গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস– হেঁতালপারের উপাখ্যান(১৪তম পর্ব)

পরিচিতিঃ ১৯৮৩ এর ১৫ই জুন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপ বড়রাক্ষসখালিতে জন্ম। জল জঙ্গলে বড় হয়ে ওঠা। বর্তমানে দক্ষিণ২৪ পরগণার কাকদ্বীপের একটি বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। কবিতার নিয়মিত লেখক নয়।বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস “হেঁতালপারের উপাখ্যান“-র ১৩তম পর্ব

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস

হেঁতালপারের উপাখ্যান(১৪তম পর্ব)

সে ও তারা

“Whether at Naishapur or Babylon/Whether the Cup with sweet or bitter run,/The Wine of Life keeps oozing drop by drop,/The Leaves of Life keep falling one by one” – O. Khayyam (Rubaiyat viii)

বুড়ো মনি মণ্ডলের বিশ্রাম নেই। দু’বেলা নিয়ম করে চন্দ্রানীর ঘাটে এসে বসে থাকে সে। এখানে যে ক’টা ঘাট আছে তাদের মধ্যে চন্দ্রানীর ঘাট প্রায় সারাক্ষণ ফাঁকা থাকে। নৌকা প্রায় লাগে না বল্লেই চলে। অমন অলুক্ষণে ঘাটে কেউ আসতে চায় না। কতকাল আগে চন্দ্রানী ‘আবড়া পেট’ নিয়ে এখানে ঝুলে পড়েছিল। মহল্লার লোকে এখনো তার ভুত দেখে। ” মাগির আত্মা ঘুড়ে বেড়াটে চারদিকে”।  এখনো তাকে খিস্তি খেউড় করে দ্বীপের লোকেরা। “মাগির কী বাই! ব্যার আগে পেট করলিয়া ঘুরতল।” এখানকার কৃষ্ণচূড়া গাছটা সব কিছুর সাক্ষী। গাঙের জলে কত লবনাম্বু গাছ উপড়েছে, কত গাছ আবার নতুন করে জন্মেছে। কিন্তু বাঁধের উপর সগর্বে জীবন্ত জীবাশ্মের মতো কৃষ্ণচূড়া গাছটা ঠিক দাঁড়িয়ে আছে।

ঝন্টু মণ্ডল নিখোঁজ হওয়ার দিন থেকে রাত দিন এখানেই বসে থাকে তার বাপ। মাঝে মাঝে ধার দিয়ে যাওয়া কোনো নৌকা দেখতে পেলেই বলে ” কে যাউটু রেএএ বাপ, আমার ঝন্টুকে দেখচু?” প্রথম প্রথম দিন কয়েক এর ওর সহানুভূতি পেত। সবাই বলতো ” হায় রে, বুড়াটা পাগলা হইচে”।  এখন কেউ তাকায় না তার দিকে। সে বাঁধে বসে হাঁক পাড়লে কেউ উত্তর দেবার দরকারও মনে করে না।

একটা আদ্যিকালের হাতা ছেঁড়া গেঞ্জি আর ‘খদি’ পরে বসে থাকে বুড়ো। পাশে একটা চিঁওন গাছের মোটা লাঠি শুয়ে থাকে ঠিক পাহারাদারের মতো।

চঞ্চলী গাঙ বাঁধ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আসে। ঝন্টুর বাপ লুথিয়ানের নাবার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে বসে আছে। সেও গাঙখাল করেছে তার দীর্ঘ শৈশব আর যৌবনে। তার স্থির বিশ্বাস ঝন্টুকে জলের টান ওই দিকেই নিয়ে গেছে। ঝন্টু ভাল সাঁতার জানতো। শরীরে তাকত ছিল তার খুব আসমানি। সে নিশ্চই মরেনি। কোথাও না কোথাও আছে। তরুবালা একদিন বলেছিল ” দেখবু বুড়া, তোর ব্যাটা একদিন আমার কানুর মতো আইসবে, শ্রাদ্ধ শান্তি করবুনি। যে অলাউঠা যা কয় কউ।” মনি মণ্ডল ভাবে ঝন্টু আজ নয় কাল ঠিক ফিরে আসবে। লুথিয়ান থেকে কাঠ বোঝাই নৌকা ঘাটের দিকে আসতে দেখলে বুড়ো শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে হাঁক পাড়ে ” কে রেএ বাআ,  আমার ঝনটুকে দেখচু তোন্নে?” পাগল বুড়ো, ঘাটে সারা দিন রাত বসে থাকে। কেউ কোনো উত্তর দেয় না। গোবিন্দ মালো হো হো করে হেসে উঠে ” আমার শোশরাটা পাগলাচদা হইচে, শ্লা”। মূলোর মতো দাঁত বের করে হাসে।

“বাবু, উঠো, ফ্যাঁ ভাত রাঁধছি। চলো, খায়াইসিয়া আবার বুসবো” চঞ্চলী হাত ধরে টানে বুড়োর।

“না যাবোনি যা” চঞ্চলীর হাত ছিঁটিয়ে দেয় বুড়ো সজোরে।

“চলো না বাবু, দুটা খাওনা গো” কাতর কন্ঠ চঞ্চলীর।

পিছন থেকে মনি মণ্ডলের মেয়ে মাধবী এসে হাঁক পাড়ে। “ওই খানকি, বেবুশ্যি। আমার দাদাকে খায়া সাধ মিটেনি তোর? বাপের গায়ে হাত দুবুনি মাগি, তোর হাত কাটিয়া লুবো।”

চঞ্চলী মুখ ঘুরিয়ে দেখে মাধবীকে। চোখে মুখে ক্রোধের আগুন। হাতে একটা কাটারি। মনে হয় বেড়া করার জন্য বাতা কাটতে এসেছিল। টেনে হিঁচড়ে বাপকে নিয়ে যায়। চঞ্চলী এদিক ওদিক ফ্যালফ্যাল করে দেখে, যে পথে এসেছিল,সেই পথ ধরে ঘরের দিকে এগোয়।

দুপুরে কোলাহল ভেসে আসে মালো পাড়া থেকে। দু চার ঘর মালো সম্প্রদায়ের মানুষ, এক জায়গায় পর পর ঘর বেঁধে আছে। নইলে আর পাড়া কী! একটাই মহল্লা। বলতে গেলে গোটা দ্বীপটাই একটা পাড়া। গোবিন্দ মন্ডলের ঘর থেকে চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ বেরোয়। গোবিন্দ মাধবীর স্বামী। মনি মণ্ডলের জামাই। তার চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। হাতে একটা চেলা বানি কাঠ। ” শালি, বেবুশ্যি মাগি, আমি জয়ে ডুবিয়া রোজগের করিয়া আঁয়বো, আর বাপ-ভাতারি বাপকে খাওয়াইবে”।  মাধবীর হাঁটুর নিচে উল্টোদিকে ফেটে রক্ত পড়ছে। ” বাওয়া গো মা গো, ছাড়িয়া দও গো, আর কুনদিন হবেনি গো” বলে চিল চিৎকার করে যাচ্ছে সে। মনি মণ্ডল এঁটো হাতে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে উঠে আসে। “আমার ঝন্টু কি আসসে, বাবা?” গোবিন্দকেই জিজ্ঞেস করে অবোধ শিশুর মতো। গোবিন্দ ততোধিক ক্রুদ্ধ হয়ে বলতে থাকে ” হঁ রে শ্লা, বাঞ্চোদের ব্যাটা। বারি যা শ্লা এখাঁনু, না’লে এক চ্যালা কাঠের ঘায়ে ঝন্টুর কাছে পাঠি দুবো”। বুড়ো কিছুই বোধ হয় বোঝে না। ক্ষানিকটা সময় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে গোবিন্দের দিকে। তারপর, লাঠি ঠুকতে ঠুকতে আবার চন্দ্রানীর ঘাটের দিকে হাঁটা শুরু করে। গজগজ করতে থাকে ” ঝন্টু আইলে একসংগে খাবো কইলি, তার অখঁও আসার টাইম হইলনি। মনে হয় ডুবা চড়ায় জাল পাতচে। দেখি লোককে জিগাস করিয়া।”

ঝন্টু মণ্ডল নিরুদ্দেশ হওয়া ইস্তক তার নৌকা ভানু বাগের জিম্মায় আছে। ঝন্টু নাকি আড়ৎ থেকে দাদন নিয়েছিল দেড়শ’ টাকা। চঞ্চলী অবাক হয়ে যায় মাঝে মাঝে। ঝন্টু তাকে টাকার কথাটা কখনো কেন বলেনি? তাছাড়া টাকা নেওয়ার তাদের তো দরকার ছিল না। তাদের তো যা মাছ শাক হতো তাতেই হয়ে যেত। ভানু বাগ কি মিথ্যা বলে নৌকাটা হাতিয়ে নিয়েছে? কে জানে। কিন্তু একথা সাহস করে ভানু বাগকে চঞ্চলী বলতে পারবে না। সে ভেবেছিল, ভানু বাগের আড়তে গায়ে গতরে খেটে দেড়শ টাকা শোধ করে নৌকাটা ছাড়িয়ে নেবে। তারপর আর একজন কাউকে নিয়ে সে আবার গাঙের কারবার শুরু করবে। কিন্তু ভানু বাগের আড়তে কাজ সে করে উঠতে পারেনি। লোকটা মহা বদমাস। সন্ধে হলেই তার লুংগির নিচের পশুটা ভয়ংকরভাবে জেগে উঠে, শিকার খোঁজে। বছর চারেক আগে একটা পাগলি কিকরে এই দ্বীপে চলে এসেছিল। সম্ভবত কেউ জোর করে নৌকায় করে পের করে দিয়েছিল অন্য কোনো জায়গা থেকে, যেমন করে লোকে তিতিবিরক্ত হয়ে বিড়াল বাচ্চা, ষাঁড় ইত্যাদি গাঙ পার করে দেয় আর কি! পাগলিটা জোয়ান। আড়তের কাছে ঘুরতো, বেড়ে যাওয়া ভাত তরকারি দিত আড়তের লোকেরা। তারপর হঠাৎ একদিন সবাই দেখল তার পেটে বাচ্চা। গোরু ছাগলের মতো একদিন রাত্রে বাচ্চা হয়ে গেছিল বনবিবির থানের বারান্দায়। কী সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চা! মাথাভর্তি চুল। দেখলে কোলে নিতে ইচ্ছা হয়। পাগলি তাকে খাওয়াত, গা ধোয়াতো, বুকের মাই গুঁজে দিত তার মুখে। ভানু বাগকে নিয়ে লোকে ফিসফিস করে অনেক কিছু বলতো। সেই কারণেই হোক বা অন্য কোনো কারণে, ভানু বাগ বাচ্চা সহ পাগলিটাকে আড়ৎ এর ধারে কাছে আর ঘেঁষতে দিত না। বেচারি পাগলিটা বনবিবির থানের বারান্দায় রোদে জলে শীতে বাচ্চাটা নিয়ে পড়ে থাকত। যে বছর সুবোল ঘোড়ুই নৌকা ডুবে মারা গেছিল, সেই বছরের কথা। ঝড়ের রাত পেরোলে  যখন কেউ ঘর গুছোতে ব্যস্ত, কেউ বা আবার সব হারিয়ে মাথা ঠুঁকে কাঁদতে ব্যস্ত, তখন কারুর নজরে পড়েছিল পাগলিটা সাউর ঘাটের কাছে গাছ চাপা হয়ে থেঁতলে মরে পড়ে আছে। বাচ্চাটা সারা রাতের ঝড়ে জলে একশা হয়ে কোনক্রমে বনবিবির থানে শুয়ে আছে। সব হারানোর মাঝে, সব গোছানোর মাঝে, সব ধ্বংসের মাঝে সেদিকে কে বা নজর দেবে! সুবোল ঘড়ুইর বৌ চঞ্চলী সে বাচ্চাটাকে ঘরে তুলেছিল। সেই বাচ্চাটাই এখন তার বাচ্চা। নইলে তার আর বাচ্চা কোথায়! ওই বাচ্চাই এখন তার সমস্যা। ও না থাকলে যে দিকে খুশি সে চলে যেত, করমারি ফল খেয়ে মরতে পারতো কিংবা এক খাদি দড়ি নিয়ে এগিয়ে যেত চন্দ্রানীর ঘাটের দিকে। এখন আবার নতুন সমস্যা জুটেছে, ঝন্টুর বাপ। তাকে কে দেখবে? পাগল মানুষ। খেতে না পেলে অবশ্য কাউকে কিছু বলে না। খিদে পাক আর তেষ্টা পাক, ঝড় আসুক আর জল আসুক, তার তো একটাই কথা ” ঝন্টুকে দেখচু তোন্নে?” এই বাচ্চা বুড়ো, এদের ছেড়ে চঞ্চলী যাবে কোথায়? মরতেও পারে না।

সন্ধেবেলা সে ভানু বাগের আড়তে গিয়ে দাঁড়াল ভানু বাগের সামনে। ভানু বাগ তখন ঠাকুরের ছবির সামনে ধূপ দিচ্ছে। প্রণাম করে পিছন ফিরে দেখল চঞ্চলীকে। ঠোঁটের কোনে বাঁকা ক্রুর হাসি।

কীরে,  কী খবর, ক’।

কাকা!

হঁ, ক’

আমি তুমার আড়তে কাজ করবো।

করতুলু তো। পায়িয়ালু কেনি? একটা বর্বর ইংগিত ভানু বাগের।

ভুল হইচে কাকা। আর যাবোনি। আমি কাজ করিয়া ঝন্টুর লৌকাটা ছাড়িব।

আরে লৌকা ছাড়ায়াঁর কী দরকার? তুই আর পাগলির বাচ্চাটা তো খাবু। আমি ব্যবস্থা করিয়া দুবো।

না কাকা, ঝন্টুর বাপ….  এইটুকু বলে চঞ্চলী থেমে গেল। ভানু বাগ আর একটু কাছে এগিয়ে এসে একটা নোংরা ইংগিত করে বল্ল ” নাং এর বাপের জন্যও ভাবুটু? হা হা হা হা হা”

আচ্ছা, দেনা শোধ হয়ালে লৌকা দিয়া দুবো যা।

আর… চঞ্চলী কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়।

আর কী রে?

চঞ্চলী কী বলবে ভেবে পায়না?

আরে শালী, আড়তে যা কাজ করবু তার টাকা তুই পায়াবু। আর আমার কাছে যা করবু… একটা আদিম বর্বর ইংগিত। চঞ্চলীর ভিতরটা মুচড়ে উঠে। মনে হয় সে খাঁচায় একটা ক্ষুধার্ত সিংহের সামনে স্বেচ্ছায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার সুবোলের কথা নয়, এই মুহুর্তে শুধু ঝন্টুর কথাই মনে আসছে। ভানু বাগ আরো কাছে এগিয়ে আসে। “তোর লৌকা আমি দিয়া দুবো” বলে মলিন,  জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া শাড়ির আঁচলটা ধরে নামিয়ে দেয় চঞ্চলীর কাঁধ থেকে। তারপর সহসা তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গিয়ে ফেলে ভিতরের ঘরের বিছানায়। ‘চরাস্’ করে একটা শব্দ হয়। চঞ্চলী কেঁদে ফেলে, ” কাকা আমার আর বেলাউজ নেই গো, অউ একটা থাইল।” তার কান্না দেখে ফুঁসে উঠতে থাকে ভানু বাগের ভিতরের কেউটে সাপটা।

অনেক রাত তখন।চন্দ্রানীর ঘাটে চেঁচাচ্ছে বুড়ো মনি মণ্ডল। ” অ্যাই মুখপুড়ি, যাবোনি কইটি না। যা যা এখাঁনু। ঝন্টু জংগয়ে যাইচে আমাকে লক্ষ্য রাখতে কইচে ফরেষ্টার আইসে কি না। ফরেষ্টারের লঞ্চ দেখলে আমি তাকে কির্কম সাড়া দুবো কইছি জাঁউ? এই দ্যাখ.. কু কু কু উ উ উ উ উ উ উ। কুউ উ উ উ উ উ।  কু উ উ উ উ উ উ উ। দ্যাখচু , দ্যাখচু? হা হা হা হা হা।”রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে মনি মণ্ডলের হাসিতে। সে হাসি গাঙ পেরিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে  দিক থেকে দিগন্তে, শুধু হারিয়ে যাওয়া ঝন্টু শুনতে পাচ্ছে না। জোয়ারের জল তখন বাঁধের গলা অব্দি এসে গেছে। ছলাৎ ছলাৎ করে বাঁধের গায়ে জল আছড়ে পড়ছে আর নোনা জলের ফসফরাস থেকে লক্ষ লক্ষ জোনাকি বেরিয়ে আসছে, আর মিলিয়ে যাচ্ছে। চঞ্চলীর গলা শোনা গেল ” ওও বাবু উঠ না গো। দ্যাখব চলো আইজ ভাল রাঁধছি। উঠ না গো। ওওও বাবু।”  ডাকতে ডাকতে ডাকতে ডাকতে এক সময় চঞ্চলীর গলার কাতর বিষাদের আওয়াজ ভেসে যায় রাতের বাতাসে।

ক্রমশ…

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস–“হেঁতালপারের উপাখ্যান”(১৩তম পর্ব)

 

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *