আমার ব্যান্ডওয়ালা
অ রি ন্দ ম রা য়
গল্পটা শুধু আমার নয় আমার মত সম্ভবত 1000 জন পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দার গল্প। 2008 সাল সম্ভবত ডিসেম্বর মাস, আমি একটা বিশাল বড় বেস্ গিটার নিয়ে মেদিনীপুর রেলওয়ে স্টেশনে নামছি। একটা সিক্সপ্যাক ওয়ালা স্বাস্থ্যবান লোক, লোকই বলব কারণ আমার থেকে অনেকটা বড়, আমায় বলল তুমি বেস গিটার বাজাও? আমি বললাম হ্যাঁ কিন্তু তুমি বেস গিটারটা কি সেটা জানো? ভদ্রলোক উত্তর দিলেন অবশ্যই, আমাদের সাথে বাজাবে?
2008 সাল, মেদিনীপুরে সম্ভবত পয়সা নিয়ে ডিষ্টরসান টা আমরাই প্রথম বাজিয়েছিলাম। একটা অদ্ভুত সময়ে বড় হয়েছিলাম আমরা। টিভিতে যখন ব্যান্ডেমাতরম চলছে। আর আমরা খুঁজছি একজন গিটারিস্ট আর একজন কী-বোর্ডিস্ট-কে। সব মিলিয়ে পাঁচজন প্রাণী। আমি অরিন্দম বেস গিটারে, নিরুপমদা আর হাবুদা গান গায়, গৌতমদা গান লেখে, রাজাদা অক্টোপ্যাড বাজায়। চোখে সবার স্বপ্ন একদিন ব্যান্ড করে মেদিনীপুরের সংগীতের সিনারিও ওলটপালট করে দেব(ওই বয়সে সবাই যেমনটা ভাবে আর কি)। আমাদের আড্ডার জায়গা ছিল হাবুদার ফাঁকা ঘর। যে যার বাজাবার যন্ত্র নিয়ে সকাল-সকাল হাজির হয়ে যেতাম। গৌতমদা কবিতা লিখত দেশের হয়ে আর আমাদের জন্য লিখত গান। হাবুদা আর গৌতমদা ছোটবেলার বন্ধু ও সহপাঠী তাই ওরা একে অপরের পেছনে লাগত খুব। হাবুদা বলত “তুই পিরীতের ঝালমুড়িতের মত গান লিখ নইলে কেউ শুনবে না”। গৌতমদা বলত তুই আগে অমনি ঢিক্কাটিকা ঢিক্কাটিকা তালের সুর কর। যাই হোক গৌতমদা গান লিখে দিত হাবুদা ও নিরূপমদা সুর জমিয়ে আমাদের কোর্টে বল ফেলত আমরা মিউজিক পার্ট রেডি করে সেইগুলোই প্র্যাকটিস চলতো। আমার মনে পড়েছিল শিবনাথেরর কথা। শিবনাথ বলে একজন আমার সাথে স্কুলে পড়তো যে কিনা সিন্থেসাইজার বাজাত জানতাম একদিন শিবনাথ এর সাথে কথা হল সে বলল হ্যাঁ হ্যাঁ আমি বাজাতে চাই তোদের সাথে। শিবনাথ আমাদের সাথে যোগ দেওয়ার পরে একটু হলেও আমরা অক্সিজেন পেলাম। বাকি রইল একজন গিটারিস্ট এর। দুর্গাপুজোয় বিধান-নগরের মাঠে একটা প্রোগ্রাম দেখতে গিয়ে হঠাৎ করে এক বাঁহাতি গিটারিস্ট আমাদের খুব পছন্দ হয়ে গেল। নাম শৌণক। শৌনকদাকে সরাসরি বলতেই এক পায়ে রাজি হয়ে গেল। আর কি গৌতমদার লেখা গান , হাবুদার সুর আর আমরা মাস্কেটিয়ার্স। প্রথম শো টা আমার ভীষণ ভালো ভাবে মনে আছে। গৌতমদার কথা অনুযায়ী 31 শে ডিসেম্বর 2009 আমরা একটা স্টেজ পেয়েছিলাম মেদিনীপুর লিটল ম্যাগাজিন মেলা। ওরাও লড়াই চালাচ্ছে তখন সাহিত্য বিকেন্দ্রিকরণ সহ লিটল ম্যাগাজিনের সসম্মান আদায়ে। সেই মেলাতেই আমাদের প্রথম স্টেজ পারফর্ম। বন্ধুর পরিধি নেহাত কম ছিলনা সব মিলিয়ে জনা 500 লোকের সামনে আমরা ফাটিয়ে দিয়েছিলাম সেদিন। তৎকালীন বাংলা ব্যান্ডের বিখ্যাত গানগুলোকে সঙ্গী করে প্রায় দেড় ঘন্টা অনুষ্ঠান করেছিলাম আমরা, যেখানে দর্শকরা হাততালি ছাড়া আর কিছুই আমাদের দেয় নি। কিন্তু আমরা শপথ নিয়েছিলাম যে এই লিটল ম্যাগাজিনের ‘শো’টাই আমাদের একমাত্র হবে যা কিনা আমার টাকা ছাড়া করব। লিটল ম্যাগাজিনের শো শেষ হলো আর তার 10 মিনিটের মধ্যে মেদিনীপুর ক্লাব থেকে এক ভদ্রলোক আমাদের বললেন তোমরা বাজাবে আমাদের অনুষ্ঠানে?
আমরা তো এক পায়ে খাড়া। তখনও ব্যান্ডের অঘোষিত ম্যানেজার হিসেবে আমিই বললাম পয়সা লাগবে কিন্তু! তারপর থেকে মেদিনীপুরের আনাচে-কানাচে, ঝাড়গ্রাম, গিধনী, জকপুর , খড়গপুর, মেচেদা বিভিন্ন জায়গায় মাস্কেটিয়ার্স পরপর শো করে গেছে। শুধু জনপ্রিয় বাংলা ব্যান্ডের গান নয় মেদিনীপুরের মত মফস্বল শহরে দাঁড়িয়ে ডিমান্ড অনুযায়ী আমরা যেমন ইংরেজি গানও গেয়েছি তেমনই গেয়েছি নিজেদের গানও। মজার ব্যাপার আমরা কোনও কোনও জায়গায় অটোগ্রাফও দিয়েছি শো এর শেষে। আবার এর উল্টোটাও ঘটেছে, মার খেতে খেতেও বেঁচেছি বহুবার। কয়েক বছর বাজিয়েই শৌনকদা জীবিকার টানে অন্যত্র পাড়ি দিল। সেই শূন্যস্থান পুরণ করতে দলে এলো এলভিস লিড গিটারিস্ট হিসাবে। এই এলভিস আবার এক অদ্ভূত চরিত্রের, বাংলা গান সাহিত্য তো দূর ঠিকঠাক বাংলাটা বুঝতেই পারতো না তবুও তার ঝোঁক সে বাজাবে। তার পরিশ্রম ও ডেডিকেশন একদিন তাকেও মাস্কেটিয়ার্সের একজন অভিন্ন বন্ধু করে তুলেছিল। স্টেজ শুরু হওয়ার ঠিক আগেই বলত মুঝে কুছ নেহী আতা ভাই শিবা তু সামহাললেনা। কিন্তু শুরু হলেই এলভিস অন্য মানুষ। পাব্লিকের টেম্পারেচার হাই হয়ে যেত এলভিসকে দেখে ও শুনেই।
2014 সাল নাগাদ ঠিক করলাম পড়াশোনা করি চাকরি করব, তখন আমি মাস্কেটিয়ার্স-এর বাকিদের সাথে আলোচনা করলাম। 2014 সালের 31 শে ডিসেম্বর সেই লিটল ম্যাগাজিন মেলার মঞ্চে আমি মাস্কেটিয়ার্স-র সাথে শেষ শো করি। সার্কেল অফ লাইফ বলে একটা কথা আছে। জীবনে কি সবকিছু মিলিয়ে দেয়। একটা সময় ছিল যখন মাস্কেটিয়ার্স-র একটা শো করে আমি যা পয়সা পেতাম তাতে কলকাতায় আমার এক মাসের থাকা-খাওয়া এবং পড়াশোনার খরচ চলে যেত। আজ মেদিনীপুর থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে এই বিদেশে বসে বৈজ্ঞানিক হিসেবে কাজ করতে করতে ইউটিউব প্লাটফর্মে হঠাৎ করে একটা ভিডিও দেখে বড় আনমনা হয়ে যাই। আমরা পরিবর্তন করতে পেরেছি কি পারিনি সেটা হয়তো বড় কথা নয় সব থেকে বড় কথা হল এমন কিছু বন্ধু সেই সময় আমরা একে অপরকে পেয়েছি যারা হয়তো সারা জীবন আমাদের পাশে থেকে একসাথে বাজাবার প্রতিশ্রুতি রেখেছিল। মাস্কেটিয়ার্স আবার কবে স্টেজ করবে কি করবে না সেটা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমার কাছে খুব বড় বিষয় নয় সেটা কিন্তু সেই মানুষগুলো যে আমার জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে এবং অংশ হয়ে থাকবে সেটাই আমার কাছে বিশাল পাওয়া। এরকম অনেক সময় গেছে যখন আমরা প্রায় প্রিপারেশন ছাড়াই স্টেজে উঠেছি, ভুল করেছি ভুল বাজিয়েছি, কিন্তু কখনও এই সাত জনের দলটার সবাই একসাথে ভুল করিনি। আমি ভুল করলে রাজাদা ম্যানেজ দিয়েছে, হাবুদা ভুল করলে শিবু। কেউ না কেউ ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে গেছে। শক্ত মুঠোয় হাতটা ধরেছে। মাস্কেটিয়ার্স কত বড় হয়েছে সেটা দিয়ে আমি মাস্কেটিয়ার্স এর সাফল্য বিচার করি না। আজ দুই হাজার কুড়ি সালের শেষ দিনে এসে আমরা যে একে অপরের বন্ধু এটাই হয়তো আমার কাছে সব থেকে বড় বিচর্য বিষয়।
শেষে একটা কথা বলি মাস্কেটিয়ার্স আবার স্টেজে ফিরবে সবাই মিলেই ফিরব। সেটা শেষ বয়সে গিয়ে হলেও হবে। হতেই হবে। কারণ we are team bro..