আফ্রিকার গল্প-৫

লে স লি  নে নে কা  আ রি মা (নাইজেরিয়া)

অচ্ছুৎ কন্যা

অনুবাদঃ কা মা রু জ্জা মা ন


কাপড় না-পরা মেয়েটার তলপেটের বুনো ঝোপ পরিস্কার করে কামানো। তাতে মোম মাখানো, দেখে মনে হয় যেন অস্তগামী সূর্য্য। তার প্রসাধনী ও গা’য়ে মাখার লোসন সামনে বিছিয়ে রাখতে দেখে কাপড় পরা মেয়েরা মুখ বেঁকিয়ে হাসল, সে চোখ পিটপিট করে তাদের সুফল নিয়ে বড়াই করে বলে উঠল, ”কেমন নরম মুচমুচে চামড়া দেখবে তখন, হুঁ” – তার ন্যাঙটামি নিয়ে তামাসা করার চেষ্টা করেও সে সফল হোল না। এজেম তার বাক্সো থেকে সবকিছু বের করে আনতেই চিদিনমা ঘাড় নেড়ে সোৎসাহে হেসে সবকিছু নাড়াচাড়া করে দেখল। এবং এজেমকে তার সব জিনিস খুলে দ্যাখাতে বলল যাতে সে একটা কিছু মুফতে পেয়ে যায়, একটা খদ্দেরও যদি তার জিনিস না কেনে তাতেও সই।
মেয়েদের শরীরের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হোল চামড়া – এই একটা বুলি শুনিয়েই এজেম হুড়মুড় করে তার সব জিনিস বিক্রি করে ফেলল। এখন তার উপার্জ্জিত সম্পদকে গুছিয়ে নিতে হবে। কাপড় পরা মেয়েরা খিলখিল করে হাসতে লাগল এবং তাদের গা’য়ের নকশা করা সুন্দর বউ-পোশাক তারা ঠিক করে নিল। তারা ভাঁজ ভাঁজ সাধারণ পোশাক পরে ছিল, কোমরে সুন্দর করে জড়ানো, কাপড়ের রঙেই চোখ জুড়িয়ে যায়। তারা ন্যাঙটো এজমের দিকে তাকালো, তাদের চোখে কেমন যেন আনন্দঘন করুণা।
”তোমার বয়সে আমি কাপড় খুলে থাকতে পারতাম না। কম বয়স হোলে ঠিক ছিল।”
”আমার একজন বন্ধু মেয়ে খুঁজছে। চাইলে আমি আলাপ করিয়ে দিতে পারি। তার অত ছুতোছাতা নেই।”
এজেম তার চোখ ঘোরাল, বিরক্তিতে নয়, চোখের জলকে সামাল দিতে। সবসময় এমনই কি ঘটবে? সে চিদিনমার অনুগ্রহ প্রার্থনা করল।
”তো, কাপড় পরা বা না-পরা নিয়ে কথা বলার আমার কোনো ইচ্ছা নেই। আমার একটা লোসন চাই, এটাই আমার পছন্দ।” চিদিনমা দামী একটা ক্রিম হাতে নিয়ে তুলে ধরল। এজেম লোক দেখিয়ে সেটা ঝাঁকাল। অন্য মেয়েরা তাদের কেনাকাটা করতে চেয়ে কেমন যেন ভড়কে উঠল। তারা এজেমের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা থামিয়ে দিল এবং তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে শুরু করল যেন সে একজন ওসু মেয়ে। জিনিসের গুণাগুণ তারা ফাঁকায় ফাঁকায় বলাবলি করতে লাগল, কখনো বা চিদিনমার সঙ্গে। এজেম জবাব দিলে তারা শুনল বটে কিন্তু মন থেকে মেনে নিতে পারল না। এজেম রুখে উঠতে পারত, এবং চিদিনমাও, কিন্তু তারা তাদের খদ্দেরদের কথা শেষপর্য্যন্ত শুনে চলল। ঠিক তখনই এসে হাজির হোল চিদিনমার স্বামী। চিদিনমা যখন তার সঙ্গে বিক্রি করতে বসতে রাজী হোল সে একটা শর্ত করল। বলতে গেলে, এই শর্তেই তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হোয়ে গ্যালো। আমার স্বামীর কাছে কখনো তুমি নিজেকে বেচবে না। চিদিনমা সবসময় মজা করে একটা অভিযোগ করার চেষ্টা করত – ”এখনো তো তোমার কোনো ছেলেপুলে হয়নি, তোমার শরীরটা তাই এখনো বেশ চম্পু” – কিন্তু তাতেও কিছু চাপাভাব ছিল যা বছরের পর বছর বেড়ে উঠেছিল কেন না তখনো পর্য্যন্ত সে কাউকে পায়নি।
যে-মহিলা প্রথম এজেমকে এড়িয়ে চিদিনমার সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে এসেছিল সে ঘড়ির দিকে চোখ রেখে নজর দিল, চাপা হাসি হাসল, এবং বলল যে প্রতিটা জিনিস তাকে খোলসা করে বুঝিয়ে বলতে হবে। এজেম চেষ্টা করল, সত্যিই সে চেষ্টা করল, ফড়ফড় করে সব জিনিসের ব্যাখ্যা করল, কিন্তু ঘড়ির কাঁটা নিজের নিয়মেই ঘুরে চলল, শেষপর্য্যন্ত অনিবার্য্য লজ্জ্বায় ভেঙ্গে পড়ে চিদিনমা তাকে থামিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চিদিনমার স্বামী কাজ থেকে ফিরে এল।
আর পাঁচটা স্বামী যেমন হয় চান্স লোকটা ছিল ভালো। সে একটা পাবলিক ব্যাঙ্কের কয়েকটা শাখার তদারকি করত। এই কাজের সুবাদে তাদের বড়ো বাড়িটায় তাদের আরাম-সে চলে যেত। একজন ওসু-মেয়ে চিদিনমাকে জরুরী কাজে সাহায্য করত। চান্সকে খোলা মনের মানুষ বলা যেতে পারে। মোটের উপর কাপড় না-পরে থাকা বন্ধুর সঙ্গে তার বউয়ের মেশামেশি করে চলতে সে আপত্তি করত না এবং তার কাজের ওসু মেয়েটার উপর হয়রানি করার মতো মানুষও সে ছিল না। এটা সত্য যে সে একটু খাতির চাইত, কিন্তু তার বশ হোয়ে পড়ার পর থেকে চিদিনমা এমন হোয়ে উঠেছিল যে সে তার মাথাটা তুলে তাকে চুমু খেতে বলত, চান্স তাকে তাও আস্কারা দিত, তার দুই হাত দিযে বউ-পোশাকের ভিতর দিয়ে তার ছোট্ট পিঠটা ধরত।
কিন্তু সে ছিল খুব শান্তশিষ্ট মানুষ, যখন সে মেয়েদের দিকে ঘুরে তাদের অভিবাদন করত তার চোখ গিয়ে পড়ত এজেমের উপর এবং সেখানেই পড়ে থাকত, তার দুধের চারপাশে বাদামি চাকার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখত, দেখত তার তার পা’য়ের মাঝখানে নকশা করে ছাঁটা লোম, বসে থাকা অবস্থায় তার শরীরের আঢাকা সবকিছু। কেউ কিছু বলত না, কাউকে না-পাওয়া একজন মহিলার একজন বিবাহিত পুরুষের বাড়িতে থাকার বেয়াদবিকে সামাজিক ভ-ামি বললে আপত্তি করার কিছু ছিল না। কিন্তু চিদিনমার বিড়ম্বনা ক্রমশঃ বেড়ে ওঠাতে সর্দ্দার ঘরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চাইল এবং মেয়েরা উঠে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হোল, চান্সের সামনে মাথা নত করল এবং চিদিনমার হাত দু’টো ধরে তাকে সান্ত¡না দিল। অবশ্যই ঘটনাটা সকলের কাছে রাষ্ট্র হোয়ে পড়ল – ”সে যেভাবে তার দিকে চেয়ে তাকিয়ে খাকত” – নিচু জাতির ছিল।
চিদিনমা তার স্বামীর কাছে তার সেদিনের কাজকর্ম্মের কথা জানতে চেয়ে তার মন ভোলাতে চাইল। চান্স এজেমের দিকে চেয়ে থেকেই তার জবাব দিল। এজেম পা চালিয়ে চলতে চাইল যত জলদি পারে পালিয়ে যাওয়ার জন্য, কিন্তু সে তার দু’টো বুকের প্রতিটা দুলুনি এবং পা চালিয়ে চলতে গিয়ে তার দু’টো জঙ্ঘার ঘষ্টানির প্রতি সজাগ হোয়ে উঠল। এজেম যখন চলে যাচ্ছিল তখনই শুধু চান্স তার সঙ্গে কথা বলল, এজেম তাকে সৌজন্য দেখিয়ে ছোট্ট করে বিদায় জানাল। চিদিনমা তাকে দুয়ার পর্য্যন্ত এগিয়ে দিল।
”এজেম, আমার মনে হয় তোমার সবাইকে এড়িয়ে চলাই ভালো হবে,” সে কষ্ট পাওয়ার ভাব দেখিযে এইকথা বলে সবকিছু চুকিয়ে দিতে চাইল, ভাঙ্গনটা যে অস্থায়ী নয় সেটাই সে ইঙ্গিত করল।
”কেন?”
”সেটা তুমিও জানো।”
”তোমাকে সেটা বলতে হবে, চিদিনমা।”
”ঠিক আছে, পুরো ব্যাপারটা. মানে আমাদের বন্ধুত্বটা ঠিকই ছিল যখন আমরা কাপড় না-পরা মেয়েদের মতো যা খুশী করে বেড়াতাম, কিন্তু কাপড় পরা মেয়েরা কাপড় না-পরা মেয়েদের বন্ধু হোতে পারে না। প্রথমে আমি এটাকে বোকা বোকা বলো ভাবতাম, কিন্তু এটা সত্যি। আমি দুঃখীত।”
”তুমি তেরো বছর ধরে কাপড় ঢেকে আছো, এটা নিয়ে কখনো ভোগান্তি হয়নি।”
”আমি ভেবেছিলাম এর মধ্যে তুমি কাপড় পরা শুরু করবে। তুমি একজনের কাছাকাছি আসতে পেরেছিলে কিন্তু তুমি কোনো চেষ্টা করোনি। তোমার বড়ো বেয়াদবি ব্যাপার এটা ”
”তুমি বলার পর থেকে সে একবারই মাত্র আমাকে দেখেছে – ”
”একবারই যথেষ্ট। কাপড় পরা শুরু করো। কারুর সঙ্গে জুটে যাও। বাজারে আর এসো না। যতদিন তা না করো আমি মেনে নিতে পারবো না। না।”
এজেম জবাব দেওয়ার আগেই চিদিনমা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল। সে আর কী বলতে পারত? আমি বুঝতে পারি না আমি কখনো কারুর হোতে চেয়েছি কি না? চিদিনমা তাকে পাগল ভাবত।
এজেম তার বাক্সোটা দিয়ে তার বুক দু’টো ঢাকা দিল এবং বাস স্টপের দিকে চলল। চিদিনমা তার বাড়ি ফেরার জন্য তাকে কিছু দিয়ে সাহায্য করেনি যদিও সে জানত এজেম বাসে চড়তে একদম পছন্দ করত না – ঘামশোষা কাপড়ের চৌকো আসনে ঠাট হোয়ে বসে থাকলে লোকজন তার দিকে তাকিয়ে দেখবে, বা তার মাসিক-বন্ধনী ছিঁড়ে যাওয়ার প্রতি সেকেন্ডের কল্পনায় সে কী করবে।
বাসস্টপে কয়েকজন যুবক অপেক্ষা করছিল। তারা এজেমকে দেখে কথা বলা থামিয়ে দিল, তারপর আবার শুরু করল। এখন তাকে নিয়েই তাদের কথাবার্তা চলতে লাগল।
”ওর বয়স কত হবে বলে মনে হয়?”
”আরে ইয়ার, একেবারে বুডঢি।”
”আমি জানি না, ভাই। ওর বুক দু’টো লক্ষ্য করবি। ও নিশ্চয় বাক্সোটা নামাবে।”
তারা অপেক্ষা করেই রইল। এজেম তাদের পরোয়া করল না, সে বাক্সো ও প্রসাধনী কম্পানির নাম লেখা থলেটা দিয়ে যথাসম্ভব নিজেকে ঢেকে রাখল।
”ওই জন্যেই ওকে কেউ নেয়নি বুঝলি। এক্কেবারে বেহেড। কে ওকে আর নিচ্ছে?”
বাস আসা পর্য্যন্ত তারা এইভাবে কথা বলে চলল। যদিও পুরুষদের আগে ওঠার কথা, তারা ওকে সামনে উঠতে দিল। আসলে তাদের এই বিনয়ে ছিল আরও ভালো করে দ্যাখার জন্য তাদের গোপন কামনা। যাত্রীদের মধ্যে কাপড় না-পরা অন্য মেয়েদের খুঁজল – মনের মানুষ খোঁজার মতো আর কি – এবং একজনকে দেখে তার ভরসা হোল। কিন্তু ভরসাটা অচিরেই উবে গ্যালো। মেয়েটা ছিল বেশ সুন্দরী যা নিজেই নিজেকে কামড় দিত, কিন্তু সে যুবতীও বটে, গা’য়ের চামড়া মিহি ও টানটান। যুবক দলের কাছে এজেমের আর অস্তিত্ব রইল না। তারা সেই মহিলাকে পেয়ে বসল। তার কোমরের ভাঁজ, তার হাতের সুঠাম বিভঙ্গ নিয়ে খুব বলাবলি করতে লাগল। যুবতী মহিলা সবকিছু খুব সহজভাবে নিল। এবং একটা আঙ্গুল দিয়ে তার বইয়ের পাতা উল্টিয়ে চলল।
এজেম কৃতজ্ঞ বোধ করল, এবং হেয়োও মনে করল নিজেকে। তার মনে হোতে লাগল কোমরটা মুটিয়ে যাওয়ার আগে এবং পাছাটা ঝুলে পড়ার আগে সে তার যুবতী বয়সে দেখতে কেমন খারাপ ছিল। দেমাক দেখিয়ে কাপড় খুলে থাকার মতো কখনই সে ছিল না। কিন্তু সে শুধু মনে করত তাতে তাকে দেখতে সুন্দর লাগবে।


বাসে আরও অনেক যাত্রী উঠল। যখন একজন ওসু মেয়ে উঠল তখন বাসটা চারের তিনভাগ ভর্তি হোয়ে উঠেছিল। এজেম তার দৃষ্টি এড়ানোর আগে দু’টো আসনই দখল করে বসল। এটা বেআইনী নয়, কিন্তু এরকম কিছু চলত না, কারণ ওসুদের যাওয়ার জন্য নিজেদের আলাদা ব্যবস্থা আছে, অন্য যাত্রীরাও চোখ ফিরিয়ে রইল। ভাবাহত। বিচলিত। এমন কি চালকও সামনের দিকে তাকিয়ে রইল যখন মহিলা তার ভাড়া গুণছিল। এবং যখন সে মাঝে এসে দাঁড়াল, বাসের সব যাত্রীরা যেমন বিনয়ের সঙ্গে কাউকে পাশ কাটতে সাহায্য করে, কথা না বলে কাউকে পাশের আসনে জায়গা করে দেয় কেউ তেমন করল না। সুতরাং বেশ কিছু জায়গা খালি থাকা সত্ত্বেও ওসু মেয়ে দাঁড়িয়েই রইল। বসার জন্য কারুর উপর নিজের ন্যাঙটো শরীরকে চাপিয়ে দেওয়ার থেকে বরং এটাই ভালো। এটা এক ধরনের সামাজিক শুদ্ধতা, এজেম ভাবল, এতে ভবিষ্যতে মানুষের আচরণ ভালো হবে।
বাসটা এগিয়ে চলা শুরু করতেই ওসু মেয়ে নিজেকে গুটিসুটি করে নিয়ে যাত্রীদের যেতে দিল, তারা কিন্তু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল না। এজেম নড়েচড়ে বসল। সে নিজের কাছে প্রায় অদৃষ্ট হোয়ে উঠেছিল। জীবনের কাছ থেকে এবং সে যাদের জানত তাদের কাছ থেকে কোনো সাহারা না পাওয়াটা তাকে অদৃশ্য করে তুলেছিল। জন্মের মাহাত্ম্যের কারণেই শুধু সে ওসু হয়নি, শেষবার কথা বলার সময় তার মা তাকে বলেছিল। ”তুই অন্তুতঃ কিছু বেছে নিতে পারবি, এজেম। যা করবি ভেবেচিন্তে করবি।” তা সে করেনি, সে একটা লোককে ছেড়ে চলে এসেছিল যে তাকে প্রস্তাব করেছিল এবং তাকে সাহারা দিতে চেয়েছিল। তার মা-বাবা তখন থেকে তার সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখেনি, সে ঐতিহ্য রক্ষা করেনি বলে তারা হতভম্ব ও ক্ষিপ্ত হোয়ে উঠেছিল। সে কোনো ব্যখ্যা দিতে পারেনি, এমন কি নিজের কাছেও, লোকটা যে-কাপড় দিয়েছিল সেটার দিকে তাকিয়ে কেন তার ভারী মনে হয়েছিল, মনে হয়েছিল সেটা তাকে গলা টিপে মেরে ফেলবে।
স্টপে এসে এজেম নেমে পড়ল, বাক্সোটাকে বুকে ধরে রাখল। একটু আধটু তাকানো ছাড়া কেউ তার দিকে তেমন নজর করল না। এই কারণেই তার নগরটাকে ভালো লাগল, সবাই নিজের চরকায় তেল দিয়ে চলল। সে আরও জোরে হাঁটতে শুরু করল যখন সে তার বার্গুন্ডি রঙের দেওয়া আবাসন বাড়ির ছাদনাটা লক্ষ্য করল। এলিভেটর থেকে একজন বয়স্ক ভাড়াটে অপাঙ্গ দৃষ্টি দিয়ে তাকে দেখল। এজেম পিছু হটে দাঁড়াল, লোকটা ঘুরে তার দিকে তাকিয়েই রইল। কেউ বলতে পারে না কোনো পুরুষের সঙ্গে কারুর সম্পর্ক আছে কি না। যাদের বউ আছে তারা কেউ তার দিকে তাকিয়ে থাকলে তার খুব অসহ্য লাগে।
সে তার বাড়িতে এসে বহক্ষণ ধরে হাঁপ ছাড়তে লাগল। প্রকাশ্যে সে এমন করতে সাহস করত না পাছে তার দিকে কারুর নজর পড়ে যায়। তখনই সে চিদিনমার বন্ধুত্ব হারানোর কথা ভাবতে ভাবতে কাঁদতে লাগল।


কম বয়সে যখন তারা তাদের বাবাদের শাসনে ছিল, তখন থেকেই তাদের মধ্যে গভীর সখ্যতা গড়ে ওঠে। তারা তখন সবে স্কুলে ঢুকেছিল, তাদের মাথার হিজাব এমনই সমান ধরনের ছিল যে তাদের পাল্টপাল্টি করা যেতে পারত। এজেম তাদের মেয়েবেলা মধুর স্মৃতিতে স্মরণ করল। তাদের বাবাদের কাপড়ে ঢেকে সুরক্ষার কথাও তার স্মরণ হোল যা বলতে গেলে চরম নিরাপত্তার কাজ করত। পনেরো বছর বয়সে যখন তার মা তার শোওয়ার ঘরে ঢুকেছিল সে হাউমাউ করে খুব কেঁদেছিল, এবং এজেমকে বলেছিল এখন তার কাপড় খুলে থাকার সময়।
একমাত্র পয়সাওলা লোকেরা তাদের মেয়েদের দীর্ঘদিন কাপড় পরিয়ে রেখে ছাড় পেয়ে যেত, বউ-পোশাক লাভ করা পর্য্যন্ত তারা প্রায় ওইভাবে থাকতে পারত। কিন্তু এজেমের বাবা গরীব হোয়ে জন্মেছিল, তার বাড়ি ছিল গ্রামে যেখানে অল্প বয়স থেকেই মেয়েদের কাপড় খুলে নিয়ে ন্যাংটো করে রাখা হোত, অনেকের এমন কি দশ বছর বয়সেই – যতদূর এজেমের বাবা জানত বহুকাল ধরে এমনই চলে আসছে। যাদের পরিবারের মেয়েরা বয়সকাল পার হোয়েও কাপড় পরে থাকত তাদের কপালে কী ঘটেছিল তাও সে জানত, ব্যতিক্রম ছিল বিকলাঙ্গ মেয়েদের ক্ষেত্রে যারা দান-করা ছেঁড়া কাপড়ের ’গোষ্ঠী পোশাক’ পরে থাকত। কিন্তু এজেমের মতো মেয়েদের যদি কাপড় পরিয়ে রাখা হোত, নগর পর্ষদ তার জন্য কর ধার্য্য করত এবং তার বাবা সেটা না মেটাতে পারা পর্য্যন্ত কর ক্রমশঃই দ্বিগুণ হোয়ে উঠত। তখন তার মেয়েকে প্রকাশ্যে ন্যাংটো করা হোত, এবং তার পরিবারের নামে বদনাম ছড়ানো হোত। না, সেই অপমান তার বাবার সহ্য হয়নি। যা কিছু হবে তার মর্জ্জি মাফিক হবে।
যেদিন এজেমকে ন্যাংটো করা হোল সেদিন থেকেই তার বাবা তার সঙ্গে কথাবার্তা বলা বন্ধ করে দিল। একজন বয়স্ক মানুষ যে কোনো ন্যাংটো মেয়ের সঙ্গে কথা বলবে এমন আচরণ সে বরদাস্ত করতে পারল না। এজেম বাড়ি ছেড়ে ইস্কুলে বাজারে বা অন্য কোথাও যেতে চাইত না যেখানে লোকজন তাকে দেখতে পাবে। চিদিনমা তখনো তারা বাবা-পোশাক পরে থাকত, সে তার (ভীতিবিহ্বল, সঙ্গতি সম্পন্ন) বাবাকে বলল যে সে-ও পোশাক ছেড়ে থাকবে যাতে এজেম ও সে একসঙ্গে দুনিয়ার মোকাবিলা করতে পারে – দুজন বে-ওয়ারিশ বাচ্চা মেয়ে।
চিদিনমার মা-বাবা এটাকে ধার্ম্মিকতা বলে মনে করার চেষ্টা করেছিল – সময় হওয়ার আগেই একজন মেয়ের কাপড় খুলে থাকা, কারণ সে ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত ছিল। কিন্তু এতে ধর্ম্মীয় উগ্রতার গন্ধ ছিল এবং তাদের সঙ্গে অনেকের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছিল, যার কারণে তার মা-বাবা তাকে কখনো ক্ষমা করেনি, কথাটা চিদিনমা গোপন করে রেখেছিল।
এজেমের মনে একটা বিশ্বাস কাজ করত যে একই সময়ে তাদের কেউ গ্রহন করবে কিন্তু কুড়ি বছর বয়সে চিদিনমা বউ-পোশাক লাভ করেছিল, তখন এজেম হোয়ে উঠেছিল তার একান্ত সাথী । তারপর চিদিনমা এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিল. তারপর দু’টো মেয়ে যারা সারা জীবন ধরে কাপড় পরে কাটাবে যদি চিদিনমার এই ব্যাপারে কিছু বলার থাকে। এবং এই সময়েও এজেমা কাপর না পরে আঢাকা হোয়েই ছিল, কেউই তাকে গ্রহন করল না, একটা সম্ভাবনায় ভেসে তার সময় কেটে চলল।
এক ঢোকে সে একমগ মদ গলায় ঢালল, তারপর আরও একমগ, এই করতে করতে সে গতকালের চিঠির পাতা উল্টিয়ে চলল। সে একটা লেফাফা খুলল যা সে আগে খুলতে চায়নি, সেটা ছিল : তার বাড়ি ভাড়ার পূনর্নবীকরণ এবং মাসিক ভাড়ার বিপুল বৃদ্ধি। আজকের কামানি দিয়ে পরের দু’মাস আপসে চালিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু ভাড়ার এই বাড় সবকিছু ভ-ুল করে দিল এবং চিদিনমার তাকে ত্যাগ করার কারণে সে তার মহামূল্য সম্পদকে আর বিক্রি করতে পারল না। যদি তার আর কোনো কামানির ব্যবস্থা না হয়, তবে তাকে বাধ্য হোয়ে এর থেকে ছোটো কোনো শহরে চলে যেতে হবে।
যখন সে প্রথমে বাসাটা ভাড়া নেয় তখন এজেম একটা বিরাট বাড়ি নির্ম্মান কম্পানিতে কাজ করত। তার ন্যাঙটো থাকাটা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, সেখানে আরও মেয়ে ছিল যাদের কেউ গ্রহন করেনি, এজেম যা কাজ করত তা ভালো করেই করত, এতে তার উন্নতি হয়েছিল। বছর দশেক পরে সে ত্রিশ বছরের হোয়ে উঠেছিল, সে-ই ছিল কাজের সর্দ্দার, এবং তখনো সে ন্যাঙটো হোয়ে থাকত।
মাস তিনেক আগে সে একজন সম্ভাব্য খদ্দেরের কাছে নিজেকে মেলে ধরেছিল। স্বভাবতঃই সেই ঘরে সে-ই ছিল একমাত্র মহিলা। খদ্দের তার দেহ নিয়ে তেমন আগ্রহ দ্যাখায়নি, বরং তার বিবেচনায় কাজকর্ম্ম থেকে মন সরিয়ে আনা কাউকে না-পাওয়া একজন মহিলার অসচ্চরিত্রতাই তার ভাবনার বিষয় হোয়ে উঠেছিল। এজেম এইসব ব্যাপারে অভ্যস্থ ছিল, সে তখন দরদস্তুর নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করল। যখন লোকটা তাকে অগ্রাহ্য করে, তার কোনো সহকর্ম্মী লোকটার সমালোচনা করেনি, তারা কাগজের কাজে মুখ ডুবিয়ে চাপাহাসি হাসার পথই বেছে নিয়েছিল। সে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে এল।
এজেম কখনো মানব সম্পদ দপ্তরে যায়নি, সে সেটা পছন্দ করত। মানব সম্পদ দপ্তরের অধিকর্তা ছিল একজন কাপড় পড়া, বয়স পঞ্চাশের মতো। সে বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে তার কথা শুনল, তারপর এজেমের খোলা বুকের দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করে বলল, ”ঘরে কোনো মেয়েকে হাতের কাছে পাওয়া গেলে তুমি কী করে আশা করো যে একটা লোক ’পাই চার্ট’ জাতীয় কিছুর প্রতি নজর দেবে? তুমি কাপড় ঢাকা হোলে হয়তো এমন হোত না। যতদিন না তা করছো তুমি আর খদ্দেরদের সামনে যেয়ো না।”
এজেম ভবন থেকে বেরিয়ে এল, আর ফিরল না। সে নিজেকে ঘরবন্ধ করে রাখল যতক্ষণ না চিদিনমা একবোতল ভদকা নিয়ে এসে তার দরজায় ধাক্কা মারল, কোলে তার ছোটো মেয়ে। সে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল ঘরে বসে প্রসাধনী বিক্রি করার একটা ফেস্টুন।
এখন আর তার সেই শক্তি নাই, এবং আর কিছু দিনের মধ্যেই এজেমের সমস্ত সঞ্চয় শেষ হোয়ে যাওয়ার কথা। সে টিভি চালিয়ে দিল। একটার পর একটা চ্যানেল ঘুরিয়ে চলল, সে এমন একটা চ্যানেল খুঁজে পেল যেখানে একজন উলঙ্গ মেয়ে খবর পড়ছিল। মেয়েটা জানাল যে ওনিতসার একটা বাড়িতে আগুন লেগেছে। এজেম দুপুরের খাবার বানাতে লাগল, পিছনে খবর হোয়ে চলল। সে ভাজার জন্য সব্জী কুচোল, ’বেওয়ারিশ মেয়েদের’ কথাটা বারবার তার কানে বেজে উঠল। সে আওয়াজটা বাড়িয়ে দিল।
সংবাদ পাঠিকার সঙ্গে অভিভাবকের ভাব নিয়ে যোগ দিল একজন বয়স্ক মানুষ যে আরও বিস্তৃত করে বলতে শুরু করল।
”বাড়িটা কাউকে না-পাওয়া মেয়েদের গাড্ডা হোয়ে উঠেছে বলে খবর রটেছিল। তাদের কারুর কারুর উপস্থিতি বেআইনি কারবার হোয়ে উঠেছিল। কাপড়ের ব্যবসায়ী যারা সেখানে বাস করত তারা তা নিয়ে কোনো পরোয়া করত না। কর্তৃপক্ষ দমকলের লোকেদের আগুন নেভানো থামিয়ে দিয়েছে যাতে ওইসব নষ্ট হোয়ে যাওয়া মেয়েরা তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। ছাই থেকে অন্ততঃ তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের পরিচয় এখনো পর্য্যন্ত জানা যায়নি।”
এটাও একটা কারণ ছিল যার জন্য এজেমা মেট্রো এলাকায় থাকতে চাইল। ছোটো শহরগুলো বেওয়ারিশ মেয়েদের তেমন দেখতে পারত না। এমন কি তারা ওসু জাতির চাকরাণী না হোলে তাদের অপরাধী বলে গণ্য করা হোত। তাদের অন্ততঃ কিছুটা স্বাধীনতা আছে, এজেম ভাবল – ওইসব ওসু মেয়েরা যারা বাড়ির কাজ করত, ওইসব ওসু পুরুষরা যারা খনিতে বা একদা তার নকশা করা বাড়ির রাজমিস্ত্রির কাজ করত – তার ঈর্ষাটা দমে এল যখন সে ভাবল যে এই স্বাধীনতার কারণ অবান্তর ধারণা। যতদুর মনে হয় বেওয়ারিশ মেয়েদের জায়গা বড়ো বড়ো কারখানা যেখানে তারা তাদের থেকে সৌভাগ্যবান মেয়েদের জন্য কাপড় বুনতে পারে।
শহরের মেয়র সাংবাদিক সম্মেলন করতে এল।
”এই শহরটা সুন্দর, শহরের মানুষরাও সুন্দর। যদি লোকজন কাপড় ছাড়াই বেওয়ারিশ হোয়ে ঘোরাফেরা করতে চায়, তবে তাদের এখানে ঠাঁই হবে না। সম্পত্তি হারালে এবং তারা কোথাও যেতে না পারলে আমার কিছু করার নাই – এটা একটা পারিবারিক শহর। আমাদের সীমান্তে পৃথিবীর অন্যতম একটা কারখানা আছে। তারা সেখানে যেতে পারে।” ছবি সাংবাদিকদের দিকে ঘুরে এল, তারা বিজ্ঞের মতো ঘাড় নাড়ল। তার অভিব্যক্তিতে যে করেই হোক নৈতিক মূল্যবোধ লাগু করার দৃঢ়তা ফুটে উঠল এবং জীবনহানির জন্য সে দুঃখ প্রকাশ করল।
এজেমের মধ্যে আতঙ্কের ভাব জেগে উঠল। তার যা টাকাকড়ি আছে তা কত দিনে তাকে উপকূল প্রদেশে যেতে বাধ্য করবে কে জানে যেখানে সে কাপড় কারখানায় যোগ দিতে পারবে? তার একটা কাজের বড়ো দরকার, এবং যত তাড়তাড়ি সম্ভব।

কী ধরনের কাজ একজন ন্যাঙটো মানুষ করতে পারে? যেকোন কাজে যোগ দেওয়ার পক্ষে এজেমের বয়স বুড়িয়ে গিয়েছিল যেখানে সবমময় তাকে ঘিরে থাকবে বছর কুড়ি বয়সীরা যাদের কেউ না কেউ একদিন গ্রহন করবে। তার জায়গায় সে এমন কাজের খোঁজ করল যেখানে ন্যাঙটো হোয়ে থাকাটা তেমন বিশেষ চোখে লাগবে না। একটা নার্সিং হোমে সে পাঁচ সপ্তাহ টিকে রইল যখন একজন আত্মীয় দর্শনার্থী তার উপস্থিতিতে আপত্তি জানাল। একটা কফির দোকানে সে আড়াই ঘন্টা কাজ করল যখন আগের এক সহকর্ম্মীকে দেখেবভঃ সে পিছনে গিয়ে মুখ লুকাল। পরের দিনই সে কাজটা ছেড়ে দিল। যেখানেই সে গ্যালো তার এই ভাবনা উছলে উঠল যে কর্পোরেট কাজে সে অনেক নিরুপদ্রপে ছিল। শহরতলি ছেড়ে সে অন্যত্র কাজের সন্ধান করল, লোকজন তার খোলা শরীর দেখে সরাসরি জিগ্যেস করতে লাগল কেন সে কাপড় পরে থাকে না, তারা অবশ্য বুঝতে পারল যে তার মধ্যে ওসু মেয়ের ছাপ নাই। কদাচিৎ এজেম যখনই কোনো ওসু মেয়ের দ্যাখা পেল সে বুঝল তাদের দূরে সরিয়ে রাখা হয়, তাদের মাথা কামানোটা তাদের জন্মচিহ্ণ, একটা কানের উপর দিকটা উৎসর্গ করা। অন্য পথচারীরা তাদের গা বাঁচিয়ে চলল পোঁতা খুঁটির মতো, ডাকবাক্সের মতো বা অন্যপথ ধরে যাওয়ার মতো। কিন্তু এজেম তাদের দেখল।
সে মরীয়া হোয়ে সন্ধান করতে লাগল, প্রতিটা খোঁচাই তাকে ছুরির মতো বিঁধল, এমন কি সে তখনো বাবা-পোশাক পরা যুবতী মেয়েদের প্রতিও বিরক্ত হোয়ে উঠল যারা তাকে দেখে মুখ টিপে হাসত, তারা এটা জানত না বা পরোয়া করত না যে অচিরে তাদেরও কাপড়ের রক্ষাবর্ম্ম খুলে নেওয়া হবে। সবচেয়ে খারাপ লাগত ’ওহ, বেবি’ বলে করুণা দ্যাখানোর ভাবটা, কাপড় পরা বয়স্ক মহিলাদের ফিসফিস করে বলা যে কেউ নিশ্চয় ওকে গ্রহন করবে।
কিছুদিন পর তার একটা স্পা’তে ম্যাসেজ করার কাজ জুটল। সেখানে সবাইকে কাপড় খুলতে হয়, তা দেখে সে খুব মজা পেল। এই কৃত্রিম সমতাটা ছিল মনে কিছুটা সান্ত¡না পাওয়ার মতো। তার কাজের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভিতরে এসে ঢুকল এক মহিলা, তার পরনে অতি সুন্দর বউ-পোশাক, এমন সুন্দর এজেমের জীবনে কখনো চোখে পড়েনি। সে উন্নত মানের পরিষেবার ফরমাশ করল যাতে স্পা’র সব ধরনের সুবিধা থাকবে।
”আমি কি আপনার স্বামীর এ্যাকাউন্ট নম্বর জানতে পারি?”
”আমার এ্যাকাউন্ট নম্বর,” জোর দিয়ে বলল মহিলা, বলে সে তার কার্ডটা কাউন্টারে বাড়িয়ে ধরল।
ডেস্কের মেয়েটা কার্ডটার দিকে তাকাল, তারপর ম্যানেজারকে সেটা ধরিয়ে দিল। প্রতীক্ষালয়ের সবাই সেই দিকে দৃষ্টি ফেরাল।
ম্যানেজার এজেমের বয়সী এক মহিলা, সে এগিয়ে এল, খদ্দেরের দিকে তাকিয়ে দেখে তার উদ্ধত ভাব বিনয়ী ও নরম হোয়ে উঠল। ”আমি দুঃখীত। মেয়েটা নতুন, এখনো বাবা-পোশাক পরে থাকে। দয়া করে মাফ করে দেবেন।” ফিনফিনে পোশাক পরা মেয়েটা চুপ করে রইল। ”আপনি আজ যা যা করাবেন তার উপর আমরা যতটা সম্ভব ছাড় করে দেবো। মারিয়া এক্ষুণি আপনার ম্যাসেজ শুরু করে দেবে।”
”না,” মেয়েটা দৃঢ়কন্ঠে বলল। ”আমি ওকে দিয়েই করাতে চাই।” এজেম তখন তাকে জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখার বাহানা করছিল। সে ঘুরে তার দিকে আঙ্গুল বাড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে চেয়ে তাকাল।
একটুৃ পরেই সে কাজ করার ঘরে চলে এল। মেয়েটাকে পোশাক খুলতে সাহায্য করল। তার কাপড়ের চিকন ভাব অনুভব করল। তার গালে সেটা বুলিয়ে নিতে চাইল। সে সেটা ঝুলিয়ে দিয়ে ম্যানেজারের সামনে এল। ম্যানেজার তাকে হলঘরে টেনে নিয়ে এসে তাকে ফিসফিস করে কড়া কথা শোনাল।
”তুই কি জানিস ওটা কে? ও ওদিনাকা, ওদিনাকা। ও যদি খুশী না হোয়ে ফিরে যায়, তবে তোর চাকরি খতম। আশাকরি তুই বুঝতে পেরেছিস।”
এজেম ঘাড় নাড়ল। ভয় ভয় ভাব নিয়ে ম্যাসেজ ঘরে ফিরে এল। ওদিনাকা ধনী পরিবারের মুষ্ঠিমেয় মহিলাদের একজন যে স্বাধীনচেতা, যে প্রচলিত প্রথার ধার ধারত না, তার কী পরিণতি হোতে পারে তা নিয়েও পরোয়া করত না। তখনো পর্য্যন্ত সে বিয়ে করেনি, কিন্তু পোশাক পরে থাকত। খুব সাধারণ পোশাক নয়, ফিনফিনে চিকন পোশাক, তাতে সাহসিয়ান ছাপ যা সহজেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করত, মানুষ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত। পৃথিবীর কাপড় খারখানার প্রায় অর্ধ্বেকের মালিক সে। এই অভাবনীয় সৃষ্টিছাড়া স্বভাবে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল, কিন্তু তার অগাধ সম্পত্তি তাকে তার মতো করে থাকার সাহস যুগিয়েছিল : কথা কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া নয়।
ওদিনাকা ম্যাসেজ টেবিলে বসে পা দোলাতে লাগল। এজেমের দিকে ফিরে চিৎ হোয়ে শুয়ে পড়ল, এজেম তার হাতের মাঝে তেল মাখিয়ে গরম করতে লাগল। ওদিনাকার হাঁটু থেকে তার পা’য়ের গুল পর্য্যন্ত প্রলেপ বুলিয়ে দিল। হাতের তালু দিয়ে তার পেশীগুলো গরম করে তুলল। সে খুঁটিনাটি কিছু জানতে চাইল, বুঝতে চাইল সে কথা বলার মতো মানুষ কি না, না কি সে শুধু ম্যাসেজ করাতে চায়। তার ভাবনার কিছু ছিল না। ওদিনাকা শুধু তার কথার জবাবই দিল না, সে এজেমের সম্পর্কেও নানাকথা জানতে চাইল। কিছু সময়ের মধ্যেই এজেমের খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারল সে কীভাবে এখানে এসে পড়েছে, স্থপতির লাভজনক পেশা অনুসরণ কথা না ভেবে ওদিনাকা তার স্নায়ুর উত্তেজনাকে প্রশমিত করতে চাইল।
”তোমার কাপড় পরে না-থাকাটা ঠিক ভালো দ্যাখায় না, তাই নয় কি?”
এজেম ম্যাসেজ করে চলল, এইরকম সমাজদ্রোহী ভাবনার সে কী জবাব দেবে বুঝতে পারল না।
”জানবে তুমি আমি একই,” ওদিনাকা বলে চলল।
নিয়মিত শরীরচর্চ্চা কারণে মহিলার সুঠাম দেহ, তার রঙ ও তার তন্বী চেহারা এজেম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বোঝার চেষ্টা করল। যেসব কারণে তারা আলাদা সেইসব কথা সে নিজের মনে ভাবল, বাঁচার জন্য খরচখরচা নিয়ে যে ওদিনকার কোনো ভাবনা নাই তাও সে ভাবল। সে হাসল, নিজের মনে।
”আপনি খুব ভালো মানুষ, কিন্তু আমরা এক নই। আমাদের বয়সটা হয়ত’একই,” জবাবে বলল সে, যতটা সম্ভব মৃদু ভাষায়, শেষে একটা সওয়াল জাগিয়ে তুলে। ওদিনাকা গ্রাহ্য করল না, ঘুরে তার মোকাবিলা করতে চাইল।
”আমি যা বলতে চাইছি এই পুরুষশাসিত দুনিয়ায় বিয়ে না-করে থাকটা আমাদের একটা বিশাল আকাক্সক্ষা।”
অবশ্য, এজেম বলল না, তুমি যেভাবে স্বাধীন, আমি তা নই, তুমি তোমার খুশীমত নিজেকে কাপড়ে ঢেকে রেখেছো।
”আমি কাপড় ঢেকে থাকলে সেটা হোত আইন-বিরোধী – ” সে বলতে শুরু করল।
”যতসব বেআইনি কদাচার। যখন আমার মতো তোমার টাকা হবে তখন আইন তোমার কিচ্ছুটি করতে পারবে না। এখন তুমি কাপড়ে ঢেকে থাকতে চাও না কি?”

ওদিনাকা ছিল তার রক্ষাকর্তা। সে তাকে তার পুরোণো বাসা থেকে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে গ্যালো। নিজের পকেট থেকে তার ইজারার টাকা মিটিয়ে দিয়ে তাকে মুক্ত করল। এবং নগরের এক সুন্দর এলাকায় তার নিজের বাড়িতে তার থাকার বন্দবস্ত করে দিল।
এজেমের বাসায় দু’টো শোওয়ার ঘর, রান্নাঘরটা বেশ বড়ো, পরিচ্ছন্ন নির্ম্মল পরিবেশ। দেখে মনে হয় এটা বহুদিন ধরেই ফাঁকা পড়ে ছিল। বা, সম্প্রতি সেটা সংস্কার করা হয়েছে, এখন তার আগের বাসিন্দার গন্ধ ও ব্যক্তিত্ব থেকে মুক্ত। সেটার সঙ্গে একটা ইন্টাকম ছিল যার মাধ্যমে ওসু মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। তারা জায়গাটার দেখভাল করত। দরকার পড়লে এজেমকে সবকিছু পরিস্কার করতে হোত। কিম্বা মুদির মালপত্র আনতে হোত যা তার ফ্রিজে ভরে রাখা থাকত। এজেম যখন তার কাজের জায়গাটা অনেক দূর পড়ে বলে বলল, ওদিনাকা বলল, না চাইলে তাকে কাজে যেতে হবে না। সুতরাং স্পা’য় কাজ না-করতে যাওয়ার ব্যাপারটা সহজ পছন্দ হোয়ে দাঁড়াল। এই অবসর সময় তাকে বাড়ির অন্যান্য মেয়েদের আরও ভালো করে জানার সুযোগ করে দিল।
সেখানে ডেলাইলা বলে একজন ছিল। সে পোশাকে-আশাকে যেন ওদিনাকার ছোটো সংস্করণ, কিন্তু তার নিজের উপর তেমন আত্মবিশ্বাস ছিল না। চল্লিশের কাছাকাছি বয়সের ডোরিন এজেমের প্রিয় হোয়ে উঠেছিল। তার একটা বইয়ের দোকান ছিল – বইয়ের দোকান হিসাবে সেটা ভালোই চলত – সে এমন একটা ভান করত যে মনে হোত সে কী ছিল তার সবকিছু জানে এবং সেটা সে পছন্দই করত। সে কাপড় পরে থাকার ইচ্ছাটা সংবরণ করে চলত।
”থাকুক ওরা তাকিয়ে তাকিয়ে,” কয়েক গ্লাস মদ গলায় ঢাললেই সে বলত। ”এই দেহটা হোল একটা শিল্পকর্ম্ম।” সে তার বুক দু’টো হাত দিয়ে তুলে ধরত, তাতে এজেম ও অন্যান্য সবাই খিলখিল করে নেশাড় – হাসি হেসে উঠত।
মোরাইয়ো, মুকাশো, মারিয়মের মতো বাকি মেয়েরা নম্র ছিল, কিন্তু তারা সহজে মিশতে চাইত না। উদ্ধতার অভিযোগ এড়িয়ে চলতে তারা সামাজিক ভদ্রতা দেখিয়ে চলত, কিন্তু এইটুকুই মাত্র। এজেম ও ডোরিন তাদের তিনজনকে ’তিন ম’ বলত, বা কয়েক পাত্র পান করার পর ”মমম, না” – তাদের উদ্ধতার কারণে। কখনো কখনো তারা ওদিনাকার প্রায়-রাত্রিকালীন ককটেল পার্টিতে যোগ দিত, কিন্তু সপ্তাহ কয়েকের মধ্যে ওদিনাকা, ডেলাইলা, ডোরিন আর এজেম মিলে একটা বন্ধুসংঘ হোয়ে উঠল।
এই মহিলা সংঘে এজেমের ন্যাঙটামি কখনো হাসির খোরাক হোয়ে উঠত না, কোনো পুরুষের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটিয়ে দেওয়ার সময় কোানো অশোভন প্রস্তাব করা চলত না যারা তারা খুঁত নিয়ে অন্যকিছু ভাবতে পারে। ওদিনাকা তার বিশাল ব্যবসা নিয়ে কথা বলত, ডোরিন তার ছোটো কারবার নিয়ে। তারা একে অপরকে ভয়ঙ্কর কিছু পরামর্শ দিয়ে উত্যক্ত করত। এজেম তার যে-কাজ ছেড়ে দিয়ে এসেছে তা নিয়ে কথা বলত, তা ছাড়া তার আর কিছু বলার থাকত না। কেন সে বেওয়ারিশ হোয়ে আছে তার কোনো প্রমাণ দিল না, কী করে সে তার ভালো কিছু করতে পারে তা নিযে একটার পর একটা পরামর্শ দিয়ে তাকে উত্যক্ত করাও হোল না – এই প্রথম তার লজ্জ্বাভাব নিছকই লাজ হোয়ে উঠল।
তা ছাড়াও সবার কথা বলার সময় প্রায়ই প্রতিটা বিষয়ের মাঝে নিজের কথা সবাইকে জোর দিয়ে বলতে লাগল। এজেম কিছু মনে করল না কারণ সকলের মধ্যে ওদিনাকার জীবন সবথেকে মজার ছিল, জন্ম থেকেই অকুন্ঠ বিলাসিতা। সে কাপড় কম্পানিটা পেয়েছিল তার বাবার সূত্রে। তার অবসরের পর, সেটা প্রায় এক দশক আগে। তা নিয়ে একটা গোলমাল সৃষ্টিও হয়েছিল। কিন্তু একটা সম্পদশালী বংশ যদি একজন মহিলাকে কর্ণধার করে রাখতে চায়, তবে তা এমন একটা বিলাসিতা হয় যা তারা সহজেই সামলে উঠতে পারে। এবং সেই মহিলা যদি নিজেকে পোশাকে ঢেকে রাখে এবং বেওযারিশ মেয়েদের খোঁজ করে তাদের সাহারা দেওয়ার মতো কাজ করে তবে তাকে দমিয়ে রাখবে এমন ক্ষমতা কার আছে?
”আমি একটা নতুন দুনিয়া সৃষ্টির কথা ভাবি,” ওদিনাকা প্রায়ই বলত, ”যেখানে কাপড় পরে না-থাকাটা একজন মহিলার নিছক পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার হবে।”
এই বাড়িতে প্রথম রাত কাটানোর দিনে ওদিনাকা এজেমের জন্য একপ্রস্থ কাপড় কিনে এনেছিল, একটা উপহার, সে বলল, এজেমের যখন ইচ্ছা হবে, সেটা পরবে। এজেম কাপড়টার দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এমন কি সেই বাড়ির চৌহদ্দিতে, তার নিজের ঘরেও সেটা পরে থাকার তার সাহস হোল না। ওদিনাকার ককটেলে ডোরিন তার পাশে বসত, সে বলত, ”আমরা এইসব চোদনা কিছুর বিরোধিতা করে চলবো, এজেম” – তাতে সন্ধ্যার মজলিসে একে অপররের পিছনে লেগে হাসির ফোয়ারা ছুটতে লাগল।
”তুই কি সত্যিই এইভাবে তোর দোকানে যাস?” একদিন বিকেলে এজেম ডোরিনকে জিগ্যেস করল। ”তুই কেন নিজেকে ঢেকে রাখিস না? তুই ওদিনাকার লোক জানলে কেউ কিচ্ছু বলতে পারবে না, ঠিক কি না?” সে নিজেকেও সমঝানোর চেষ্টা করছিল যে কাপড় পরে বাইরে যাওয়ার হিম্মত ধরবে।
এজেমের দিকে পুরো মন দিতে নিজের মনে ভাবনা করা থামিয়ে দিল। ”বুঝলি, আমাদের এই নিয়েই বাঁচতে হবে। দশ বছর বয়সে আমার কাপড় খুলে নেওয়া হয়েছিল। তুই কি ভাবতে পারিস এত কম বয়সে নিজেকে নাঙ্গা করে রাখলে কেমন মনে হোতে পারে? আমি দশ বছর প্রায় লুকিয়ে থেকেছি। তারপর আমি নিজের মর্য্যাদাকে খুঁজে পেয়েছি। আমার নিজের চামড়া দেখে কেউ আর আমায় অস্বস্তিতে ফেলতে পারে না। আমি ঠিক করেছি যে যতদিন আমি বেঁচে থাকবো আমি কাপড় পওে থাকবো না, আমি বেওয়ারিশ হোয়েই থাকবো। তা নিয়ে কেউ কিচ্ছু বলতে পারবে না। ওদিনাকা নিজের মতো করে নিয়ম ভেঙ্গে চলে, আমি আমার মতো করে। আমি কাপড়ের সুরক্ষা চাই না। যদি আইন মেনে কাপড় না-পরে থাকতে হয়, আমি কাপড় না পরেই থাকবো। ওদের আইন যদি আমায় অস্বস্তিতে ফেলতে চায়, আমি ঘোড়ার ডিম হয়েই থাকবো।”

সমাদর এবং নিজের মতো স্বাধীন হোয়ে চলার অনুভূতির সপ্তাহগুলো ক্রমশঃ শিকড় বিছিয়ে চলল। একদিন রাতে যখন ওদিনাকার বাসায় এজেম অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে যোগ দিল, সে এমনভাবে নিজেকে ঢেকে এসেছিল যে তার কাপড়ের সাজটা মেয়েদের টাইয়ের মতো লাগছিল, এইভাবেই সে কাপড় পরতে জানত। ডোরিনই প্রথম তাকে অভিনন্দন জানাল, এবং যখন সে ছুটে এসে এজেমকে বুকে জড়িয়ে ধরল, সে ফিসফিস করে বলল, ”নিজের মতো করে সংস্কার ভাঙ্গো,” কিন্তু তার হাসিটা ছিল শুকনো।
ওদিনাকা আনন্দে চিৎকার করে উঠল। ”আরও একজন! আমরা উৎসব করবো।”
সে সঙ্গে সঙ্গে সব ব্যবস্থা করল। ইন্টারকমের মাধ্যমে ওসু মেয়েদের তার ফরমাশের কথা জানাল। এর আগে এজেম কোনো ওসু মেয়েকে কাজ করতে দ্যাখেনি, কিন্তু যখনই সে ওদিনাকা বা ডোরিনের কাছ থেকে তার ঘরে ফিরে আসত, সে দেখত তার বেশ করে বিছানাপত্র সাজানো গোছানো, বাথরুমের আয়নায় একফোঁটাও কিছু লেগে থাকত না, বেসিনে টুথপেস্টের কুলকুচির ফ্যানাও জমে থাকত না, এবং ঘরগুলোকে দেখে এমন অনুভূতি হোত বুঝি এইমাত্র কেউ খালি করে গিয়েছে।
এক ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে এজেম ও অন্যান্য বাসিন্দাদের পার্টির জন্য নিজেদের প্রস্তুত হোয়ে উঠতে হোল। ওদিনাকার বাসাটা ভরে উঠল। ডোরিন ছাড়া সব পুরুষ ও মহিলার পরনে পোশাক। তারা একসঙ্গে মিলে গল্পগুজব করতে লাগল। ডোরিন সোফায় বসে সবকিছু পরিচালনা করতে লাগল, মদে চুমুক দিতে দিতে, লাজুক হাসি হাসতে হাসতে।
এজেম তাতে যোগ দেওযার চেষ্টা করল, কিন্তু নিজ-পোশাকেও সে নিজেকে সারা জীবনে পোশাক না-পরে থাকা মহিলা ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারল না। ওদিনাকা এজেমকে তার আলোচনার চক্রে টেনে আনার চেষ্টা করল, কিন্তু এজেম শুধুমাত্র কিছু অস্পষ্ট প্রত্যুত্তর দিতে পারল, সে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আরও অস্বস্তি থেকে রেহাই পেতে চাইল। শেষপর্য্যন্ত এজেম এককোনে বসে উৎসবের আনন্দ দেখতে লাগল।
সে অনুমান করতে পারছিল না যে সবাই তাকে লক্ষ্য করছে। তখন একটা লোক যে আগে নাটকীয় ভাব দেখিয়ে মাথা নুইয়ে ওদিনাকাকে অভিবাদন করেছিল সে তার পাশে এসে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসল।
”তো, তুমি নতুন একজন, না?”
”হ্যাঁ, তাই তো মনে হয়।”
”তোমাকে দেখে তো মনে হয় তোমার যথেষ্ট বুদ্ধিশুদ্ধি আছে। তা, তোমাকে কেউ গ্রহন করেনি কেন?”
এজেম টানটান হোয়ে উঠল, সাবধানী হোয়ে পড়ল।
”এই ’বুদ্ধিশুদ্ধি’ থাকার মানেটা কী?”
লোকটা তার কথায় কান দিল না।
”তুমি কি জানো আমি একটা মেয়ের বাচ্চা বয়স থেকে তাকে পাওয়ার চেষ্টা করছি?” সে ওদিনাকার দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ল। ”আমাদের মিলন একটা ঠাকুরমা’র রূপকথা হোয়ে উঠতে পারত। একজন বড়ো তুলো চাষির সঙ্গে একজন বড়ো কাপড় বুনুয়ে। তোমার কী মনে হয়?”
এজেম ঘাড় ঝাঁকাল। তার কী আর বলার আছে?
”আর সে করছে কী না উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে।”
তার উদ্ধত ভাব দেখে এজেম হতবাক হোয়ে পড়ল, সে মুখ ঘুরিয়ে নিল। লোকটা শুধু হাসল এবং ঘরের একজনকে ডাকল। হঠাৎই সবার হাসি এজেমের দিকে ঘুরে এল বলে মনে হোল, প্রতিটা স্মিত হাসি তৃপ্ত হাসি হোয়ে যেন তাকেই ছুঁড়ে মারা। তার মনে হোল সে নিজে আগের মেয়ে হোয়ে পড়ছে যার আবার মাথা উঁচু করে চলতে পারার জন্য চিদিনমার কঠিন শাসনের দরকার। সে মাথা নিচু করল, বাসায় ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে।
সে ছুটে যেতেই ডেলাইলার সঙ্গে ধাক্কা খেল। তার বগলের নিচেয় ধরে রাখা একটা বাঁকানো বাক্সো। সেটা ছিল পারিবারিক সূত্রে পাওয়া মহামূল্য বংশধন যা ওই ভিড়ের মধ্যেও এজেম চিনতে পারল। এইরকমটা একটা কিছুর প্রতি ওদিনাকার ঈর্ষা ছিল, কারণ এইরকম কিছু কখনো সে লাভ করেনি, সে ওই প্রাচীন বস্তুটার সূত্র জানতে পারল না। সে সবসময় চাইত ডেলাইলা প্রশংসা করার মতো বস্তুটা নিয়ে আসুক। কিন্তু ডেলাইলা সেটা তাকে দ্যাখাতে বা জানান দিতে চাইত না। সে তার গোপন সম্পদের রহস্যটা ধরে রেখে একটা সান্ত¡না খুঁজে পেত।
এজেম ডেলাইলাকে তেমন পছন্দ করত না। সে যেন ওদিনাকার ক্ষুদ্র সংস্করণ। কিন্তু ওদিনাকা ছিল ওদিনাকাই। ডেলাইলা ছিল দেখনদারি স্বভাবের। সে তার আস্তিনে বংশগৌরব ধারণ করে থাকত। এজেমের অস্বস্তিটা স্পষ্ট হোয়ে উঠল যখন ডেলাইলা থেমে পড়ে এজেম ও দরজার মাঝ দিয়ে তাকাল এবং তাতে সান্ধ্য মজলিস নীরব হোয়ে পড়ল।
”সবকিছু ঠিক তো?” সে জিগ্যেস করল।
এজেম ঘাড় নাড়ল, সেটায় ছিল একটা টানটান ভাব, তাতে স্পষ্ট হোয়ে পড়ল যে না, তা নয়। দরজার ভিতর দিকের অফুরন্ত মজা নিয়ে ডেলাইলার উদ্বেগটা সে লক্ষ্য করল। একটা বিশেষ ভঙ্গীতে ঘাড় নাচিয়ে ডেলাইলার চলন, মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের ধরন, তার মাথার কৌণিক বিভঙ্গ দেখে হঠাৎই এজেমের মনে বাসের ওসু মেয়ের ছবিটা ভেসে উঠল। তার মুখে নিশ্চয় একটা ভাব ফুটে উঠেছিল কেন না সে অলক্ষ্যে আত্ম-সচেতন হোয়ে পড়ে তার একটা হাত উপরে তুলে তার চুলগুলো ঠিক জায়গায় করে নিল – ঠিক যেখানে একটা পরিচয় সূচক ক্ষতচিহ্ণ থাকতে পারত যদি কোনো সরকারি ধাত্রী তার ছ’মাস বয়সে তার মাথায় আঁচড় কেটে দিত এবং তার আঠারো বছর হওয়া পর্য্যন্ত প্রতি দু’বছর অন্তর সেটাকে নতুন করে নিতে হোত। ওসু জাতির প্রথা সম্পর্কে এজেমের এইটুকু পর্য্যন্তই জ্ঞান ছিল। তার জাতির লোকজন ওসু জাতির পাশাপাশি বাস করত। তারা একে অপররের ব্যাপারে তেমন খোঁজ রাখত না।
ওদিনাকা আনন্দে চিৎকার করে উঠল। ”আরও একজন! আমরা উৎসব করবো।”
সে সঙ্গে সঙ্গে সব ব্যবস্থা করল। ইন্টারকমের মাধ্যমে ওসু মেয়েদের তার ফরমাশের কথা জানাল। এর আগে এজেম কোনো ওসু মেয়েকে কাজ করতে দ্যাখেনি, কিন্তু যখনই সে ওদিনাকা বা ডোরিনের কাছ থেকে তার ঘরে ফিরে আসত, সে দেখত তার বেশ করে বিছানাপত্র সাজানো গোছানো, বাথরুমের আয়নায় একফোঁটাও কিছু লেগে থাকত না, বেসিনে টুথপেস্টের কুলকুচির ফ্যানাও জমে থাকত না, এবং ঘরগুলোকে দেখে এমন অনুভূতি হোত বুঝি এইমাত্র কেউ খালি করে গিয়েছে।
এক ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে এজেম ও অন্যান্য বাসিন্দাদের পার্টির জন্য নিজেদের প্রস্তুত হোয়ে উঠতে হোল। ওদিনাকার বাসাটা ভরে উঠল। ডোরিন ছাড়া সব পুরুষ ও মহিলার পরনে পোশাক। তারা একসঙ্গে মিলে গল্পগুজব করতে লাগল। ডোরিন সোফায় বসে সবকিছু পরিচালনা করতে লাগল, মদে চুমুক দিতে দিতে, লাজুক হাসি হাসতে হাসতে।
এজেম তাতে যোগ দেওযার চেষ্টা করল, কিন্তু নিজ-পোশাকেও সে নিজেকে সারা জীবনে পোশাক না-পরে থাকা মহিলা ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারল না। ওদিনাকা এজেমকে তার আলোচনার চক্রে টেনে আনার চেষ্টা করল, কিন্তু এজেম শুধুমাত্র কিছু অস্পষ্ট প্রত্যুত্তর দিতে পারল, সে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আরও অস্বস্তি থেকে রেহাই পেতে চাইল। শেষপর্য্যন্ত এজেম এককোনে বসে উৎসবের আনন্দ দেখতে লাগল।
সে অনুমান করতে পারছিল না যে সবাই তাকে লক্ষ্য করছে। তখন একটা লোক যে আগে নাটকীয় ভাব দেখিয়ে মাথা নুইয়ে ওদিনাকাকে অভিবাদন করেছিল সে তার পাশে এসে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসল।
”তো, তুমি নতুন একজন, না?”
”হ্যাঁ, তাই তো মনে হয়।”
”তোমাকে দেখে তো মনে হয় তোমার যথেষ্ট বুদ্ধিশুদ্ধি আছে। তা, তোমাকে কেউ গ্রহন করেনি কেন?”
এজেম টানটান হোয়ে উঠল, সাবধানী হোয়ে পড়ল।
”এই ’বুদ্ধিশুদ্ধি’ থাকার মানেটা কী?”
লোকটা তার কথায় কান দিল না।
”তুমি কি জানো আমি একটা মেয়ের বাচ্চা বয়স থেকে তাকে পাওয়ার চেষ্টা করছি?” সে ওদিনাকার দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ল। ”আমাদের মিলন একটা ঠাকুরমা’র রূপকথা হোয়ে উঠতে পারত। একজন বড়ো তুলো চাষির সঙ্গে একজন বড়ো কাপড় বুনুয়ে। তোমার কী মনে হয়?”
এজেম ঘাড় ঝাঁকাল। তার কী আর বলার আছে?
”আর সে করছে কী না উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে।”
তার উদ্ধত ভাব দেখে এজেম হতবাক হোয়ে পড়ল, সে মুখ ঘুরিয়ে নিল। লোকটা শুধু হাসল এবং ঘরের একজনকে ডাকল। হঠাৎই সবার হাসি এজেমের দিকে ঘুরে এল বলে মনে হোল, প্রতিটা স্মিত হাসি তৃপ্ত হাসি হোয়ে যেন তাকেই ছুঁড়ে মারা। তার মনে হোল সে নিজে আগের মেয়ে হোয়ে পড়ছে যার আবার মাথা উঁচু করে চলতে পারার জন্য চিদিনমার কঠিন শাসনের দরকার। সে মাথা নিচু করল, বাসায় ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে।
সে ছুটে যেতেই ডেলাইলার সঙ্গে ধাক্কা খেল। তার বগলের নিচেয় ধরে রাখা একটা বাঁকানো বাক্সো। সেটা ছিল পারিবারিক সূত্রে পাওয়া মহামূল্য বংশধন যা ওই ভিড়ের মধ্যেও এজেম চিনতে পারল। এইরকমটা একটা কিছুর প্রতি ওদিনাকার ঈর্ষা ছিল, কারণ এইরকম কিছু কখনো সে লাভ করেনি, সে ওই প্রাচীন বস্তুটার সূত্র জানতে পারল না। সে সবসময় চাইত ডেলাইলা প্রশংসা করার মতো বস্তুটা নিয়ে আসুক। কিন্তু ডেলাইলা সেটা তাকে দ্যাখাতে বা জানান দিতে চাইত না। সে তার গোপন সম্পদের রহস্যটা ধরে রেখে একটা সান্ত¡না খুঁজে পেত।
এজেম ডেলাইলাকে তেমন পছন্দ করত না। সে যেন ওদিনাকার ক্ষুদ্র সংস্করণ। কিন্তু ওদিনাকা ছিল ওদিনাকাই। ডেলাইলা ছিল দেখনদারি স্বভাবের। সে তার আস্তিনে বংশগৌরব ধারণ করে থাকত। এজেমের অস্বস্তিটা স্পষ্ট হোয়ে উঠল যখন ডেলাইলা থেমে পড়ে এজেম ও দরজার মাঝ দিয়ে তাকাল এবং তাতে সান্ধ্য মজলিস নীরব হোয়ে পড়ল।
”সবকিছু ঠিক তো?” সে জিগ্যেস করল।
এজেম ঘাড় নাড়ল, সেটায় ছিল একটা টানটান ভাব, তাতে স্পষ্ট হোয়ে পড়ল যে না, তা নয়। দরজার ভিতর দিকের অফুরন্ত মজা নিয়ে ডেলাইলার উদ্বেগটা সে লক্ষ্য করল। একটা বিশেষ ভঙ্গীতে ঘাড় নাচিয়ে ডেলাইলার চলন, মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের ধরন, তার মাথার কৌণিক বিভঙ্গ দেখে হঠাৎই এজেমের মনে বাসের ওসু মেয়ের ছবিটা ভেসে উঠল। তার মুখে নিশ্চয় একটা ভাব ফুটে উঠেছিল কেন না সে অলক্ষ্যে আত্ম-সচেতন হোয়ে পড়ে তার একটা হাত উপরে তুলে তার চুলগুলো ঠিক জায়গায় করে নিল – ঠিক যেখানে একটা পরিচয় সূচক ক্ষতচিহ্ণ থাকতে পারত যদি কোনো সরকারি ধাত্রী তার ছ’মাস বয়সে তার মাথায় আঁচড় কেটে দিত এবং তার আঠারো বছর হওয়া পর্য্যন্ত প্রতি দু’বছর অন্তর সেটাকে নতুন করে নিতে হোত। ওসু জাতির প্রথা সম্পর্কে এজেমের এইটুকু পর্য্যন্তই জ্ঞান ছিল। তার জাতির লোকজন ওসু জাতির পাশাপাশি বাস করত। তারা একে অপররের ব্যাপারে তেমন খোঁজ রাখত না।
ডেলাইলার বাক্সোর দিকে তাকিয়ে এজেমের মনে হোল যে একজন ওসু মেয়ে – যদি সে যথেষ্ট চালাক হয়, যথেষ্ট বেপরোয়া হয়, এবং তার অসম্ভব ঘন চুল থাকে – তার মহামূল্য কিছু থাকতে পারে – যেমন, একটা চমৎকার বাঁকানো বাক্সো যা পরিবারের বহু প্রজন্মের রক্ষিত ধন হোয়ে ছিল – এবং গভীর রাতে সেটা চুরি করে নিয়ে আসতে পারে। যতদূর পর্য্যন্ত সে জীবনে বাড়ির বাইরে বের হয়নি, তার থেকেও বহুদূর সে যেতে পারে, এমন এক নগরে যেখানে তাকে কেউ চেনে না জানে না। আর সে চালাক চতুর ছিল বলেই এই জগতের মানুষের মধ্যে বেমালুম ঢুকতে পেরেছে যাদের সে ভালো করেই জানে, তাকে তার জীবনভর তাদেরই সেবা করে যেতে হয়েছে।
ভাবনাটা মাথায় শিকড় গেড়ে বসার আগেই ডেলাইলার মুখের অনিশ্চিতির ভাবটা বদলে গিয়ে কৃত্রিম মিষ্টতার রূপ নিল। সে এজেমের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বলল, ”একটু আরাম করো তাহলে।” তারপর পার্টিতে যোগ দিল।
ভোরে শেষ মেহমান বিদায় নেওয়ার সময় এজেম জেগে উঠল। সে আট’টা পর্য্যন্ত নিজের ঘরেই ছিল। ওদিনাকার দরজা খুলে রাখার নীতির সুযোগ গ্রহন করে সে তার পরোপকারী মানুষটার ঘরে ঢুকল। যদি সে সেখানে না থাকত, সে কখনই বিশ্বাস করতে পারত না যে আগের রাতে পার্টিতে আসা লোকেদের ভিড়ে ঘরটা এখনো ভরে আছে। তিন ঘন্টায় একজন কেউ বা কয়েকজন কেউ পঞ্চাশজন অতিথির ধবংস¯তূপটা আমূল বদলে দিযেছিল,
ডেলাইলার বাক্সোর দিকে তাকিয়ে এজেমের মনে হোল যে একজন ওসু মেয়ে – যদি সে যথেষ্ট চালাক হয়, যথেষ্ট বেপরোয়া হয়, এবং তার অসম্ভব ঘন চুল থাকে – তার মহামূল্য কিছু থাকতে পারে – যেমন, একটা চমৎকার বাঁকানো বাক্সো যা পরিবারের বহু প্রজন্মের রক্ষিত ধন হোয়ে ছিল – এবং গভীর রাতে সেটা চুরি করে নিয়ে আসতে পারে। যতদূর পর্য্যন্ত সে জীবনে বাড়ির বাইরে বের হয়নি, তার থেকেও বহুদূর সে যেতে পারে, এমন এক নগরে যেখানে তাকে কেউ চেনে না জানে না। আর সে চালাক চতুর ছিল বলেই এই জগতের মানুষের মধ্যে বেমালুম ঢুকতে পেরেছে যাদের সে ভালো করেই জানে, তাকে তার জীবনভর তাদেরই সেবা করে যেতে হয়েছে।
ভাবনাটা মাথায় শিকড় গেড়ে বসার আগেই ডেলাইলার মুখের অনিশ্চিতির ভাবটা বদলে গিয়ে কৃত্রিম মিষ্টতার রূপ নিল। সে এজেমের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বলল, ”একটু আরাম করো তাহলে।” তারপর পার্টিতে যোগ দিল।
ভোরে শেষ মেহমান বিদায় নেওয়ার সময় এজেম জেগে উঠল। সে আট’টা পর্য্যন্ত নিজের ঘরেই ছিল। ওদিনাকার দরজা খুলে রাখার নীতির সুযোগ গ্রহন করে সে তার পরোপকারী মানুষটার ঘরে ঢুকল। যদি সে সেখানে না থাকত, সে কখনই বিশ্বাস করতে পারত না যে আগের রাতে পার্টিতে আসা লোকেদের ভিড়ে ঘরটা এখনো ভরে আছে। তিন ঘন্টায় একজন কেউ বা কয়েকজন কেউ পঞ্চাশজন অতিথির ধবংস¯তূপটা আমূল বদলে দিযেছিল, আবার পরিস্কার হোয়ে উঠেছিল পৃথিবীর অন্যতম ধনী মহিলার আধুনিক রুচি মাফিক। এজেমের মনে পড়ল দু’টো মদের গ্লাস উছলে ওঠার কথা আর একজন ছোটোখাটো চেহারার মানুষের কথা যে শেষপ্রান্তের একটা টেবিল থেকে ভাষণ দেওয়ার জিদ ধরেছিল। বলতে গেলে তারই মতো একজন মহিলা সমস্ত উচ্ছিষ্ট পরিস্কার করেছিল। সে ওদিনাকাকে কী বলবে তা ভেবে পাচ্ছিল না – সে বাচ্চা মেয়ের মতো অভিযোগ করতে পারে না যে একজন তাকে অপমান করেছে। কিন্তু মনে মনে সে আহত হয়েছিল এবং একটু সান্ত¡না খুঁজে পেতে চাইছিল।
সে দেখল ওদিনাকা আলসে ঘুমে শুয়ে আছে, চাদরটা কোমর পর্য্যন্ত টানা।
”তোমার ভালো লেগেছিল, এজেম? আমি দেখলাম তুমি আজুর সঙ্গে কথা বলছো। এমনিই সে চলে গিয়েছিল, তুমি জানো।” সে তার ভ্রƒ কোঁচকাল।
তো, এজেম এখন আর তাকে দোষারোপ করতে পারে না। ”আমাদের মধ্যে বেশ মজার কথাবার্তা হয়েছিল,” বাধ্য হোয়ে বলল সে।
”হ্যাঁ, মজারই বটে,” সে বলল। ”সে যা বলেছে তা নিয়ে মন খারাপ করো না।”
ওদিনাকা ইন্টারকমের বোতাম টিপে প্রাতরাশ নিয়ে আসতে বলল। তারপর গতরাত নিয়ে কথা বলতে শুরু করল। তা নিয়ে হাসতেও লাগল। সে জানত না যে ঘটনার সময় এজেম সেখানে ছিল না।
দশ মিনিট পর আবার সে ইন্টারকমের বোতাম টিপল। ”আমার খাবার কোথায়?” সে জানতে চাইল, প্রায় চিৎকার করে।
এজেমের অভিব্যক্তি দেখে সে চোখ ঘোরাল।
”তুমিও শুরু করো না।”
ওসু মহিলার সমর্থনে এজেম মুখ খুলল। কিন্তু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বন্ধ করল যা সে প্রায় বলে বসেছিল তার কদর্য্য ক্রান্তিকারি কথায় শুধু লজ্জ্বিত হোয়ে উঠেই নয়, এটা নিজেকে রক্ষা করার মতো হোয়ে উঠেছিল বলেও।
”তুমি ঠিক ডোরেিনর মতো,” ওদিনাকা বলে চলল। ”দ্যাখো, আমি ওইসব মহিলাদের একটা বাহিনীকে কাজে লাগিয়েছি। তাদের একটা কাজ আছে, তাদের সেটা করা দরকার। তুমি জানো সেটা কেমন চলছে, ঠিক কি না?” ওদিনাকা টিভিটা চালিয়ে দিল। একটা বিজ্ঞাপনে একটা পরিবারের ছুটির দিন দ্যাখানো হোল যেখানে কীভাবে কাপড় তৈরী হয় তা বাচ্চারা জানতে পারবে। এজেমের স্কুলে দ্যাখানো একটা তথ্যচিত্রের কথা মনে পড়ল, তাতে একটা আবাসিকে বেওয়ারিশ মেয়েরা কী রকম করুণ অবস্থায় দিন কাটাত তা তুলে ধরা হয়েছিল – রেশনের খাবার, রক্ষীদের দুর্ব্যবহার, সুরক্ষা যা ছিল তা না থাকারই মতো। এর অর্থটা ছিল ভয় ধরিয়ে এইরকম একটা জায়গায় আটকে রাখা, এবং সেটা সফল হয়েছিল।
অনুষ্ঠান শুরু হোতেই ওদিনাকা আওয়াজটা বাড়িয়ে দিল। তখন এজেমের কাছে স্পষ্ট হোয়ে পড়ল যে তাকে কাজ থেকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়েছে।

এজেম ঠিক করল সে তার নতুন পোশাক পরে সে প্রথমে ডোরিনের দোকানে ঢুঁ মারবে। তার ভিতরে যে অস্থিরতা গুড়গুড় করছে ডোরিন তা জানতে পেরে তাকে কিছু সান্ত¡নার কথা শোনাবে। এমন কি সে ডেলাইলার ইতিহাস জানতেও পারে, তাতে এজেমের পালিয়ে চলে যাওয়ার সন্দেহভঞ্জন হবে। ডোরিন অনেকবারই তাকে তার দোকানে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল – ”তুই এখানে সারা জীবন ধরে থাকতে পারবি না। দ্যাখ আমি কী করেছি। দ্যাখ কাউকে না-পাওয়া একজন মেয়ে নিজের চেষ্টায় কী না কী করতে পারে।”
ওদিনাকার বাড়ির নিরাপত্তায় নিজ-পোশাক পরে থাকাটা একটা ব্যাপার ছিল। এজেম আয়নার সামনে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের পেটের পেলবতা, তার পা’য়ের দৃড়তা যা নিয়ে সে সবসময় গর্ব্ব বোধ করত, তার ঝুলে পড়া দু’টো বুক দেখতে লাগল। সে কাপড়টা তুলে নিয়ে নিজের সামনে মেলে ধরল। দেখে অনেক ভালো লাগল। সে সাধারণ ভঙ্গিমায় সেটা পরল, যেসব আধুনিক মহিলা তার চোখে পড়েছে তাদের মতো যতটা সম্ভব ভালো করে সেটা গা’য়ে বেল্টের মতো জড়াল।
তার সাবালক জীবনে এই প্রথম কেউ তার দিকে তাকাল না। যখন তার রাস্তার একজন লোকের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে তাকানোর সাহস হোল এবং লোকটা তাকে সমীহ দেখিয়ে মাথা ঝোঁকাল, সে প্রায় ভিরমি খেয়ে পড়ল। এটা কোনো আকস্মিক সৌভাগ্য ছিল না। প্রত্যেকেই – পুরুষ ও মহিলারা – তাকে আলাদভাবে গ্রহন করল, অধিকাংশই তাকে আর পাঁচটা দেহের মতো ভেবে উপেক্ষা করল। কিন্তু যখন তারা তাকে স্বীকৃতি জ্ঞাপন করল, তার মনে হোল তার কাঁধের সুরক্ষিত কুঁজো ভাবটা মসৃন হোয়ে উঠেছে, যেন সে স্বস্তি বোধ করতে অরুমোদন লাভ করেছে। সে সদম্ভে হাঁটতে লাগল, তার সঙ্গে তার কাপড়ের রক্ষাবর্ম্মে প্রতিটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেচে নেচে উঠতে লাগল। কাপড়ে বাঁধা পড়ে তার নিজেকে এমন মুক্ত মনে হোল যা আগে তার কখনো এমন হয়নি।
এজেম একটা পরিচিত মুখ দেখে এতই খুশী হোল যে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। মুখের বাহক যে মাস কয়েক আগে তার বন্ধুত্ব অস্বীকার করেছে সেইকথা তার মনে হওয়ার আগেই সে তার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বসল। এজেমের দিকে এগিয়ে আসার আগে চিদিনমা থতথত খেয়ে তার জবাবে সাড়া দিল, এবং হাসল।
”তুমি কাপড়-ঢাকা! তোমাকে কেউ গ্রহন করেছে! ঘুরে দাঁড়াও, আমার দিকে তাকাও। তোমার বউ-পোশাকে তোমাকে দারুণ সুন্দর লাগছে। আমার খুব খারাপ লাগছে যে তুমি বিয়ের অনুষ্ঠানে আমাকে নিমন্ত্রণ করোনি।”
কথাগুলো ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার মধ্যে একটা চাপা ক্ষোভও ছিল। তাদের শেষকথা বিনিময় বাতাসে প্রতিধ্বনি করে উঠছিল।
”কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। তোমাকে নিমন্ত্রণ করারও কিছু ছিল না।”
চিদিনমার হাসি মিলিয়ে গ্যালো। ”তোমাকে মিথ্যে বলতে হবে না। আমি জানি তুমি আমায় ভয় করতে। এর জন্যে আমি দুঃখীত।”
”না, সত্যি বলছি, কিছু হয়নি।” এজেম আরও কাছে এল তার কাছে গোপন কথাটা বলতে চেয়ে, তাদের আগের অন্তরঙ্গতা ফিরিয়ে আনতে চেয়ে। ”এটা নিজ-পোশাক। আমি নিজেই কাপড় পরা শুরু করেছি।”
কথাটা হজম করতে চিদিনমার কিছুক্ষণ লাগল। তারপর ঘৃণায় ফুঁসে উঠল। জমতে থাকা অন্তরঙ্গতা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল। তার হাসি শুকিয়ে এল, এবং বিনয়ী ভাবটাও।
”তুমি নিশ্চয় তোমার খসমকে নিয়ে সুখে আছো।”
”চিদিনমা, আমার কোনো স্বামী নাই। আমি শুধু নিজেকে কাপড়ে ঢেকে নিয়েছি।”
চিদিনমার দৃষ্টি এমন বিষাক্ত হোয়ে উঠল যে এজেম পিছিয়ে এল, একটা লোকের সঙ্গে ধাক্কা খেল। লোকটা ক্ষমা প্রকাশ করল।
”সত্যিই তাই? নিজ-পোশাক, তাই না? তোমার পরিবার ভালো, তুমি তাদের কেউ? আমার বিশ্বাস হয় না।” চিদিনমা তার স্বর নামিয়ে নিলেও এজেম তা করল না। পথচলতি মানুষেরা স্তম্ভিত হোয়ে তাকাল। এজেম তাকে চুপ করিয়ে দিল।
”ও তোমার এখন শরম লাগছে? তুমি এ নিয়ে একটুও গর্ব্ব করতে পারছো না?”
এজেম যখন চলে যাওয়ার জন্য মুখ ঘোরাল, চিদিনমা তার কাপড়টা টেনে ধরল। তখন সে ফিসফিস করে বলল, ”তুমি ভাবছো তুমি এখন কাপড়-ঢাকা। কিন্তু তুমি এখনো ন্যাঙটোই আছো। কোনো দামী নিজ-পোশাক এটাকে পাল্টাতে পারবে না – এটা সত্যিই হাসির ব্যাপার!”
এটা ছিল আক্রোশ ও বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ। কাউকে আঘাত দিতে চাওয়া, এবং দিয়েওছিল। এজেম তার পুরোণো বন্ধুর মুঠি থেকে তার কাপড়টা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু চিদিনমা ছাড়বে না। সে বলেই চলল, চোখের জলে তার গলা ভেঙ্গে এল।
”কিছু ত্যাগ না দিলে তুমি কাপড়-ঢাকা হোয়ে থাকতে পারো না। তুমি ওটা করতে পারো না। এটা ঠিক নয়। আমি তোমার জন্যে যা করেছি তার পরে এটা ঠিক হোতে পারে না।”
চিদিনমা তখন প্রকাশ্যেই কাঁদতে লাগল। এজেম তার আলগা হোয়ে যাওয়া মুঠির সুযোগ নিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল, এতে সে একটু চোটও পেল।
এজেম ভাবল, ওদিনাকার ঐশ্বর্য্যরে বাড়িতে তাদের প্রথা ভাঙ্গাটা ভুলে যাওয়াটা সহজ ছিল। রাত্রির পর রাত্রি গ্লাসে টুঙটাঙ করে যাওয়াটাও সহজ। যা কিছু মহিলা ত্যাগ করতে পেরেছে বলে সে কি এই কাপড় পরতে পারে? সে নিজের ইচ্ছায় বা চুক্তির ভিুিত্ততে একজন কাপড় বুনুয়ে, সেটা কি তার বয়সের অতীত এবং রাষ্ট্রের কৃপায় বেঁচে থাকাটা একটা ভারস্বরূপ? কাপড়টা তার গা’য়ে খুসখুস করতে লাগল, যেন ঘষা তার দিয়ে বোনা।
এজেম যে-পথ দিয়ে এসেছিল, সেই পথ দিয়ে ফিরে চলল – ওদিনাকার বাড়ির নিরাপত্তায়। ভয়ে জড়োসরো হোয়ে পড়ে সে তার বাসার চাবিগুলো নিয়ে থতমত খেয়ে পড়ল। এবং সে ভিতরে ঢুকল। ভিতরে ঢুকে সে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়াল, মেঝের উপর পিছলে পড়ল, মাথা থেকে হাঁটু পর্য্যন্ত, সে হাঁপ ছাড়তে লাগল। তার মনে হোল … কিছু একটা, তাতে সে এদিক ওদিক তাকাল, তখন সে ওসু মেয়েটাকে এককোণে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। তার চামড়া কালো নয়, কিছুটা হাল্কা, সন্ধ্যার বাদামি আভার সঙ্গে প্রায় মেশানো, তার মাথার একপাশে তার ক্ষতটা কুৎসিত চুণার পিণ্ড। তাকে দেখে এজেমের বয়সী বা তার থেকে বেশী বলে মনে হোল। তার হাতে পরিস্কার করার লোশন ও একটা ন্যাকড়া। সে কিছু পরে ছিল না।
তার ঘাড়ের কুঁজভাব ও চোখে তাকানোর ভাব দেখে স্পষ্ট হোয়ে পড়ল যে সে তার ন্যাঙটামি উপভোগ করছে না। এজেম তার নিজের মুখের ভাব কতদিন থেকে ধরে রেখেছিল? কতদিন ধরে তার লজ্জ্বার গভীর ভাব নিয়ে তার মধ্যে প্রায় ডুবে থেকেছিল?
যেদিন তাকে তার বাবা-পোশাক ছাড়তে হয়েছিল, সে তার বাবাকে অনুনয়-বিনয় করেছিল, তার বাবা তার কাপড় ছিঁড়ে ফেলতে গেলে সে তার সঙ্গে দক্ষযজ্ঞ বাধিয়ে তুলেছিল। তার মা তার মর্য্যাদা রক্ষা করে সেটা সহ্য করতে গিয়ে তার জন্য কেঁদেছিল। কিন্তু এজেম পাগল হোয়ে উঠেছিল। শেষে যখন তার বাবা কাপড়টা খুলে নিয়েছিল, এমন কি তার মুড়িয়ে রাখা আঙ্গুল যা দিয়ে সে ছেঁড়া টুকরোটা ধরে রেখেছিল তা খুলিয়ে সেটা ছিনিয়ে নিয়েছিল। এজেম নিজেকে কুঁচকে তুলে তার উপাঙ্গগুলো ঢেকে নিয়েছিল। সেই থেকে প্রতিদিন এই আতঙ্ক তাকে সামলাতে হয়েছিল, গিলে নিতে হয়েছিল তার পেটের গভীরে যেখান থেকে কখনো সেটার লাভা ফেটে বের হোতে পারবে না।
ওসু মেয়ে ঘাড় নাড়ল, তারপর দেওয়ালের একটা প্যানেল দিয়ে বেরিয়ে কোথায় অদৃশ্য হোয়ে পড়ল। প্যানেলের ফাঁকটা ধীরে ধীরে নিঃশব্দে সরে এসে ঠিকঠাক হোয়ে উঠল। এবং এজেম যখন দেওয়ালের কাছে এল সে ফাঁকটা আর দেখতে পেল না। জোর করে ভিতরে ঢোকার চেষ্টায় সে সেটাতে নখ দিয়ে আঁচড়াতে লাগল, তার নখগুলো বেঁকে খসে পড়ল। তার দিকে কোনো প্রবেশপথ খুঁজে না পেয়ে সে সেটার উপর ঘা মারতে লাগল, চিৎকার করতে লাগল – সে চাইল কেউ এসে তাকে স্বাগত জানাক।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *