁপা শ্রাবণরাতের উপবনে
এসেছো নতুন পথে পায়ে পায়ে নশ্বরের দাগ


ঈশ্বরের ঋণ আজ প্রিয়তম মাটির শরীরে    
ঝড়ের রাতের ভয় এলোমেলো সংসার সাগর
উচ্ছ্বাসের ঢেউগুলি উদ্ধত ফেনার মতো তেজি
তোমার নূপুরে বাজে মায়াময় কীর্তনের সুর

প্রমত্ত শিকারি আজ খণ্ডমেঘে ভাসায় সায়ক
লোহিত কণিকা নাকি শ্বেতপ্রবালের দ্বীপভূমি
কেঁপে উঠেছিল জানি শোষকের তরবারি কোপে 
আভূমি প্রণাম করি ঈশ্বর এসেছে পায়ে পায়ে

ক্ষয়ে যাওয়া দিবাস্বপ্ন মৃত্যুহীন প্রাগার্য মাহুত
নির্জন গোড়ালি চিহ্ন রেখে গেছে কালের ভাঁড়ারে।                             

আট.

সন্ধ্যার প্রদীপ হাতে হৃত-রাজ্য অন্বেষণ চোখে
দূরে দূরে জ্বলে ওঠা প্রাগৈতিহাসিক গ্রামগুলি
এসো তবে ছড়া বাঁধি মগ্ন নির্জন আখড়াবাড়ি        
সলজ্জ ইশারা ঘিরে মেতে ওঠে আরাধ্য পাঁচালি

শীতলপাটির দেশে শূন্যতম বোধের খিলান
কৃষ্ণমেঘের ঠোঁটে মায়ামুগ্ধ ভ্রুকুটির খেলা
দক্ষিণের জানালায় বেজে ওঠা পাতালকাতর
গান নয়—স্নানযাত্রা  অতীতবিলাসী শঙ্খবেলা


ব্রজবুলি পুথিপাঠে উঁকি দেয় চারণের চাঁদ  
তোমার হাতের আঁকা সেঁজুতি ব্রতের আলপনা
সিঁদুরে গুঞ্জন নাকি পদ্যগন্ধী গ্লোবাল ভিলেজ
 বৃষ্টিসংগ্রহ মুদ্রায় সারারাত নম্র আলোচনা

নক্ষত্রলিপির স্বপ্ন বনদেবী রজঃস্বলা নদী
নিঃশব্দে কুটোটি নেড়ে  নিসর্গে একাকী পাই যদি। 

                                  ★★★

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *