জ য় ন্ত কু মা র ম ল্লি ক-র একটি ধারাবাহিক গদ্য(দশম পর্ব)
অথ নেকড়ে-মানব-মানবী কথাঃ গল্প বনাম সত্যি ঘটনা
দশম পর্ব
নেকড়ের ভালোবাসা
তুর্কীরা তাদের সন্তানদের ”সিংহ-বাঘ” এর পরিবর্তে নেকড়ের সাথে তুলনা করে থাকে। এর কারণগুলো নিচে হলোঃ
১। “নেকড়ে” তার পিতামাতার প্রতি খুব অনুগত এবং তারা বৃদ্ধ বয়সে তার পিতামাতার সেবা করে।
২। নেকড়েকে আরবিতে “ইবনে আল-বার” বলা হয় যার অর্থ “ভাল ছেলে” কারণ যখন তার বাবা-মা বৃদ্ধ হয়, তখন তারা তাদের জন্য শিকার করে এবং তাদের যত্ন নেয়।
৩। “নেকড়ে” কখনও তার স্বাধীনতার সাথে চট করে আপোষ করে না এবং কারও দাস হয়।
৪। পুরুষ নেকড়ে পর স্ত্রী নেকড়ের দিকে তাকায় না। তারা এত বিশ্বস্ত যে পুরুষ নেকড়ে তার একমাত্র স্ত্রী নেকড়ে ব্যতীত অন্য কারো সাথে সম্পর্ক করেনা।
৫। একইভাবে, একজন মহিলা তার সঙ্গী নেকড়ের প্রতি অনুগত। নেকড়ে দম্পতির একজন মারা গেলে অপরজন কমপক্ষে তিন মাস মৃত্যুর জায়গায় দাঁড়িয়ে শোক করে।
৬। সাধারণত এই ‘আলফা’ স্ত্রী-পুরুষ ও তাদের সন্তানদের নিয়েই নেকড়ের একেকটি পাল গঠিত হয়। তাই একপাল নেকড়ের পারস্পরিক বন্ধন হয় অত্যন্ত মজবুত।
৭। নেকড়েরা নিজের এলাকা রক্ষায় কোনো প্রকার ছাড় দিতে প্রস্তুত না। এরা প্রয়োজনে জীবন দিয়ে দেবে, তবুও নিজের এলাকায় শত্রুর অবস্থান মেনে নেবে না। সিংহের মতো শক্তিশালী না হলেও এরা ভয়ানক রকমের ক্ষিপ্র। এ কারণেই তুর্কিরা তাদের বংশকে সিংহের পরিবর্তে নেকড়ের সাথে তুলনা করে। তাছাড়া তুর্কী সেনাবাহিনী আর্ম বেইজের পতাকা সম্বলিত লোগোতে নেকড়ের চিহ্ন শোভা পায়। তাদের সন্তানদের বাচ্চা নেকড়ে সাথে তুলনা করে কারণ তাদের বিশ্বাস “সিংহের মত রক্তাক্ত বিচ্ছিন্ন না হয়ে নেকড়ের মত একতাবদ্ধ জাতি ভাল।”
২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসের কথা। ভালোবাসার সঙ্গীর খোঁজে ঘর ছেড়ে দূরে পাড়ি জমায় ওআর-৫৪ নামে একটি নেকড়ে। নামটি বিজ্ঞানীদের দেওয়া। তার গলায় বাঁধা রেডিও ট্রান্সমিটার কলারের মাধ্যমে জানা যায় পরের দু’ বছরে ৮ হাজার ৭১২ মাইল পাড়ি দিয়েছে সে। ঘুরে বেড়িয়েছে পাহাড় ও তৃণভূমি। খাবারের প্রয়োজনে করেছে শিকার।
বিজ্ঞানীরা ওআর-৫৪’র গতিবিধি থেকে জানতে পারেন, এ সময়ের মধ্যে দু’বার যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য ওরেগনে তার বাবা-মায়ের কাছে গিয়েছে সে। হয়তো তখনো কোনো সঙ্গী পায়নি বলে অভিযোগ করতেই গিয়েছিল সে। তারপর গত শরতে সে পৌঁছায় নেভাডা অঙ্গরাজ্যে। হাঁটা থামায়নি সে। সঙ্গীর খোঁজে রোজ গড়ে ১৩ মাইল হেঁটেছে এ নেকড়ে।
কম বয়সী নেকড়েদের জন্য ঘর ছেড়ে দূরে পাড়ি জমানো খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এ তথ্য জানান অলাভজনক প্রতিষ্ঠান জীববৈচিত্র্য কেন্দ্রের জীববিজ্ঞানী আমারক ওয়েইস। তিনি বলেন, নেকড়েদের বয়স দেড় বা দুই বছর হলেই সঙ্গীর খোঁজে বের হয় ওরা।
ওআর-৫৪’র বাবা ওআর-৭ও সঙ্গীর খোঁজে ক্যালিফোর্নিয়া গিয়েছিল। পরে সঙ্গীসহ ফিরে আসে ওরেগনে। সেখানেই জন্ম নেয় ওআর-৫৪। কিন্তু বাবার মতো সফল হয়নি ওর জীবনটা। এই শীতে তার কলারের রেডিও ট্রান্সমিটারের তথ্যে দেখা যায়, সে একই জায়গায় আটকে রয়েছে। পরের সপ্তাহে ক্যালিফোর্নিয়ার শাস্তা কাউন্টিতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। ক্যালিফোর্নিয়ার মৎস্য ও বন্যপ্রাণী বিভাগ ওআর-৫৪’র মরদেহের ময়নাতদন্ত করে তার মৃত্যুর কারণ জানার চেষ্টা করে।
নেকড়েটির বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। ওয়েইস বলেন, নেকড়েরা সঙ্গীর খোঁজে যাত্রার সময় পথে মূত্র বিসর্জনের মাধ্যমে নিজেদের চিহ্ন রাখে। পরে সেসব জায়গায় আবারও ফিরে আসে তারা। এটা অনেকটা ‘পি-মেইল’। কিন্তু ওআর-৫৪ কোনো সঙ্গী খুঁজে পায়নি; এর মানে এ অঞ্চলে খুব বেশি নেকড়ে নেই।
যুক্তরাষ্ট্রে একসময় প্রচুর ধূসর নেকড়ে বাস করতো। ১৯ ও ২০ শতাব্দীতে সরকারের চেষ্টায় তাদের একেবারে নির্মূল করে ফেলা হয়। তবে এখন সংরক্ষণবাদীরা তাদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। তারপরও তাদের সংখ্যা নগণ্য।
ওয়েইস বলেন, যদি এ অঞ্চলে যথেষ্ট নেকড়ে থাকতো, তাহলে ডিসেম্বর বা জানুয়ারির মধ্যেই ওআর-৫৪ সঙ্গী খুঁজে পেতো এবং ফেব্রুয়ারির মধ্যে সে গর্ভবতী হতো। তাহলে এপ্রিলেই কয়েকটি বাচ্চা নেকড়ের জন্ম দিতো সে।
নেকড়েটির মৃত্যু প্রসঙ্গে ওয়েইস বলেন, দলে থাকুক কি একা, নেকড়েদের জীবন বেশ কঠোর। তরুণ ও স্বাস্থ্যবান একটি নেকড়েও নানা কারণে মারা যেতে পারে। হতে পারে হরিণ শিকারের সময় মাথায় আঘাত পেয়েছে সে বা র্যাকুন খাওয়ার সময় দম আটকে গেছে। ইয়েলোস্টোনে এক নেকড়ের সঙ্গে এমন হয়েছিল। কোনো গাড়ি তাকে ধাক্কা দিয়েছে বা শিকারি তাকে হত্যা করেছে, সেটাও হয়ে থাকতে পারে।
এর আগে ওরেগনের নেকড়ে ওআর-৫৯ ক্যালিফোর্নিয়ায় মারা গেছে। ২০১৮ সালে ডিসেম্বরে তার গুলিবিদ্ধ মরদেহ পাওয়া যায়। পরে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ঘোষণা দেন, নেকড়েটির মৃত্যুর ব্যাপারে কোনো তথ্য দিলে দুই হাজার পাঁচশ’ মার্কিন ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে।
নেকড়েদের রক্ষার জন্য ‘ফেডারেল এনড্যাঞ্জারড স্পিসিজ অ্যাক্ট’ও ‘ক্যালিফোর্নিয়া এনড্যাঞ্জারড স্পিসিজ অ্যাক্ট’ নামে আইন রয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার মৎস্য ও বন্যপ্রাণী বিভাগ বলে, নেকড়েসংখ্যা রক্ষায় যে কোনো ঝুঁকি খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখি আমরা। এখন আমরা ওআর-৫৪’র মৃত্যুর বিষয়টি তদন্ত করছি। আমরা জনগণকে মনে করিয়ে দিতে চাই, নেকড়ে হত্যা করা অপরাধ এবং এর সাজা হবে। এতে কারাদণ্ডও হতে পারে।
নেকড়ের মূত্র ও মানুষের জন্মনিয়ন্ত্রণ
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে মধ্যযুগে অন্ধ বিশ্বাসে নারীরা অযাচিত গর্ভধারণ থেকে দূরে থাকতে যৌনমিলন করবার আগেই ঘরের বাইরে গিয়ে কোন নেকড়ের মূত্র ত্যাগ করার স্থানের ওপর মূত্র ত্যাগ করতে হতো, কিংবা ঘুরে আসতে হতো কোন গর্ভবতী নেকড়ের মূত্রত্যাগের স্থান থেকে! “…a woman could avoid pregnancy by walking three times around the spot where a pregnant wolf had urinated”. কেউ কেউ আরো বলেন যে সংসর্গের ঠিক পর মুহূর্তেই নারীর যৌনাঙ্গে নেকড়ের মূত্র স্প্রে করে দেয়া হতো। কি অবৈজ্ঞানিক ও অস্বাস্থ্যকর একটা প্রথা!
বাস্তবে নেকড়ে-মানুষ সংঘাত
নেকড়ের সাথে মানুষের সংঘাতের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। একটা সময় ডাচ, ব্রিটিশ, ড্যানিস কিংবা ফরাসি সাহেবদের কাছে ভারতের পরিচয় ছিল ‘সাপ এবং শ্বাপদের দেশ’। সেসময় বাঘ, এশিয়াটিক চিতা কিংবা নেকড়ের দলের সামনে প্রাণও হারিয়েছেন অনেকে। তবে তার থেকেও বেশি মানুষের শিকার হয়েছে এইসকল বন্যপ্রাণীরা। শতাব্দী পেরিয়ে ভারতের বুক থেকে মুছে গেছে এশিয়াটিক চিতা। এবার বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে ইন্ডিয়ান গ্রে উলফ বা ভারতীয় ধূসর নেকড়ে-ও (Indian Gray Wolf)। যদিও নেকড়ে সাধারণত মানুষকে আক্রমণ করে না, তবুও গবাদি পশু আক্রমণের কারণে তারা মানুষের কাছে হিংস্র হিসেবে পরিচিত।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতীয় ভূখণ্ডে বর্তমানে নেকড়ের সংখ্যা মাত্র ৩১০০টির মত। যেখানে ভারতে রয়েছে ২৯৬৭টি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। তবে বাঘের সঙ্গে নেকড়ের প্রধান পার্থক্য, তারা সাধারণত দলবদ্ধভাবে থাকে। সেদিক থেকে দেখতে গেল, বাঘের থেকেও বেশি বিপন্ন হয়ে উঠেছে এই প্রাণীটি। এমনটাই অভিমত বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু দ্রুতগতিতে নেকড়ের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার কারণ কী?
তার একটি কারণ শিকার। ঔপনিবেশিক সময়ে নির্বিচারে নেকড়ে শিকার চলত ভারতে। স্বাধীনতার পর সত্তরের দশকে শিকার নিষিদ্ধ করে ভারত সরকার। তবে তারপরেও নেকড়ের সংখ্যার ইতিবাচক পরিবর্তন হয়নি কোনো। উল্টে বছর বছর কমেছে তাদের সংখ্যা। সেখানেই উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া অন্যান্য বন্যপ্রাণীদের মতোই বাসস্থানহীনতায় ভুগছে ভারতীয় ধূসর নেকড়ে। ক্রমাগত নগরায়নের জেরে বিলুপ্ত হতে বসেছে ভারতের নেটিভ প্রাণীটি। বাড়ছে সভ্যতার সঙ্গে সংঘাত। ফলে, অনেকক্ষেত্রেই লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে নেকড়ে। পথসারমেয়দের সঙ্গে তাদের প্রজননের ফলে জন্ম নিচ্ছে কুকুর-নেকড়ের সংকর। প্রভাব পড়ছে নেকড়ের জিনে। ফলে, আদতে সংখ্যাবৃদ্ধি বা বংশবিস্তার হচ্ছে না ধূসর নেকড়ের। জুলজিক্যাল সার্ভের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের মোট ইকোলজিক্যাল জোনের মাত্র ৫ শতাংশ অঞ্চল সংরক্ষিত করা হয়েছে। তাতে অধিকাংশ জায়গাতেই প্রাধান্য পেয়েছে বাঘ, সিংহ, হাতি কিংবা গণ্ডারের মতো প্রাণী। আমাদের দেশে নেকড়ে সংরক্ষণের জন্য সেইভাবে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয় নি একটি ক্ষেত্র ছাড়া, পরে সেই কথায় আসবো।
অন্যদিকে ক্রমশ প্রকট হচ্ছে নেকড়েদের খাদ্য সমস্যাও। ইউরোপীয়, আমেরিকান কিংবা সাইবেরিয়ান নেকড়ের থেকে ভারতীয় নেকড়েদের আয়তন অনেকটাই ছোটো। ফলে, বড়ো আয়তনের প্রাণী শিকারে অক্ষম ভারতীয় নেকড়ের দল। সাধারণত তাদের খিদে মেটায় ছোটো আকৃতির হরিণ ও অন্যান্য গবাদি পশু শিকার করে। হরিণের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় ধীরে ধীরে দেখা দিচ্ছে খাদ্যসংকট। প্রাণী বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই চিতার পর ভারত থেকে সম্পূর্ণভাবে মুছে যাবে নেকড়ের অস্তিত্বও।
সাম্প্রতিককালে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় মানুষের বসতি বা কৃষিজমি লাগোয়া জঙ্গল থেকে মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে পড়ছে হায়না, নেকড়ে, প্রভৃতি মাংসাশী প্রাণীরা। এই আবাসকে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ওপেন ল্যান্ডস্কেপ। বসতি এলাকা থেকে তারা তুলে নিয়ে যাচ্ছে গবাদি পশু। নেকড়ে বা হায়না দক্ষ শিকারিও। এদের আরও একটা বৈশিষ্ট্য, শুধু খাবার জন্য শিকার নয়, গোয়াল বা ছাগলের খোঁয়াড়ে হানা দিলে এক সঙ্গে সব ক’টিকেই মেরে ফেলে যাতে তারা চেঁচামিচি করে গৃহস্থকে সজাগ না করে দেয়। আক্রান্ত হয়েছে মানুষও। মানুষের সঙ্গে সঙ্ঘাতের ফলে এই প্রাণীরাও মারা পড়ছে বা আক্রান্ত হচ্ছে। এই প্রাণীরা বাস্তুতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উত্তরপ্রদেশে এক সময়ে প্রচুর হায়না শিকারের ফলে কৃষ্ণসার হরিণ মাত্রাতিরিক্ত হয়ে পড়েছিল। তাতে ফসলের খেত উজাড় হয়ে যাচ্ছিল। আবার বসতি এলাকার কাছাকাছি থাকায় অনেক সময় কুকুরের সঙ্গে নেকড়ের ক্রস ব্রিডিংয়ের ফলে নতুন প্রজাতিও তৈরি হচ্ছে। তাতেও আসল নেকড়ের বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা।
বিগত দশকে কোন এক অকালকুষ্মান্ড হোমো স্যাপিয়েন্সের অবিমৃশ্যকারিতার জন্য একটি খালি প্লাস্টিকের বয়ামে ভারতের সবচেয়ে বিপন্ন প্রাণীদের একটি, ভারতীয় নেকড়ের মুখ আটকে যায় (ওপরে স্যাংচুয়ারী এশিয়া চিত্র দেখুন)। এর ফলে তার জীবন সঙ্কট হয়েছিল। ছ’টি ভারতীয় নেকড়ের একটি পরিবার আওরঙ্গাবাদের কাছে জালনার উপকণ্ঠে বাস করত, যেখানে এক আলোকচিত্রী (আনন্দ পাতিল) এই মর্মান্তিক দৃশ্যটি দেখে ছবি তুলেছিলেন। তিনি পুলিশকে অবহিত করেন, বন্ধুবান্ধব ও স্থানীয়দের নেকড়েটিকে উদ্ধারের জন্য জড়ো করেন, কিন্তু আতঙ্কিত নেকড়েটিকে ধরা যায়নি। পরের দিন সকালে, তিনি ফিরে এসে দেখেন অভুক্ত ও প্রায় শ্বাসরুদ্ধ প্রাণীটি ক্লান্ত, অবসন্ন এবং মৃত্যুর কাছাকাছি অবস্থায় পৌঁছে গেছে। বন কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে তিনি প্লাস্টিকের বয়াম থেকে তাকে মুক্ত করতে সক্ষম হন। এরপর নেকড়েটিকে একদিনের জন্য পর্যবেক্ষণে রেখে ভালভাবে খাওয়ানোর পরে তার দলের কাছে ছেড়ে দেন।
২০১৮ সালে ঝাড়গ্রাম শহরের এক শিক্ষকের দাবি, তাঁর ক্যামেরায় ধরা পড়েছে পূর্ণবয়স্ক এক নেকড়ের ছবি। বন দফতরের বক্তব্য, আগে থেকেই ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলে ভাল সংখ্যক নেকড়ে রয়েছে।
তাঁর দাবি, বিকেলে পাখির ছবি তুলতে ঝাড়গ্রাম শহরের উপকণ্ঠে পেপার মিল থেকে বৃন্দাবনপুর যাওয়ার রাস্তা ধরে মোটরবাইকে যাচ্ছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন বন্ধু শুভেন্দু মাহাতো। হঠাৎই নাকি পিচ রাস্তার ধারে বৃন্দাবনপুরের চুয়া জঙ্গল লাগোয়া খালের পাড়ে একটা নেকড়ে দেখতে পান। বিশ্বরূপের দাবি, “রাস্তা থেকে প্রায় একশো মিটার দূরে খালপাড়ে নেকড়েটা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। খানিক পরেই জঙ্গলে ঢুকে যায়।”বিশ্বরূপ যেখানে নেকড়ে দেখার দাবি করেছেন, সেই চুয়া জঙ্গল এলাকাটি শহরের পেপার মিল মোড় থেকে মাত্র দেড়-দু’কিলোমিটার দূরে। এখানকার জঙ্গলে ভারতীয় নেকড়ে আছে। নেকড়েরা মূলত জঙ্গলের ছোটখাটো প্রাণী শিকার করে। অনেক সময় শিকারের পিছু ধাওয়া করে জঙ্গলের বাইরে চলে আসে। লোকালয়ের জঙ্গল-রাস্তায় কখনও সখনও ওদের দেখা যায়। তবে বিরক্ত না করলে ওরা ক্ষতি করে না।
পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় থেকে নেমে আসা সাহারজোর নদীর ওপর তৈরি হয়েছে লাকড়াকুঁদি জলাধার। লাকড়াকুঁদির আবার একটা গল্প রয়েছে। এখানে নাকি একটা সময়ে অসংখ্য নেকড়ে থাকত। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে গ্রামবাসীরা নেকড়ের দলনেতাকে মেরে পুঁতে দিয়েছিল। তারপর থেকে এই জায়গাটির নাম হয়েছে লাকড়াকুঁদি। একথা যদি সত্যি হয় তাহলে ‘লাকড়া’ শব্দের অর্থ হল ‘নেকড়ে’। বলরামপুরে নেকড়ে নামে একটি গ্রামও রয়েছে।
সাম্প্রতিককালে বর্ধমানের দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লকের লাউদোহা এলাকায় একটি ধূসর নেকড়ের দেখা মেলে। লাউদোহার মাধাইগঞ্জের জঙ্গলেও নেকড়ে দেখা গিয়েছে৷ ছ’ দশক আগে শেষবার ওই অঞ্চলে বিলুপ্তপ্রায় জীবজন্তুগুলির দেখা মিলেছিল। মূলত বনাঞ্চল বৃদ্ধি পাওয়ায় ও জঙ্গলে মানুষের অবাধ প্রবেশ কমে যাওয়ায় ওই জন্তুগুলির আবির্ভাব হয়েছে।
এবার নেকড়ে-মানুষ সংঘাতের একটা বাস্তব ঘটনার কথা বলি। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসের কথা। ঘটনাটি ঘটেছিল ঝাড়গ্রাম জেলার সাঁকরাইল থানা এলাকার ঘন জঙ্গল বেষ্টিত নয়াগাঁতে। ভোর রাতে নেকড়েরা সমবেতভাবে হানা দিয়েছিল চুপিসারে এক গৃহস্থ পতন বেরার ছাগল রাখার গোয়ালে। ছিটে বেড়ার দেওয়াল ভেঙে তারা ঢুকে পড়ে গোয়ালে। ছাগলের আর্ত চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় গৃহস্থের। এরপরই তারা দৌড়ে গিয়ে দেখে তিনটে নেকড়ে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে। তাদের পিছনে ধাওয়া করে তারা দেখতে পায় একটা ছাগল মরে পড়ে আছে। তার গলার নলি ও পেট চিরে দিয়েছে নেকড়ের দল। আধ খাওয়া অবস্থায় বাড়ি থেকে কয়েকশ মিটার দুরে একটি জমির ধারে পড়েছিল সেটি। আরও দু’টো ছাগল খেয়ে ফেলেছে ততক্ষণে। লাঠি নিয়ে তাড়া করতেই তারা রোহিণীর জঙ্গলের দিকে পালিয়ে যায়।
উল্লেখ্য কয়েকমাস আগেই এই থানারই ডাহি গ্রামে এক গৃহস্থের গোয়াল থেকে ৬টা ভেড়া তুলে নিয়ে গিয়েছিল নেকড়ের পাল। সেবার অবশ্য সেই পালের দেখা মেলেনি ফলে গুজব ছড়িয়েছিল অজানা জন্তুর। বনদপ্তর জানিয়েছে, হায়না বলে অনেকে ভুল করলেও এগুলো আসলে নেকড়েরই একটি প্রজাতি।
৭ই জানুয়ারী, ২০১৯ সন্ধের সময় বাঁকাশোল গ্রামে বাড়ির সামনে বসে আগুন পোহাচ্ছিলেন সনাতন ও তাঁর ভাইপো ললিত হেমব্রম। আচমকাই কুকুরদের তাড়া খেয়ে একটি প্রকাণ্ড নেকড়ে জঙ্গলের দিক থেকে ছুটে বেরিয়ে গ্রামের দিকে চলে আসে। নেকড়েটির কামড়-আঁচড়ে ললিতের বাঁ চোখ, কপাল, গাল, বাঁ হাত ও চিবুক ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। ললিতকে বাঁচাতে গেলে নেকড়েটি ললিতকে ছেড়ে দিয়ে তাঁর কাকা সনাতনকে আক্রমণ করে। সনাতনের হাতে পরপর কয়েক জায়গায় কামড়ে দেয় নেকড়েটি। কাকা-ভাইপোর চিৎকারে গ্রামবাসীরা লাঠি নিয়ে তেড়ে এলে নেকড়েটি জঙ্গলে পালিয়ে যায়। ওই দিন রাতেই দু’জনকে ঝাড়গ্রাম জেলা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ভর্তি করান আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা। সেখানে চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে ১৭ তারিখ হাসপাতাল থেকে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন তাঁরা। ২৪ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার ঘন ঘন বমি করছিলেন ললিত। খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে ফের নিয়ে যাওয়া হয় ঝাড়গ্রাম সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে। তাঁর স্নায়ুর সমস্যা হচ্ছিল। খাবার ও জল খেতে পারছিলেন না। অবস্থার অবনতি হওয়ায় ২৫ জানুয়ারি মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয় তাঁকে। সেখানকার ডাক্তাররা ললিতকে বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। রেফার করার সময় ফর্মে লিখে দেন ‘সাসপেক্টেড র্যাবিস’। কলকাতায় আনার আগে ২৭ জানুয়ারি রাতেই মারা যান ললিত। এমন ঘটনা একেবারে অস্বাভাবিক নয়। কুকুর বেড়াল হোক আর নেকড়ে বা বাঘই হোক, কামড়ে ক্ষত যখন খুব গভীর হয় তখন বুঝতে হবে তা ডিপ ট্যিসু পর্যন্ত গিয়েছে। অ্যান্টি র্যাবিস ভ্যাকসিন তো নিতেই হবে, কিন্তু প্রথমেই কলের জলের তোড়ে জায়গাটা ধুয়ে দেওয়া দরকার। ক্ষতের চারপাশে ইমিউনো গ্লোবিউলিন ইঞ্জেকশন দিয়ে দ্রুত জীবাণুমুক্ত করাটাও অন্যতম কর্তব্য। না হলে ভ্যাকসিনের কাজ শুরু হওয়ার আগে র্যাবিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
পরের মাসে আবারও নেকড়ে বাঘের হামলায় জখম হন বেশ কয়েকজন। দিনকয়েক আগে জামবনি ব্লকের ভালুকা গ্রামে তিনজন আহত হয়েছিলেন। এবার ঝাড়গ্রাম ব্লকের সাপধরা অঞ্চলের বেশ কয়েকটি গ্রামে বৃহস্পতিবার সকালে হামলা চালায় নেকড়েটি। পশুটির আক্রমণে গুরুতর জখম এক চার মহিলা-সহ কয়েকজন। প্রথম খবরটি আসে শিমুলডাঙা গ্রাম থেকে। গ্রামের বাসিন্দা মালিনি মাহাত (৩০) সকালে উঠোন ঝাঁট দিচ্ছিলেন। তখনই মাসাংডির জঙ্গল থেকে একটি নেকড়েটি বেড়িয়ে এসে তাঁকে আক্রমণ করে বলে খবর। তাঁর চিৎকার শুনে ছুটে আসেন কাকা ধীরেন মাহাত (৪২)। তাঁকেও কামড় দেয় নেকড়েটি। গ্রামবাসীরা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলে পালিয়ে যায় পশুটি। কুন্ডলডি, ডোলকাট, ধোবাধবিন, রাজপাড়া, দুবরাজপুর লাগোয়া জঙ্গলে ঢুকে যায় প্রাণীটি। এরপর ফের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে কুন্ডলডিতে বকুল মাহাত নামে আরও একজনকে আক্রমণ করে। পশরো গ্রামেও আহত হন একজন। চারজনকে ঝাড়গ্রাম সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ভরতি করা হয়। মালিনী মাহাতকে মেদিনীপুর হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে মনে করা হয়েছিল নেকড়ের আক্রমণ বোধহয় এদিনের মতো থেমেছে। কিন্তু গ্রামবাসীদের ধারণা ভ্রান্ত করে দিয়ে ফের আক্রমণ চালায় নেকড়ে। নেদাবহড়ায় এক পুরুষ ও এক মহিলার উপর আক্রমণ চালায় সে। মুখের মাংস খুবলে নেয়। এরপর হানা দেয় ঘৃতখাম গ্রামের দিকে। সেখানেও দুই মহিলাকে আক্রমণ করে। এই আহতদেরও ঝাড়গ্রাম সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ভরতি করা হয়।
১৮ই মে, ২০২১ সালে বাঁকুড়ার পাত্রসায়ের বাজিতপুর গ্রামের এক বাসিন্দার বাড়িতে ঢুকে অতর্কিতভাবে হামলা চালায় এক নেকড়ে বাঘ। রাতের অন্ধকারে এই বাঘটি ঢুকে পড়ে শেখ শরিফউদ্দিনের ঘরে, তারপরই চড়াও হয় ওনার উপর। পাত্রসায়রের জঙ্গলে হায়না ও নেকড়ে রয়েছে। গ্রাম থেকে জঙ্গল আড়াই কিলোমিটার দূরে। সেদিন সন্ধ্যা থেকে বজ্র-বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি হচ্ছিল। বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে এলাকা। রাতে প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে বাড়ির বারান্দায় সরিফুদ্দিন তাঁর দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে ঘুমাতে যান। সন্তানেরা একটি দড়ির খাটে আর তিনি মাটিতে বিছানা পেতে শুয়েছিলেন। স্ত্রী ছিলেন ঘরের ভেতর। আনুমানিক রাত ১২টা-সাড়ে ১২টা নাগাদ একটা নেকড়ে তার মাথায় থাবা বসিয়ে দেয়। সেটাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে শেখ। তার চিৎকারে বাচ্চাদের ঘুম ভেঙে যায়। স্ত্রী বেরিয়ে আসে। আক্রান্তের চিৎকার শুনে সেইস্থানে উপস্থিত হয় গ্রামবাসীরাও। টানা আধঘন্টা নেকড়ে-মানুষে লড়াই এর পর গ্রামবাসীদের দেখে পালিয়ে যায় নেকড়েটি। আক্রান্তকে পাত্রসায়র ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। আগে কখনও ওই এলাকায় বুনো জন্তুর আক্রমণ হয়নি। তবে বিদ্যুতের ঝলকানি ও বৃষ্টিতে কোনও কারণে ভয় পেয়ে জন্তুটি ওই বাড়িতে ঢুকে থাকতে পারে বলে মনে করা হয়।
যদিও নেকড়ে লোক এড়িয়ে চলে ও সাঁঝ নামলেই নিজের মান্দ (গর্ত) থেকে বাইরে আসে কিন্তু বাচ্চা হলে মায়েদের খাবার খোঁজে দিনের আলোতেও বাইরে আসতে হয়। বাচ্চারা একটু বড় হলে নানা রকম ট্রেনিং দিয়ে জঙ্গলের উপযোগী করে তুলতেও নেকড়ে মা তাদের নিয়ে দিনের আলোতেও বাইরে আসে। সেই সময় তাদের সাথে দেখা হলে এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।
নেকড়ের প্রিয় খাবার হিসাবে হরিণ, কাঠবিড়ালি ও ইঁদুরের সঙ্গে সঙ্গে জংলি পাখিরাও এই প্রাণীর শিকারের তালিকায় রয়েছে৷ নেকড়ের বিষ্ঠা সংগ্রহ করে দেখা গেছে একটির মধ্যে হরিণ এরও লোম রয়েছে৷ প্রাকৃতিক পরিবেশে নেকড়ের সংখ্যা বাড়লে এবং বনে যথেষ্ট খাদ্য পেলে নেকড়ে আর গবাদি পশু শিকার করে না৷ সেক্ষেত্রে পশু পালকদের সঙ্গে সংঘাত কম থাকে; নইলে বাড়ে।
ছবিঃ সংগৃহীত- আন্তর্জাল
ক্রমশঃ
আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকে