অ ল ক জা না– র কবিতাগুচ্ছ
পতিত চল্লিশ তারার লেখচিত্র
এক
পা থেকেই শুরু করা যাক, এমন খণ্ডতপানা পা এর আগে দেখেনি চোখ, অনুভব দৌলতে কতকিছু নাগালশাসিত, তেমন স্নায়ুহীন একটি ছায়ার অভিজ্ঞতা পুঁজি করে কবি বরাবরের জন্য তীর্থের কাক—জড়ানো আকরিক, জড়িয়ে থাকা ফুল, এমন নির্ভরতার পা মাথায় তোলা থাক, ঠোঁটের বিপন্নতা পায়ে ভাসান হলে শরীরের পঞ্চপীঠে বেজে ওঠে আরোগ্যের কাঁসর ঘন্টার স্তব,
দুই
দু’পায়ের ফাঁকে সমাধান নিয়ে
দাঁড়িয়ে থাকে মানবেন্দ্র,
যার সাক্ষাৎ পেতে কেটে যায়
একটি অখণ্ড জীবন,
সমাধান নিয়ে আসে নতুন উপসর্গের অঙ্কুরোদ্গম, এভাবেই কবি চিরদিন
দুঃখের জন্য বিরহী চাতক।
দশ নয়, কেবল দু-জনের প্রশ্রয়ে কবিতার অলিন্দে নিরন্তর অক্ষর সেলাই,
প্রত্যেক পুরুষ শরীরের জলবিভাজিকায়
ভাসতে থাকে একক নারীসুলভতা
যাকে পাহারা দেয় মন,
এভাবেই জমা করি, বয়ে বেড়াই
অপেক্ষাবুনন পতিত চল্লিশ তারার লেখচিত্র।
তিন
দীর্ঘ যাত্রার পর খানিক বিরতি চেয়ে
প্রতিটি পথ এঁকেবেঁকে যায়–
ঝোপঝাড় আর ছায়ার সপাঠ স্তোত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে একটি দুটি গাছ, হঠাৎ মোড়ের মাথায় এক পসলা বৃষ্টির আলিঙ্গন, করুণার জলপটি কি এমন আশ্চর্যের?
পথ অনন্ত, নিরন্তর চলা– এভাবেই
একটি মানুষ রাস্তা হয়, অথবা পতিত চল্লিশ তারার বিসর্জন শেষে একটি গাছ, যে নিজেই সংগ্রহ করে দানা, পৃথিবীর সেরা শ্রষ্টার মালিকানা পেতে শাখা-পালায় সরবরাহ,
আর বিলিয়ে দেয় সশ্রম হৃৎপিণ্ডের রস।
চার
ভালোবাসতে শিখে গেলে একদিন,
কম্পাস ছাড়াই তাগেবাগে
নখদর্পণে এসে যায়, পূর্ব-পশ্চিমের তফাত, মানুষের মতো আচরণ করে মোবাইল
হাসপাতালের বেডে বিশল্যকরণী
পাতাবাহার। আরো কতকিছু
নাগালে ও নাগাল ছাড়িয়ে পৃথিবীর
সরলতম জলরেখা। ভালোবাসতে
শিখে গেলে নির্ভার একদিন তুমি ও আমি পাখিজীবন, অথবা বিচ্ছেদের
সমস্ত উপহারে মিশিয়ে দেব আকাশ।
পাঁচ
কেউ জোর করলেও আগের মতো খাবারে আগ্রহ নেই, দুপুরে চামচ মেপে ভাত, রাতে কৃপণতার রাতগন্ধী দুটো রুটি, চল্লিশ বেরিয়ে আসা মন-শরীরের দূরত্ব ও ভারসাম্য,
সতর্ক সচেতনতায় সামলে এখন বাকি বরাদ্দ পরমায়ু যাপনের পালা,গাছে গাছে হলুদ পাতার বিষণ্ণতা। পত্রবৃন্তে বাড়তে থাকে মায়া, আগের মতো সারা দিনরাত নয়, পরিবারের একটা মুহূর্তের দরকরি টুথব্রাশের মতো অপেক্ষার চাষাবাদ। তবু ঘর-উঠোন তিন চারটে চেনা স্বর, এ বাগানের আমিই মালি–
ছয়
নিজের সঙ্গেই যত বিরোধ, পৃথিবীর যত
ভূ-কম্প মনের ভেতর দিনভর চলছে তো চলছেই। হাসি, মুগ্ধ-প্রসন্নতা লুকোচুরি, পারফিউমের সমার্থক মুখে মানায়ও বেশ, এভাবেই ঘর থেকে উঠোন, খিড়কি থেকে সদোর সামলে নিচ্ছে আমাদের অদৃশ্যবাদ। আমার নামে খাওয়া জল কিংবা শ্রাদ্ধের নোটিফিকেশন জানিয়ে যায় তুমি এখন বাতাসের মতো পালটে নিচ্ছো অভিমুখ,
ব্যর্থ অক্ষমতার মতো কিছু আত্মহত্যা, নামের ওপর জাঁকিয়ে বসে ঘুঁটে মারা দেয়াল, কপালে কপাল ঠুকে সবাই কেমন ঈশ্বর হতে চায়!
সাত
ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের মতো শিরাধমনীর বোলমুখে এখনো বেজে ওঠে আঠারোর তরঙ্গ গান—
বশীকরণের মন্ত্রোচ্চারণ তো আছেই, কতকিছু এসময় আর মানায় না, তবু বসন্ত বৃষ্টির সংগোপন স্নিগ্ধতা জামার সুতোর নিষেধ পেরিয়ে ছুঁয়ে যায় হৃৎপিণ্ডের আসপাশ—-
নির্ধারিত এই দিগন্ত রেখায় ফেলে আসি আমার
অনুচিত রিপুর গুচ্ছ গুচ্ছ শবদেহ, এখন নিঃস্বার্থ ভালোবাসার দিন, একে অন্যকে ছাড়াই মেঘ চুইয়ে জোছনা নামার মতো আমাদের চোখে ঘুম এসে যায়, চোর সাধু পাশাপাশি হাঁটলেও পারস্পরিক নীরব অক্ষাংশের তফাত বুঝিয়ে দেয় পতিত চল্লিশ তারার লেখচিত্র।
আট
একটি দরজা ঠিক একটি নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি
দুটো পাল্লা নারী-পুরুষের মতো কানায় কানায় একাকার, সারারাত তোমাকে পাহারা দেয় আর ভাগাভাগির গল্পে একাকিত্বের প্রহর পোড়ার শেষে দরজায় কড়া নাড়ে ভোরফুল, আকাশে এখন লাল-সবুজ-গেরুয়া আবির খেলা এমন রঙ সার্কাস দেখতে দেখতে ভুল হয়ে যায় বাড়ি ফেরার রাস্তা। আমার বাড়ি আমি ঠিকই চিনি
তবে কে কখন এসে আমার অভিসন্ধি না বুঝে রঙ চড়িয়ে যায়, তখন বুঝতে পারি রাষ্ট্র এখন বলপ্রয়োগ পন্থী, কবিতা এখন সবাই পড়ে,
বাহবা দেয়, যুগটা এখন স্তাবকদের জিম্বায়!
নয়
বরাদ্দের এতগুলো দিন এতগুলো রাত্রি
কেটে গেছে অবিকল, অন্তঃসার শূন্য অসুখ,
ছায়া-রৌদ্রের সমস্ত চেতনা আমার অক্ষমতার সঙ্গে শরীরে ঘাম চষিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে কখন–
দুবেলা ভাত ডাল রুটির লোভে অনর্থক এই পতিত আমিত্ব জানিনা কার ভালোলাগে ? ভিড়ের চৌরাস্তায় ভ্রাম্যমাণ নীরব একাকিত্বের কংকাল, জীবন্ত সিগারেটে তাকে আপ্রাণ অনুসরণ, কোলাহল থেকে সরিয়ে দীর্ঘ কোন নীরবতায় চোবাতে অশেষ আগ্রহী দেহ ও মন।
পরাজয় ছিল দু’হাতের, পায়েরও একে একে প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঙ্গে মাথাটিও বিকৃত
আশ্চর্য এই, কেবল অলক নামধারী শরীর- মোহনায় জমা হয় সমস্ত কলংক!
দশ
এ মুহূর্তে আমি শরীরের ঠিক কোথায় বেঁচে আছি ঠোঁটের জীবন্ত সিগারেটটাই কেবল জানে
চোখ নির্নিমেষ তাকিয়েই আছে, চা দোকানের উপচানো কোলাহল কানের উপর ভিড় করে, কি আশ্চর্য ! বিশেষ কিছু শোনার অপেক্ষায় আমার কর্ণকুহর সজাগ খরগোশ। বৃষ্টি মানেই হাঁটুর নিচে বয়স নেমে যায়, চোখে পড়ে এক ছাতার তলায় জোড় সংখ্যার ঘনিষ্ট রসায়ন,
ভালোবাসতে খুব খুব ইচ্ছে হয়, আগের মতো শুরুর দিকে যেমন যেভাবে—-সুখের স্নায়ুযুদ্ধ।
এগারো
চোখ ও মনের যুগল দৌড় যতটা কুলোয় ততটাই পুঁজি—গাছ, গাছের মতোই সহিষ্ণু, মানুষের সঙ্গে মিলে এমন কোন সাম্য আকৃতির প্রাণী পৃথিবীতে নেই। নিজেকে অনেকবার সজ্ঞান ঠকিয়েছি—এটাও রীতি—কবি ইচ্ছে করেই দুঃখের জন্য বিরহী চাতক ! মধ্যরাতে তারাদের কলহে উল্কাপাত, কার ঝরে পড়ার কথা, ঝরে যায় কে? মোহাড় চৌরাস্তা থেকে বাঁশপাতা গ্রামের দূরত্ব-৬ কিমি, একবার ঘুরে এলে জীবনের অর্ধেক ক্লান্তি কেটে যায়, কিছু মুখের সঙ্গে দেখা হওয়া জরুরি, কিছু মুখ প্রত্যাশা রেখে সরে যায় বহুদূর, যেভাবে থাকার কথা কাদা জল ছায়া রোদ নির্যাতনের সংসার নিয়ে সেভাবেই দিনপাত, কতকিছু হারিয়ে এখন বেবাগ হালকা আমি বাকি পরমায়ুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করি নির্ভার মেঘ।
বারো
মুখের মধ্যে একটি বিষ বোঝাই দাঁত গচ্ছিত রেখে কেমন পরমায়ু খরচ, মানুষ কামড়ের প্রদাহে হার মেনে যায় সাপের বিষ ও ধন্বন্তরির অব্যর্থ দাওয়াই। প্রচণ্ড ধ্বংসের চেয়ে আমি নিজেকে বেশি ভয় পাই, মাঝেসাঝে নিজেকে তাই ক্লীব মনে করা অসংগত নয় ? রাস্তায় বাঁক মানে চোখ থেকে সরে যায় দৃশ্যপট, সচেষ্ট তুমি নিক্তিতে মেপে নাও ভালোবাসা, তবু আমার নীরবতায় ঢিল পড়লে একটা নির্ভরযোগ্য
হাত খুঁজি, অপেক্ষা সাজাই—-সন্দেহ একটি সযত্নে পালিত আদিভৌতিক বিষের নাম, মুখ থেকে যা একবার গড়িয়ে পড়লে আমরা পরস্পর নীল হয়ে যাই।
তেরো
আরশোলা কবে যেন পাখি হ’তে চেয়েছিল ?
ডানা ও সন্ধিপদে লেগে থাকবে ভেজা মেঘের ঋতু অথবা আকাশের অগভীর নীল ঘাম, দূরাশার জন্য ঝুঁকির জীবন বিফল হলে– একদিন নিজস্ব জাত খুইয়ে বসে প্রতিটি জন্ম।
পাঁচজন পাণ্ডবের, দ্রৌপদী-ফোরসাবজেক্ট ;
এক-দুই-তিন দুরমুশ করলে স্বর্গ যাত্রার একমাত্র বিশ্বস্ত ভরসা, চতুর্থ বিষয়ের হাত।
কবি নগ্নতা চেয়েছে কবে ? সর্বত্র
ছড়ানো শস্য খুঁটে নিতে অনিকেত ঘুরপাক, চোখের সংকীর্ণতায় প্রতিটি সম্পর্কে নিঃশব্দ ঘুণ বসত। অন্যকে বঞ্চিত করে
যদি নিজেকে জিতিয়ে নেওয়া বলে
মনে রেখোঃ তুমি এক আশ্চর্য স্বেচ্ছাচারী,
এই জয়ের নাম নাগাসাকি একাকিত্ব!
ভালোবাসার মতোই একদিন সবাই ঘেন্না
শিখে যায়, নিঃশ্চল বিশ্রাম চেয়ে
ঘুমিয়ে পড়ে বাতাস, তখন শিশির শুভেচ্ছা
মুছে দেয় ধুলোর দুর্মুখ, তুমি বাতাস
ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে দেখো ঝড়,
খুলে দিচ্ছে নিরাপত্তার আগল সমগ্র,
তোমার বাতাস প্রেমের ভেতর হঠাৎ
জন্ম নেয় নিটোল অক্ষয় অমাবস্যা।
চৌদ্দ
এভাবেই নির্দিষ্ট হয়ে যায় নিজস্ব কক্ষপথ,
মনস্তত্ত্ব ও দর্শন মিশেলে আমার নির্মাণ ও যাপন, হারমোনিয়ামের মতো ছড়ানো পথের সপ্তম সুরের ডাকে অবিকার, নিজস্ব একটি পথের এজলাসে আমার চাঁদদেখা ছাউনি—– আমাকে চিনে নেবে পথের ধুলো, গাছ ও গাছের ছায়া। এশিয়ার ভেতর কত দাগ, দ্বন্দ্ব, ভাগাভাগির আকাশ ও জমিন তবুও সীমান্ত পেরিয়ে চিল-চিৎকারে সদর্পে বলতেই অভ্যস্ত আমরা এশিয়া মহাদেশের সভ্যসুধী, পালিত এসব দ্বিচারিতা কতখানি স্বস্তির না সুখের ? সমগ্র একটি মহাদেশ মানুষের মতো ক্ষত গোপন রেখে ইস্ত্রিকরা জামাকাপড়ে
কেমন তার মুখে বিনয়মিষ্ট হাসি খিলখিল।
পনেরো
প্রতিটি শব্দের থাকে নিজস্ব বাড়িঘর
চঞ্চল উড়ুক্কু মাছের মতো থাকে ইচ্ছে—
বৃষ্টির ফোঁটা ও রোদের অভিসার,
চিহ্নমাত্র পথে পড়ে থাকলোই বা
পাখি ও মানুষের মতো দিনশেষে বাড়িফেরা এক মীমাংসিত সংবিধান, এর বাইরে, তবুও এর বাইরে অসফল কিছু ফুল পাতা গন্তব্যের আগে ঝরে যাওয়ার নিয়তিতে বিশ্বাসী।
এত কবি, এত নাশকতা হড়পা বাণের নিয়মে
তছনছ করে বিরচিত বাসর, তুমি না চিনলেও আমি তাকে আদিগন্ত জানি সেই স্বেচ্ছাচারী বিভীষিকা, প্রতিটি শব্দের থাকে নিজস্ব বাড়িঘর, শরীরের তুমি, মননের তুমি উভয় তুমিকেই আপ্ত সহায়ক শব্দে সজোরে আজ বেঁধে রাখতে চাই।