একুশের গদ্যঃ অঞ্চলের ভাষা আঁচলের ভাষা

       অঞ্চলের ভাষা আঁচলের ভাষা

                                       

অমিত মাহাত

কবি ভবতোষ শতপথী সেই কোন কালে লিখে গেছিলেন ঝুমুরের ভাষায়
                        ” মাগা দুধে ছাইল্যা কদিন বাঁচে হে
                      মুরুব্বিরা ঠিকেই বল্যে গেছে। “

মায়ের কাছে আব্দার করে হোমটাস্ক করে দেওয়ার। আমাদের ছেলেবেলার বাড়ির কাজ আজকের বাচ্চাটির কাছে কালের নিয়মে হয়ে যায় হোমটাস্ক। ভাষার মৃত্যু ঘটে এভাবেই।

বাচ্চাটি এবার বিকেলে খেলতে গিয়ে শিখে ফেলে  “বুচা, লুড়কি বাইগন, সিঘননাইক্যা ফ্যাতফ্যাতনি ” এইসব শব্দ। বাচ্চার পিঠে লেখা হল উত্তমমধ্যম। বাচ্চার মাথায় ঢোকানো হল। উসব খারাপ ভাষা। পাড়ার ছানার কাছে এই শিখেছিস। অই শিখেছিস। 

ভাষা তার আঞ্চলিকাও হারাতে বসেছে। আগামীদিনের কাছে বড় বিপদ এটি।  বিশ্বায়নবাদ এগুলোই মারবে প্রথমে।

ভাষার বিপদের কথা বরং তোলা থাক আজ। সাহিত্যে সম্ভাবনার কথা হোক এবার। বাংলা অভিধান ঘাটলে দেখা যাবে বাংলা অভিধানের নব্বই শতাংশ শব্দের উৎপত্তি দেখুন। সংস্কৃত থেকে। আরবি থেকে পারসি থেকে শব্দ সব বাংলা হয়েছে। বাংলা এসেছে উর্দু থেকে। হিন্দি থেকে। অসমিয়া থেকে। উড়িয়া থেকে।

এবার  যদি প্রশ্ন করা হয়,  বাংলার নিজস্ব শব্দ কোনগুলো?   উত্তরে কপাল চাপড়াতে হবে মশাই।  বাংলা অভিধানে দেখবেন কিছু শব্দ পাবেন। শব্দের পাশে লেখা রয়েছে দেশি শব্দ। এই দেশি শব্দগুলোই বাংলার নিজস্ব শব্দ।

দেশি শব্দগুলো এসেছে আঞ্চলিকতা থেকে। বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের বিশেষ শব্দ ভাষা ঢুকে পড়েছে বাংলার ভান্ডারে। এখন যদি বিশেষ অঞ্চলের সব আঞ্চলিক ভাষাগুলো দাবি করে বসে এই সব শব্দ আমাদের আঞ্চলিকতার সম্পদ। ভাষা তার আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য আর সম্মান দুটোই ফেরত চাই।

বাংলা ভাষা আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। বর্তমান সময়ের সাহিত্যে এই ভাষা কলোনিয়াল পিছড়েবর্গ এইসব নিয়ে চর্চা যত বাড়বে ততই আঞ্চলিকার প্রসার ঘটবে।

ঢেঁকি একটি দেশি শব্দ। আপামর বাঙালি জানেন। কিন্তু বলুন তো মশাই ঢেঁকির শরীরের বিভিন্ন অংশগুলোর নাম? পারবেন না। আচ্ছা আপনি জানেন ঢেঁকির কোন অংশটিকে স্বামী বলা হয়? গর্ভ কোন অংশের নাম?

আর একটি শব্দ হল লাঙল। আপনি জানেন জৎ কোনটি?ঈশ, বঁটা ,চাইমঠা জানেন? গোরুর গাড়ি দেশি শব্দ। আরা, কানিখিলা, বেড়াখুটা, আড়াস, উলার, দাবু, ধুরি, জুয়াখাড়ি, তেতলা, এইগুলোর সাথে পরিচয় আছে ? মাটির বাড়ি নিশ্চয় দেখেছেন? দেওয়াল  শব্দটি বাড়িরই অংশ। আর যেসব শব্দের সাথে চেনাজানা হয়ে ওঠে নি। এ মাটির কতটুকু চেনা যায়? মাটির ভাষা?  ধন্না, হুড়কা, ঠেসাডাঙ, দিরখা, ভঁথা, পিঁঢ়া, ডেহইর, খলা, খাপতি, দাঁতিয়া, মধইন, ভাগ, বাটাম, ধারি, খুঁধি, কাদাপাটা, বাইট্যা, ঘরের ভেতরের এত এত শব্দ ছড়িয়ে রয়েছে। তালিকা দীর্ঘ হবে।

মাটির হাঁড়িতে আসি এবার। হাঁড়ি কলসি চেনা শব্দ। হাঁড়ির উপরের যে মাটির ঢাকনাটি থাকে। তারও একটি নাম আছে। সরা। হাঁড়িটিকে বসানোর একটি খড়ের বেড়ি আসন দেওয়া হয়।  এরও একটি সুন্দর নাম। বেটনি।  সানকি চেনেন? কারাহি? বাহানি দেখেছেন?  হাঁড়িটিকে অর্ধেক ভেঙে ঘরের দাঁতিয়ায় ঝুলিয়ে দেওয়া হল। হাঁড়ি হয়ে গেল পায়রা টং। ব্যবহারের ফলে হাঁড়ি দু ফালি হয়ে গেল ভেঙে। এক অংশ হল খাপরা। অন্য অংশ স্ত্রীবাচক শব্দ। খাপরি। খাপরি অংশটি আবার ভাঙল। এবার তার নাম হল খলা। খলা অংশটি ফের ভেঙে টুকরো টুকরো হল। তারও একটি নাম। খাপতি।

আমাদের ছোটবেলায় যে সব শব্দের সাথে খেলা করেছি। তার কতক কতক তুলে ধরা যাক। শিশু যখন খুবছোটো। সদ্যজাত। আমরা শিখেছি। আলছানা।  তারপর যখন ঘাড় ডাঁসাল হল। মা ঠাকুমা’রা শিশুটিকে নিজের প্রসারিত দু পায়ের বিছানায় শুয়ে একটি ছড়া কাটেন।
“আট বাঁধঅ কাট বাঁধঅ হামদের বাবুকে (মুনু) বাঁধঅ
বাবু বাঢ়ে করৈল পং
ষষ্ঠী মায়ের কাঠের বঝা ” লে লে ষষ্ঠিমাইকে গড় লাগা।

তারপর যখন হামাগুড়ি দিতে শিখল। কাড়া হতে শিখল। এবার বাচ্চার নতুন জামা দরকার। গাঁ থেকে শহর বাজারে যেতে হল পোশাকের জন্য। দোকান যখন জিজ্ঞেস করেন -বাচ্চার কত বড়? উত্তরে  বেশির ভাগ মায়েরাই বলে ফেলে -কত আর? কাড়া মতন টা।

কাড়া শব্দটিকে অনেক বাঙালি লেখক চন্দ্রবিন্দু যোগে লেখেন। এটি ঠিক নয়। কাড়া লিখুন  নয় তো মহিষ লিখুন। কাঁড়া শব্দটি পশু অর্থে ব্যবহৃত হয় না। কাঁড়া অর্থের মানে হল যিনি চোখে দেখতে পান না। কাঁড়া নকি হে? আবার সাঁওতালি তে মহিলারা বলেন – এ না! নুই দঃ কাঁড়া গিয়া!

বেলপাহাড়ি অঞ্চলে ঘোরাফেরার সৌজন্যে বেশ কিছু সেখানকার শব্দ সংগ্রহ করেছি। গাঁড় বা গাঁইড় অর্থে আপনি বুঝবেন অশ্লীল একটি শব্দ। গাঁইড় বললে বেলপাহাড়ি  বুঝবে শরীর। গা। কেউ যদি সাইকেল চালাতে চালাতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে। একটিই বাক্য শোনা যাবে। -দেইখ্যে চলবিস ত। গাঁইড়ে উঠাতে কে বলিছে হেঁ! 

পরিশেষে একটি কথা। ভাষা বাঁচুক। বাঁচুক আঞ্চলিকতাও। ভাষা মনের ভাব প্রকাশের উচ্চারিত মাধ্যম একটি। নিজের ভাষাটির প্রতি মনোযোগী হন। চর্চা বাড়ুক। পাশের মানুষটির আঞ্চলিকতাকে ঘেরাটোপে গন্ডিতে না ফেলে বরং  খোলা আকাশের নীচে  ভাষার আদান-প্রদান হোক। ভাবের বিনিময়।হোক।

                                  ★★★

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *