ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস–“চোরাবালি”(পর্ব-৯)

পরিচিতিঃ ইন্দ্রনীল বক্সী, “জন্ম – নকশাল পিরিয়ডে ..৭৩ এ দুর্গাপুরে , উচ্চতা মাঝারি, গায়ের রঙ মাজা, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল টাইপ। লিখছি সেই কিশোরবেলা থেকে, দুর্গাপুর বেলা থেকে বর্তমান নিবাস – বর্ধমান। কি লিখছি ছাই নিজে তো জানিই না অন্যরাও জানে বলে মনে হয় না। হাবিজাবি করে চারটি বই প্রকাশিত।” বাইফোকালিজম্-এ তাঁর আজ ধারাবাহিক উপন্যাস ‘চোরাবালি‘-র নবম পর্ব

[contact-form][contact-field label=”Name” type=”name” required=”true” /][contact-field label=”Email” type=”email” required=”true” /][contact-field label=”Website” type=”url” /][contact-field label=”Message” type=”textarea” /][/contact-form]

ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস

চোরাবালি(পর্ব-৯)

টানা মিনিট কুড়ি হয়ে গেল দেবু দাঁড়িয়ে জেলখানা মোড়ের বিগ বাজারের পাশের চায়ের দোকানটায়। ওদের কোচিং ক্লাসের পাঁচজনের আজ আইনক্সে প্রোগ্রাম। অর্ক, বিশ্বজিৎ, নন্দিতা, নাজমা আর দেবু …বেশি কাউকে জানায়নি ওরা। একই ব্যাচের হলেও ওদের এই ক’জনের মধ্যে একটা বোঝাপড়া আছে, নন্দিতা আর নাজমা আবার কাছাকাছি এলাকায় থাকে। টিকিট নিজের নিজের হলেও হল থেকে বেরিয়ে ট্রিট দেবে অর্ক, আজ ওর জন্মদিন। দেবু কিছুটা আগেই এসে গেছে কলেজ থেকে, বিশেষ কিছু ছিল না আজ কলেজে। ইয়ুথ ফোরামের কি একটা মিটিং ছিল, দেবু যায়নি। যতই ফোরাম টোরাম বলুক, আসলে রুলিং পার্টির ঝোল টানা ব্যাপার স্যাপার সব দেবু ভালই জানে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল। ও যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে হাত বিশেক দূরে একটা সাদা রঙের টাটা সুমো এসে দাঁড়াল। বিগ বাজারের বিরাট বিল্ডিংটার পুরোটাই বিগ বাজার নয়, রয়েছে আইনক্স, হোটেল, ডান্স বার… দেবু জানে। টাটা সুমো থেকে কলবল করতে করতে খুব সাজ গোজ করা, চোখ ধাঁধানো পোশাকে তিনটে মেয়ে নামল, নেমে বিল্ডিংয়ের ঠিক পিছনের দিকে নয়, পাশের দিকে থাকা লিফটের দিকে এগিয়ে গেল। দেবু অপলক তাকিয়ে থাকে মেয়েগুলোর দিকে, মেয়েগুলো নিজেদের মধ্যে হিন্দিতে কথা বলছে, ওর মধ্যেই একটা নীল রঙের ঘাগরা-চোলি পরা মেয়ে আচমকাই ঘাড় ঘুড়াতেই দেবুর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল, দেবু দেখল অপূর্ব দেখতে মেয়েটা এক মুহূর্ত যেন থমকে গেল, তারপর গলা নামিয়ে সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে বাকি দুজনও ওর দিকে তাকাল এবং নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতে করতে লিফটের ভিতর হারিয়ে গেল। দেবু একটু অপ্রস্তুত হয়ে এদিক ওদিকে তাকিয়ে আবার সিগারেটে মনোনিবেশ করল। এখানে এরকম সময় এত সেজেগুজে মেয়েগুলো কি করতে এলো!… এগুলো সম্ভবত ডান্সবারের মেয়ে! গাড়ি এসে নামিয়ে দিয়ে গেল। এত সুন্দর সুন্দর দেখতে মেয়ে ডান্স বারে থাকে! দেবু আপন মনে ভাবতে ভাবতে অবাক হয়ে যায়। ও শুনেছে একদুবার রজতের কাছে, দেবু কোনো দিন ডান্সবারে আসেনি, আজ স্বচক্ষে দেখে একটু ভিতরে ভিতরে উত্তেজনা টের পেল।
বাঁদিকে ফিরতেই দেবু দেখল একটা রিক্সা থেকে নন্দিতা আর নাজমা নেমে আসছে, ওকে ওরা দেখতে পেয়েছে। দেবুও একটু এগিয়ে গেল ওদের দিকে।
“পারিস মাইরি! তোদের কি বিয়ে বাড়ি, কি সিনেমা সব জায়গায় যেতেই একইভাবে সেজে গুজে যেতে হয়! …দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বোর হয়ে গেলাম…”
“বাজে বকিস না, বোর না হাতি …দিব্যি মেয়ে দেখে দেখে টাইমপাস করছিলি …” চোখটা সরু করে হাতের একটা গুঁতো দিয়ে বলে ওঠে নন্দিতা।
দেবু দৃশ্যত ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়,ওরা কি ওকে দেখল নাকি ওই মেয়ে গুলোর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে! …নাঃ …নন্দিতাটা ফাঁকায় ঢিল মারছে নির্ঘাৎ…
“বেশ করেছি দেখেছি… না দেখলেই তো তোদের কষ্ট বেশি …তাই না বল? ধুর সেরকম আর কই স্যাম্পেল!” দেবু ঝটিতে উত্তর দেয়…
নন্দিতা আর নাজমা দৃষ্টি বিনিময় করে নিজেদের মধ্যে, মুচকি হাসে দুজনেই …
“ দেখলি নাজ্জু! …বলছিলাম না …মাল ঠিক আগে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়ে গিলবে …কিন্তু বাকি গাণ্ডুগুলো গেল কোথায়?”
“এঃ নন্দিতা …তুই আজকাল বড্ড মুখ খারাপ করছিস..একটু সেন্সর কর.” নাজমা বলে ওঠে হাসতে হাসতে।
“বেশ করছি শালা …ছেলেরা করলে কিছু না না! … আরে বন্ধু বান্ধুবদের মধ্যে একটু মুখখারাপ করলে হেব্বি আরাম হয় যাই বলিস!…”
ওদের কথাবার্তা চলতে চলতেই অর্ক আর বিশ্বজিৎ এসে পড়ল। পাঁচজনে বিশাল বাড়িটার চারতলার সুসজ্জিত করিডোর পেরিয়ে প্রায়ান্ধকার কয়েকটি হলের একটির মধ্যে ঢুকে গেল। সিনেমা তখন শুরুর মুখে, বিক্ষিপ্ত ভাবে লোক বসে রয়েছে। অনেক সিটই ফাঁকা।

“কেমন দেখছিস?” আধো অন্ধকার হলের মধ্যে পাশেই বসে থাকা নন্দিতাকে ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করল দেবু।
“ধুর শালা …এমন শুরু করল ভাবলাম বেশ জমবে …”
“বোর হচ্ছিস তার মানে!”
“ওই আর কি …একটু ঠান্ডায় ল্যাদ খাওয়া হচ্ছে আর কি, তোর কি! তুই দেখ না…”
“এই যে , কথা বলতে হলে বাইরে গিয়ে বলো … যত্তসব …” পিছন থেকে এক মোটাসোটা মহিলা বলে উঠলেন বিরক্ত গলায়। দেবু আর নন্দিতা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে জিভ কাটলো, নন্দিতা মুখে ওড়নাটা চেপে ধরে হাসি চাপার চেষ্টা করতে লাগল, হাসির দমকে ওর শরীর ফুলে ফুলে উঠছে … দেবু নিজেও হাসি চেপে নন্দিতার দিকে আড় চোখে দেখে, বড্ড ফাজিল মেয়েটা ….উঃ …এত হাসির কি আছে কে জানে বাবা!
কোনোরকমে বাকি সিনেমাটা শেষ করে ওরা নেমে এলো আইনক্স থেকে। সবাইমিলে অজস্র গালাগাল দিল বিশ্বজিৎকে, এই সিনেমাটা দেখার আইডিয়াটা ওরই। পাঁচজনে মিলে ‘ফুডপাথ’ নামের জনপ্রিয় ফাস্টফুডের দোকানটার সামনে এসে দাঁড়ায়। চিকেন রোলের অর্ডার করল অর্ক সর্বসম্মত ভাবে, শুধু কেউ রোলে সস খাবে না বা কেউ পেঁয়াজ বেশি–এটুক বলে এসে দাঁড়ালো।

“জানিস মধুরিমার বাবা-মা ওকে ব্যাঙ্গালুরু পাঠিয়ে দিয়েছে !” আচমকাই এটা ওটা কথার মাঝে বলে ওঠে বিশ্বজিৎ।
“তাই!…একদিক দিয়ে দেখলে ঠিকই করেছে বলা যায় …এখানে মুশকিলে পড়তো, শুনেছি বাড়ি থেকে বেরোনোই বন্ধ হয়ে গেছিলো।” অর্ক বলে ওঠে…
“ …আর আর…যে শালা কেসটা করলো সে বিন্দাস ঘুরে বেড়াচ্ছে … কি দুনিয়া মাইরি! …শুনলাম সংসদেও মালকড়ি দিয়ে ম্যানেজ করেছে …” ঝাঁজিয়ে উঠে বলে নন্দিতা।
এর মধ্যেই ওদের যার যার রোল চলে আসে হাতে হাতে।

“ছাড় না ওসব ফালতু কেস… ভাল্লাগে না… ” এতক্ষণ চুপ করে থাকা নাজমা বলে ওঠে। দেবুও কিছু না বলে রোলে মনোনিবেশ করে, ওর চোখ চলে যায় পার্কাস রোডের দিক থেকে আসা একটা বাইকের দিকে, এমনিতে এখানে অজস্র বাইক দাঁড় করানো আছে, যাচ্ছে আসছে, কেউ কেউ একটু মাত্রা ছাড়া স্পিডেই। এ চত্বরটা দোকানদার ছাড়া উঠতি কম বয়সীদের সমাবেশেই জমজমাট থাকে রাত পর্যন্ত। যেন সব সময়েই একটা ‘ইয়ুথ কার্নিভাল’ চলছে বলে মনে হয়। কিন্তু কেন জানি এই নির্দিষ্ট বাইকটা খুব ধীর গতিতে রাস্তার একদিক ধরে এগিয়ে আসছে, দুজন রয়েছে বাইকে, পিছনের জনের হাতে একটা থলি ধরা… আচমকাই পিছনের জন থলিটা ফেলে দিল আর হাতটা তুলে ধরতেই ফটাস ফটাস করে আওয়াজ! … সবাই একটু চমকে উঠে আওয়াজের দিকে তাকাতেই দেখল একজন পথ চলতি মাঝ বয়সী লোক হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে রাস্তায়… তারপর ধীরে বাঁদিকে কাত হয়ে লুটিয়ে পড়ল … কয়েক মুহুর্ত কেটে গেল বুঝতে ব্যাপারটা। তারপরই শুরু হলো আতঙ্কের আর্তনাদ। দেবুরা বসে পড়েছে দোকানের সামনেই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়, অনেকেই এদিক ওদিক ছুটছে, বসে থেকে দেবু দেখতে পায় সেই বাইকটা বেরিয়ে যাচ্ছে চত্ত্বর থেকে খুব দ্রুততার সঙ্গে …মুখে গামছা জড়ানো পিছনে বসা লোকটার শুধু চোখ গুলোই দেখা যাচ্ছে …দেবুর সঙ্গে একমুহূর্ত চোখাচুখি হলো যেন! … এই দৃষ্টিটা কি অদ্ভুত ! ভীষণ চেনা লাগে দেবুর …। রাস্তায় পড়ে যাওয়া লোকটা বার দুই থর থর করে কেঁপে উঠল তারপর স্থির হয়ে গেল।

সরাসরি বুকে গুলি, দু দুটো। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু লোকটির। পরিচয় এখনও কেউ জানেনা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বিগ-বাজারের সামনের রাস্তার একটা অংশ। লোকে লোকারন্য, সবাই ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার বেশ কয়েক মিনিট পর নিরাপদ বুঝে এসে ভিড় করে দাঁড়িয়ে উত্তেজনার মৌতাত নিচ্ছে। একজন পায়জামা পাঞ্জাবী পরা মাথায় টাকওয়ালা লোক মোবাইলে কাউকে উত্তেজিত হয়ে কিছু বলছে, সম্ভবত নেতা গোছের কেউ হবে। পুলিশের একটা গাড়ি এসে ধীরে সুস্থে দাঁড়ালো পড়ে থাকা মৃতদেহ ঘিরে জমে ওঠা ভিড়টার একটু দূরেই।
দেবু-নন্দিতা-নাজমারা …কোনরকমে ভিড় এড়িয়ে হেঁটেই অনেকটা চলে আসে। এরকম একটা ঘটনার অভিঘাত ওদের সবাইকেই বেশ অস্থির-অস্বাভাবিক করে তুলেছে, নাজমার গা গুলোচ্ছে। নন্দিতা একটা টোটোতে ওকে নিয়ে ওদের বাড়িতে পৌঁছে তারপর বাড়ি যাবে। অর্ক ভীষণ ভয় পেয়েছে, দেবু সেই থেকেই চুপ মেরে গেছে একেবারে। দেবুর চিন্তায় ভেসে উঠছে খালি ওই গামছা জড়ানো মুখ আর তার একফালি ফাঁকে একজোড়া তীব্র দৃষ্টির চোখ, বড্ড চেনা…

রাত বেশ কিছুটা হয়েছে, কিন্তু দেবুর চোখে ঘুমের লেশ মাত্র নেই। গলার কাছটা ঘামে ভিজে উঠছে বারবার। দুবার উঠল, বাথরুম থেকে ঘুরে এলো, জল খেল। এরকম ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে কোনোদিন দেখেনি দেবু, সেই একবার বীরহাটায় একটা মোবাইলচোর কে প্রচন্ড মারতে দেখেছে, মারের চোটে মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছিল লোকটার মনে আছে। নিজে যে একদম মারামারি করেনি কোনোদিন এমন নয়, এই দু’বছর আগেই সরস্বতী পুজোর দিন ঘোষ পাড়ার সঙ্গে বেশ জোর মারামারি হলো, দেবুও ছিল। বাবা জানে না, মা জানত, চেপে গেছে। হন্তদন্ত হয়ে ছেঁড়া জামা গায়ে যখন বাড়ি ফিরলো দেবু মায়ের ইশারায় মণি নিঃশব্দে দেবুর জামা কাপড় কোথায় যে লুকিয়ে ফেলল মুহূর্তে দেবু জানেই না! কিন্তু একটা লোক চোখের সামনে এভাবে… নাঃ খুব অস্থির লাগছে ওর। আবার একবার উঠে ঘাড়ে পিঠে জল দিয়ে এসে শোয় দেবু, বালিশের পাশে রাখা মোবাইলের ভিডিও ফাইল খোলে, নতুন কটা ক্লিপিংস লোড করেছে দিন কয়েক আগেই, ঘন হয়ে আসে ওর নিঃশ্বাস ভিডিওর মেয়েটার শীৎকার ওর উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয় আরও, পরে থাকা বারমুডা এক টানে নামিয়ে ফেলে অনেকটা … একসময় চরম মুহূর্তে পর স্বাভাবিক নিয়মে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে, একটা ঘোর এসে থিতিয়ে দেয় ওর অবসন্ন শরীর, পৃথিবীতে ঘুমের সম্ভবত এর থেকে ভালো ওষুধ আর কিছু নেই।

ক্রমশ…

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্বটি পড়ার জন্য নিচের লিংকে ক্লিক করুন

ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস–“চোরাবালি”(পর্ব-৮)

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *