গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস “হেঁতালপারের উপাখ্যান”(পঞ্চম পর্ব)

পরিচিতিঃ ১৯৮৩ এর ১৫ই জুন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপ বড়রাক্ষসখালিতে জন্ম। জল জঙ্গলে বড় হয়ে ওঠা। বর্তমানে দক্ষিণ২৪ পরগণার কাকদ্বীপের একটি বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। কবিতার নিয়মিত লেখক নয়।বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস “হেঁতালপারের উপাখ্যান“-র পঞ্চম পর্ব

 

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস

হেঁতালপারের উপাখ্যান(পঞ্চম পর্ব)

 

অপু, দাদা ও মা

Me poor man, my library
Was dukedom, large enough.” The Tempest, Shakespeare.

সেটা পাকা ধানে বন্যার বছর। হ্যাঁ, আমাদের ছোটবেলায় অত সব সাল তারিখ মনে রাখার নিখুঁত মুন্সিয়ানা দেখাবার মতো লোক ছিল না দ্বীপে। কোন এক ঘটনা দিয়েই সময়কে আটকে রাখা হতো ভাঙা দেওয়ালের চিড়ফাটা আয়নায়। সে আয়নার ফাটলের মধ্য দিয়ে মাঝে মধ্যে বেরিয়ে আসত অনেক অলৌকিক দিনের একেকটা ট্রাজেডি। বুক ভাঙলে যেমন রক্ত গোলাপ বেরিয়ে আসে, তেমনি করে ভাঙা আয়নার ভিতর থেকে যে গল্প গাথা বেরিয়ে আসত তা রক্তাক্ত ট্রাজেডি ছাড়া কীই বা বলা যায়! আমাদের দ্বীপের লোকেরা সময়কে বেঁধে রাখতো ‘মিঠা বন্যার সন’ ‘নোনা বন্যার সন’ ‘পাকা ধানে বন্যার সন’ কিংবা ‘নৌকা ডুবি হ’য়ে কমল দোলুই এর মৃত্যুর সন’ ‘বীরেন মণ্ডলের বৌকে যে বছর সাপে কাটল’ এরকমভাবে। আপনারা শিক্ষিত শহুরে লোকেরা যেমন ক্রীশ্চান এরা, মহাম্মেডান এরা, শকাব্দ, বংগাব্দ ইত্যাদি প্যারামিটার দিয়ে সাল, তারিখ মনে রাখেন, আমাদের দ্বীপে ওরকম ছিল না। দ্বীপের নিজস্ব একটা ক্যালেণ্ডার ছিল বলতে পারেন। সে ক্যালেণ্ডার এত সহজ, এত স্পন্টেনিয়াস যে, যে কেউ তা বানাতে পারতো ওই দ্বীপে।
যেকথা বলছিলুম। তিন মা ব্যাটা ঘরে। আগের রাত থেকে আকাশের কোনে কোনে ভ্রুকুটি দেখা যাচ্ছে। রাতে চাল ছিল না, খাওয়া হয়নি। ভোর রাত থেকেই ঝড়ো হাওয়া শুরু হল। খাওয়া নেই। তার উপর ঘরটাও মজবুত নয়। যেকোনো সময় কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। ক্ষিধেয় ছটপট করছি আমরা দু ভাই। মা’দের ক্ষিদে পায়না বিশ্বাস তখন ভেঙে গেছে। একটু বড় হয়েছি। গরীব মানুষেরা ছোট বেলায় বড় হয়ে যায়। আমার দাদা তো বড় নয়, প্রৌঢ় হয়ে গেছিল। ঝড়ের গতি ধীরে ধীরে বাড়ছিল তখন। ছোট থেকে দেখেছি ক্ষিধে পেলে মা অব্যর্থ সমাধান। গিরা শাক, শাপলা গাছ, ঘড়া গীমা শাক, কী ছিল না দ্বীপে! এখন অনেক কিছু বাজার হাটে বিক্রী হয় যা তখন সভ্য লোকের অখাদ্য আর হাড়হাভাতে লোকের পেটের আগুন নেভাতে অদ্বিতীয় ছিল। চাল, খুঁদ না থাকলে অন্যান্য দিন মা মুহুর্তের মধ্যে এসব নিয়ে সেদ্ধ করে এক থালা দিয়ে দিত। গীরা শাকের সুবিধা হল, এটা খেতে গেলে নুনও লাগে না; তাই এই সুযোগ আমরা কখনোই ছাড়তাম না।
কিন্তু মাকে সেদিন খুব অসহায় দেখাচ্ছিল। মা কোথাও বেরোতে পারছিল না। আমাদের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল আর অস্থির হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ ঝড়ের গতিটা বেড়ে গেল। মা বোধ হয় বুঝল আর দেরি করা যাবে না। এরপর দেরি করলে বাচ্চাদের মুখে আর খাবার তুলে দেবার কোনো রাস্তাই থাকবে না। “তোন্নে চুপ করিয়া বুস। আমি যাবো আর আইসবো” বলেই মা বেরিয়ে গেল। ফিরে এল এক আঁচল ধান নিয়ে। আগেই বলেছি তখন পাকা ধান। ধান আঁটো হয়ে গেছে। শিস থেকে ধান ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছে মা। পাশেরই কারুর জমি থেকে। সদ্য গাছ থেকে নেওয়া ধান। পেকেছে ঠিক কথা। কিন্তু কাঁচা কাঁচা ভাবটাও আছে। তারপর সেই ধান একটা চটের বস্তায় ভ’রে ফেল্ল মা। বস্তাটা রাখল শিলের উপর, তারপর আস্তে আস্তে নোড়া দিয়ে বস্তার উপর ঘা দিতে লাগল। কিছু সময় পরে বস্তা খুলে বের করল। ধানগুলো ভেঙে আধ-খেঁচড়া চাল বেরিয়েছে। মা কুলো দিয়ে সেগুলো আলাদা করে নিল চোখের পলকে। ধান থেকে চাল বার করার মরিয়া সে চেষ্টা চোখ বব্ধ করলেই দেখতে পাই। ওই বয়সেই বুঝে গেছিলুম মা’র ভিতর কীরকম ঝড় চলছে তখন। বাইরের ঝড় আর ভিতরের ঝড় তখন মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। আধ-ভাঙা নরম চালগুলো উনুন জ্বেলে চটজলদি হাঁড়িতে করে বসিয়ে দিয়েই মা আমাদের দিকে তাকিয়ে কী সুন্দর একটা পরিতৃপ্তির হাসি হাসল। সে হাসি বলছিল “এই তো বাবা, তোনকের খাবার রাঁধিটি। আর খিধায় রইতে হবেনি”। নরম চাল, তাও আবার আধ ভাঙা, অল্প সময়েই সেদ্ধ হয়ে জাউ ঘাটা হয়ে গেল। মা দুটো থালায় গরম গরম বেড়ে দিল। আমি বল্লাম ‘তুমার কাই?” একগাল হেসে মা বল্ল, “আমি কি অত তাড়াতাড়ি খাই কুনদিন? তোন্নে খা, খা বাপ। তাড়াতাড়ি খা”। আমি আর দাদা বায়না ক’রে আমাদের থালা থেকে খাইয়ে দিলাম নিজেদের হাত দিয়ে। আমরা এক গাল খাচ্ছি, মা কে একগাল খাওয়াচ্ছি। খেতে না পেয়ে যে মা কোনোদিন একটুও কষ্ট পায়নি, একফোঁটা চোখের জল ফেলেনি, সেদিন দু’জন খাইয়ে দিতে মা ঝরঝর করে কাঁদছিল। আমরা অবাক হয়ে যাচ্ছিলুম। হঠাৎ কান্নাভেজা চোখ নিয়ে মা উপরের দিকে ইশারা করল। দেখলুম ঘরের পশ্চিম পাশের খড়ের ছাউনিটা উড়ে গেছে ঝড়ে। আমরা ঝটপট খেয়ে নিলুম। ঝড়ের গতি এবার বেশি বেশি টের পাচ্ছিলাম পশ্চিম পাশের খোলা চাল দিয়ে। হাওয়া মাঝে মধ্যে ঘরে ঢুকে পুরো ঘরটাকে নাড়িয়ে দিচ্ছিল। মা আমাদের আঁকড়ে ধরল। হঠাৎ ঘরের পশ্চিম দেওয়ালটা যা এতক্ষণ জল পাচ্ছিল হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। আর একটু হলে আমরা চাপা পড়ছিলুম প্রায়। আর এখানে থাকা যায় না। মা সেই দৈত্যের মতো ঝড়ের মধ্যেই আমাকে দাদাকে, দুজনকে দুহাতে ধরে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। কোথাও একটা মাথা গলাতেই হবে। আমাদের ঘরের উত্তরপাশে একটা উঁচু বাঁধ আছে। কারুর বাড়ি অব্দি যেতে গেলে এই বাঁধটা পেরোতেই হবে। ঝড় তার সমস্ত শক্তি দিয়ে তখন তাণ্ডব দেখাচ্ছে। আমরা তিন মা ব্যাটা কোনোক্রমে ওই বাঁধটার উপর উঠলাম। কিন্তু তারপরেই মা আমাদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেল্ল। দাদার হাত কোনক্রমে ধরে রাখলেও, হাত ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম আমি। আর যেই বেরিয়ে গেলাম, অমনি রোগা পাতলা শরীরটাকে এক ঝাপটায় বাতাস অন্তত দুশো ফুট দূরে নিয়ে চলে গেল। আমি জানি না ওই সময়টা ঠিক আমার ভিতর কী চলছিল। কিন্তু এটা মনে আছে, আমি চার পাঁচটা ধান গাছ ধরে বসে পড়েছিলুম। আর পিছনে মুখ ফেরাতেই দেখছিলাম আমার মা ঝড়ের শব্দকে ছাড়িয়ে উঁচু গলায় চীৎকার করছিল ” কে কাই আছ গো, আমার সর্বনাশ হয়াল গো, আমার ব্যাটাকে উড়ি লিছে গো।” হঠাৎ আমার হাত ধরল গণেশ বাগদি। মা’র চীৎকারে বেরিয়ে এসেছে সে। আমাকে তার বাড়ি নিয়ে গেল। মাও দাদাকে নিয়ে উঠল সেখানে। ঝুপড়ি ঘর। তার উপর সামনে পিছনে মোটা মোটা গাছ। ঝড় সেভাবে আক্রমণ করতেই পারছেনা গণেশ বাগদির ঘরকে। আমাদের জামা কাপড় সব ভেজা। তাই নিয়ে বসে থাকলাম ঝড় থামার অপেক্ষায়।
তখন সব্ধ্যা হতে যায় যায়। ঝড় নেই। আকাশের পশ্চিম দিক লাল আভায় ভরে উঠেছে। ঘরে ফিরলাম। ঘর নেই। একটা ধ্বংসাবশেষ মাত্র। মা ফ্যালফ্যাল করে একবার আমাদের দিকে, একবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। গংগা ঘড়ুই একটা ত্রিপল হাতে ক’রে আনল। “বৌদি চারটিয়া খুঁটি পুতিয়া ওউটা উপরে দিয়া দেইটি। কুনরকম ক’দিন রও।”
গংগাবুড়ির ঘাটের দিক থেকে কোলাহল আসছিল। কার নাকি নৌকা ডুবেছে। কে নাকি মরেছে। দৌড়ে গেলাম। কতগুলো লোক জটলা করছে। তখন সূর্য ডুবে যাচ্ছিল তড়িৎগতিতে। ফিরে আসবার সময় জংগলের দিকে একবার তাকালুম। এক দল ভেড়া ঢুকে যাচ্ছে গোধূলির আলো আঁধারিতে ডুবে যাওয়া রহস্যময় জংগলে। স্পষ্ট দেখেছিলাম। কিন্তু ভেড়া কেন জংগলে ঢুকেছিল সে কথা আজও ভাবায় আমাকে। আচ্ছা, ওই চারপেয়ে পশুগুলো কি কোনোদিন ফিরে এসেছিল লোকালয়ে? জানি না।

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্ব পড়তে নিচের লিংকটি ক্লিক করুন

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস “হেঁতালপারের উপাখ্যান”(চতুর্থ পর্ব)

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *