গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস–হেঁতালপারের উপাখ্যান(১৫তম পর্ব)

পরিচিতিঃ ১৯৮৩ এর ১৫ই জুন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপ বড়রাক্ষসখালিতে জন্ম। জল জঙ্গলে বড় হয়ে ওঠা। বর্তমানে দক্ষিণ২৪ পরগণার কাকদ্বীপের একটি বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। কবিতার নিয়মিত লেখক নয়।বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস “হেঁতালপারের উপাখ্যান“-১৫তম পর্ব

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস

হেঁতালপারের উপাখ্যান(১৫তম পর্ব)

 

    অপু ও শম্ভু
“জিন্দেগি য়ুঁ ভি গুযার হি যাতি/কিঁউ তেরা রাহগুযার য়াদ আয়া”গালিব
(জীবন তো এমনি কেটে যেত/কেন যে তোমার পথের কথা মনে পড়লো)
এবার অনেক দিন পর বাড়ি এলুম। যখন বাড়িতে ঢুকি, মা ছিল না। মনে হয় কারুর বাড়িতে চালের তুঁষ ঝাড়তে গেছে কিংবা মাইল দুয়েক দূরে পাকাওয়ালাদের বাড়িতে বড়ি দিতে গেছে। বিউলি ডাল আর লাউএর শাঁস ( ‘কাঁখুর’ বলি আমরা) দিয়ে বড়ি তৈরি করা হোত তখন। সে অন্যরকম বড়ি। কতরকম তরি তরকারি হোত সে বড়ি দিয়ে। মাছের সংগে, শাকের সংগে যার সংগেই রান্না হবে সে তরকারির স্বাদ বেড়ে যাবে বহুগুণ।
  দরজার কবাটে বরাবর দড়ি বেঁধে রেখে মা কোথাও যেত। বাড়ি এসে দড়ি খুলে ঢুকলুম। হাঁড়ির চাপা খুলে দেখলুম খুতের ভাত আর হাঁড়ির চাপায় শালুক গাছের ঘন্ট। এক খাবলা ঘন্ট তুলে মুখে দিলুম।আহা, অমৃত! মা’র হাতেই একটা অমৃতত্বের স্বাদ রয়েছে। তেল নেই, হলুদ নেই, লংকা নেই, তবুও মা হাত ছোঁয়ালেই সব কিছু স্বর্গের অমৃত হয়ে যায়। কবাট বন্ধ করে দড়ি বাঁধলুম।
  খাস খালের পাড় ধরে এগিয়ে চিওন গাছের জংগল ঘেঁষে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালুম। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলুম। কেউ নেই, কিছু নেই। সার ভাঁটার গাঙ খাঁ খাঁ করছে। হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গাবুড়ির ঘাট পেরিয়ে চন্দ্রানীর ঘাটের দিকে পা চালালুম। শীতের নরম বৈকালিক রোদ লুথিয়ানের দক্ষিণে নাবায় তখন ঝিলমিল করে খেলা করছে। বিস্তর স্থির জল হ’তে লাল আভা প্রতিফলিত হয়ে গায়ে এসে লাগছে। সমস্ত জল কেমন একটা রঙীন রোশনাই এর মতো ছোট ছোট মাছেদের গায়ে জল ছিঁটোচ্ছে। ভারার খালের দিক থেকে একটা নৌকা বেরিয়ে আসছে দিগন্তজোড়া লাল রং মেখে। পিছনে একটা লোক খালি গায়ে বৈঠা ধরে বসে আছে। ছলাৎ ছলাৎ করে বৈঠা জল কাটছে, আর লাল রং ছড়িয়ে পড়ছে জলের উপর। বাঁধ থেকে অদূরেই একদল শুশুক ডুব সাঁতার খেলছে, জল থেকে উঠে জল ছিটিয়ে আবার ডুবে যাচ্ছে। চন্দ্রানীর ঘাটে বুড়ো মনি মণ্ডল বসে আছে কৃষ্ণচূড়া গাছে হেলান দিয়ে। একটা মুটি গামছা পরা, গায়ে একটা ছেঁড়া কম্নল। আমাকে দেখে সচকিত হয়ে ওঠে।
কে রেএএএ বাপ?
আমি গো জ্যাঠা।
ওওওওও।
বুড়ো আবার গাঙের দিকে চোখ ফেরায়। তারপর হঠাৎ বলে উঠে
আমার ঝন্টুকে দেখচু?
না তো জ্যাঠা।
দেখুনি?
না।
ওই তো আইসেটে। দেখতে পাউটু?
ভারার খালের দিক হতে যে নৌকাটা আসছিল সেটার দিকেই হাত ইশারা করে বলে।
আমি আর পা দশেক এগিয়ে যেতেই বাঁকের মুখে দেখলুম এক হাঁটু কাদায় নেমে শম্ভু ঝাঁকর উল্টে মাছ ধরছে। একটা গামছা কাছা মেরে পরা। গায়ে একটা পিঠ ছেঁড়া গেঞ্জি। একটা একটা করে ঝাঁকর উল্টোচ্ছে আর চিংড়ি মাছ ধ’রে পিছনে গুঁজে রাখা একটা হাতল ছেঁড়া নাইলনের পুরানো ব্যাগে রাখছে। আমি তার সোজাসুজি গিয়ে বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে হাঁক দিলুম,
শম্ভু
কে? ওহহ তুই! কদবা আসসু রে? ভাল আচু অপু?
হঁ ভাল আছি। তুই ভাল আছু?
হঁ
কদগুয়া মাছ ধরছু শম্ভু?
হইচে মুটামুটি।
ঝাঁকরের নিচে জমে থাকা একটুখানি কাদাজলে হাত ধুয়ে ঢাল বেয়ে উপরে উঠে এল শম্ভু। হাঁটু অব্দি কাদা লেগে আছে। বল্লাম ” খায়ে লাবিয়া ধুয়া লে”
ধুইটি দাঁড়া। তুই কদ্দিন পরে আইলু! বুস।
ঘাসের উপর বসে পড়লুম। শম্ভুর কোমর থেকে ব্যাগটা টেনে এনে দেখি এক ব্যাগ চিংড়ি।
অত মাছ কী করবু?
ভাজিয়া খাবিব তোকে। তুই কদ্দিন খাউনি এগা!
ওহহ,
আর চঞ্চলী বৌদিকে দুবো। তরুবালা ঠাকমাকে দুবো একটুখাঁয়ি।
অই শুঁউ
ক’
মনি জ্যাঠাকে দেকচু?
হুম, অইতো অউখাঁয়ে বুসিয়া আছে।
আমাকে ডাকতল।
শম্ভুর ঠোঁটজোড়া একটু ফাঁকা হল। যেন যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর আগে পরিজনকে সান্ত্বনা দেবার শেষ চেষ্টা।   “যে যায় তাউকেই ডাকে, সব লোককে ঝন্টুদার কথা জিগাস করে”
অহহহ।
সারাদিন অউখাঁয়ে বুসিয়া রয়। খাইতে টাইতেও যাইতে চায়নি। ঘরে তো কেউ নাই। চঞ্চলী বৌদি ডাকিয়া লিয়া যায়া খাবায়। চঞ্চলী বৌদিকে তো যা তা কয়া খিস্তি দ্যায়। আবার একটা বিবর্ণ হাসি শম্ভুর ঠোঁটে।
আসোয়ে কী জাঁউ তো মাথার ঠিক নেই বুড়ার।
মাথায় হাত দিয়ে একটা সর্বস্ব হারানোর ভঙ্গি করে দেখায় শম্ভু।
খুব মন খারাপ লাগছিল মনি জ্যাঠার  জন্য।
শম্ভু
ক’
কী ভাবলু?
কী ভাব্বো?
শুঁউ
ক’
গৌরিকে তো তার মামুর দরে পাঠি দিচে শুঁউলি।
হুম, গোপালনগরে।
অহ্
একটু চুপ করে থেকে বল্লুম,
শম্ভু
ক’
তুই ভুলিয়া যা অকে
ভুলিয়াব? শ্লা, বকাচদা, ওকে ব্যা করচি রে, ব্যা হওয়া বৌকে ভুলিয়াব?
তা’লে?
তা’লে বাল। চ’ উঠ।
শম্ভু
কী কউটু
তোর লৌকাটা..
হঁ, ঝন্টু সাউ চালাটে দেখিটি তো। আমাকে মজুর রইতে কইতল লৌকায়।
শ্লা,শুয়ারের বাচ্চা। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
আচ্ছা শম্ভু,
হুম
ভালাবাসা কি অপরাধ? অন্যাই?
শুঁয়্, ন্যায় অন্যাই বলিয়া কিছু নেই। তুই তো পড়াশুঁয়া করুটু, এক সময় হয়ত জাঁআবু, আসলে কি জাঁউ তো, ক্ষমতা যার হাতে রয় তার সব কাজ ন্যায়। আর আমান্নে যা করব সব অন্যাই। আমি যেদি  ভানু বাগের মত বড়লোক হইতি তখঁ গৌরিকে লিয়া, আমাকে লিয়া কিছু কইতে সব লোকের বুক কাঁপত। তখঁ আমি যা করতি সৌটাই ন্যায়।
আমি মাথা নাড়লাম। শম্ভু থামল এতটা বলে। আমি পরম উষ্ণতা নিয়ে বল্লাম,
শম্ভু…
চিন্তা করি না, আমি সামনে সিজিনে আবার বাঙাল টলারে যাইটি। কুন অসুবিধা নেই।
কী যেন ভাবল শম্ভু। তারপর মাথা চুলকে বল্লে ” তোর জুতা কিঁয়ার টাকা গুছি রাখছি, নেই কইতলু। তুই যেঠি থাউ সেটি জুতা নেই পরলে হয়নি, আমি জাঁয়ি।”
আমি কী বলব বুঝতে পারছিনা। শুধু অবাক হয়ে শম্ভুর দিকে তাকিয়ে আছি। আমার পিঠে হালকা চড় মেরে শম্ভু একটা শুষ্ক হাসি দিয়ে বল্লে, “দাঁড়া বুস। আমি মাছগা দিয়াইসি।”
কাই যাবু দিতে? ঘরে?
পথমে চঞ্চলী বৌদির দরে, তারপর তরুবালা ঠাকমার দরে, তারপর ঘরে৷ আমি ছুটিয়া যাবো আর আইসব। ঘরে কয়াসবো বাবাকে, তোর মাকে যেন দুটা দিয়াইসে।
কথা বলতে বলতে দ্রুত পা চালাল শম্ভু। আমি কিছু যে বলবো তার সময় দিলেনা। এক হাঁটু কাদা মেখে এই শীতের সন্ধায় আবছায়া আলোতে একটা ছেঁড়া গেঞ্জি পরা লোক স্রোতের মতো মুহুর্তে চোখের আড়ালে চলে গেল।
  জোয়ার হচ্ছে। জল আস্তে আস্তে উপরে উঠে আসছে। মনি জ্যাঠার চিৎকার বাড়ছে আলো যত কমছে। “ঝন্টু রেএএএএএএ, ঝন্টু রেএএএএএএএ, কু উউউউউউউউ, কুউউউউউউউউউউ”।
  চন্দ্রানীর ঘাটে হঠাৎ একটা কোলাহল হচ্ছে। আমি উঠে দাঁড়ালুম। বাঁক পেরিয়ে ঘাটে গিয়ে দেখলুম এক কাণ্ড। চঞ্চলী বৌদি মনি মণ্ডলের হাত ধরে কাদা জল থেকে তোলার চেষ্টা করছে।মনি মণ্ডল ”ঝন্টু ঝন্টু” ব’লে চিৎকার জুড়েছে। তাকে জল কাদা থেকে কিছুতেই চঞ্চলী বৌদি তুলে আনতে পারছেনা। কিছুই বুঝতে পারলুম না। ওদিকে বাঁধের উপর আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বৌদি কেঁদে উঠে আমাকে বল্লে ” অপু, ভাই আইসনা গো একবার, ও ভাই,  একটু আইস না গো”। ঘটনা যা বুঝলাম,রাম মালি তার ছোট নৌকায় কাঠ কেটে ওপার থেকে এপারে এসে চন্দ্রানীর ঘাটে নৌকা লাগিয়েছিল একটু আগে। এই ঘাটে কাঠ নামিয়ে রাখলে সুবিধা হল চুরি হারি হয়না। সারা রাত এখানে কাঠ ফেলে রেখে ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমানো যায়। সে যাই হোক, রাম মালির নৌকা ঘাটে লাগতেই বুড়ো মনি মণ্ডল লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে ” ঝন্টু ঝন্টু” বলে কাঁদতে কাঁদতে নৌকায় গিয়ে উঠেছে। সারাদিন চোরের মতো জঙ্গলে লুকিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করে কাঠ কেটে বয়ে নৌকায় তুলেছে রাম মালি। একা একা বৈঠা বেয়ে নৌকা এনেছে এপারে। এরপর মনি মণ্ডলের এই নাটক তার সহ্য হবে কেন? একটা আগালি কাঠ নিয়ে সজোরে বসিয়ে দিয়েছে মনি মণ্ডলের বাম পায়ে। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠে নৌকা থেকে এক হাঁটু কাদা জলে পড়ে গেছে বুড়ো। তার গায়ের কম্বল জলে, কাদায় ভিজে লেপ্টে যা তা হয়ে গেছে।
আমি কাদায় নেমে অনেক কষ্টে মনি জ্যাঠাকে তুল্লাম। প্রায় জোর করে পৌঁছে দিলুম চঞ্চলী বৌদির ঘরে।
  খাস খালে নেমে পা হাত ধুচ্ছি। শম্ভুর ডাক শুনতে পেলুম। অপু রেএএএএএ
আমি সাড়া দিলুম। পায়ে পায়ে এগিয়ে এল।
এখাঁয়ে কেনি?
আমি বুঝিয়ে সব বল্লেম।
শ্লা, খানকির পো রাম। একটা বুড়া লোককে…শম্ভুর মুখ রাগে লাল হয়ে গেল। এই শ্লাকে আমি একদিন চ্যালা কাঠ লিয়া.. তার মুখের কথা সম্পূর্ণ করতে পারলনা, বোধ হয় রাগের চোটে।
তোর সংগে তো চঞ্চয়ী বৌদির দ্যাখা হয়নি?
না।
তা’লে মাছ?
ব্যাগে করিয়া কবাটের ফাঁকে গুঁজিয়া দিয়াসসি।
অহ। ঠিক আছে, চ’।
রাম মালি ফটাফট শুকনো কাঠ নৌকা থেকে পাড়ের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি করতে পারবে, ঘরে যেতে পারবে তত তাড়াতাড়ি।  তাছাড়া নেহাৎ পেটের দায় না থাকলে সে কেন এখানে কেউই শখ করে সন্ধার পর চন্দ্রানীর ঘাটে আসেনা। ব্যতিক্রম মন্টু সাউ। সে শখ করে শুধু চন্দ্রানীর ঘাটে নয়, শ্মশান ঘাটে গিয়েও রাত বিরেতে বসে থাকে। আর আছি আমাদের মতো ক’জন ছন্নছাড়া, যাদের কারুর বা ভুতে বিশ্বাস নেই, কারুর বা বিশ্বাসের চেয়ে সাহস বেশি, আবার কারুর বা ভুতের ব্যাপারে ন্যায় নীতি ঠিক বেঠিক আবেগ আছে।
আমরা বাঁক পেরিয়ে গিয়ে একটা ঘাসের চাঙড়ের উপরে বসলুম। কাঠ ফেলার বিশ্রী শব্দ এখানে কম আসছে। জোয়ার অনেটা উঠে এসেছে। ক্ষীণ কাস্তের মতো চাঁদ উঠেছে এপারের জঙ্গলের পুব দিকে শ্মশান ঘাটের কাছে। সম্মুখের কিছুটা অংশ ফাঁকা, ঝাঁকর ভর্তি।  একটু আগে এখানেই শম্ভু মাছ ধরছিল। ধারালো ঝাঁকরে হয়তো একটু আধটু কেটেকুটে গেছে। হাত বাড়িয়ে চুচ্চুড়ি গাছের ডাল ভেঙে তার রস নিচ্ছিল শম্ভু। একটা খটাস বা কিছু বাঁধের এপার থেকে দৌড়ে ওপারে চলে গেল। ওপারে লুথিয়ান থেকে একদল শেয়ালের বিপন্ন ডাকের শব্দ ভেসে এল। একটা তারা খসে পড়ল লুথিয়ানের মাথায়।
অপু
হঁ, ক’
তোর এ দ্বীপ ভাল্লাগে?
অন্ধকারে হেসে উঠলাম।
শ্লা, বকাচদা, এর বাইরে আর আমানকের পিথিবী আছে? ভাল হউ খেরাপ হউ অউঠি রইতে হবে।
সেটা আলদা কথা। কিন্তু কত লোক আধা বয়েসে মরেটে, কত লোকের ঘর ভাঙেটে বন্যায়, কত লোক মরিয়া মান্ডাসে ভাসিয়া কাই কুন্ঠি চলযাটে, শ্লা যেন হিসাব নেই!
হঁ ঠিক কইচু শম্ভু। ঝন্টুদা টা তো কাই গেল আর আইলইনি। মনি জ্যাঠা…
হুম, দ্বীপটার উপরে শ্লা অভিশাপ আছে, বুঝচু?
আমি আবার হেসে ফেল্লাম।
হাসুটু? লোকগার অবস্তা দ্যাকচু? আমার যেদি লৌকাটা রইত, আমি অউ লোকগাকে অনাহারে রইতে দিতিনি।
একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে গেল আমার অজান্তেই।
অপু
ক’
একদিন আমার সাথে এক জাগায় যাবু?
হঁ যাবো।
ভয়ের বেপার আছে কিন্তু।
তবু যাবো।
শম্ভু চুপ করে গেল। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বল্লে, গপাআ নগর যাবো।
বল্লাম “গৌরির কাছে?”
হঁ। অর জন্য চুড়ি কিঁইচি। দিতে যাবো।
আমি আর কিছু বল্লাম না। শম্ভু নিশ্চিত যাবে। আমিও যাবো ওর সংগে। কিন্তু আমার কষ্ট হল সম্ভাব্য দেখা না হওয়ার ছবিটা ভেবে। শম্ভুকে কিছু বল্লাম না। ওর ভিতর একটা মহাসাগর আছে, সেখানে জাহাজ ভাসে, তাদের উপর মস্ত ইমারত,  ইমারতের উপর মাস্তুল, মাস্তুলে একটা একলা পাখি এক পায়ে ঠায় বসে আছে। আমি চাইনা সে সমুদ্রে তুফান উঠুক, মাস্তুল নড়ে যাক।
  সাউর ঘাটের দিক থেকে একটা নৌকা ছপাস ছপাস করে বৈঠা ফেলতে ফেলতে এগিয়ে আসছে। বৈঠার মাথায় ফসফরাসের জোনাকি জ্বলছে, নিভছে। আবছায়া অন্ধকারে নৌকা দেখা যায়না, মানুষও চেনা যায়না। দু’জনেই তাকিয়ে আছি। হঠাৎ আওয়াজ ভেসে এল “কে বুসস গো ওঠিটাআআআ?” এতো মন্টু সাউর গলা। শম্ভু উত্তর দিল জোর গলায় ” আমি শম্ভু গোওওওও”।
ধীরে ধীরে নৌকা ধারে এল। মন্টু সাউর সাধের নৌকা। আহ্লাদি। বৈঠা হাতে মন্টু সাউ। আর কেউ নেই নৌকায়।
যাবু?
কাই যাওট?
শ্মশান ঘাটে। যাবু নাকি?
একটু ইতস্তত করছিলাম।
কীরে ভয় লাগচে? আরে তোন্নে কারুর ক্ষতি করুনি, তোনকের ক্ষতি করার ক্ষমতা কুন্ শ্লার আছে!
উঠে পড়লাম নৌকায়। দাঁড় নামাইনি কেউ। মন্টু সাউ আমাকে বৈঠা দিয়ে মাঝখানে এসে বসে। বিড়ি খায়। লম্বা লম্বা চুল হালকা হাওয়ায় এদিক ওদিক হয়।
  শম্ভু গাছের সংগে আহ্লাদিকে বেঁধে দেয়। তিনজন নেমে আসি নৌকা থেকে। জঙ্গল পেরিয়ে উঠে পড়ি ঘাটে। দগদগে আগুন জ্বলছে। একটু আগে বোধ হয় কাউকে পোড়ানো হয়েছে। বসে পড়ি বাঁধের উপর। আজ একদম ভয় করছেনা। মন্টু সাউ বিড়ি ধরায় আবার, টানতে টানতে বলে, “অউ জন্য এখাঁয়ে আইসি।”
আমি বিষ্ময়ে বল্লুম “কেনি?”
শম্ভু বল্লে “চিতা দেখতে?”
“এটা চিতা না রে” গম্ভীর গলা থেকে গভীর তত্ত্বকথা উঠে আসছে যেন। “আসলে অউটা হইল আমানকের ভবিষ্যৎ, আর ভবিষ্যত যে দেখতে পায়, সে কুনদিন কারুর সাথে অন্যাই করতে পারেনি।” মন্টু সাউ একটা লম্বা টান দেয় বিড়িতে। আমি আর শম্ভু অন্ধকারে মোহাবিষ্ট অশরীরীর মতো বসে থাকি।
ক্রমশ…
লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্ব পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন–

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস– হেঁতালপারের উপাখ্যান(১৪তম পর্ব)

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *