জ য় ন্ত কু মা র ম ল্লি ক-র একটি ধারাবাহিক গদ্য(অষ্টম পর্ব)
অথ নেকড়ে-মানব-মানবী কথাঃ গল্প বনাম সত্যি ঘটনা
অষ্টম পর্ব
নেকড়ের জাতকুল
ধূসর নেকড়ে যে কোনও পরিবেশগত পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতে সক্ষম কারণ এটির ভালো অভিযোজন দক্ষতা রয়েছে। ইউরেসিয়া ও অস্ট্রেলেসিয়া মহাদেশে প্রাচীন পৃথিবীর নেকড়েদের বর্তমানে জীবিত ন’টি স্বীকৃত উপ-প্রজাতিদের মধ্যে রয়েছে-
(১) তুন্দ্রা নেকড়ে (Canis lupus albus) – বিস্তার পূর্বতন রাশিয়া, বিশেষ করে কামচাটকা উপদ্বীপে ও উত্তর স্ক্যানডিনাভিয়ায়। এরা বড় আকারের, লম্বায় ১ মিটারের বেশি এবং ওজন ৪০ কেজির ওপরে, পুরুষ স্ত্রীর থেকে আকারে বড়; লোমশ, ফিকে ধূসর রঙের হলেও ক্ষেত্রবিশেষে তা পরিবর্তিত হতে পারে। এরা বড় বনভূমি এবং নদী উপত্যকায় বসবাস করে। এদের খাদ্যে প্রায় একচেটিয়াভাবে রেইনডিয়ার থাকে, যদিও এরা খরগোশ, পাখি এবং ছোট ইঁদুরের মতো খাদ্যও খায়। এদের সীসা-ধূসর পশম ঘন, দীর্ঘ এবং নরম হওয়ায় ঐতিহাসিকভাবে এদের চামড়া শিকারি এবং ব্যবসায়ীদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান; অতএব বিপন্ন।
(২) ইউরেশিয়ান ধূসর নেকড়ে (Canis lupus lupus) –
আকারে বেশ বড় ইউরেশিয়ান নেকড়ের বিস্তার রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম চীনের নিম্নভূমি। এরা নেকড়েদের বৃহত্তম এবং সর্বাধিক বিস্তৃত উপ-প্রজাতিগুলির মধ্যে একটি। ঐতিহ্যগতভাবে, ইউরেশিয়ান নেকড়ে সমগ্র ইউরোপ এবং এমনকি পশ্চিম এশিয়ার কিছু অংশে পাওয়া যায়।
যাই হোক, মধ্যযুগে, এই নেকড়েদের ব্যাপকভাবে শিকার করা হয়েছিল, যার ফলে এদের মোট সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছিল। আজকাল, ইউরেশীয় নেকড়ে মাত্র কয়েকটি দেশে অবশিষ্ট রয়েছে যার মধ্যে অনেক দেশেই এরা এখনও নেতিবাচক মানবিক মিথস্ক্রিয়াগুলির হুমকিতে রয়েছে।
ইউরেশিয়ান নেকড়ে একটি বৃহত্তম নেকড়ে উপপ্রজাতি যার গড় ওজন প্রায় ৩৯ কেজি। এরা স্বাভাবিকভাবেই রেইনডিয়ার, চামোইস, বন্য ছাগল এবং আইবেক্সের মতো প্রজাতি শিকার করে খায়, কিন্তু এরা মাঝে মাঝে গবাদি পশুও শিকার করে, যে কারণে মানুষ এদের মেরেও ফেলে।
(৩) রাশিয়ার নেকড়ে (Canis lupus communis)- বিস্তার উত্তর-মধ্য রাশিয়ার উরাল পর্বত অঞ্চল ও সাইবেরিয়া।
(৪) কাস্পিয়ান সাগরের নেকড়ে (Canis lupus cubanensis) – বিস্তার ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্যের অঞ্চল; বিতর্কিত উপপ্রজাতি।
(৫) মঙ্গোলিয়ার নেকড়ে (Canis lupus campestris)
ঐতিহ্যগতভাবে মঙ্গোলিয়া জুড়ে এবং চীন, রাশিয়া এবং কোরিয়ান উপদ্বীপের কিছু অংশে পাওয়া যায়। এক সময়ে, মঙ্গোলিয়ায় নেকড়ে সংখ্যা প্রায় ৩০,০০০ অনুমান করা হয়েছিল, কিন্তু নিয়মিত নেকড়ে শিকারের ফলে এই সংখ্যা ২০০০ সালের গোড়ার দিকে প্রায় ১০,০০০ জনে নেমে আসে।
আজকাল, মঙ্গোলিয়ান নেকড়ে মঙ্গোলিয়ায় মোটামুটি সুরক্ষিত, যদিও নেকড়েগুলি এখনও বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে।
(৬) স্টেপি নেকড়ে (Canis lupus desertorum)
দক্ষিণ কাজাখস্তান এবং উত্তর ইউক্রেনের কিছু অংশ সহ সমগ্র ককেশাস জুড়ে এদের পাওয়া যায়। এটি মাঝারি আকারের নেকড়ে যা স্টেপি অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যান্য নেকড়ের সাথে তুলনা করলে, এই নেকড়ে মোটা, বাদামী-ধূসর পশম সহ মোটামুটি গড় আকারে। এটি ককেশীয় স্টেপি বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে একটি কীস্টোন প্রজাতি হিসাবে প্রধান ভূমিকা পালন করে, যেখানে এটি স্থানীয় বাস্তুতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতেও সহায়তা করে।
যাই হোক, যদিও এই নেকড়ের সংখ্যা বর্তমানে কিছুটা স্থিতিশীল, বছরের পর বছর ধরে ক্রমবর্ধমান মানব-নেকড়ে সংঘর্ষের কারণে এটি বিলুপ্তির উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। বেশিরভাগ জাতীয় আইনের অধীনে সুরক্ষিত না থাকায় এখনও এদের রেঞ্জের বিভিন্ন অংশে এদের শিকার করা হয়।
(৭) হিমালয় বা তিব্বতের নেকড়ে [Canis (lupus) chanco]
মঙ্গোলিয়ার নেকড়েদের সংগে এই উপপ্রজাতি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এই নেকড়ে হিমালয়ের কিছু অংশ সহ ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে পাওয়া যায়। এরা বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রে বাস করতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে পাহাড়ী বন এবং আলপাইন অঞ্চল যদিও এরা তৃণভূমিও পছন্দ করে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, এই নেকড়েগুলি বিভিন্ন ধরণের ছোট থেকে মাঝারি আকারের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের খায়, তবে এরা ইয়াক, ভেড়া এবং অন্যান্য গৃহপালিত পশুদেরও শিকার করে। তাই সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে কারণ কৃষকরা তাদের পশুর পালকে রক্ষা করতে নেকড়েদের মেরে ফেলে।
(৮) আরবের নেকড়ে (Canis lupus arabs) একটু ছোট আকারের মরুভূমির নেকড়ে। ঐতিহ্যগতভাবে এদের আরব উপদ্বীপ জুড়ে পাওয়া যায়। যাই হোক, এটি এখন শুধুমাত্র সৌদি আরব, ইয়েমেন, ওমান এবং দক্ষিণ ইসরায়েলের কিছু অংশের মধ্যে ছোট পালে পাওয়া যায়। এই নেকড়েগুলি তাদের প্রজাতিদের মধ্যে মোটামুটি অনন্য কারণ তারা বনভূমি বা তুন্দ্রা পরিবেশের পরিবর্তে মরুভূমিতে বাস করে। ফলস্বরূপ, তাদের দেহে খুব পাতলা এবং ছোট পশম রয়েছে যা হালকা রঙের হয়। আরবীয় নেকড়ে সাধারণত ২০ কেজির মত ওজনের হয়, যা বড় নেকড়েদের আকারের মাত্র অর্ধেক। এটির বিশাল কান এবং অন্যান্য অনন্য অভিযোজন রয়েছে যা এটিকে মরুভূমির পরিবেশে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে।
(৯) ভারতীয় নেকড়ে (Canis lupus pallipes)
আরবীয় নেকড়ে জিনগতভাবে ভারতীয় নেকড়ের থেকে আলাদা এবং আরো ঘনিষ্ঠভাবে ইউরেশিয়ান নেকড়ে সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। পূর্বে, আবাসের বিস্তার অনুসারে, ধূসর নেকড়ের সবচেয়ে ছোট আকারের উপ-প্রজাতি প্যালিপস বর্ণনা করার সময় আরব এবং ইরানের নেকড়ের নমুনা ব্যবহৃত হয়েছিল, কিন্তু তা সাম্প্রতিক জিন সংক্রান্ত প্রমাণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই কিছু বিজ্ঞানী বলেন, ক্যানিস লুপাস প্যালিপস (Canis lupus pallipes), যারা ০.২৭ এবং ০.৪ মিলিয়ন বছরের মধ্যে পূর্ব পুরুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, তাদের থেকে ভারতীয় নেকড়েরা বংশ পরিচয় অনুসারে ও জিনগতভাবে আলাদা, যদিও দৃশ্যতঃ এই দুই প্রজাতির চেহারা একই রকম। তবে বাসস্থানের অধিক্রমণ এবং শারীরিক মিলের কারণে, ইরানী নেকড়ে এবং ভারতীয় নেকড়ে দীর্ঘদিন ধরে এক এবং অভিন্ন হিসাবে স্বীকৃত ছিল। কিন্তু বিশেষ করে গবেষণায় দেখা গেছে যে ভারতীয় ধূসর নেকড়ে পশ্চিম এশিয়া এবং মধ্য এশিয়ায় পাওয়া প্যালিপস নয়, কারণ ভারতীয় নেকড়ে ৪০০,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অন্য কোনও উপ-প্রজাতির সাথে প্রজনন করেনি। তাই গবেষকরা প্রস্তাব করেছেন যে ভারতীয় নেকড়েকে একটি পৃথক প্রজাতি অর্থাৎ ক্যানিস ইন্ডিকা (Canis indica) হিসাবে নতুন করে শ্রেণীবদ্ধ করা উচিত। সেক্ষেত্রে প্যালিপস শুধু ইরান থেকে আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের নেকড়েদের বোঝাবে, কিন্তু ভারত নয়। কিন্তু মুস্কিল হল বিশ্বের স্তন্যপায়ী প্রজাতি (২০০৫)-এর শ্রেণীবিন্যাস কর্তৃপক্ষ ক্যানিস ইন্ডিকাকে একটি প্রজাতি হিসাবে স্বীকৃতি দেয় নি।
উত্তর আমেরিকার স্বীকৃত উপপ্রজাতিগুলো হল- arctos আরক্টিক (কানাডার কুইন এলিজাবেথ দ্বীপপুঞ্জ), baileyi মেক্সিকো, columbianus ব্রিটিশ কলম্বিয়া, crassodon ভাংকুভার দ্বীপ, hudsonicus হাডসন বে, irremotus উত্তর রকি পর্বত, labradorius লাব্রাডর, ligoni আলেজান্ডার আর্কিপেলাগো, mackenzii ম্যাকেঞ্জি নদী, manningi বাফিন দ্বীপ, occidentalis উত্তর-পশ্চিম, orion গ্রীনল্যান্ড, pambasileus আলাস্কা ও tundraum আলাস্কা-তুন্দ্রা।
পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্লভ প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে একটি হল লাল নেকড়ে (Canis rufus)। এরা বিলুপ্তপ্রায় নেকড়ে প্রজাতির মধ্যেও অন্যতম। পূর্ব আমেরিকার আটলান্টিক মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে টেক্সাস পর্যন্ত, উত্তরে পেনসিলভেনিয়া ও দক্ষিণে মেক্সিকো উপসাগরীয় অঞ্চলে এদের উপস্থিতি রয়েছে। বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় লাল নেকড়ে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার বড় কারণ হল পশম ও চামড়ার জন্য অবাধে শিকার, আবাসভূমি ধ্বংস এবং খাদ্যের সংকট। পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানীদের নিরলস চেষ্টায় এদের সংরক্ষণ এবং কৃত্রিম পরিবেশে প্রজননের মাধ্যমে বংশবিস্তারের ব্যবস্থা করা হয়। বর্তমানে পৃথিবীতে বন্য পরিবেশে ১০০ থেকে ১২০টি লাল নেকড়ে রয়েছে। ধারণা করা হয়, লাল নেকড়ে ধূসর নেকড়েদের নিকটাত্মীয়। এরা দেখতেও অনেকটা ধূসর নেকড়ের মতোই। তবে এরা আলাদা প্রজাতি এবং দৈর্ঘ্যে প্রায় ৫ ফুট, কান লম্বা এবং শরীরে লালচে পশম রয়েছে। লাল নেকড়ে প্রতিবারে ৫ থেকে ৬টি বাচ্চার জন্ম দেয় এবং বাবা-মা উভয়েই বাচ্চাদের লালন-পালন করে। এরা দলবদ্ধ সামাজিক প্রাণী, তবে কখনও একাকী আবার কখনও ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে খরগোশ, ইঁদুর জাতীয় প্রাণী ও হরিণ শিকার করে খায়।
স্বপন কুমারের কালো নেকড়ে সিরিজ ছিল। কিন্তু কালো নেকড়ে শুধুমাত্র ধূসর নেকড়ের একটি জেনেটিক মিউটেশন। কালো পশম জেনেটিক মিউটেশনের কারণে হয় যা একটি গৃহপালিত কুকুর এবং একটি বন্য নেকড়ের মধ্যে প্রজননের ফলে সৃষ্ট হয়।
জিন তত্ত্ব ও গৃহপালিত নেকড়ের উদ্ভব
গবেষণা করে দেখা গেছে যে নেকড়ের মতো দেখতে প্রাণীর উৎপত্তি প্রায় ৬০ মিলিয়ন বছর আগে যাদের নাম ছিল মিয়াসিস (Miacis)। এরা এশিয়ায় বাস করত। ৩০ থেকে ৪০ মিলিয়ন বছর আগে এরা বিবর্তিত হয়ে বর্তমান নেকড়ের কাছাকাছি আকৃতি পায় যাদের নাম কায়ানোডিক্টিস (Cynodictis)। এরপর কয়েক লক্ষ বছরের বিবর্তনের ফলে এই কায়ানোডিক্টিস দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক ভাগ যায় আফ্রিকায়, আরেক ভাগ যায় ইউরেশিয়ায়। এই ইউরেশিয়ান প্রজাতির নাম টমার্চাস (Tomarctus) যাদের থেকেই আজকের কেনিস ল্যুপাস (Canis lupus) বা নেকড়ে, শেয়াল এবং কুকুরের উৎপত্তি হয় মধ্য প্লাইস্টোসিন যুগে উত্তর আর্কটিক অঞ্চলে প্রায় ০.৮-০.৩ মিলিয়ন বছর পূর্বে।
২০১৫ সালে সুইডিশ জিন তত্ত্ববিদ পন্টাস স্কোগলুন্ড সাইবেরিয়ায় পাওয়া নেকড়ের ফসিলের জিনের ওপর গবেষণা করে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যেখানে তিনি দেখিয়েছেন কুকুরের পূর্বপুরুষদের শিকারের সঙ্গী হিসেবে প্রায় ৩৬,০০০ বছর থেকে ৪০,০০০ বছর আগে থেকে ব্যবহার করা হত যা প্রকারান্তরে গৃহপালিত করার প্রথম পর্যায়।
পন্টাস স্কোগলুন্ড ২০১০ সালে সাইবেরিয়ার মৃত প্রাণীর দেহাবশেষ নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে একদল জিন তত্ত্ববিদকে সাথে নিয়ে টেমির উপদ্বীপে পাড়ি জমান। সেখানে বিভিন্ন প্রাণীর দেহাবশেষের সাথে একটি নেকড়ের চোয়ালের হাড় খুঁজে পান। এটাকে তিনি ল্যাবে এনে পরীক্ষা করে দেখেন, এই নেকড়েটি জীবিত থাকা অবস্থায় যেসব খাদ্য গ্রহণ করেছে বা এর জিন আধুনিক কিছু কুকুরের পিওর ব্রিডের সাথে মিলে যায় যা ঐ সময়ের নেকড়েদের থেকে কিছুটা ভিন্ন। তিনি কার্বন ডেটিং করে দেখেছেন, এই নেকড়েটি ৩৬,০০০ বছর থেকে ৪০,০০০ বছর আগে জীবিত ছিল। তিনি মনে করেন, নেকড়েদের ধরে বন্দি করা হত এবং এরা বন্দি থাকতে থাকতে একসময় পোষ মেনে যায়।
ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেস বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনীয় জিন তত্ত্ববিদ রবার্ট ওয়েন মনে করেন, মানুষ যখন ৪০,০০০ বছর আগে শেষ তুষার যুগের সময় ইউরোপ এবং এশিয়ায় বসতি স্থাপন করেছিল সেই সময়ে তারা নেকড়েকেও পোষ মানায়।
প্রত্নতাত্ত্বিক এবং জিন তত্ত্ববিদ গ্রেজার লারসনের মতে, পশ্চিম ইউরেশিয়ার কোথাও ধূসর নেকড়েদের মানুষ গৃহপালিত করেছিল। নেকড়ে এবং মানুষ একসময় একে অপরের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। তুলনামূলক উন্নত মস্তিষ্ক এবং প্রস্তরনির্মিত অস্ত্রের উদ্ভাবনের কারণে মানুষ শিকারের ক্ষেত্রে বেশি সফল হতে থাকে। দলছুট বা দলের অন্যান্য সদস্যদের থেকে তুলনামূলক দুর্বল নেকড়েরা মানুষের বসতির আশেপাশে ঘুরঘুর করা শুরু করে খাবারের গন্ধে। প্রথমদিকে হয়তো মানুষ তাদের আক্রমণ করে হত্যা করেছে, তবে একসময় অবশ্যই বুঝতে পেরেছে যে এরা মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। ঠিক এই সময় থেকেই নেকড়ের পোষ মানার প্রথম পর্যায় শুরু হয়েছে। কিছু গবেষক মনে করেন, নারীরাই প্রথম হয়তো নেকড়েকে পোষ মানিয়েছিল। তবে বন্দি বানিয়েই হোক বা নেকড়ে স্বদিচ্ছায়, যাযাবর আদিম মানুষেরা যখন এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে পাড়ি দিয়েছে, এই নেকড়েরা তখন মানুষের সঙ্গী হয়েছে। এই সফরসঙ্গী বা শিকার-সঙ্গী নেকড়েরাই কালক্রমে তাদের হিংস্রতা হারিয়েছে।
মনে পড়ে গেল সেই কুকুর ও নেকড়ের গল্পটি। এক রাতে একটি নেকড়ের খুবই খিদে পায়। এ সময় তার সঙ্গে একটি মোটা কুকুরের দেখা হলো। নেকড়ে কুকুরকে হিংসা করে বললো, “তুমি দেখতে এতো মোটা। অবশ্যই তুমি আমার চেয়ে বেশি খাও”। কুকুর বলল, “তুমি যদি আমার জিনিস খেতে চাও। তাহলে অবশ্যই আমার মত কাজ করতে হবে”। নেকড়ে বলল, “কী কাজ?” “বাড়ি পাহাড়া দেয়া এবং চোর ধরার কাজ”। “আমি কি চেষ্টা করতে পারি”। নেকড়ের কথা শুনে কুকুর খুব খুশি হলো। সে নেকড়েকে নিয়ে তার মালিকের বাড়ির দিকে ছুটলো। সে সময় নেকড়ে কুকুরের গলায় একটি স্পষ্ট দাগ দেখলো। “তোমার গলায় কি হয়েছিল?” “বেশির ভাগ সময় লোহার চেইন দিয়ে আমার গলা বাঁধা থাকে সেজন্য এমন একটি দাগের সৃষ্টি হয়েছে”। “লোহার চেইন”, নেকড়ে অবাক হয়ে বলল, “তুমি নিজের মতো চড়াফেরা করতে পারো না”? “না, আমার মতো করতে পারি না। দিনের সময় আমার মালিক লোহার চেইন দিয়ে আমাকে বেধে রাখে। কিন্তু রাতের বেলায়, আমার স্বাধীনতা আছে। তবে এটি ঠিক যে, আমি অনেক সুস্বাদু খাবার খেতে পারি। আমার মালিক আমাকে খুব পছন্দ করেন। …..কি হয়েছে, তুমি হাঁটছো না কেন? কোথায় যাচ্ছো তুমি?” নেকড়ের চলে যাওয়ার ইচ্ছা দেখে কুকুর জোর দিয়ে বললো। নেকড়ে বলল, “আমি বনে ফিরে যাচ্ছি। তুমি তোমার সুস্বাদু খাবার খেতে যাও। এতো সুস্বাদু খাবার খেতে না পারলেও আমার গলায় লোহার চেইন বেধে রাখতে চাই না এবং স্বাধীনতাও হারাতে চাই না”। নেকড়ে তার কথা শেষ করে দৌড় দিয়ে চলে গেল।
ইউক্রেনের একটা উপকথা রয়েছে- ‘সিরকো আর তার নেকড়ে বন্ধু’।
গ্রামে এক লোক বউ, ছেলেমেয়ে নিয়ে বাস করত। তার সাথে থাকত সিরকো নামের এক কুকুর। সিরকো অনেক বছর ধরে তার মনিবের সাথে আছে। বয়সের ভারে সে এখন আগের মতো বাড়ি পাহারা দিতে পারে না। কাজ করতে না পারার শাস্তি হিসেবে একদিন সিরকোকে মনিব দিল বাড়ি থেকে বের করে।
‘কত্তগুলো বছর আমি মনিবের খেদমত করেছি। এখন আমার বয়স হয়েছে। দয়ামায়ার ধার না ধেরে, মনিব আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল! মানুষ এত্ত নিষ্ঠুর!’
এসব ভাবতে ভাবতে আপন মনে সিরকো পথ চলছিল। হঠাৎ কোত্থেকে এক নেকড়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল।
‘বলি এভাবে ঘোরাফেরা করছো, তোমার কাহিনিটা কী বলো দেখি বাপু।’ কৌতূহল নিয়ে নেকড়েটা সিরকোর কাছে এগিয়ে এলো। হাজার হোক জ্ঞাতিসম্পর্কীয় হালকা-পাতলা একটা আত্মীয়তা তো আছে কুকুর জাতটার সাথে। হয়তো সেটার তাগিদেই সিরকোকে অনেকক্ষণ ধরে এলোপাতাড়ি ঘুরতে দেখে নেকড়ের কেমন একটু মায়াই হয়।
‘আমি আর কাজে লাগছি না দেখে মনিব আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। আমার কোত্থাও যাওয়ার নেই।’ দুঃখী দুঃখী গলায় উত্তর দিল সিরকো।
শুনে নেকড়ের মনটা খারাপ হয়ে গেল, ‘আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি। যেভাবে বলব সেভাবে যদি কাজটা করতে পারো তবে নিশ্চিত থাকো, মনিব তোমাকে আবারও বাড়িতে আশ্রয় দেবে।’
‘দয়া করো নেকড়ে ভায়া! আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধারের পথ বাতলে দাও।’ সিরকো প্রায় কেঁদে কঁকিয়ে উঠল, ‘এ উপকারটা করলে বিনিময়ে আমিও প্রতিদান দেবার চেষ্টা করব।’
‘বেশ, শোন মন দিয়ে। শিগগিরই ফসল তোলার জন্য তোমার মনিব আর তার স্ত্রী মাঠে যাবে। স্বামীর কাজে সাহায্য করতে মনিবের স্ত্রীও তাদের বাচ্চাটাকে খড়ের গাদায় ঘুম পাড়িয়ে রাখবে। তোমাকে কিন্তু বাচ্চাটার আশপাশেই ঘাপটি দিয়ে থাকতে হবে, যেন আমার বুঝতে সুবিধা হয় বাচ্চাটা ঠিক কোথায় ঘুমোচ্ছে। মনিব আর তার স্ত্রীর ব্যস্ততার সুযোগে আমি সেখানে গিয়ে বাচ্চাটাকে খপ করে মুখে তুলে নেব। তুমি তখন আড়াল থেকে বেরিয়ে বাচ্চাটাকে আমার মুখ থেকে কেড়ে নেবার চেষ্টা করবে। আমাকে একটু ভয় দেখাবার ভান ধরবে। আমিও ভয় পেয়েছি এমন একটা ভান করে মুখ থেকে বাচ্চাটিকে ফেলে পালিয়ে যাব।‘
মাঠের ফসল পেকে উঠলে যথাসময়ে সিরকোর মনিব বউ-বাচ্চা নিয়ে মাঠে গেল। মাঠের কাছাকাছি জায়গায় বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়িয়ে ফসল তোলার কাজে স্বামীকে সাহায্য করতে শুরু করল স্ত্রী।
ওদিকে নেকড়ের কথামতো খড়ের গাদার ওপাশে ঘাপটি মেরে থাকা সিরকোর উঁকি দেয়া কান দেখে নেকড়ের বুঝে নিতে দেরি হলো না বাচ্চাটা কোথায়। ফন্দি মাফিক নেকড়ে সেখানে গিয়ে বাচ্চাটিকে তুলে দিল দৌড়। নেকড়ের পিছু পিছু ঘেউ ঘেউ করতে করতে সিরকোও ছুটল। এমন ভয়ংকর কাণ্ড দেখে মনিব সব ভুলে সিরকোকে উদ্দেশ করে বলে উঠল, ‘ধর ওকে সিরকো!’
সিরকো ছুটে গিয়ে নেকড়ের মুখ থেকে বাচ্চাটিকে ছিনিয়ে নিয়ে মনিবকে ফিরিয়ে দিল। কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে মনিব সিরকোকে এক টুকরো রুটি আর গোশত খেতে দিল। সন্ধ্যায় বাড়ির পথে রওনা দেয়ার সময় সিরকোকেও সঙ্গে নিয়ে নিল।
বাড়ি ফিরেই মনিব সিরকোকে গরম গরম খাবার দিল। সেই খাবার হুড়োহুড়ি করে খেতে গিয়ে সিরকোর জিভ গেল পুড়ে। সবাই সেটা নিয়ে হাসাহাসি করল।
বাচ্চাকে বাঁচানোর পুরস্কারস্বরূপ সিরকো আবার মনিবের বাড়িতে আশ্রয় পেল। বন্ধু নেকড়ের জন্যই এটা সম্ভব হয়েছিল, সে কথাটা সিরকো ভুলে যায়নি। কীভাবে বন্ধুর উপকারের প্রতিদান দেয়া যায় সেটা নিয়ে সে ভাবতে লাগল।
মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে দারুণ সব খাবারের অয়োজন হয় একদিন। সিরকো মাঠে গিয়ে নেকড়েকে দাওয়াত দিয়ে আসে, ‘শোনো ভাই, আগামী রোববার সন্ধ্যায় তুমি আমাদের সবজিবাগানে এসে ঘাপটি দিয়ে বসে থেকো। সময়মতো এসে তোমাকে চুপিচুপি ভেতর বাড়িতে নিয়ে যাব। খাসা আয়োজন হয়েছে খাওয়াদাওয়ার। কবজি ডুবিয়ে খেয়ো ভায়া! ভরপেট খাইয়ে তোমার দয়ার প্রতিদান দিতে পারব আশা করি। ‘
সিরকোর কথামতো বিয়ের দিন সবজিবাগানে ঘাপটি মেরে বসে থাকে নেকড়ে। সিরকো সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চুপিচুপি নেকড়েকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসে। তারপর টেবিলের তলায় লুকিয়ে রাখে। অতিথিদের জন্য সাজিয়ে রাখা মজাদার সব খাবার থেকে কিছু খাবার নিয়ে টেবিলের তলায় লুকিয়ে থাকা নেকড়েকে দেয়।
অল্প সময়ের মধ্যেই নেকড়ে গপাগপ সাবাড় করে ফেলে। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সিরকো আবারও খাবার নিয়ে আসে। আবারও সে গপাগপ করে সবটা খেয়ে ফেলে। নেকড়েকে খাবার জোগাতে গিয়ে একপর্যায়ে সিরকোর পিঠেই অতিথিদের পিটুনি পড়তে যাচ্ছিল।
মনিব সেটা দেখে তাদের বিরত করে বলে, ‘দয়া করে ওকে কেউ মারবেন না। আমার বাচ্চাটাকে নেকড়ের মুখ থেকে বাঁচিয়ে সিরকো আমাদের কৃতজ্ঞতায় বেঁধে ফেলেছে। ওকে এ পরিবারেরই একজন সদস্য হিসেবে দেখার অনুরোধ থাকল সবার প্রতি।’
মনিবের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো খাবার চাখার অনুমতি পেয়ে সিরকোর তো পোয়াবারো। সে ভালো ভালো গোশতের টুকরো, পিঠা, কেক, মিষ্টি সমানে টেবিলের তলায় চালান দিতে থাকল। এত এত খেয়ে নেকড়েটার শুধু পেটই ভরে উঠল না, মনটাও খুশিতে বাগবাগ হয়ে গেল। খুব খুশিতে থাকলে নেকড়ের আবার গান গাইবার ঝোঁক চাপে।
যেই না নেকড়ে সুর তুলেছে, সুরের বদলে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা বেসুরো চিৎকারে অতিথিরা চমকে ওঠে। আতঙ্ক নিয়ে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। অনেকেই নেকড়েকে মারবে বলে লাঠিসোটা খোঁজাখুঁজি শুরু করে। মতিগতি সুবিধার না দেখে সিরকো নিজেই লাফ দিয়ে নেকড়ের ওপর গিয়ে পড়ে। ভাবখানা তার এমন যে ব্যাটাকে আজ মেরে আর আস্ত রাখবে না!
ওদিকে রাগে-ভয়ে অস্থির অতিথিদের শান্ত হবার অনুরোধ করে মনিব বলে, ‘সবাই শান্ত হন। কেউ নেকড়েকে মারতে যাবেন না, তাতে সিরকোর পিঠেই ঘা পড়ার আশঙ্কা আছে। বদের হাড্ডি নেকড়েকে শায়েস্তা করতে সিরকো একাই যথেষ্ট।’
সিরকো নেকড়েকে টানতে টানতে মাঠে নিয়ে গেল। বলল, ‘একবার তুমি আমার উপকার করেছিলে। আজ সেই উপকারের প্রতিদান দিলাম বন্ধু। তুমি পালাও জলদি।’
এরপর, দুই বন্ধু একে অন্যকে বিদায় জানিয়ে আলো ঝলমল বিয়েবাড়ির দিকে একজন, অন্যজন মাঠ পেরিয়ে দূরের বনের দিকে হাঁটা দেয়।
ছবিঃ খেয়েদেয়ে খুশি হয়ে সঙ্গীত সাধনায় মগ্ন নেকড়ে মানুষ যখন ধীরে ধীরে কৃষিকাজ শুরু করে তখন শিকারের প্রয়োজনীয়তা কমে যায়। ফসল উৎপাদন এবং পশুপালন করেই তারা জীবনধারণ শুরু করে। এই পর্যায়ে এসে নেকড়ে থেকে বর্তমানের কুকুর প্রজাতি আলাদা হয়েছে (উপপ্রজাতি ফ্যামিলিয়ারিস) বলে অনেকেই মনে করেন। মানুষের কৃষিকাজ শুরুর পর্যায়ে যেসব নেকড়ের দেহাবশেষ পাওয়া যায় সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এসব প্রাণীর খাদ্যাভ্যাসে শর্করা জাতীয় খাবার ছিল, যা প্রমাণ করে মানুষের কৃষিজাত উচ্ছিষ্ট এরা গ্রহণ করত।
মানুষ কৃষিকাজ শুরু করলে খাদ্যে আমিষের মাত্রা কমতে থাকে আর শর্করার মাত্রা বাড়তে থাকে। একদিকে যেমন পোষমানা নেকড়েরা শিকার করা ছেড়ে দেয়, অন্যদিকে তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তিত হতে থাকে। একসময় তাদের হিংস্রতা কমে যায়। তাদের এই বৈশিষ্ট্যই পরবর্তী প্রজন্মের নেকড়ের মাঝে বাহিত হয়। ধীরে ধীরে জিনগত পরিবর্তন ঘটে তাদের দাঁত এবং চোয়ালের আকার ছোট হয়, কান খাড়া থাকে না।
আরেকটি কারণ হচ্ছে যাযাবর মানুষের চলতি পথে এই পোষমানা নেকড়ে এবং বিভিন্ন অঞ্চলের নেকড়ের মধ্যে মিলনে সংকর প্রজাতির নেকড়ের উদ্ভব হয়েছে, যা বর্তমান কুকুরের কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। যারা প্রাকৃতিক ভাবে সংকরায়িত হয়নি, তাই নেকড়ের বৈশিষ্ট্যও বজায় থাকেনি।
আধুনিক কুকুর এবং নেকড়েদের কিছু আকারগত এবং জিনগত পার্থক্য থাকলেও তারা অনেকদিক দিয়েই একই রকম। কুকুরের কান ঝুলে থাকে, এদের চোয়াল শিকার না করার কারণে ছোট, মাথা ছোট এবং নম্র স্বভাব। জিনগত পার্থক্যের মধ্যে রয়েছে খাবার হজমকারী অন্তত তিনটি জিন, যেগুলো শর্করা জাতীয় খাবার হজমে সাহায্য করে। এগুলো নেকড়েদের মধ্যে পাওয়া যায় না। একটি কুকুরের পাঞ্জা নেকড়েদের পাঞ্জার প্রায় অর্ধেক আকারের হয়, কারণ কুকুর সাধারণভাবে নেকড়েদের মতো শক্তিশালী হয় না।
বিশ্বে নেকড়েদের বিস্তার ও সংখ্যা
ইউরোপ (রাশিয়া, বেলারুশ এবং ইউক্রেন বাদে) ২০১৪ সালের হিসাবে ২৮টিরও বেশি দেশে ১২,০০০- পর্তুগাল ২০০-৩০০, স্পেন ২,০০০-৩,০০০, ইতালি ২,০০০+, ফ্রান্স ৫৮০, জার্মানি ১২৮ পাল, নরওয়ে ১০০, সুইডেন ২৮৯-৪৭৪, গ্রীনল্যান্ড ২০০, ফিনল্যান্ড ২১৬-২৪৬, পোল্যান্ড ২,৫০০, এস্তোনিয়া ২০০, লাটভিয়া ৬০০, লিথুয়ানিয়া ৩০০-৪০০, বেলারুশ ১,৫০০-২,০০০, ইউক্রেন ২,০০০, চেক প্রজাতন্ত্র ২০, স্লোভাকিয়া ৩৫০-৪০০, স্লোভেনিয়া ৪০-৬০, ক্রোয়েশিয়া ২০০, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা ৪০০, সার্বিয়া এবং মন্টিনিগ্রো ৫০০, হাঙ্গেরি ২৫০, রোমানিয়া ২,৫০০, বুলগেরিয়া ১,০০০-১,২০০, গ্রীস ১,০২০, উত্তর মেসিডোনিয়া ১,০০০, আলবেনিয়া ২৫০ ও রাশিয়া ২৫,০০০-৩০,০০০।
উত্তর আমেরিকা- কানাডা ৬০,০০০, উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল, নুনাভুত এবং ইউকন ৫,০০০, ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ৮,৫০০, আলবার্টা ৭,০০০, সাসকাচোয়ান ৪,৩০০, ম্যানিটোবা ৪,০০০-৬,০০০, অন্টারিও ৯,০০০, কুইবেক ৫,০০০, ল্যাব্রাডর ২,০০০, যুক্তরাষ্ট্র ১৮,০০০ (যার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ ১০,৫০০-১২,০০০ আলাস্কায়), মিনেসোটা ৪,১০০, উইসকনসিন ৭৫০, মিচিগান ৭৫০, ওয়াইমিং, আইডাহো এবং মন্টানা ১,৬৫৭, উত্তর-পশ্চিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১,৮০২, মেক্সিকো ১৮৬।
এসিয়া- চীনে ১২,৫০০ (২০০৩), ইরান ১,৫০০, ইরাক ১১৫, ইজরায়েল ১৫০, জর্ডন ২০০, কাজাখস্তান ৩০,০০০, কিরগিজস্তান ৪,০০০, লেবানন ৫০, মঙ্গোলিয়া ১০,০০০-২০,০০০, সৌদি আরব ২৫০-৭০০, সিরিয়া ২০০, তাজিকিস্তান ১,৭০০, তুরস্ক ৭,০০০, তুর্কমেনিস্তান ১,০০০, উজবেকিস্তান ২,০০০, ভারত ১,০০০, বাংলাদেশ ০, আফগানিস্তান, নেপাল বা ভুটানের কোন সাম্প্রতিক সংখ্যা জানা যায় নি।
ভারতে, নেকড়ে বিভিন্ন রাজ্যে পাওয়া যায়। সেখানে অনেক সময় নেকড়েরা দল বেঁধে ঘোরে। কিন্তু বেশির ভাগ সংরক্ষিত বন্যপ্রাণ (জাতীয় উদ্যান বা অভয়ারণ্য) এলাকার বাইরে বাস করে, যেমন পশ্চিমবঙ্গে। ভারতে নেকড়ে অধ্যুসিত সম্ভাব্য আবাসস্থল ৩,৬৪,৪২৫ বর্গকিমি যার মধ্যে পশ্চিম ভারতে রয়েছে নেকড়ের সবচেয়ে বড় আবাসস্থল সৌরাষ্ট্র-কচ্ছ-থর অঞ্চল ১,০২,৮৩৭ বর্গকিমি। এর মধ্যে প্রজনন এলাকা সম্ভবত ৮৯,০০০ বর্গকিমি। যে সব রাজ্যে নেকড়ে বেশি সেগুলো হল মধ্য প্রদেশ (৬২৬-৯৩৮), রাজস্থান (গড় ৫৩২), গুজরাট (৪০১-৬০০) ও মহারাষ্ট্র (৩২২-৪৮১)। এছাড়া কম সংখ্যায় নেকড়ে আছে ছত্তিশগড় (২৫৯-৩৮৯), অন্ধ্র প্রদেশ (১৩৩-১৯৯), তেলেঙ্গানা (১২৭-১৯০), ওড়িশা (৬৮-১০২), ঝাড়খন্ড (৬৬-৯৯), কর্ণাটক (৫৮-৮৭), উত্তর প্রদেশ (৪৯-৭৪) ও বিহার (২৬-৪০) রাজ্যে। তামিলনাড়ু, উত্তরাখন্ড ও হরিয়ানাতেও নেকড়ে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। উত্তরপূর্ব ভারতে নেকড়ের সংখ্যা জানা যায় নি।
নেকড়ে পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলে খুব বেশি নেই, যা আছে তা দক্ষিণ-পশ্চিমের জঙ্গল মহলে। সাম্প্রতিককালে ২২টি নেকড়ে দেখা ও ১৩৭টি মল পাওয়া গেছে এই অঞ্চলে যাদের মধ্যে জিনের তফাতও রয়েছে। ক্যামেরার ফাঁদে বেশি ধরা পড়েছে পুরুলিয়ায়, তারপর বাঁকুড়া ও ঝাড়গ্রামে, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায়, যেমন পাঞ্চেৎ পাহাড়, ওনা (ঝালদা), কাঁসাচোরা (সিমলাপাল), বরপোচা (রাণিবাঁধ) ও কোদোপাল (বেলপাহাড়ি)। নেকড়ের সংখ্যা কম বর্ধমান ও বীরভূমে। ভুলাভেদা, ঝিলিমিলি, বাঁশপাহাড়ি, যমুনা ও চান্দাবিল্লার জঙ্গলে বেশি নেকড়ে আছে। ছোটনাগপুর উপত্যকায় নেকড়েদের ব্যবহারিক করিডোরও রয়েছে। নেকড়ে-মানুষ সংঘাত বেশি থেকে কম দেখা গেছে রাণিবাঁধ, বান্দোয়ান, বাঘমুন্ডি, মাঠা, যমুনা, ঝালদা, বাঁশপাহাড়ি, ঝিলিমিলি ও অযোধ্যার জঙ্গল সংলগ্ন গ্রামগুলিতে। এখানে নেকড়েরা বেশির ভাগ ছাগল তুলে নিয়ে যায়। একবার ঝাড়গ্রামের শিমুলগঙ্গা গ্রামে মানুষের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে।
অতীতে বাংলাদেশে কৃষকরা তাদের গবাদি পশু শিকার করার জন্য নেকড়েদের পিটিয়ে হত্যা করেছিল। ধূসর নেকড়েকে শেষবার ১৯৪৯ সালে সে দেশে দেখা গিয়েছিল। তারপর নেকড়ে আর দেখা যায় নি। তবে সাম্প্রতিক কালে, ভারতীয় ধূসর নেকড়েকে আবার বাংলাদেশ সুন্দরবনের তালতোলি গ্রামে দেখা গিছল বটে কিন্তু তাকেও গ্রামবাসীরা পিটিয়ে মারে। সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল যে বিষয়টি, তা হল প্রাণীটির গলা ও গালে থাকা সাদা সাদা কিছু দাগ।
আগে ভারতীয় সুন্দরবনে নেকড়ে চাক্ষুষ দেখার কোন রেকর্ড ছিল না ৷ কিন্তু ২০১৭ সালে একটি ছবিতে নেকড়ে দেখা গিয়েছে সুন্দরবনে৷ সুন্দরবনে ঘুরতে যাওয়া এক পর্যটকের দল নেকড়ের ছবিটি তোলে৷ সুন্দরবন ব্যাঘ্রপ্রকল্পের সজনেখালি অভয়ারণ্য এলাকায় পাখির ছবি তুলতে গিয়ে দেখা মেলে ওই নেকড়ের৷ সময় নষ্ট না করে ছবিটি ক্যামেরাবন্দি করে নেয় তারা ৷ বন দফতরের কাছে ছবিটি পাঠানো হলে তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখে।
ক্রমশঃ…
আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকে