ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস–“চোরাবালি”(পর্ব-১৭)

পরিচিতিঃ ইন্দ্রনীল বক্সী, “জন্ম – নকশাল পিরিয়ডে ..৭৩ এ দুর্গাপুরে , উচ্চতা মাঝারি, গায়ের রঙ মাজা, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল টাইপ। লিখছি সেই কিশোরবেলা থেকে, দুর্গাপুর বেলা থেকে বর্তমান নিবাস – বর্ধমান। কি লিখছি ছাই নিজে তো জানিই না অন্যরাও জানে বলে মনে হয় না। হাবিজাবি করে চারটি বই প্রকাশিত।” বাইফোকালিজম্-এ তাঁর আজ ধারাবাহিক উপন্যাস ‘চোরাবালি‘-র ১৭তম পর্ব

ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস

চোরাবালি(পর্ব-১৭)

হাইওয়ে পেট্রোলিং এর গাড়িটা ধীরে বাঁধের উপর দিয়ে অন্ধকার ভেঙে এগিয়ে চলেছে ইদিলপুর ইরিগেশন বাংলোটা পেরিয়ে। আধো অন্ধকারে প্রকান্ড দামোদর শুয়ে আছে চাঁদের আলো বুকে নিয়ে। বালির চর পেরিয়ে স্রোতের ধীরেসুস্থে বয়ে চলা জলের রেখা দেখা যাচ্ছে মৃয়মান জোৎস্নায়। বাঁধের ডানদিকে বসতি, আধপাকা বাড়ি কিছু, বাড়ি যেমনি হোক চালে মাঝে মধ্যেই একটা করে ডিশ এন্টেনা দেখা যাচ্ছে।
গাড়িটা বাঁধের অসমান রাস্তা হেলতে দুলতে পার করে কাঠগোলা ঘাটে এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে নেমে এলো তাপস খাঁ।
গদাই ঘোষের অনুরোধ একরকম আদেশের মতোই একথা তাপস খাঁ জানে, ফোন যে আসতে পারে সে আন্দাজ ছিলোই! তাছাড়া ফোন তো আসতেই হবে, তা নাহলে কিছুদিন অন্তর দর কসাকসিটা ঝালিয়ে নেওয়া যাবে না যে! বাড়তি শখ আলহাদ, ছেলের ম্যানেজমেন্ট কোটায় অ্যাডমিশন, রেনেঁশায় বাংলো, এসব কি আর এই মেজোবাবু হয়ে পারা যায়! গদাই ঘোষেদের কল্যাণ্যেই তো জীবন জবজবে ঘিয়ে ডুবে রয়েছে। তবে একথা মানতে হবে গদাই ঘোষ আপ্যায়ন করতে জানে! রেলপাড়ের খোকোন বা সুরিন্দরের মতো নয়!

গাড়ি থেকে নেমে জামাটা ঠিক করে কোমড়ের বেল্টটা ঠিক করতে করতে একটা প্রশান্তির হাসি খেলে যায় তাপস খাঁয়ের মুখে, আধো অন্ধকারে ড্রাইভারও লক্ষ্য করতে পারে না। সাবধানে বাঁধের ঢাল বেয়ে নামতে নামতে রুমাল বার করে নাকে চাপা দেয় তাপস খাঁ। বড্ড দুর্গন্ধ… একটু দুরেই গদাই ঘোষের ঘাট অফিসের আলো দেখা যাচ্ছে।

“আরে আসুন আসুন স্যার …” গদাই ঘোষ একমনে পেপার পড়তে পড়তে একবার করে বাঁধের দিকে দেখে নিচ্ছিল কোনো গাড়ি এসে দাঁড়ালো কিনা। একটা গাড়ি এসে আলো নিভিয়ে দাঁড়াতেই বুঝে গেছিলো যে তাপস খাঁয়ের গাড়ি এসেছে। এখানে তাপস খাঁ নতুন আসছে না! এর আগে অনেকবারই এসেছে।
বুধুয়াকে ইসারা করতেই একটা চেয়ার এগিয়ে দেয়, তাপস খাঁ ভারী শরীরটা নিয়ে ধপ করে বসে পড়ে একটু নড়ে দেখে নেয় চেয়ারটা মজবুত কিনা! মুখে বিগলিত হাসি ঝুলিয়ে একবার পকেটের মোবাইলটা বের করে দেখে নেয় শুধু।
“তারপর দাদা …কেমন আছেন বলুন!… কি সেবায় তলব করেছেন?” তাপস খাঁ মুখে হাসি ঝুলিয়েই বলে ওঠে।
“বলছি… একটু চা হোক… বুধুয়া…”
“কি স্যার এই ভর সন্ধ্যে বেলা চা বলছেন!”
“ওঃ… তাহলে এখনি ঢালি একটু!”
“হ্যাঁ স্যার… এই অল্প করে হেঁ হেঁ… বুঝতেই পারছেন ডিউটিতে আছি…”
“বুধুয়া দুটো কাঁচের গেলাস দে… আর চিকেন ফ্রাইয়ের প্যাকেটা প্লেটে ঢেলে নিয়ে আয়…”
বুধুয়া যেন আগে থেকে সব জানে! এত দিনের অভ্যাসে ও ঠিক বোঝে কোন অতিথির জন্য কি ব্যাবস্থা করতে হবে। কথা শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কাঁচের গ্লাস আর প্লেটে করে চিকেন ফ্রাই এসে যায় সামনের ছোটো টেবলটায়। গদাই ঘোষ চিভাস রিগালের সীল কেটে একটা বড় পেগ ঢেলে দেয় তাপস খাঁই-র গেলাসে, নিজের গেলাসে পরিমানে নিতান্তই অল্প নিয়ে ঢেলে জল ঢালে প্রয়োজন মতো। তাপস বাবু আবার সোডা ছাড়া খান না তাই তার জন্য সোডা আনানোই ছিলো।
“চিয়ার্স … বলুন কি সমস্যা“ আঙ্গুল গ্লাসে ডুবিয়ে তিনবার ছিটিয়ে বলে ওঠে তাপস খাঁ।
“আগে বলুন ছেলের কোন ইয়ার হলো?”
“আরে দাদা এই তো সেকেন্ড ইয়ার… আরও কয়েকবছর , তারপর আবার ইন্টার্ণশিপ …”
“হুম … তা ডাক্তারের বাবা হতে গেলে তো একটু ধৈর্য্য ধরতেই হবে!”
“বলুন কি হয়েছে …”
“সমস্যা অনেক গুলো… যেমন সুরিন্দার বাড়াবাড়ি করছে , আমার লোকেদের মেশিন দেখিয়েছে ঝুঝুটির দিকে, এম ভি গাড়ি আটকাচ্ছে… দিনের বেলা লাশ পড়ছে ! বলছি হচ্ছেটা কি?”
“আরে ! ওটা কি আপনার লোক ছিলো নাকি?…আমি তো জানি…” মুখের কাছে নিয়ে গিয়েও নামিয়ে নেয় তাপস খাঁ গেলাসটা।
“না , আমার লোক নয়… আমার লোক হলে এ কদিনে আর একটা লাশ পেতেন আপনারা” গদাই ঘোষের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। তাপস খাঁও একটু দমে যায়, সে বিলক্ষন জানে গদাই ঘোষ কি কঠিন লোক! এমনিতে উটকো ঝুট ঝামেলায় থাকেনা, কিন্তু ল্যাজে পা পড়লে ঘুরিয়ে ছোবল দিতে সময় নেবে না!
“হ্যাঁ সেই তো … ওটা শুনলাম অন্য কেস, আপনাদের লাইনের নয়…”
“হুম …গাঁজা কেস, আমার কাছে খবর আছে ওটা সুরিন্দর উড়িয়েছে…ও আবার এসব লাইনেও আছে জানতাম না!”
“সেকি দাদা… আমাদের কাছে তো খবর নেই !”
“তাপস বাবু, আপনাদের কাছে খবর নেই তা হয়! আমিও জানি আর আপনিও, সেটিং শুধু আমার চলে এ এলাকায় তা তো নয় …ছাড়ুন। ওসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না, কিন্তু আমার রাস্তা কাটা হচ্ছে কেন এটাই আমার কথা!”
“না না এসব তো ঠিক নয় …এলাকা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে, বি এল আর ও, থানা সবাই মিলে আবার এসব হুজ্জুতি তো ঠিক নয়!” বেশ একটা বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে গেলাসের বাকিটুকু গলাধঃকরণ করে বলে ওঠে তাপস খাঁ। চিকেনের একটা পিস তুলে সামনের দাঁত দিয়ে ছিঁড়তে থাকে।
“ঠিক তো নয়ই! সুস্থ ভাবে সব কিছু চললেই হলো … অশান্তি হলে খবর হবে আর খবর হলে সবার অসুবিধা”
“আমায় কি করতে বলছেন?”
“দেখুন সুরিন্দার এখন পলিটিক্যাল সাপোর্টে লাফাচ্ছে… লোডিং দেখছে ওর লোকাল নেতা , ভাবছে পাল্লা থেকে শিল্ল্যা অবধি গোটা দামোদর ওর জমিদারি! ওকে বোঝান …লিমিটে থাকতে”
“স্যার বোঝাই নি এমন নয়, আমাদের কি বলুন তো! খুব জ্বালা …সবদিক থেকে প্রেশার। কিন্তু ব্যাটার খিদে একটু বেশি …বড্ড একগুঁইয়ে টাইপ!”
“ব্যবসায় গোঁওয়ারতুমি চলে না …তাতে আপনাদের আমার আর ওরও ক্ষতি…”
“ঠিক আছে আমি কথা বলছি …আর!”
“এম ভি আমার গাড়ি আটকেছে! কে একজন নাকি নতুন অফিসার এসেছে …সে নাকি খুব কড়া!” বলতে বলতে চেয়ারে একটু পিঠটা এলিয়ে বসে গদাই ঘোষ , মুখে একটু হালকা হাসি খেলে যায়।
“হ্যাঁ দাদা আমিও শুনেছি… আপনার গাড়ি আটকায় এত সাহস!”
“জানেনই তো কড়া অফিসারের অনেকটা নতুন মাড় দেওয়া পাঞ্জাবীর মতো ! প্রথম প্রথম খুব কড়কড় করে… তা ভালো করে জানুন মাড় ভাঙতে কি চাইছে!”
“এটা দাদা এম ভির ব্যাপার, থানার হলে আমি দেখে নিতাম ”
“হবে হবে …খাঁকিই তো! আপনার জাতের, ঠিক কানেকশান হয়ে যাবে। বসান আমার সাথে , বাকিটা বুঝে নেব। নতুন পোস্টিং তাই নিজের লোক পাঠাচ্ছি না। আগে ধাত বুঝতে হবে ।”
“ঠিক আছে দাদা দেখছি …এই লাস্ট …আর ডালবেন না …ডিউটিতে আছি “
“সেকি! …সে ঠিক আছে, তাহলে এটা নিয়ে যান আমার আর কি কাজে লাগবে!”
তাপস খাঁ চিভাস রিগালের অর্ধেকের বেশি তরলসহ বোতলটা থলিতে ভরে নেয় নির্দ্বিধায়। গদাই ঘোষ জানে কার কি ধাত্, তাই বড় বোতলই আনিয়ে রেখেছিল। পকেট থেকে একটা মোটা খাম বের করে টেবলে নামিয়ে রাখতেই সেটিও তুলে নেয় তাপস খাঁ। শুধু যে স্কচে পেট ভরবে না সেটাও জানা গদাই ঘোষের।
“বেশ তাহলে আজ উঠলাম, আমি দেখছি দাদা সাধ্য মতো …আপনার কথা কোনোদিন ফেলেছি বলুন!”
“বেশ দেখুন …দরকার হলে একটা ফোন লাগাবেন ”গদাই ঘোষ উঠে অফিসের দরজা অবধি এগিয়ে দেয় তাপস খাঁকে। বুধুয়া একটা টর্চ নিয়ে চরে উপর দিয়ে পথ দেখিয়ে তাপস খাঁর সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে।

গদাই ঘোষ বাঁধের অন্ধকারে বুধুয়ার টর্চের আলোটা নড়তে নড়তে বাঁধের উপরে উঠছে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবতে থাকে এবার কি! এতে কাজ না হলে কি করা যাবে?
বাইরে চাঁদের আলোয় নিঝুম হয়ে থাকা চরের বাতাসে এক এক সময় ঠান্ডা একটা বাতাস এসে ঘাট অফিসের জানালার পাল্লাটাকে নড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে মাঝে মধ্যে। রাত একটু হয়েছে এবার বাড়ি যেতে হবে! রমেশ গাড়িতেই বসে আছে গদাই ঘোষের অপেক্ষায়। বিহারী পট্টি থেকে খোল,খঞ্জনি সহকারে সমবেত গানের আওয়াজ ভেসে আসছে। সারাদিন হাড় খাটুনির পর এ একটা বিনোদনের নিজস্ব ব্যবস্থা।

ক্রমশ

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন–

 

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *