স রো জ দ র বা র- র গল্প
ঈশ্বরের গুপ্তকথা
ঈশ্বর যে দিনে অন্তত দু-বার মানুষ হয়ে ওঠেন, এই কথাটা জেনে এত অবাক হয়েছিল জয়দেব যে, তাজমহল না-দেখার দুঃখ অব্দি সে সাময়িক ভুলে গিয়েছিল।
জয়দেবের চেনাজানা হেন লোক নেই যে এখনও তাজমহল দেখেনি। অনেকের তো আবার দু-তিন বার করে দেখা হয়ে গেছে। ছোটবেলায় একবার, বড় হয়ে আর-একবার। জয়দেব শুধু তাজমহলের ছবি দেখেছে। সত্যি বলতে পৃথিবীর কোনও আশ্চর্যই সে দেখেনি। এটাও তার কাছে এক আশ্চর্যের বিষয়, যে, কোনও আশ্চর্য না-দেখেই কেমন কেটে যেতে পারে এক-একজন মানুষের জীবন। কত মানুষই তো তাজমহল দেখেনি। জয়দেবের বাপ-ঠাকুদ্দাও দেখেনি।
এইভাবে ভাবনাটাকে ঘুরিয়ে সে খানিক সান্ত্বনা দেয় নিজেকে। তবে সাধ তার কমে না। আজকাল থেকে থেকেই তাজমহল ভেঙে-টেঙে দেওয়ার কথা হয়। জয়দেব শোনে আর প্রতিবার ভাবে, টাকাপয়সা জমিয়ে একবার জিনিসটা দেখেই আসবে। যারা দেখেছে, তারা বলে, অমন একখানা মস্ত বিস্ময়ের সামনে দাঁড়ালে জীবন নাকি সার্থক হয়। তা জয়দেবও জীবনটাকে সার্থক করাতে চায়। কিন্তু হবে কী করে! টাকাই জমে না। আয়ের থেকে ব্যয় বেশি। ভাঁড়ে যা জমে, মাঝেমাঝেই ভেঙে বের করতে হয়। এইরকম ধারের-খাতা মার্কা জীবন হলে কী আর যারপরনাই আশ্চর্য হওয়ার উপায় থাকে!
জয়দেব নিজের উপরই তাই বিরক্ত। লোকে কত বাড়ি, গাড়ি, টাকা-পয়সা করে ফেলে। সবাই কি আর ধান্দাবাজি আর দলবাজি করে আলিসান বাড়ি হাঁকিয়েছে! লোকে খেটেও তো কতকিছু করে। অন্তত একটা ফ্ল্যাট কেনে। একদিন আহ্লাদ করে শপিংমলে যায়। সপ্তাহে অন্তত একবার খাসির মাংস কেনে। জয়দেব এসব কিছুই পেরে ওঠেনি। কেন যে পারল না! ভেবে ভেবে নিজের উপর রাগও হয় জয়দেবের।
কিন্তু কী আর করা যাবে! এই পাঁশুটে মেঘলা দিনের মতো জীবনটা যে আজীবন তার সঙ্গেই থেকে যাবে, এখন জয়দেব তা বেশ ভালোই জানে। আর তাই সে নিজের মতো করে কিছু বিস্ময়ের জিনিস খুঁজে নিয়েছে। যেমন রেললাইন। এই এত এত লাইন কোথায় যে চলেছে, মাঝে মাঝে জংশনে পাক খেয়ে সাপের মতো কিলবিল করে আবার ছুটে যাচ্ছে – এই পুরো ব্যাপারটা ভারি বিস্ময়ের। সে ভাবে, কেবল সাতটা কেন, তার মতো মানুষ নিজের মতো করে আরও কিছু আশ্চর্য বানিয়ে নিতে পারে। তা-ই বা কম কী!
আরও একটা আশ্চর্যের জিনিস হালে খুঁজে পেয়েছে জয়দেব। সেটা হল কুকুরের ইংরেজি বোঝা। মাঝেমধ্যেই সে রাস্তাঘাটে দেখে, ঢাউস ঢাউস কুকুরের গলার দড়ি ধরে লোকে ছুটে চলেছে আর ইংরেজিতে কুকুরটাকে ধমকাচ্ছে। জয়দেব অবাক হয়। একটা ধাড়ি কুকুরও তবে ইংরেজি বুঝতে পারে! এমনিতে ইংরেজি যারা বলতে পারে আর বুঝতে পারে, তাদের প্রতি অগাধ সম্ভ্রম জয়দেবের। পাঁশকুড়া লোকালে এক ভদ্রলোক ইংরেজিতে চিঠি লেখার বই বিক্রি করত। লোকটার ফিটফাট পোশাক, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, চোখে চশমা। ডান হাতটা মুখের সামনে এনে খানিক আড়াল করে কাটা কাটা উচ্চারণে সে দু-চারটে চিঠি মুখস্থ বলে যেত। ট্রেনের বাকি সব হকারদের থেকে যেন সে ভিনগ্রহের জীব। একদিন জয়দেব তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, হ্যাঁ গো তোমার বইপত্তর কেমন বিক্রি হয়? লোকটা পালটা প্রশ্ন করে, কেন বলোতো? জয়দেব বলে ফেলে, এই যে এত ফিটফাট থাকো, এর তো বেজায় খরচ। লোকটা উত্তর দিয়েছিল, এরকম না-থাকলে লোকে ইংরেজি শেখার বই কিনবে কেন? কথাটা ভারি মনে ধরেছিল জয়দেবের। ইংরেজি যারা বলতে পারে, তারা বেশ আলাদা। তারপর যেদিন থেকে দেখল, কুকুরও ইংরেজি বোঝে – নইলে লোকে তার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে কেন – সেদিন থেকে তার আর বিস্ময়ের শেষ নেই।
এইসব আধুলি-বারো আনা বিস্ময় নিয়েই দিন কেটে যায় জয়দেবের। বড় বিস্ময় তার নাগালের বাইরে। তখনও জয়দেব জানত না যে, ঈশ্বরের গুপ্তকথা একমাত্র সেই-ই জানবে।
দুই
ঈশ্বরকে কি জয়দেব কম খুঁজেছে! তার মতো লোকেদের ঈশ্বর ছাড়া আর কেই-বা আছে। কোনও চাকরিতেই সে বেশিদিন টিঁকে থাকতে পারেনি। যতবার চাকরি গেছে, ততবার সে ঈশ্বরকে বলেছে, আর-একটা ব্যবস্থা করে দাও। ব্যবস্থা ঠিক হয়েও গেছে। সে চাকরি যদিও আবার গেছে। এইভাবেই চলছে।
কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করে দেখেছে জয়দেব। মানুষের যত ক্ষমতাই থাকুক না কেন, সে ঈশ্বর হতে পারে না। একবার বাধ্য হয়েই জয়দেব একবার সিকি ক্ষমতার এক নেতার কাছে গিয়েছিল, একটা চাকরির ব্যবস্থার জন্য। তা নেতার হাবেভাবে তো মনে হচ্ছিল, পৃথিবীটা তার আঙুলের ইশারাতেই চলে। কিন্তু যেই চাকরির কথাটা এল, নেতা চুপসে গেল। ইনিয়ে বিনিয়ে জিলিপির মতো করে যা বলল, তার মানেটা দাঁড়ায় এই যে, সিকির উপর আধুলি, আধুলির উপর বারো আনা, তার উপর ষোল আনা ক্ষমতার মুদ্রারা সব ঝনঝন করছে। তাই খুচরো নেতা একা কিছু করতে পারবে না, চেষ্টা করে বড়জোর দেখতে পারে। তা ছাড়া এই সব দেখাশোনার পিছনে খরচাপাতিও কিছু কম নয়।
জয়দেব বোকার মতোই বলেছিল, তাহলে একেবারে ষোল আনার কাছে গেলে হয় না! খরচাপাতি যদি কিছু লাগে, তাঁকেই নয় দেওয়া যাবে। কথা শুনে সিকি নেতার সে কী হাসি! বলে, যদি যেতে পারেন তো যান, আমার আপত্তি নেই। তবে, তিনিও কি পারবেন! মাথার উপর সেন্টার আছে, কোর্ট আছে। জয়দেব বলল, আর সেন্টারের মাথায় কে আছে? সিকি নেতা ভুঁড়ি দোলানো হাসি হেসে বলে, আমেরিকা আছে, রাশিয়া আছে, চিনও আছে।
বিষণ্ণ হয়ে ফিরে আসে জয়দেব। তার মানে এইসব মানুষের হাতে তো কোনও ক্ষমতাই নেই। অথচ ঈশ্বরের হাতে আছে। যতবার যেখানে তার দরকার হয়েছে, সে ঈশ্বরকে বলেছে, একটা কিছু ফন্দিফিকির করে দাও দিকি। জয়দেব খেয়াল করে দেখেছে, তারপর থেকে দু-দিন হোক কি চার দিন, একটা কিছু উপায় ঠিক হয়েই গেছে।
সেই সেবার যখন চাকরি গেল জয়দেবের, খুব ভেঙে পড়েছিল সে। একটা অদ্ভুত চাকরিই বলা যায়। সংস্থাটা হরেক রকম বিমা করায়। তা যেদিন সে প্রথম চাকরিতে ঢুকল, একজন ফিটফাট লোক তার হাতে লম্বা একখানা তালিকা ধরিয়ে দিল। তাতে গাদাগুচ্ছের ফোন নম্বর। জয়দেবকে বলা হয়েছিল, রোজ ফোন করো এই লোকগুলোকে। বলো, একটা বিমা করানোর জন্য। যে রাজি হবে, তার কাছে গিয়ে বিমার কীর্তন গাও। যদি করায় তো বেঁচে গেলে, নইলে আবার ফোন করো। টার্গেট পূরণ হলে ভালো, নইলে বাপু মানেমানে কেটে পড়ো। জয়দেব চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, লোকজন খুব মন দিয়ে এই কাজ করে চলেছে। কেউ কেউ আবার ফোন করে ইচ্ছুক লোকের টিক-মারা-তালিকা ধরিয়ে দিচ্ছে আর-একজনকে, সে বেরিয়ে যাচ্ছে লোকগুলোকে রাজি করাতে। তো জয়দেবও দিনকতক এই কাজ করল। কিন্তু তার গলায় কী ছিল কে জানে! আর্ধেক লোক হাবিজাবি বলে ফোন রেখে দেয়। নয়তো ফালতু বকে সময় নষ্ট করে। টার্গেট পূরণ তো দূর, মাসের শেষে জয়দেবের নামের পাশে বসল মস্ত শূন্য। আর চাকরিটাও গেল।
সেদিন বাড়ি ফিরে গভীর রাতে জানলার পাশে বসেছিল জয়দেব। খুব পূর্ণিমা ফুটেছিল। জয়দেব কাঁদতে চাইছিল, কিন্তু পারছিল না। জোয়ারের জল সরে যাওয়া নদীর বুকে বালির উপর চাঁদের আলো পড়লে যেমন দেখায়, তার মুখখানা সেরকমই দেখাচ্ছিল। যদিও জয়দেব নিজে তো দেখতে পায়নি। সে দেখতে পাচ্ছিল, একজন ঈশ্বর এবার চাঁদের আলো বেয়ে নেমে আসছে তার কাছে, আর বলছে, এত চিন্তা কীসের আমি তো আছি! কিন্তু একটু বাদে চোখ কচলে দেখল, এরকম কিছুই হচ্ছে না। অথচ সে ঈশ্বরকে ডাকছিল প্রাণপণে।
যেদিন দেখা পাওয়ার কথা, সেদিন দেখা হল না। অথচ আচমকা একদিন ঈশ্বরের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল চা দোকানে। একা একা বসে সে চা খাচ্ছিল, ফাঁকা দোকান, বেলা তখন একটু চড়া হয়েছে; দেখল, পাশেই ঈশ্বর। এর আগে ঈশ্বরকে কখনও দেখেনি জয়দেব। চিনতে তবু তার ভুল হল না। ঈশ্বরের সঙ্গে কথা হল তার, মনের দুঃখ সে জানাল। ঈশ্বর সব শুনলেন। বললেন, চিন্তা কী! কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। জয়দেব অবাক হয়ে বলল, এ আবার কেমন কথা। স্বয়ং ঈশ্বর হয়েও আপনি নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারছেন না! ঈশ্বর বললেন, ঈশ্বর বলেই তিনি নির্দিষ্ট করে কিছু বলেন না। জয়দেব আর কথা বাড়ায় না। ঈশ্বর একসময় চলে যান, জয়দেবও চায়ের দাম মিটিয়ে ফিরে আসে। শুধু শুনতে পায় না যে, চা দোকানি গোবিন্দ বলেছিল, লোকটার মাথা একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে। নইলে কেউ একা একা বিড়বিড় করে।
তবে ঠিক তার পরেই বইপাড়াতে প্রুফ দেখার একটা চাকরি পেয়ে গেল জয়দেব। চাকরিটা টিকেও আছে বেশ। মাঝেমধ্যেই এখন ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা হয় জয়দেবের। বিশেষত সন্ধের কলেজ স্ট্রিট ধরে সে যখন একা একা হাঁটে, ওই অত লোকের ভিড়েও সে দেখে এক-একদিন ঈশ্বর তার পাশেই আছে। টুকটাক কথা হয় জয়দেবের সঙ্গে। ভালো লাগে জয়দেবের।
বইপাড়ার সকলেই জানে, একা একা কথা বলার রোগ আছে লোকটার।
সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত একটা বইয়ের প্রুফ নিয়ে বেজায় ঘেঁটে জয়দেব। ঢাউস একটা উপন্যাস। তাড়াতাড়ি ছাপাতে হবে, তাই রাতের মধ্যে প্রুফ দেখে দিতে হবে জয়দেবকে। বেশি রাত জাগা তার অভ্যেস নেই। চোখ জ্বালা করে। অক্ষরেরা সব নাচতে শুরু করে। তবু জয়দেব লাল কলমখানা ঘষে ঘষে এগিয়ে চলেছে। তার উপর কে চোখের মাথা খেয়ে কম্পোজ করেছে কে জানে, সমস্ত শাসক বানান ভুল করে ‘শাশক’ লিখে রেখেছে। জয়দেব খুঁটিয়ে পড়ছে, ধীরে ধীরে সংশোধন করছে। করতে করতে তার মনে হয়, শাসককে কি আর শুধরোনো যায়! তার জীবনে সে দেখেছে, শাসক বদল-টদল হয়, এর বেশি আর কিছু বদলায় না। এই গোটা উপন্যাসেও যদি শাসক ভুল বানানেই থেকে যায়, তাহলেও এখানে শাসকের ভূমিকা একটুও বদলাবে না। গল্প সেই একই থাকবে।
পরক্ষণেই মাথা থেকে এই চিন্তা বের করে দেয় জয়দেব। এই বাজারে আর-একবার সে চাকরি খোয়াতে চায় না। অতএব লাল কলমটা আবার তুলে নেয়, আর ঠিক তখনই দেখে, অদূরে ঈশ্বর। ঈশ্বরকে যেন আজ করুণ, ক্লান্ত মনে হয় তার। পেনটা নামিয়ে রেখে সে জিজ্ঞেস করে, হলটা কী? ঈশ্বর যেন কথা বলার মানুষ পেয়ে ঝলমল করে ওঠেন। বলেন, একটা কথা বললে বিশ্বাস করবে? জয়দেব জিজ্ঞাসু, তাকিয়ে থাকে। ঈশ্বর বলেন, দিনে অন্তত বার দুয়েক আমি মানুষ হয়ে উঠি, জানো?
এত অবাক জয়দেব সেদিন ঈশ্বরকে দেখেও হয়নি। তার মনে হয়, জীবনের সবথেকে আশ্চর্যের মুখোমুখি সে। আর কোনও আশ্চর্য না-দেখা জন্য তার কোনও খেদ নেই। ডাকলে ঈশ্বরের দেখা পাওয়া যায়, এ কথা সে ঢের শুনেছে। কিন্তু তাই বলে, ঈশ্বর আবার মানুষও হয়! সে তো শুনে এসেছে, মানুষ ভালো কাজ করলে নাকি ঈশ্বর হয়ে ওঠে। জয়দেবের চোখেমুখে অবিশ্বাস নেমে আসে। ঈশ্বর বুঝতে পেরে বলেন, ভেবে দেখো তো, যদি মানুষই না হব, তাহলে মানুষের দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ বুঝব কেমন করে! ব্যথা ভাগ করে নিলে তবে না সমব্যথী। দুঃখ নিজের করে না-নিতে পারলে কীসের আর দুঃখ লাঘব! জয়দেব তবু ভ্যাবাচাকা মুখে বসে থাকে। তার ঠোঁট দুটো ঈষৎ ফাঁক, খেয়াল নেই তার। একটু পরে সে ঢোঁক গিলে বলে, কিন্তু ঈশ্বর মানুষ হবেই-বা কেমন করে? ঈশ্বর মৃদু হেসে বলেন, সেভাবে তো আর আলাদা মানুষ হওয়া যায় না। প্রতিদিন কোনও কোনও মানুষের ভিতরই দু-দণ্ড করে জিরিয়ে নেন তিনি। জয়দেবের চোখে হঠাৎ আলো ঝিকিয়ে ওঠে। সে বলে, তাহলে তো মানুষ অনেক খারাপ কাজ করা থেকে রেহাই পেয়ে যাবে। যখনই কোনও মানুষ খারাপ কাজ করতে যাবে, ঈশ্বর তো অন্তর্যামী, যদি তখনই গিয়ে তার ভিতর থিতু হন, তাহলে আর সে নষ্ট কাজ করতেই পারবে না। ঈশ্বর এবার বিষণ্ণ, বলেন, তা হয় না। ঈশ্বরকে যখন মানুষ হতেই হয়, তখন মানুষের ভালো কাজেও ঈশ্বরকে থাকতে হয়, খারাপ কাজেও। মানুষই সব, তার বাইরে কিছু নেই, তবু সব মানুষের জন্য একজনকে ঈশ্বর হয়ে থাকতে হয়। সেই থাকা বড় কষ্টের। কিন্তু কী আর করা যাবে! মানুষের স্বপ্ন হয়ে বেঁচে থাকার ঝক্কি কি আর যেমন-তেমন হবে!
এইসব শুনেটুনে জয়দেবের হাত যেন আর সরে না। অনেকক্ষণ সে ঝুম মেরে বসে থাকে, আর ভাবে, যদি মানুষই সব হবে, তবে ঈশ্বরের থাকার দরকারটা কী! মুখে অবিশ্যি সে-কথা বলে না। কিন্তু ঈশ্বর সবই বোঝেন। বলেন, একজন ঈশ্বর না-থাকলে মানুষ কি আর মানুষ হয়ে থাকতে পারত! প্রত্যেকটা মানুষ তখন নিজেকে ঈশ্বর ভাবত। সে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা, দারুণ বিশৃঙখলা। মানুষ না-থাকলে ঈশ্বর নেই, ঈশ্বর না-থাকলে মানুষও নেই। বলে চলেন ঈশ্বর, মানুষ ঈশ্বর হতে পারুক বা না-পারুক, ঈশ্বরকে মানুষ হতে হয়-ই হয়। মানুষের প্রয়োজনে না হলেও, ঈশ্বরের প্রয়োজনেই।
জয়দেব আবার হাঁ করে সেইসব কথা ভাবতে থাকে। কখন যে ঈশ্বর চলে গিয়েছেন খেয়াল করে না। একসময় ঘুম এসে তার দু-চোখের পাতা টেনে ধরে। পরদিন যে তাকে প্রুফের জন্য অনেকগুলো কথা শুনতে হবে, ঈশ্বরও তাকে তার থেকে বাঁচাতে পারবে না, এসব জেনেও একসময় তবু সে ঘুমিয়ে পড়ে।
তিন
ঈশ্বরের কৃপায় কি-না কে জানে, চাকরিটা গেল না জয়দেবের। কথাও তেমন শুনতে হয়নি। বোধহয় সকলেই জানত যে, এক রাতের ভিতর অতবড় উপন্যাসের প্রুফ দেখা যায় না। এমনিই জয়দেবের উপর কয়েক কিলো বাটখারা যেন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
সে যাকগে, সেই রাতের পর থেকে জয়দেব বেশ ফুরফুরে থাকে। আজকাল একটু বেশিই লোকজনের সঙ্গে কথা বলে সে। তার মনে হয়, হতেও তো পারে, এই মুহূর্তে তার ভিতর ঈশ্বর বিশ্রাম নিচ্ছেন। কিংবা সামনের মানুষটার ভিতরও থাকতে পারেন। জয়দেবের মনে হতে থাকে, ঈশ্বর যেন একটা পার্টির মতো। অনেক আলাদা লোক, একে অন্যকে দেখে ঠিক যেমন চিনে যায়, যে, তারা এক পার্টির; সেইমতো কথাবার্তা বলে, ব্যবহার করে একে অন্যের সঙ্গে; ঠিক সেরকম মনে হচ্ছে ইদানীং জয়দেবের। নিজেকে তার মনে হচ্ছে ঈশ্বর পার্টির লোক।
সেদিন বাড়ি ফেরার সময় দ্যাখে, রাস্তায় জল জমা নিয়ে বেজায় ঝগড়া হচ্ছে। একটা ফচকে ছেলে বাইক নিয়ে সাঁ করে বেরোতে গেছে, আর জল ছিটকে একটা বাবু বাবু লোকের গায়ে পড়ে একেবারে কেলো। ফচকে বোঝায়, রাস্তায় জল জমলে সে কী করবে! বাবু বলে, জমা জলে একটু ধীরে বাইক চালাতে পারত না কি সে! আর জল নয় ছিটিয়েছে, একবার স্যরি তো বলতে পারত। জলে পা না-ঠেকিয়ে, একটু দূরে দাঁড়িয়ে অনেকগুলো লোক এই রগড় দেখছিল। আচমকা, জয়দেব গিয়ে বলল, দেখুন, যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে, আপনারা আর ঝগড়া করবেন না। ঈশ্বর আমাদের সবার ভিতর আছে,আপনাদের দুজনের ভিতরও আছে, চেয়ে দেখুন, চিনতে পারবেন। খামখা ঝগড়া করে ঈশ্বরকে কষ্ট দিচ্ছেন কেন!
ওরা দুজনেই কীরকম একটা আগুন-আগুন চোখে জয়দেবের দিকে তাকিয়ে দেখল, তারপর চলে গেল। ঝগড়াটা এই করে থামল যা হোক। জয়দেবের মনে হল, এরই ভিতর একবার যেন সে ঈশ্বরের হাসি দেখতে পেল, মাত্র এক ঝলক।
তারপর একদিন বাজারে দরাদরি, মাপামাপি নিয়ে ঝামেলার দিনও সে এগিয়ে গেল। বলল, ঈশ্বর কি চান, এই সামান্য জিনিস নিয়ে তোমরা তাকে বিব্রত করো! এরকম করতে নেই। লোকজন কেমন যেন হকচকিয়ে গেল তার কথা শুনে। জয়দেবের আত্মবিশ্বাস এতে আরও বেড়ে গেল। একদিন লোকাল ট্রেনের ঝগড়া সে এই করে থামিয়ে দিল। তারপর সেদিন রাস্তার মোড়ে একটা ছেলে, একটা মেয়েকে কী যেন একটা বাজে কথা বলেছে; সেই নিয়ে বেশ হইচই চলছে; আচমকা জয়দেব ছেলেটাকে গিয়ে বলল, আরে ভাই, ঈশ্বর কি একটা মেয়েকে বাজে কথা বলতে পারেন! ঈশ্বরের লোক তুমি, আর এই সামান্য কথাটা বুঝতে পারছ না। যাও, মেয়েটার কাছে ক্ষমা চেয়ে নাও। ছেলেটা, একটু বখাটে টাইপের, ভাবল, ঈশ্বর বুঝি কোনও বেপাড়ার দাদা। কে কার লোক, কোত্থেকে কী কীচাইন হবে তার ঠিক নেই, সে সোজা গিয়ে মেয়েটার কাছে ক্ষমা চাইল। মিটে গেল ঝামেলাটা। এত সহজে মিটল যে, সকলেই অবাক হল।
জয়দেবের এখন মাঝেমধ্যে মনে হয়, ঈশ্বর পার্টির লোক হয়ে সে বেশ ভালোই কাজ করছে। অবশ্য সে নিজে করছে, নাকি তার ভিতর ঈশ্বর বিশ্রাম নিতে এসে এসব করাচ্ছেন, কে জানে! তবে যতবার এরকম কিছু হয়, জয়দেব এক ঝলক যেন ঠিক দেখে ফেলে ঈশ্বরের হাসি। সে ভাবে, তার দায়িত্ব তবে আরও বাড়ল।
কাজের চাপও বেশ বেড়েছে। এখন প্রায়শই রাত জেগে প্রুফ দেখতে হয় জয়দেবকে। জয়দেব কাজ করে আর ভাবতে থাকে এরকমই কোনও এক রাতে ঈশ্বর আসবেন, আবার একদিন দেখা হবে। কিন্তু বহুদিন হল ওই একচিলতে হাসির আভা ছাড়া ঈশ্বরের সঙ্গে আর দেখা হয় না জয়দেবের। তা না হোক, ঈশ্বরের গোপন কথাটা সেই-ই তো সম্ভবত একা জানে। ফলত তার অনেক কাজ করার বাকি। এই ভেবে তড়িঘড়ি সে প্রুফ শেষ করার দিকে মন দেয়।
তন্ময় হয়ে কাজ করতে করতে সে-রাতে হঠাৎ জয়দেব শুনতে পায়, পাশের রাস্তায় কারা যেন কথা বলছে। এই রাতবিরেতে কেউ কি অসুস্থ হল! এমনিতে পাড়ায় একটু ঝামেলা চলছে। এক পার্টিরই দুই দল নাকি একে অন্যকে দেখলে কুকুরের মতো মারছে। বখরা-টখরা নিয়ে ঝামেলা। জয়দেব ভাবে, আরে পাগল, ওইসব দল করে কী হবে! যদি জানতিস যে, আসলে তোরা ঈশ্বর পার্টির ছেলে, তাহলে এত দ্বন্দ্বই থাকত না। ঈশ্বর কি বখরা চায়, নাকি বখরা না-পেলে অন্যকে ঠেঙায়! এই এত্ত সহজ কথাটা কেন যে এরা বোঝে না!
জানলা খুলে জয়দেব দেখে, ভালোই একটা গণ্ডগোল বেধেছে। একবার ভাবে, যা হচ্ছে হোক, সে তার হাতের কাজটুকু আগে শেষ করে তারপর উঠবে। তারপরই তার মনে হয়, এ কেমনধারা ভাবনাচিন্তা! ঈশ্বর পার্টির লোক সে, আর এখন হাত গুটিয়ে বসে থাকলে হয়!
পায়ে পায়ে ঘরের বাইরে, রাস্তায় নেমে এসে জয়দেব বোঝে, ঝামেলাটা ভালোই পাকিয়েছে। রাস্তার আলোগুলো কেন জ্বলছে না কে জানে! তার মধ্যেই ইট-পাটকেল ছুড়ছে বোধহয়! কাদের বাড়ির জানলার কাচ ভাঙার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আচমকা একটা কান ফাটানো আওয়াজ হল। বোমাবাজি হচ্ছে নাকি! জয়দেব ভাবে, শিগগির কিছু একটা করতে হবে। ঘরে ফিরে তো আর যাওয়া যায় না। বরং একটু এগিয়েই দেখা যাক, কোনোভাবে ঝামেলাটা মেটানো যায় কি-না। অন্ধকারের দিকে পা বাড়ায় জয়দেব।
রাস্তা ধরে আর একটু এগোতেই কারা যেন এসে তাকে হঠাৎ পিছন থেকে চ্যাংদোলা করে তুলে ধরল। জয়দেব যত বলে, ওরে আমি জয়দেব, তোরা আমায় কেন তুলে নিয়ে যাচ্ছিস, কে আর কার কথা শোনে! তখনও কাচ ভাঙার আওয়াজ। তখনও থেকে থেকেই কান ফাটানো শব্দ।
একটা জায়গায় কারুর বাড়ির জানলা গলে সামান্য একটু আলো এসে পড়েছিল, সেখানে তাকে নামাল ওরা। জয়দেব আবছা দেখেই বুঝল, এরা তো এপাড়ার ছেলে নয়! ওই জন্যই তাকে চিনতে পারেনি। এরা কারা তবে! ছেলেদুটো জিজ্ঞেস করল, বল শালা, কে পেট্রল এনেছিল? জয়দেব ভ্যাবলার মতো বলে, কীসের পেট্রল? ছেলেদুটো বলে, তা জানবি কেন! শালা, আমাদের এলাকায় গিয়ে আমাদের দাদাকে গুলি করে মেরে পেট্রল ঢেলে অফিস পুড়িয়ে দিচ্ছিল; আর তোমরা কিছু জানো না! ন্যাকাচোদা শালা… তুই কোন পার্টি বলতো? জয়দেব বলে, আমি ভাই সত্যি এসব কিছুই জানি না, আমি ঈশ্বর পার্টির লোক। তোমরাও ঈশ্বর পার্টির লোক।
এই শুনেই ছেলেদুটোর মুখ থেকে খিস্তি ছুটল। একজন বলল, ঈশ্বর মারাচ্ছে ঈশ্বর; অন্যজন বলল, এ মালটাকে আজ মেরেই ফেলব। একটা লাশ না পড়লে বাঞ্চোতগুলোর হুঁশ ফিরবে না। কার কত ক্ষমতা একবার দেখে নিক! ওপেন গুলি চালালে কী হয় বুঝুক শালা।
কার হুঁশ ফেরাতে কার লাশ কেন ফেলতে হবে, এসবের মাথামুন্ডু বুঝতে পারে না জয়দেব। একটু ভয় পেয়েছে সে। কিন্তু ভরসা একটাই, ঈশ্বর আছেন। হয়তো আশেপাশেই। জয়দেব তখনও ছেলেদুটোর মুখের উপর বলে চলেছে, আমি সত্যিই ঈশ্বরকে জানি। ঈশ্বর চায় না, কেউ কাউকে মারুক ধরুক। তোমরা আমার কথা একটাবার শোনো, তোমাদের এইসব হাঙ্গামা থেমে যাবে…।
তার ওইসব কথার ভিতরই একজন একটা আস্ত ইট হাতে করে তুলে আনে। আর একজন, যে জয়দেবের গদ্দান ধরে ছিল এতক্ষণ, সে এবার জয়দেবকে এক ধাক্কায় রাস্তায় ফেলে দিল। তারপর ইটটা তার সঙ্গীর থেকে চেয়ে নেয়। আস্ত ইটটা এখন ছেলেটার উঁচু করা হাতে, জয়দেবের থেকে অনেকটা উপরে, বাতাসে, যেন শূন্যে ভাসমান। যেন একটা অসম্ভবের সম্ভাবনায় ইটটাও ঈষৎ কাঁপছে। আর-একটু পরেই পরিণতি; ইটটা নেমে আসবে জয়দেবের খুলিতে। আর কী আশ্চর্য, ঠিক তখনই, ইট থেকে চোখ সরাতেই, ওই আবছা আলোয় অচেনা ছেলেটার ভিতর জয়দেব এক ঝলক দেখতে পেল তাঁকে।
করুণ, বিষণ্ণ, নিরুপায়, একাকী ঈশ্বরকে তখন যদিও আর সান্ত্বনা দেওয়ার সময়টুকুও ছিল না জয়দেবের হাতে।