গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস–“হেঁতালপারের উপাখ্যান(১৭তম পর্ব)”

পরিচিতিঃ ১৯৮৩ এর ১৫ই জুন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপ বড়রাক্ষসখালিতে জন্ম। জল জঙ্গলে বড় হয়ে ওঠা। বর্তমানে দক্ষিণ২৪ পরগণার কাকদ্বীপের একটি বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। কবিতার নিয়মিত লেখক নয়।বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস “হেঁতালপারের উপাখ্যান“-র ১৭তম পর্ব

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস

হেঁতালপারের উপাখ্যান(১৭তম পর্ব)

সে ও তারা

“জান দি দি হুয়ি উসি কি থি/হক তো য়ে হ্যায় কি হক আদা না হুয়া”- গালিব

(যে জীবন দিলাম তোমায় সে তো তোমারই দেওয়া/আসল কথা এই,তোমাকে কিছুই দেওয়া হলো না)

মানুষের বোধ আর উপলব্ধি আসে ঘাস পাথর মাটি নদী সাগর আর এই বিশাল চরাচরে যে অগুনতি মানুষ আছে, সেসব দেখেশুনে। বিচারবোধে তারতম্য ঘটে সে তার নিজস্ব দর্শনের জন্য, কিংবা কোনো দর্শন না থাকার জন্য। প্রত্যেক মানুষের জীবনে অসংখ্য দার্শনিক ধারণার প্রত্যয় ঘটে একেক সময়। যতক্ষণ না সে সঠিক দিশা পায়, ততক্ষণই সে দিশাহীন, হালহীন নৌকার মতো একবার সামনে, একবার পিছনে যেতে থাকে।

আমার এই ত্রিশোর্দ্ধ জীবনে এসে এখন মনে হয়, আমি যে দ্বীপের, যে মহল্লার বাঁচা মরা, জীবন যৌবন, জীবনহানি যৌবনের ক্ষয় নিয়ে লিখতে বসেছি তা যথার্থ আরশির মতো হয়ে উঠবে না কোনোকালে। আপনি আমি তাজমহল নিয়ে যতখানি আবেগাপ্লুত,  তার চে’ বেশি অশ্রুর, বেশি আবেগের দাবী হয়তো রাখতে পারে একটা হাড়হাভাতে দ্বীপের নিখুঁত ইতিহাস যা একজন যথার্থ শিল্পীর হাতে ত্রুটিহীন বুনোটের অক্ষর সমাবেশের মতো। যা নিখুঁত শিক্ষিত সন তারিখ ও মুহুর্তের ক্ষমাহীন দিনপঞ্জিকা দিয়ে সাজানো। কোনো লেখকই তা করে উঠবার ক্ষমতা দেখাতে চাননি, তার প্রয়োজনও হয়তো নেই। কোনো ইতিহাসবিদ কখনো রক্ত কলমে লিখবেন না এই দীন হীন ভিক্ষুক দ্বীপের কোনো শাহজাহান আর মমতাজমহলকে নিয়ে, কোনো বিজ্ঞানী তাঁর নিজস্ব গবেষনাগারে পরীক্ষা করে দেখবেন না, কতগুলো আরজুমান বানু বেগম মমতাজ হয়ে উঠতে পারেনি।

জীবন মানে এক ওডিসি। একটা দীর্ঘ যাত্রা। এই যাত্রা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আরো দীর্ঘ হয়ে উঠে তার কাছে যার বাঁচা আর মরার মধ্যে একটা সরু লক্ষ্মণরেখা পেণ্ডুলামের মতো দুলতে থাকে অথচ কখনো ধপ করে পড়ে যায় না মাটিতে। আমরা সেই দীর্ঘ জীবনকে একটা টেবিলে বসিয়ে দিয়ে আসুন চারদিক থেকে দেখি, দেখি কেমন করে আয়ু কমতে কমতেও জীবন একটা ভারবাহি দীর্ঘ পথ হয়ে উঠে। সে পথে কখনো কোথাও গোলাপ ফুটেছিল কি না। সে গোলাপ কখনো কেউ কাঁটাসুদ্ধ তুলে রেখেছিল কি না ছেঁড়া বাম পকেটে, সে পকেট হয়তো গোলাপের ভার নিতে পারেনি আর মাঝ পথেই পাহাড়ের মতো ধ্বসে পড়েছে বুকের বাম দিক হতে।

জীবন এখানে একটা নৌকার মতো, যা নিরন্তর হাত বদল হয়, অথচ পৌঁছাতে পারে না অভীষ্ট ওপারের জংগলের কোনো একটা কাঙ্খিত চোরা খালে। ঝড় আসে, ঢেউ উঠে, মাতাল হয় গাঙ, কিন্তু তবুও ভাঙা নৌকার ছেঁড়া পাটাতন নিয়ে সমস্ত বুদবুদের উপর দিয়ে দু একটা নৌকা পৌঁছায়, জানি না যখন পৌঁছায় তখন তার আদৌ পৌঁছানো দরকার ছিল কি না। এ বিচার আপনিই করুন, আপনার নিজস্ব দর্শনের পর্দায় ফেলে দেখে নিন আপনি।

অর্ধেক গাঙ পেরিয়েছে নৌকাটা। একেকটা বসন্ত আসে যায়, মানুষ হিসাব রাখে না, কিন্তু গাঙ রাখে। আবার একটা বসন্ত এসেছে ঘুরে ফিরে। নৌকার পিছনে বৈঠা ধরে বসে আছে একজন লোক। গলুই এর কাছে একজন মহিলা। দাঁড় টানছে না। এমনিই বসে আছে। চন্দ্রানীর ঘাটে বুড়ো কৃষ্ণচূড়া গাছ ফুলে লাল হয়ে উঠেছে। গাছের তলায় একটা ফুলেল কার্পেট পেতে রেখেছে যেন কেউ। আমি সন্ন্যাসী সৈনিকের মতো বসে আছি সেই কার্পেটের উপর। নৌকাটা আরো এগিয়ে আসে। আমি চোখ তুলে দেখি শ্রীকান্তদা আর চঞ্চলী বৌদি। সচকিত হয়ে উঠি। দেখলুম মধু ভাঙতে গেছিল। বড় একখানা হাঁড়ি নৌকার খোলে। হাঁড়ির মুখটা দেখা যাচ্ছে বাইরে থেকে। নৌকাটা ধীরে ধীরে ঘাটে এসে লাগে। আমাকে চঞ্চলী বৌদি দেখতে পেয়েই হেসে জিজ্ঞেস করে ” অপু, কবি আসসো? ভালো আছ, ভাই?”

হঁ,  তুমি কির্কম আছ বৌদি?

আমার… এই আছি আর কি! চলযাটে কুনরকম।

অহ,

নৌকা ঘাটের একটা বানি গাছে বাঁধছিল শ্রীকান্তদা। চঞ্চলী বৌদি হাঁড়ি বার করছিল খোল থেকে, পারছিল না। শরীর অনেক ভেঙে গেছে, হাতে পায়ে আর সে বল নেই বোঝা যাচ্ছিল। আমি সহসা বল্লেম

” আমি যাবো বৌদি? ”

নৌকা বাঁধতে বাঁধতে এক গাল হেসে শ্রীকান্তদা বল্লে ” নারে কচি, আমার হোইচে, তুই বুস। আমি লাবি লেইটি”

শ্রীকান্তদা নৌকা বেঁধে হাঁড়ি নামিয়ে আনে।  একাই ধরে বাঁধের নীচ হতে উপরে বয়ে নিয়ে এসে আমার সামনে রাখে।

আমি হাঁড়ির মুখ থেকে থালা সরিয়ে দেখি ভিতরে হাঁড়ির গলা অব্দি মধু। মধুর উপরে সদ্য ভাঙা চাকের কাঁদা ভেসে আছে। শ্রীকান্তদা কাঁদাগুলো হাত দিয়ে তুলে থালায় রাখে, তার পর সেগুলো ভালো ক’রে নিঙড়ে নিয়ে উল্টোদিকের খালে ছুঁড়ে দিয়ে বলে ” আমান্নে টকাবেয়া অউ মোম গা গয়িয়া পিফা গাছে ডায়ে সুতা ঢুকি দিয়া মোমবাতি করতি, মনে আছে কচি?” একটা সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম। মনে পড়ল সেই ছোট বেলার কথা। কালী পূজার মাসখানেক আগে মনি জ্যাঠা বলত, ” আর দুটা কটাল বাকী আছে রে টকামনে। পোদীপ তৈরি কর, মোমবাতি তৈরি কর।” আমরা, বাচ্চারা কাদা মাটি পুকুর বা খাল থেকে তুলে পেল্লাই সাইজের একেকটা প্রদীপ বানাতুম। একেকজন বিশ পঁচিশটা ক’রে। তারপর সেগুলো রোদে শুকোতে দিতুম প্রত্যেকদিন। আর মধু যারা ভাঙতে যেত তাদের ঘরে সের সের মোম থাকতো। চাইতে গেলেই দিয়ে দিত। পেপে ডাল ভেঙে কাদার উপর বসিয়ে দিতুম,  ডালের ভিতরের ফাঁপা জায়গায় একটা সুতো দিয়ে দিতুম, তারপর লম্ফ জ্বেলে ঝিনুকে করে মোম গলিয়ে ঢেলে দিতুম পেপে ডালের ভিতরে। ঠাণ্ডা হয়ে গেলেই ডাল ভেঙে বের করে আনতুম মোমবাতি।  কালী পূজার রাত্রে প্রদীপ জ্বালাতুম পোড়া মোবিল দিয়ে। তখনকার দিনে ঘাটে যেসব ট্রলার আসত, তাদের কাছে গিয়ে চাইলেই পোড়া মোবিল দিয়ে দিত। কালী পূজার রাত্রে আমাদের প্রদীপ আর মোমবাতি জ্বালাতে গিয়ে গা হাত পায় মোবিল প’ড়ে কালো ভুত হয়ে যেতুম। কখনো কখনো লাঠির আগায় ছেঁড়া কাপড় বেঁধে মোবিলে ভিজিয়ে মশাল জ্বেলে সারা রাস্তায় দৌড়াতুম আর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সুর করে গাইতুম,

“ধারে মশা ধা

ল’ বঁ কে যা

লয়ের চঙা পঙায় লিয়া

স্বর্গে উঠিয়া যা

স্বর্গনু নামিয়াইসিয়া

পর্ধান হারে বুড়ির পঁদ খুইয়া খা”

বাঁধের ধারে একটা দোচালায় একা বুড়ি পরমেশ্বরী থাকত। জন্ম ইস্তক তার তিনকূলে কাউকে দেখিনি। সে একটু ক্ষ্যাপাটে বুড়ি ছিল। গিরা শাকের তরকারি রান্না করলে যেন সুধা মনে হোত। কতদিন চুরি করে খেয়েছি তার কড়াইর তরকারি তার ইয়ত্তা নেই, আবার এই জন্য মা’র হাতে মারও খেয়েছি অগুনতিবার। সেই বুড়ি রে রে করে দৌড়ে বেরিয়ে আসত ঘর থেকে।

কুন অলাউঠা রে

নামাঙিয়ার ব্যাটা নামাঙিয়ামনে দাঁড়া।

নির্বংশ হ, সয়ার ব্যাটা সয়া মনে।

আমরা দৌড়ে পালাতুম। আবার কিছু সময় পর এসে আবার শুরু করতুম –

ধা রে মশা ধা…

শেষ অব্দি মায়ের লাঠি পিঠে পড়তোই।

 

কচি একটু মধু খা।

এই কচি

আমাকে আনমনা দেখে শ্রীকান্তদা আবার ডাকে

এই কচি ই ই

আমি দড়াম করে মনে হয় অগোছালো শৈশব থেকে নির্মম চন্দ্রানীর ঘাটে ধপাস করে পড়ে যাই।

কও, কী

একটু মধু খা কচি

থালায় করে পোয়াখানে মধু গড়িয়ে দেয় শ্রীকান্তদা।

অতটা?

হঁ খা না কচি।

আমি চঞ্চলী বৌদির দিকে তাকাই। পরম মমতায় আমার দিকে তাকিয়ে আছে সে। ঈষৎ ঠোঁট কাঁপে তার। তার পর বলে

খাওনা ভাই, কদ্দিন দেখিনি তুমাকে।

ফ্যাচ করে কেঁদে ফেলে। আমি কী করবো ভেবে পাই না। আমি জানি কেন কাঁদছে বৌদি। আমার এখানে নিঃসঙ্গ একা বসে থাকার কথা নয়। আমার পাশে যার বসে থাকার কথা তার পাশে বসার মতো যোগ্যতা এ পৃথিবীর খুব কম লোকের আছে। আমি কখনো দেবতার অস্তিত্ব বিশ্বাস করিনি, কিন্তু আমরা যারা কথায় কথায় এখন বলি পৃথিবী মানুষশূন্য হয়ে গেছে তাদেরকে অনেক আগেই সে ভুল প্রমান ক’রে দেখিয়ে দিয়েছিল পৃথিবীতে মানুষ না থাক, দেবতা আছেই।

কাঁদনি বৌদি

হঁ, কাঁদিয়া কী হবে? আমানকের কান্না কে শুঁউবে! চোখ মুছতে মুছতে চঞ্চলী বৌদি বলে।

আমি মধু খাচ্ছি থালায় মুখ লাগিয়ে। ঠিক সন্তানকে খাওয়ানোর সময় যে তৃপ্তিমাখা দৃষ্টি নিয়ে বাপ মা সন্তানকে দেখে, তেমনভাবে আমার দিকে চেয়ে আছে শ্রীকান্তদা আর চঞ্চলী বৌদি।

থালার মধু শেষ করে থালা রেখে দেই মাটতে। বৌদি থালায় লেগে থাকা মধুর ঘন আস্তরণ আঙ্গুল দিয়ে মুছে মুছে চেটে নিচ্ছে।

বৌদি

হঁ কও

এ লৌকা কার?

আমি আর ঝন্টু যৌটা চালিতি।

দিয়া দিচে ভানু বাগ?

হঁ

সব শোধ হইতল?

না

তা’লে?

শোধ কুনদিন হইতনি গো ভাই

মানে?

অলাউঠার কাছে কত দিন কাজ করলি, আমাকে চুঁষিয়া খাইচে…

বৌদির চোখে আবার জল। চেয়ে দেখলুম এ চোখের কোটরে অনেক জল এখনো জমে আছে। জল মানায় ভাল হয়তো এই চোখে।

চোখ মুছতে মুছতে বল্লে,  অলাউঠার ব্যাটা অতদিন পরে কয় কি, সুদের টাকা সবে শোধ হইচে।

শ্লা শুয়ারের বাচ্চা। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

তারপর অউ শ্রীকান্ত টাকা দিয়া লৌকা ছাড়িছে। এখঁ শ্রীকান্তকে লিয়া লৌকা বাই। দুটা পেট আছে ঘরে, একটা টকা, একটা বুড়া, আমি যে কী করিয়া চালাইছি অদ্দিন শুধু ভগবান জাঁয়ে।

সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে তখন। অস্তগামী সূর্য যেন অস্ত যাওয়ার আগে সমস্ত রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছে বসন্তে গাঙে। দূরে একটা বকের সারি আকাশের দিগন্তরেখা ধরে লুথিয়ানের দিকে চলে যাচ্ছে। একটা হলকা হাওয়ায় কয়েকটা কৃষ্ণচূড়া ফুল এসে পড়ল গায়ে।

শ্রীকান্তদা।

হুম।

একটা ভাল কাজ করচ তুমি।

কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ে গেল শ্রীকান্তদার। তারপর ঈষৎ ঠোঁটের ফাঁক থেকে বেরিয়ে এল,

জাঁউ তো, আমাকে আর বৌদিকে লিয়া কতকি হ’টে?

কী হ’টে?

লোক কয় আমি বৌদির সংগে আছি।

আর বৌদিকে তো খানকি, বেশ্যা যে যা পারে কয়।

ওহ।

লৌকাটা ছাড়িচি বলিয়া ভানু বাগের রাগ বাড়িচে, লোক লাগি দিছে।

ওহ।

লোক নাকি ঘুরেটে আমানকে ধরবে বলিয়া।

আমি নাকি বৌদির কাছে শুই।

বল্লেম,  শ্লা খানকির ব্যাটারা বৌদির খবর লিচে কুনদিন? একটা পাগলা লোক আর একটা পাগলির বাচ্চা লিয়া একটা ম্বায়া লোক অদ্দিন কুত্তাছানা হইতল কারুর লজরে পড়েনি? শ্লা, শুয়ার বাচ্চা সব।

শ্লা, কুত্তার বাচ্চাগুয়া জাঁয়েনি পাগলি কার বাচ্চা পেটে লিয়া ঘুরতল? জাঁয়েনি বৌদিকে ছিঁড়িয়া ছিঁড়িয়া খাইতল?

গালে হাত,  বুকের গভীর থেকে একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল শ্রীকান্তদার। বল্লে, জাঁউ তো কচি, যার টাকা তারুর হয়া সব লোক কয়। ন্যায় অন্যাই বলিয়া কিছু নেইরে। ক্ষমতা যার আছে তার সব কিছু ন্যাই। আমার বুকের ভিতর একটা ঘন্টা বেজে গেল ঢং করে। এই একই কথা আমি আগেও শুনেছি, অন্য কারুর মুখে।

কচি রে।

হঁ কও

তুই তো বোড় হইচু?

ইয়ে..

মন্টু সাউ আমাকে একটা কথা কইচে। কইচে, যদি চঞ্চলীর পাশে দাঁড়াইতে চাউ তা’লে অকে ব্যা কর। কউ কিছু কইলে আমি আছি। শ্লাদের খুব বাড় বাড়চে। মন্টু সাউ ঠিক কথা কইচে। আমি ঠিক করচি আমি ব্যা হবো। কিন্তু বৌদি…

হতাশা একটা সমুদ্র বই কিছুই নয়। আমি ডুবতে বসেছিলুম সেই গহীন সমুদ্রে। মনে হোল কেউ হাত ধরে তুলে আনছে আমাকে। এখনো সব শেষ হয়ে যায়নি তাহলে। এখনো পৃথিবী ঘুরছে। এখনো হাত ধরার মতো লোক আছে। চন্দ্রানীদের মৃত্যু কখনো শেষ কথা নয়, হতেও পারে না। এখনো উষর মরু প্রান্তরে জলসত্র খুলে দাঁড়িয়ে থাকে কোনো ছন্নছাড়া, এখনো যুদ্ধের দিনে লক্ষ লক্ষ ওক গাছ লাগিয়ে সবুজে সবুজ করে দেয় কোনো কোনো ভেলান।

কীরে কিছু কইলুনি?

বৌদি?

কচি ভাই, কী করিয়া করি কওতো? আমি তো একটা মায়ুঁষ। আমি কি করিয়া পারবো কও?

পারতে হবে বৌদি। তুমার জন্য নেই হউ, তুমার ব্যাটা?

আমি ঝন্টুকে খুব ভালবাসতি।

জাঁই।

সে যে কাই চলিয়াল…

বৌদি।

কও।

তুমি রাজি হয়া যাও।

না গো ভাই।

কেনি?

আমি পারবোনি।

কেনি?

দুটা দুটা মায়ুঁশ জীবননু হারিচে আমার।

তবুও তুমার রাজি হওয়া দরকার বৌদি।

কিন্তু…

শ্রীকান্তকে আমি সের্কমভাবে কুনদিন দেখিনি। ও আমার চে ছোট।

শ্রীকান্তদা ফুঁসে উঠল। এই ছোট বোড়োর নিয়মও অই চুদিরভাই ভানু বাগের মতো লোকগুয়া করচে। এগা নেই করলে ম্বায়ালোকের উপরে ওত্যাচার করবে কী করিয়া!

ঠিক কথা গো বৌদি।

এই নিয়মগুয়া ভানু বাগের মতো লোকেদের সুবিধার জন্যে।

জাঁউ তো কচি, আমি বৌদিকে কইচি, আমাকে বিশ্বাস করো, আমি কুনদিন তুমার কাছে শুবনি। তুমি যেমনটা কইব তেমনটা হবে। ব্যা মানে একটা পরিচয়। তখঁ কুন চুদিরভাই কিচু কইলে তার বাপের নাম ভুলি দুবো আমি।

সূর্য ডুবে গেছে পশ্চিমের জংগলে। হাওয়া ছেড়েছে আগের চে’ জোরে। পশ্চিমের আকাশ এখনো লাল। যেন সূর্য ডুবে যাওয়া মানেই শেষ নয়, কিছুটা রঙ আছে এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সে রঙ হয়তো শেষের নয়, বরং আগামীর নতুন সূর্যের উদয়ের খবর। একটা নৌকা চলে যাচ্ছে লুথিয়ানের দিকে। ছপাস ছপাস করে বৈঠার শব্দ উঠছে। শেয়াল ডাকছে ওপারে। আমার দু’পাশে দু’ জন বসে আছে বিচারপ্রার্থীর মতো, মাঝখানে অক্ষম বিচারক। বাম হাতে শ্রীকান্তদার হাত ধরলাম, ডান হাতে বৌদির। আবছায়া অন্ধকারে মিলিয়ে দিলাম দুটো হাত। বল্লুম, বাকীটা কাল সকালেই মন্টু সাউর বনবিবির থানে হবে।

দুটো মূর্তি চলে গেল খাস খালের রাস্তা ধরে। অন্ধকারে মুখোমুখি আমি আর চন্দ্রানীর ঘাট।

ক্রমশঃ…

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস– “হেঁতালপারের উপাখ্যান”(১৬তম পর্ব)

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *