পর্ব-৩০; বাংলার ইতিহাস( The History of Bengal); শ্রী দুর্গাশঙ্কর দীর্ঘাঙ্গী
১ম পর্ব; বাংলার পটের গল্পঃ– বর্ণালী রায়
বাংলার পটের গল্প
বর্ণালী রায়
লেখিকার পায়ের তলায় সর্ষে।আজ পুরুলিয়ার এই মেলাতে তো কাল ইতিহাসের হাত ধরে পৌঁছে যায় মুর্শিদাবাদের প্রাচীন রাজারাজড়ার কোনও অলিন্দে।”গরীবের ঘোরা রোগ” বারবার তাঁর তথ্য তত্ত্ব ও ভিন্ন দর্শনের হাত ধরে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। তাঁর সম্প্রতি এই ছোট ছোট ভ্রমণের চোরাকুঠরির সমন্বয়ে বর্ণিক প্রকাশন থেকে সম্প্রতি “ভ্রমণ-যাপন১”
শিরোনামে একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে।পাঠকরা সংগ্রহে রাখতে পারেন।চেনা পৃথিবীর অচেনা দর্শন।
“সাঁঝের যমুনায় জল আনতে বলে কে
সাঁঝের যমুনায় জল আনতে বলে কে
না জানি কোন কালার সাথে মন মজেছে….. “
বিখ্যাত একটা পটের গান।বাংলার লোক শিল্পগুলির মধ্যে অন্যতম।
লোকচিত্রকলার এক বিশিষ্ট অঙ্গ পটচিত্র । পটশিল্পের সূচনা-ইতিহাস নির্দিষ্ট করে জানা না গেলেও ধারণা করা হয়, এ-শিল্পের উদ্ভব প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। প্রাচীন কাল থেকে পটুয়ারা এ-উপমহাদেশের সাধারণ মানুষকে দর্শন-শ্রবণের মাধ্যমে বিনোদন ও শিক্ষা দিয়ে আসছেন। ভারুত, অমরাবতী, অজন্তার চিত্রকলায় ‘গল্প বলা’র যে ঢঙ বা প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়, তা পটচিত্রেরই অনুরূপ।
পশ্চিমবঙ্গ (ভারত) ও বাংলাদেশে আজও একটি বিশেষ চিত্রকর সম্প্রদায় এক আখ্যানধর্মী লোকচিত্রকলার পেশায় নিয়োজিত।এ শিল্পকলার আদি উৎপত্তি সম্পর্কে যেমন কিছু জানা যায় না,তেমনি এ শিল্পকর্মে নিয়োজত চিত্রকর সম্প্রদায়ের আদি উৎপত্তিও জল্পনা-কল্পনার বিষয়।
মধ্যযুগের হিন্দু জনসমাজ তাদের স্বকীয় যাথার্থ্যবোধে পেশাগত সোপানিক ভিত্তিতে সমাজে বর্ণপ্রথা গড়ে তোলে। বৃহদ্ধর্মপুরাণে বিশ্বরূপকার বিশ্বকর্মার নয় ছেলে সম্পর্কে উল্লেখ আছে। ঐ আখ্যান অনুযায়ী, নিচুজাতের এক রমণীর সঙ্গে বিশ্বকর্মার মিলনের ফলে ঐ নয় সন্তানের জন্ম হয়। ঐ নয় সন্তান তথা নবসায়কের নিয়তি নির্ধারিত হয় তাদেরকে গতর খাটিয়ে বেঁচে থাকতে হবে – এভাবে। পটচিত্রকরকে ঐ নয় সন্তানের কনিষ্ঠ সন্তান গণ্য করা হয়। আট সন্তান পেশাগত বা অন্যান্য উপায়ে সামাজিক পর্যায়ে তাদের অবস্থার উন্নতি করতে সক্ষম হলেও, নবম চিত্রকর সন্তানটি তাতে ব্যর্থ হওয়ায় তার জন্মকালের ললাটলিপির বোঝাই তাকে বয়ে চলতে হয়্। চিত্রকরদের এ জনসমাজ সামাজিক পর্যায়ে তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য একযোগে ইসলাম গ্রহণ করে। তবে যেহেতু তারপরেও তাদের মধ্যে প্রতিমাপূজার রীতি থেকে যায় সে কারণে তারা মুসলিম জনসমাজের মূলধারায় সামাজিক পর্যায়ে গৃহীত বা স্বীকৃত হয় নি। আর তাই এ জনসমাজের লোকেরা তাদের দ্বৈত পরিচয় দিয়ে থাকে। নিজ সমাজের মধ্যে তারা তাদের মুসলিম নামে পরিচিত আবার তাদের হিন্দু গ্রাহকদের কাছে তাদের পরিচয় দেওয়া হয় হিন্দু নামেই। তবে তাদের নামের সাথে সাধারণ নাম: চিত্রকর -এ শব্দটি দেখেই তাদের পেশা ধরা যায়।
বাংলাদেশে কাপড়ের বা কাগজের ওপর ছবি আঁকার শিল্পই হল পটচিত্র। আসলে পট শব্দটি সংস্কৃত পট্ট বা পালি পট্টিকা থেকে এসেছে, যার অর্থ কাপড়। যারা পটে ছবি আঁকতেন তাদের বলা হত পটুয়া।তবে নামের পরে পটুয়া ছাড়াও চিত্রকর, পটিদার, চাবড়ি উপাধি তাঁরা ব্যবহার করতেন। পটুয়ারা ছিলেন লোকশিল্পী বা গ্রামীণশিল্পী। পটুয়ারা বংশ পরম্পরায় ছবি আঁকতেন। আজকাল এঁদের সংখ্যা দিন দিন কমছে।
বাংলার পটচিত্র পট বা বস্ত্রের উপর আঁকা একপ্রকার লোকচিত্র। এটি প্রাচীন বাংলার (বাংলা ভাষাভাষী অধ্যুষিত অঞ্চল) অন্যতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। প্রাচীনকালে যখন কোন রীতিসিদ্ধ শিল্পকলার অস্তিত্ব ছিলনা তখন এই পটশিল্পই বাংলার শিল্পকলার ঐতিহ্যের বাহক ছিল। যারা পটচিত্র অঙ্কন করেন তাদেরকে সেযুগে এবং এযুগেও পটুয়া বলা হয়। পটের উপর তুলির সাহায্যে রং লাগিয়ে বস্তুর রূপ ফুটিয়ে তোলাই পট চিত্রের মূলকথা ।এতে কাহিনী ধারাবাহিক ভাবে চিত্রিত হতে থাকে । অন্তত আড়াই হাজার বছর ধরে পটচিত্র এ উপমহাদেশের শিল্প জনজীবনের আনন্দের উৎস, শিক্ষার উপকরণ এবং ধর্মীয় আচরণের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে ।পটের ছবিগুলো সাধারণত দ্বিমাত্রিক। ছন্দায়িত রেখা ও রঙ গাঢ় উজ্জ্বল। সরলতা, বাস্তবতা, গতিময়তা, দৃঢ়তা, বলিষ্ঠতা পটচিত্রের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ছবির মুখ সাধারণত পাশ থেকে আঁকা। লম্বা চোখ দেখতে পাতার মতো, ছুচল নাক ও চিবুক, ভারি পোশাক এ-সব ছবির সাধারণ বৈশিষ্ট্য। নৈসর্গিক দৃশ্যাবলি নেই, নেই দূরের ছবিও। চিত্রে লোকজরীতি সুস্পষ্ট, ধ্রুপদীরীতি অনুপস্থিত। কেবল নান্দনিক গুণার্জনের জন্য পটুয়ারা ছবি আঁকতেন না জ্ঞান, শিক্ষা, আনন্দ ও পুণ্যকে আদর্শ মেনে গ্রামবাংলার জনজীবনকে চেতনাগতভাবে সমৃদ্ধ করাই ছিল পটশিল্পীদের মূল লক্ষ্য।
পট মূলত দুই ধরনের রয়েছে। যথা:
জড়ানো পট: এ ধরনের পট ১৫-৩০ ফুট লম্বা এবং ২-৩ ফুট চওড়া হয়।
চৌকা পট: এগুলোর আকার ছোট হয়।
‘জড়ানো পট’–এই চিত্রের কাপড় আট থেকে পঁচিশ হাত লম্বা এবং দু’ থেকে আড়াই হাত চওড়া হয়ে থাকে। একটি কাঠের দণ্ডে পট পেঁচিয়ে বা জড়িয়ে রাখা হত বলে এ-ধরনের পটকে ‘জড়ানো পট’ বলা হত। এতে ধারাবাহিকভাবে ছবি আঁকা থাকত। পটুয়ারা জড়ানো পট খুলে গানের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে ছবির বর্ণনা করতেন। জড়ানো পটচিত্রে (scroll painting) বিশটিরও বেশি ফ্রেম বা কাঠামো থাকে। এ ছাড়াও থাকে, আড় লতাই বা আয়তাকার জড়ানো পট (oblong scroll) যাতে বিশেরও বেশি ফ্রেম থাকে।
আর একটা ছিল আয়তকার ‘চৌকশ পট’। এগুলো আকারে ছোট একটি ফুলস্কেপ কাগজের চেয়ে সামান্য বড় হত। এতে একটি মাত্র ছবি আঁকা থাকত।
নানাধরণের পট :
যমপট বা জাদুপট ও চক্ষুষ্মান পট এগুলির সাথে ধর্মীয় নিদানতত্ত্ব (eschatology) সম্পর্কিত। এগুলি সাম্প্রতিক কোন ঘটনায় শোকসন্তপ্ত পরিবারের জন্য অাঁকা হয়। হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কিত নানা আখ্যানকাহিনী চিত্রিদৃশ্য লক্ষ্যণীয়, তাদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যগুলির তফাৎ অবশ্য লক্ষ করা যায় তাদের মাথায় পরা মুকুট ও অন্যান্য দেবমূর্তি সম্পর্কিত বিশেষ চিহ্নগুলিতে। চিত্র বর্ণনায় বাস্তব ও কল্পনার উপান্তিক সীমানা মিলেমিশে একাকার হতে দেখা যায়। এধরনের লোকপ্রিয় অতিকথামূলক ধর্মীয় মূলভাবগুলির উদাহরণে মহিষাসূরমর্দিনী, কমলে কামিনী, বেহুলা-লখিন্দর, মনসা-চাঁদ সওদাগর, কৃষ্ণ-রাধা, চৈতন্যলীলা এ সবের উল্লেখ করা যায়। মরং বুরু, মরা-হাজা, পিচলু বুড়ি ইত্যাদির কাহিনী সাঁওতাঁল সম্প্রদায়ের জন্য অাঁকা হয়ে থাকে। আর মিশ্রশ্রেণীর গ্রাহকদের জন্য পীরপট অাঁকা হয়। এতে পীর যে সব অলৌকিক ঘটনা সম্ভব করেন তা অাঁকা হয়। রাশিচক্র দেখিয়ে রাশিপট অাঁকার বিষয়টিও জনপ্রিয়। যম, যাদু ও চক্ষুদানপটের মতো রাশিপট যাদুটোনা ও ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। চৌকা পটের মধ্যে চক্ষুদান পট কৌতূহলোদ্দীপক। পটুয়ারা মৃত ব্যক্তির চক্ষুবিহীন কাল্পনিক ছবি এঁকে তার স্বজনদের নিকট গিয়ে এই বলে পারিশ্রমিক দাবি করত যে, চোখ অাঁকা না হলে তারা স্বর্গের পথ দেখতে পাবে না। চৌকা পটের মধ্যে কালীঘাটের পট বিখ্যাত। ১’× ৮´ মাপের কাগজে দেবদেবী, মানুষ, ব্যঙ্গ প্রভৃতি বিষয় অবলম্বনে এই পট অঙ্কিত হতো। আঠারো-উনিশ শতকের কলকাতা ছিল এর লালন ক্ষেত্র।পটের বিষয়বস্ত্ত হয় সাধারণত ধর্মীয়, সামাজিক ও কাল্পনিক। পটুয়াদের তুলিতে মানুষের ভাবলোক ও আধ্যাত্মিক জীবন সহজ-সরলভাবে প্রতিফলিত হয়। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা আট শতক থেকে বুদ্ধদেবের জীবনী-সংক্রান্ত জাতকের গল্পসম্বলিত মস্করী নামক পট প্রদর্শন করতেন। পরবর্তী সময়ে হিন্দুধর্ম ও পুরাণ হয় পটের প্রধান বিষয়। হিন্দুদের বিভিন্ন দেবদেবী, যেমন: দুর্গা, কালী, মনসা, অন্নপূর্ণা, লক্ষ্মী, যম, চন্ডী, দশ অবতার প্রভৃতি; পৌরাণিক কাহিনী, যেমন: রামলীলা, কৃষ্ণলীলা ইত্যাদি, এমনকি কৈলাস, বৃন্দাবন, অযোধ্যা ইত্যাদি পবিত্র স্থানসমূহও এতে মূর্ত হয়ে ওঠে। এছাড়া জাদু, গাজী এবং হিতোপদেশমূলক চিত্রপটও অঙ্কিত হতে দেখা যায়। হিন্দুধর্মের শিব-পার্বতীলীলা, মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, বৈষ্ণবধর্মের শ্রীগৌরাঙ্গলীলা ইত্যাদি পটের আকর্ষণীয় বিষয়। রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী, যেমন: রামের বনবাস, সীতাহরণ, রাবণবধ, কৃষ্ণলীলা ইত্যাদিও পটে অঙ্কিত হয়।
অঙ্কন পদ্ধতি :
কাপড়ের উপর গোবর ও আঠারো প্রলেপ দিয়ে প্রথমে একটি জমিন তৈরি করা হয়। সেই জমিনের উপর তুলি দিয়ে বিভিন্ন চিত্র অঙ্কিত হয়।জমিন তৈরির পর অঙ্কনকাজ শুরু হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশজ রঙের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য; যেমন: ইটের গুঁড়া, কাজল, লাল সিঁদুর, সাদা খড়ি, আলতা, কাঠ-কয়লা ইত্যাদি। পটটিকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে কাজ করা হয় এবং রংয়ের প্রকারের মধ্যে লাল, নীল, হলুদ, গোলাপী, বাদামী, সাদা এবং কালো ব্যবহৃত হয়।কাপড়ের ওপর কাদা ও গোবর মিশ্রিত একধরনের আস্তরণ দিয়ে তা শুকিয়ে সেই কাপড়ের ওপর ছবি আঁকা হত। কখনও কখনও আবার কাপড়ের ওপর কাগজ সেঁটে তার ওপর চুন বা খড়ি মাটির প্রলেপ দিয়ে পটের জমিন তৈরি করা হত। তাঁরা দেশীয় একধরনের মোটা কাগজের ওপরও ছবি আঁকতেন। পটচিত্রে সাধারণত কালো, লাল, হলুদ, সবুজ খয়েরি ও নীল রঙের ব্যবহার দেখা যায়। সোনালি ও রুপালি রঙের ব্যবহারও মাঝে মাঝে লক্ষ্য করা যায়। রঙ তৈরির জন্য পটুয়ারা বনজ বা খনিজ পদার্থ ব্যবহার করতেন। চাল কালো করে ভেজে কালো রঙ, সিঁদুর বা পাকা তেলাকুচা ফল থেকে লাল, হরিতাল বা কাঁচা হলুদ আর ঘুষুংমাটি মিশিয়ে হলুদ, খড়িমাটি দিয়ে সাদা, ময়ুরকণ্ঠী গুঁড়ো দিয়ে নীল রঙ বানানো হত। শুকানোর পর রঙ যেন টেকসই হয়, সে-জন্য তেঁতুল বিচি গরম পানিতে ভেজানো আঠা অথবা বাবলা বা নিম গাছের আঠা কিংবা খয়েরের আঠা বা গাদের আঠা বা শিরীষের আঠা বার্নিশের মতো ব্যবহার করা হত। তুলি তৈরি করা হত সাধারণ বাঁশকাঠির সঙ্গে ছাগলের লোম সুতা দিয়ে বেঁধে।
পটচিত্র বিক্রয়যোগ্য পণ্য নয়। পটচিত্রকর্ম বংশানুক্রমিক পেশা রক্ষার উপায়। এ শিল্পশৈলীর উত্তরাধিকার এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষে বর্তায়। পটুয়া, পটিদার ও পট- এ সব নামে একজন চিত্রকর সাধারণত পরিচিত। চিত্রকর একাধারে কবি, গায়ক ও চিত্রশিল্পী। চিত্রকর হিন্দু অতিকথার আখ্যান কাহিনীকে ছড়ার আকার দেয়। আর তাতে একটা নীতি শিক্ষার বিষয়ও থাকে। স্ক্রোল পেন্টিং বা জড়ানো পটে ধারাবাহিক কয়েকটি কাঠামো বা ফ্রেমে আখ্যানকাহিনীর ধারাচিত্রগুলি অাঁকে পটচিত্রকর।গ্রাহকের কাছে সে তার জড়ানো পটের ফ্রেমগুলি একের পর এক খুলে ধরে বর্ণনা করে যেতে থাকে। আর তার মাঝে যে নীতি শিক্ষার বিষয় তুলে ধরা হয় তাতে জীবনের নানা পাপ ও পুণ্য সম্পর্কে শ্রোতারা সজাগ হয়ে ওঠে।ছবি দেখিয়ে গান গেয়ে এরা অর্থ উপার্জন করে।অনেকগুলি জড়ানো পট নকশা আঁকা গিলিপ ব্যাগে করে তাঁরা এ গ্রাম থেকে সে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে।
বাংলাদেশের বরিশাল, পটুয়াখালি, কুমিল্লা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ জেলায় এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া জেলায় পটুয়াদের বাস ছিল। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার পটুয়াটোলা আর বাংলাদেশের পটুয়াখালির নামকরণ ‘পটুয়া’ থেকে হয়েছে বলে কেউ কেউ ধারণা করেন। এ থেকেই অনুমান করা যায়, এককালে পটুয়াদের বিচরণক্ষেত্র ও পটশিল্পের প্রভাব কতটা বিস্তৃত ছিল। তবু সামাজিক অবিচার, বঞ্চনা, অবহেলা আর উপেক্ষা যুগ যুগ ধরে পটুয়াদের নিষ্পেষিত করেছে। পটুয়ারা ছিলেন মূলত নিম্নবর্ণের হিন্দু। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অত্যাচারে অনেক পটুয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। মুসলমান সমাজেও যে তাঁরা মর্যাদাবন হয়ে উঠতে পেরেছিলেন এমন সাক্ষ্যও ইতিহাসে পাওয়া যায় না। মুসলমান পটুয়ারা গাজী পীর বা ধর্মযোদ্ধাদের কাল্পনিক বীরত্বকাহিনির পাশাপাশি হিন্দু দেবদেবী, পুরাণ, মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি বিষয়কে পটের উপজীব্য করেছেন। বাংলাদেশ অঞ্চলে কালুগাজীর পট বেশি জনপ্রিয় ছিল। গাজীর পটে বাঘের পিঠে গাজী এবং বনবিবির ছবি দেখতে পাওয়া যায়। কলকাতার কালীঘাট মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ‘চৌকশ পট’ শিল্প। মূলত মন্দির ঘিরেই শিল্পটি বিকশিত হলেও সমকালীন ঘটনা, বিষয় ও চরিত্র পটশিল্পীদের উপজীব্য হয়ে উঠেছিল। কালীঘাটকেন্দ্রিক পটচিত্রের সুনাম দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও পৌঁছেছিল। কালীঘাটের পটুয়াদের মধ্যে শিল্পী হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন কালীচরণ ঘোষ, নিবারণচন্দ্র ঘোষ, বলরাম দাস, গোপাল দাস ও নীলমণি দাস।
পটুয়ারা কেবল চিত্রশিল্পীই ছিলেন না, ছিলেন একাধারে কবি, গীতিকার ও সুরকার। সাধারণত পারলৌকিক ও ধর্মীয়ভাব মিশ্রিত বিষয় নিয়ে পট নির্মিত হলেও পটুয়ারা বিষয় নির্বাচনে রক্ষণশীল ছিলেন না। কর্মে ও চেতনায় তারা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, বলা যেতে পারে ধর্মনিরপেক্ষ। সমাজের নানা অন্যায় অবিচার পটুয়াদের পটে চিত্রিত হয়েছে দ্রোহের হাতিয়ার হিসেবে। গ্রাম-বাংলার হাট-বাজার, পথে-ঘাটে বিভিন্ন লোকালয়ে পট দেখিয়ে গান গেয়ে, গল্প বলে তারা মানুষকে জ্ঞান ও আনন্দ বিলাতেন, বিনিময়ে জীবনধারনের মতো অর্থ উপার্জন করতেন। সে-কারণে তাঁদের বলা হত ভবঘুরে চিত্রকর। তাঁদের নীতিজ্ঞান ছিল উঁচু পর্যায়ের। সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায়ে রাখতে পটশিল্পীরা ছিলেন সদা সচেষ্ট, যার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁদের ছবি ও গানে। পটুয়ারা কেবল লোকরঞ্জকই ছিলেন না, ছিলেন লোকশিক্ষকও।
পটের গান :
“প্রজাগণে বলে, রাজা শুন মহাশয়
শনিকে নিতে পারলে আপনার যাত্রা শুভ হয়
শনির চিন্তা মহাচিন্তা রাজা যখনি করিল
শনির দৃষ্টিতে রথ উড়িতে লাগিল”॥
মঙ্গলকাব্যের কবিরা পুষ্পিকায় যেমন আত্মপরিচয় দিতেন তেমনি পটুয়ারাও তাঁদের গানের শেষে নিজেদের নাম এবং ঠিকানাটিও ব্যক্ত করেন।যেমন:
” এইখানেতে শেষ করিলাম মনসার বন্দনা।
শিল্পী দুখুশ্যাম চিত্রকর গ্রাম নয়াপিংলা ঠিকানা।”
ক্রমশঃ…