গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস “হেঁতালপারের উপাখ্যান”(চতুর্থ পর্ব)

পরিচিতিঃ ১৯৮৩ এর ১৫ই জুন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপ বড়রাক্ষসখালিতে জন্ম। জল জঙ্গলে বড় হয়ে ওঠা। বর্তমানে দক্ষিণ২৪ পরগণার কাকদ্বীপের একটি বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। কবিতার নিয়মিত লেখক নয়।বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস “হেঁতালপারের উপাখ্যান“-র  চতুর্থ পর্ব

 

গৌ ত ম   ম ণ্ড লর ধারাবাহিক উপন্যাস

হেঁতালপারের উপাখ্যান(চতুর্থ পর্ব)

 

অপু, দাদা ও মা

“তিতাস শাহী মেজাজে চলে” অদ্বৈত মল্লবর্মন (তিতাস একটি নদীর নাম)

মানুষ যখন এক ঘর ছেড়ে আর এক ঘরে যায় তখন প্রকৃতই দেশ ছাড়ার, ভিটে মাটি ছাড়ার যন্ত্রণা অনুভব করে। শৈশব আমাদের টানে বটে, কিন্তু শৈশবের কতটুকু বা মানুষ মনে রাখতে পারে! ক্লাস টু তে তখন পড়ি, দাদা ক্লাস থ্রীতে। তখনই এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ায় আমরা উঠে এলুম। যেখানে উঠে এলুম তাকে পাড়া বলার চাইতে শ্মশান বলাই ভাল। আলিংকারিক নয় প্রকৃত অর্থেই শ্মশান।সে কথায় পরে আসছি। উঠে যখন এলুম, তখন উঠে আসবার যে কসরত তা বেশী পোহাতে হয়নি। একটা স্টীলের ট্যাংক,সেটা দাদা মাথায় করে এনেছিল। আমি বয়ে এনেছিলাম দুটো শীতল চাঁটাই। খেজুর পাতা দিয়ে বোনা চাঁটাইকে আমাদের পাড়া গাঁয়ের লোকেরা ওই নামেই ডাকে। খেজুর পাতার চাঁটাই, বেশ সুন্দর একখানা জিনিস। এত সুন্দর করে খাপে খাপ দিয়ে বোনা হতো দেখলে বেশ অভিজাত লাগতো। ওতে শুতেও আরাম লাগতো বেশ। গরমের সময় একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব।সেই জন্যই কিনা জানিনা লোকে শীতল চাঁটাই বলতো। শীতল চাঁটাই গ্রামের দিকে তখন সব মেয়েরাই বুনতে পারত। আমার মা বোধ হয় অন্যদের চেয়ে বেশ ভালোই আয়ত্ত করেছিল, হাত চলতো মেশিনের মতো। সে যাই হোক, যা বলছিলাম; আমি ঘর ছাড়ার সময় বয়ে এনেছিলাম দুটো শীতল চাঁটি। আর বাদ বাকী জিনিসপত্তর মা এনেছিল। বাদবাকী জিনিসপত্তর বলতে এলাহি কিছু নয়। গোটা তিন চারেক কাঁথা, একটা কাপড়ের মশারি, গোটা দুয়েক বালিশ আর রান্নার কয়েকটা বাসনপত্র। রান্নার বাসনপত্রগুলোর জন্য মাকে দ্বিতীয়বার ফিরে আসতে হয়েছিল আগের ঘরে। সেগুলো একটু সাবধানে আনতে হবে কিনা! তখন মাটির হাঁড়ি, মাটির কড়াই, মাটির কলসী ব্যবহার ছিল আমাদের। শুধু আমাদের কেন! বলা ভাল, আমাদের মতো সব গরীবগুর্বো লোকেদের। তবে আমার কাকাদের বাড়ি তো পাশেই ছিল, তাদের হাঁড়ি, থালা বাসন ছিল অ্যালুমিলিয়ামের।আর কড়াই ছিল লোহার। আমাদের অবশ্য গোটা দুয়েক কি তিনেক থালা আর একটা গেলাস ছিল অ্যালুমিলিয়ামের। তো সে যাই হোক, মাকে ওই মাটির জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য আলাদা করে দ্বিতীয়বার ফিরে আসতে হয়েছিল ওই ঘরে। আমার বাড়ি ছাড়া, মানে পাড়া ছাড়ার দৃশ্যটুকু বেশ মনে আছে। আমি আর দাদা খালি পায়ে দড়ি লাগানো হাফ প্যান্ট পরে খালি গায়ে জিনিসপাতি বয়ে নিয়ে আসছি, পাকাওয়ালাদের বাড়ির উঠোন দিয়ে সোজা রাস্তা ধরে, দৃশ্যটা ভুলে যাইনি কেন জানিনা। তখনকার দিনে আমাদের পাড়ার মাইতিদের সবাই ‘পাকাওয়ালা’ বলতো, আমরাও শুনে শুনে তাই।বলতাম। পরে বুঝেছি ওখানে একটাই পাকার ঘর ছিল তখন। তাই তার মালিকদের ওই নাম হয়ে গেছিল। সে যাহোক, ওই যে বললাম, শৈশবের বেশীরভাগ ইতিহাসের পাতা কোন বাতাসে উড়ে যায় মানুষ বুঝতে পারেনা। তবে আমার ক্ষেত্রে বাতাস হয়তো একটু সদয় হয়েছিল, কিংবা কিছু জিনিস আঁকড়ে ধরে বসে থাকা রোগ থাকে কিছু লোকের। হয়তো এই দুটোর যেকোনো একটা কারণে কিছু কিছু টুকরো অথচ মনখারাপ করা ঘটনা আমার স্মৃতিপটে হঠাত হঠাত এখনো ভেসে উঠে।
সে সব অন্য কথা। আসলে আমাদের ঘর ছাড়ার স্মৃতিটা আমার কাছে দেশ ভাগের পর যারা দেশ ছেড়েছিল তাদের মতোই। পিছনে তাকালে কান্না পায়, আবার সামনে তাকালে মনে হয়, এবার অন্তত শান্তিতে থাকতে পারবো, কেউ এসে হঠাত হঠাত ঘর দোর ভেঙে দিয়ে চলে যাবেনা আর তারপর মাকে সেই ভাঙা ঘরের ডালপালা আবার কষ্ট করে সাজিয়ে আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে পাখির ছানার মতো পাখনায় ঢুকিয়ে সারারাত জাগতে হবেনা। তাই আমাদের যাওয়ার মধ্যে কান্না ছিল, কিন্তু সে কান্না চোখে ছিলনা,অন্য কোথাও, চোখে বরং আনন্দই ছিল। সব আনন্দ যে একরকম হয়না তা তো সেই বয়সেই বুঝেছিলুম। ওই আনন্দটা ঠিক করে বোঝানো মুশকিল। যে কখনো নিকোনো উঠোন ছেড়ে গাছ তলায় একটা সারা দুপুর ঘুমিয়েছে, কিংবা যে দৌড়বাজ ১০০০ মিটার স্প্রিন্টের শেষ প্রান্তে এসে পিছন ফিরে তাকিয়ে ভাবে ‘কেন এলাম’ সে ছাড়া কেউ বুঝবেনা। আমার মার চোখ চকচক করছিল। সে চোখ আনন্দে নাকি কষ্টে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল তখন বোঝার বয়স মনে হয় হয়নি আমার, কিন্তু তবুও মনে হয় বুঝেছিলাম। কিন্তু এই বয়সে এসে অনুভব করি, সব জিনিস বুঝলেও বোঝানো যায়না।
আমার বাবা বাড়ীতে থাকতো কালেভদ্রে। মেদিনীপুর, মেছোগ্রাম, কাকটিঁয়া বিভিন্ন জায়গায় মাটি কাটার কাজে চলে যেতো। ক’টাকা আর তাতে পাওয়া যেত! পুরুষ মানুষ বাড়ী থেকে আজকাল বেরুবার আগে যেমন গৃহিনীকে এটা ওটা বুঝিয়ে দিয়ে হাতে টাকা পয়সা দিয়ে যায়, অমন টা বাবার ক্ষেত্রে ছিলনা। মাকেই সংসার চালাতে হতো। তখনকার দিনে ছোট ছোট গুড়ি জাল দিয়ে বাগদার মিন ধরতো অনেকে। মাও তাই ধরতো আমাদের সামনের ড্রেনটায়। স্লুইশ গেট দিয়ে নোনা জল ঢুকতো কিনা, তাই তাতে বাগদা, চেঁওয়া, পারসে, চিংড়ি, ডাকুর কত কি মাছ জন্মাতো। মা, বাগদার পোনা বিক্রী করে চাল কিনে আনতো ৫ কিলোমিটার দূরের কাঙাল পাত্রদের দোকান থেকে। চাল তো নয়, চালের ক্ষুদ। ধান ভাঙার পর কুলো দিয়ে কুঁড়ো উড়িয়ে ভাল চাল আর ভাঙা চাল আলাদা করা হতো। সেই ভাঙা চালই ক্ষুদ। এই কুলো দিয়ে চাল উড়োনোর জন্য মাকে অনেকের বাড়ীতে ডাকতো। মা সারা দিন কুলো ধরে সন্ধে বেলা অনুগ্রহের কেজি দুই তিন ক্ষুদ নিয়ে বাড়ি ফিরতো। হাত পা কোমর তখন সব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কিন্তু মা কাতরাতোনা। বেশ হাসি হাসি মুখে সন্ধেবেলা এসে বলতো ” খুব কষ্ট হইছে তোনকের বাবা? সারাদিন পান্তাভাত… আমি গরম ভাত রান্ধি দেইটি, তোন্নে পড়তে বুস।” যেন ভাবটা এমন মার কোনো কষ্ট হয়নি। সারাদিন যেন কত ভাল খেয়েছে। তারপর আমরা পড়তে বসতাম। মা উনুন ধরিয়ে ভাত বসাতো। আর মাঝে মধ্যে এসে আমাদের পড়া দেখিয়ে দিয়ে যেতো। আমাদের দুই ভাইএর পড়াশোনার ব্যাপারে মা কিন্তু খুব ভাবতো। নিজে ক্লাস নাইন অব্দি পড়ে আর সুযোগ পায়নি, হয়তো তাই।
যাই হোক, একটা সংসার বয়ে নিয়ে তিন মায়ে পোয় উঠে গেছিলাম একটা শ্মশানে। তবে একটা ঘর পেয়েছিলাম।এক্কেবারে আমাদের ঘর।সেই ঘরে ঢুকে মার চলন বলন দেখে মনে হয়েছিল মা একটা নিজের ঘর পেয়েছে। কদিন তো গেল সারা ঘর টা নিকোতে। আমাদের দু ভাই এর একটু অসুবিধা হয়েছিল ইস্কুলে যেতে। দূরত্বটা বেড়ে গেছিল কিনা। কিন্তু নতুন স্ফুর্তিতে আমরা ইস্কুলে যেতে লাগলাম। মাটির রাস্তা।বর্ষাকালে একহাঁটু কাদা। জল জমে একাকার। যেন একটা সমুদ্রের মতো হয়ে যেত মাঠ ঘাট মিলে মিশে। আর সেই সমুদ্রের কাছেই বোধ হয় হাত পেতেছিলুম আমি। সমুদ্র সরে যেত ক’ দিন পর আবহাওয়া ঠিক হয়ে গেলে। কিন্তু জেগে থাকতো শ্মশান, বাড়ী আর একখান নদী, দেশ ছাড়া না হলে হয়তো যাকে কখনো পেতামই না।

ক্রমশঃ…

লেখা পাঠাতে পারেন

 

আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকে

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস হেঁতালপারের উপাখ্যান(তৃতীয় পর্ব)

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *