কাকচক্ষু দর্শন : ভাষা ভাবনা[১]
কামারুজ্জামান
জীবে দয়া করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।
গুরুবাণী বলে কথা। সবাই বোঝে। এটাও তো একটা ভাব ও ভাষ্য যা কিছু বলতে চায়, যা সবাই বুঝে নেয়, এবং সেইমত অবশ্য কেউ করে কি না তার স্থিরতা থাকে না। কিন্তু এটাই কি শেষ কথা? এর বাইরে ও ভিতরে আরও কিছু কথা কি থেকেও থাকে না। যেমন, ঈশ্বর কে কী কোথায় তা না জেনে না বুঝেই তাকে সেবা করতে বলা, এবং তার আগে সর্ব্বজীবে দয়া করতে বলা – যার মধ্যে জীব হিসাবে মানুষও অন্তর্ভুক্ত। এখানে প্রথমেই যেটা বোঝার সেটা হল মানুষ বাদে আর সব জীব, এবং প্রকৃতিও, মানুষের দয়া বা সেবায় বেঁচে থাকে না, তারা নিজেরাই নিজে বেঁচে থাকে, ঈশ্বর বা কারুর দয়া বা সেবায় বাঁচে না – ডাবায় খড় খোল না পেলেও গরু দিব্যি ছাগলের মতো নিজের আহার খুঁজে নিতে পারে, মানুষই বরং নিজের স্বার্থেই তাকে গোশালে বেঁধে রাখে, পূজাও করে – অবশ্য কেন করে তা না জেনেই। দ্বিতীয়তঃ, যেটা নিয়েও সওয়াল ওঠানো যায় ও যা নিয়ে গোল বা সরগোল ওঠার কথা. তা হল মানুষকে কেন অন্যের দয়া ও সেবায় বেঁচে থাকতে হবে, কেন সে নিজের বৃত্তিতে নিজের কীর্তিতে স্বাধীন অস্তিত্ব ও সত্তা নিয়ে বেঁচে থাকবে না বা সেইভাবে বেঁচে থাকার অর্থাৎ নিজেই নিজে ক’রে খাওয়ার তার কেন সুযোগ থাকবে না? কেন তাকে পরের সেবা ও দয়া নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে? কেন অধিকাংশ মানুষকে পরভৃত্য হয়ে থাকতে হবে – জীবিকার বদলে লঙ্গরখানা, মানে, নাকের বদল নরুন? নরুন নয়, মানুষের নাক নিয়ে বেঁচে থাকাটাই জরুরী। কিন্তু সেটা থেকেই সে বঞ্চিত। কথাটা কি তাকে বঞ্চনা করার উদ্দেশ্যেই রচিত? নিশ্চয় তাই।
মানুষকে বঞ্চনা করার উদ্দেশ্যে এমন অনেক কথাই রচিত। এমন অনেক মানুষই পূজিত। এমন কথার গুলি খেয়ে হজম করতে করতেই মানুষের জ্রান বেরিয়ে যায়। মানুষ বুঝেও বুঝতে চায় না এইসব কথা তার উদ্দেশ্যে রচিত এক একটা দিব্যাদেশ: হও ধর্মেতে ধীর, হও কর্মেতে বীর…
কূটাভাস তো অবশ্যই, এটা একটা দার্শনিক সমস্যাও বটে, সর্ব্বোপরি আর্থ-সামাজিক সমস্যা এবং নৈতিক বিধি ও বিভেদ যার সমাধান খুঁজতে গিয়েই আসলে দর্শনের উদ্ভব (এবং ধান্দাবাজি রাজনীতির জনপ্রিয় প্রচার ও প্রসার)। মার্কসের ভাবনায় বলতে গেলে, দার্শনিকরা অনেক কিছু করেছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু করেনি। সেই ভেবেই মনে হয় মার্কস হেগেলের শীর্ষাসন দর্শনকে মাটির উপর খাড়া পা’য়ে দাঁড় করিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। তাতে কতটা কী হয়েছে তা বোঝা না গেলেও অধিবিদ্যক দর্শন অন্ততঃ কিছুটা মানুষের শরীর অর্জন করতে পেরেছে। তার আগে সক্রেটিসও তাই করে গিয়েছেন, মানুষের সমস্যাকে কল্পনা ও পরিকল্পনার আকাশ থেকে সটান মাটির পৃথিবীতে নামিয়ে আনার কথা বলেছেন। কিন্তু ভবী যে ভোলবার নয়।
হ্যাঁ, ওই আর্থ-সামাজিক সমস্যা না থাকলে মানুষকে ওইসব গুরুবাণী শুনে থাকতে হত না। আসলে গুরুবাণী (এবং সেইসঙ্গে খয়রাতি যার মানে সেই জীবদয়া, বকলমে ঈশ্বর-সেবা) বিলিয়ে/শুনিয়েই মানুষকে মাথায় টুপি পরিয়ে রাখা হয়, তাদের আসল সমস্যাকে জিইয়ে রাখা হয়, মানুষকে বেকেটের গোডোর মতো অপেক্ষা করিয়ে রাখা হয়, স্থিতাবস্থাকে আরও সুস্থিত করে তোলা হয়। এটা জানা ও বোঝা খুব জরুরী। কিন্তু মানুষকে এমন করে রাখা হয় যে তারা জানা ও বোঝাকে গ্রাহ্য করে না, ক্ষমতার মদভাষ্যে তারা বুঁদ হয়ে থাকে, এর যে বিকল্প ভাবনাও থাকতে পারে তা নিয়ে কখনই তারা মাথা ঘামায় না, এবং এইভাবে তারাও স্থিতবস্থাকে আরও স্থিত হয়ে থাকার সুযোগ করে দেয়, তারাও নিজেদের এই যজ্ঞের কুশীলব বলে ভাবে। আসলে তাদের এইভাবে ভাবানো হয়, তাদেরকে নিয়তিবাদী করে রাখা হয়, তারা সবসময় জ্যোতিষির পাঠশালে ও ট্যাঁকশালে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে। তাদের ওই তোতাবুলি সদ্বাভটা ক্ষমতার পক্ষে অত্যন্ত জরুরী, কারণ মানুষকে শাসন করতে হয়, তাদের শাসনে রাখতে হয়।
এটাই চলে আসছে যুগান্তরকাল ধরে। সবেতেই এর প্রমাণ মিলবে।
তারা শিকারি নয়, তারা শিকার, যজ্ঞশালার সহজ শিকার। বন্দুকের সওদাগরেরা তাদের তাক করতে একটুও ভুলচুক করে না।
তো, এইসবের সঙ্গে ভাষার কী সম্পর্ক? সম্পর্ক নাই? আছে, আর আছে বলেই তো ভাষা নিয়ে এত ছল-চাতুরি – ভাষার ভেলকি খেলিয়েই যে জগৎ চলে। ভাষা একইসঙ্গে অস্ত্র ও নিরস্ত্র। ক্ষমতায় যারা থাকে, যারা মানুষকে নিজেদের শাসনে রাখে তারা ঠিকই জানে কখন কোনটা প্রয়োগ করতে হয়, কোনটা প্রয়োগ করলে কী পরিণতি হয় – অস্ত্র, না নিরস্ত্র? এই বধ্যভূমে তাদের কাছে সব অস্ত্রই সমান, সব অস্ত্রই সমান ধারালো, রক্তপাত হয় না।
আবারো বলি, ভাষা নিছক ভাষা নয়, তার থেকে আরও বেশী কিছু – শুধু মুখের কথা নয়, লেখার ভাষ্য নয়, শিল্প-সাহিত্যের ক্ষুরধার ক্ষুধা নয়, ছবির অপলক চোখ নয় – ভাষা এমনই যা আসতেও কাটে, যেতেও কাটে, রাখলে রাখে, মারলে মারে – এমনই তার সর্ব্বচর মরুভূমি, ক্ষুধান্তের সালিশ।
ফ্যাসিস্ট হিটলারের পার্টির নাম ছিল : National Socialist German Party (Nazi Party)! সমাজতন্ত্রের শেষ পরিণতি এই ফ্যাসিস্টতন্ত্রই।
ভাবা যায় পার্টির নামে মজদুর সমাজতান্ত্রিক হয়েও কীভাবে একটা ফ্যাসিস্ট পার্টি হয়ে যায়! এক লাফে কীভাবে তার নামধাম উল্টিয়ে যায়!
নামে কী আর আসে যায়। যে-ই নর, সে-ই নরাধম। আসলে বলতে গেলে, ভাষা কখনো বিষ, কখনো নির্বিষ। একইসঙ্গে ম্যাটার এবংএ্যান্টি-ম্যাটার।
ভাবা যায় ভাষায় কখন কী থেকে কী হয়? কিন্তু যা হয় তা ভাষার জিভ খসিয়েই হয়। সুতরাং, সাধু সাবধান! ভাষাকে বুঝতে ভুল করলে বা তার কালানুক্রমিক বিবর্তনকে বুঝতে না পারলে বিপদে পড়তেই হবে। নিরীহ মানুষের কাছে ভাষা বিভীষণ জ্বর রাক্ষস যার রাক্ষুসে তিন পা, ছয় হাত, ছয় মাথা এবং নয় চোখ। কখনো অসুস্থ মনকে প্রশমিত করে, কখনো বা সুস্থ মনকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। ভাষা মন খোলসা করে কথা বলে না। গণতন্ত্রকে স্বেচ্ছাতন্ত্র করে তুলতে ভাষার জুড়ি নাই। ভাষা সবই পারে, সবই করে। সুতরাং, একদেশদর্শী হিসাবে গ্রহণ করলে মারাত্মক ভুল হবে।
কেন না ভাষার নিহিতার্থ বহুরূপে তার বিবর্তন ঘটিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রবঞ্চনা করে। মানুষকে ভুল পথে টেনে নিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, ভাষার গতিও স্থিতিশীল নয়, তার গতিশীলতা স্থান-কাল সাপেক্ষ – আর্থ-রাজনৈতিক তথা সমাজ-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতে তার গতিমুখ যখন তখন পাল্টিয়ে যায়, ইতিবাচক থেকে নেতিবাচক এবং এমন কি তার নঞর্থক হয়ে ওঠারও প্রবণতা লক্ষ্যনীয়। ভাষার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ও অভিব্যক্তি কালানুক্রমে হারিয়েও যায়, তার মূল খুঁজতে গিয়ে অথই সমুদ্রে পড়তে হয় (সমুদ্র বলতে আমরা যা জানি তার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হোল পুষ্করিণী) – এবং সেই মূলগত অর্থটা অনেক ক্ষেত্রেই চির-নির্বাসিত হয়ে থাকে, কোনো ফরমান আর তাকে তার সূতিকাগারে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারে না। সেটা তখন আমাদের জরুরী প্রকার প্রকরণের তালিকার বাইরে রয়ে যায়। মনে রাখতে হবে সমাজ সময় ও তার প্রেক্ষিতই ভাষার নিয়ন্ত্রক – এইটুকু নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ভাষা মানুষকে দিয়ে যা খুশী করিয়ে নেয়, ভাষাকে শাসন করতে গিয়ে শেষাবধি মানুষই তার শাসনে শাসিত হয়ে পড়ে – ভাষা তখন একাই সব ও সর্বস্ব। মানুষ নিজে ভাবতে গিয়ে নিজেই ভাষার ভাবনার কবলে গিয়ে পড়ে (ভাষা ও ভাবনার মধ্যে প্রতিনিয়ত একটা সংঘর্ষ ও নির্ম্মান চলে, ভাষায় ভাবনা অনূদিত হয়, আবার ভাষাও ভাবনায় অনূদিত হয়, ভাষাই তার হয়ে ভাবে এবং তাকে ভাবায়। সেই অর্থে ভাষা একগুঁয়ে স্বেচ্ছাচারী।
একইসঙ্গে যা প্রচার ও অপপ্রচার। অব্যবহিত চাহিদা পড়লেই তার ডাক পড়ে নতুন ফুটফুটে শিশু প্রসব করার জন্য যার প্রতি মানুষ আকর্ষিত হতে বাধ্য হয় (এই চাহিদা আবার অনেকক্ষেত্রেই আরোপিত মানুষের উপর বস্তুগত চাহিদা আরোপনের মতো, বাজারে না বিকোলে তাকে উঠিয়েও নেওয়া হয় – তবে অভিধানের মজুত শব্দভাণ্ডারে সেটা রয়েই যায়, পচতে থাকে, আবার পচেও না, না-পচলে সেটা আবার নতুন করে উঠে আসে)। সামাজিক প্রেক্ষিতে যেমন আরোপিত চাহিদার দাপটে মৌলিক চাহিদার যেমন ক্রমান্বয় প্রবৃদ্ধি ঘটে চলে, ভাষাও তেমন শক্তিতে তার শরীরবৃদ্ধি ঘটিয়ে চলে – তার জরুরী প্রয়োজন থাকুক বা না-থাকুক। পোস্ট-মর্ডানিজম, ডিকন্সট্রাকশন, পোস্ট-ট্রুথ, পোস্ট-হিউম্যান, এ্যানথ্রোপোসিন ইত্যাকার কথাগুলো তারই কিছু দৃষ্টান্ত। গণতন্ত্র বলে একটা ধারণা অতি-প্রাচীন কালে থাকলেও ফ্যাসিবাদ কথাটা কিন্তু উত্তর-শিল্প কালের সংযোজন। কিন্তু এইসব কথা বা ধারণা কতটা যৌক্তিক ও প্রাসঙ্গিক তা নিয়ে অশেষ সংশয় থেকেই যায়। মজাটা হচ্ছে, দার্শনিকরা বড়োই অস্থিরমস্তিষ্ক, ভাষা যেন সবসময় তাদের যাদুটোনা করে রাখে, তারা কথা গিলে খায়, বাজারে তাদের চাহিদা কমে গেলে তারা নতুন নতুন তত্ত্বপণ্য ছেড়ে তাদের পা’য়ের তলায় মাটি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে, একই সহজ কথা বা ধারণায় শব্দের পারমিউটেসন ও কম্বিনেসন ঘটিয়ে নতুন বিজ্ঞাপনের মোড়কে পুরানো কথায় আরও জটিলতা সৃষ্টি করে উপভোক্তাকে আকৃষ্ট করতে চায় (প্রসঙ্গতঃ স্মর্তব্য: পিকাসো একবার মন্তব্য করেছিলেন যে তিনি তাঁর ছবিকে যত জটিল ও দুর্ব্বোধ্য করে আঁকেন ততই তাঁর ছবির খরিদ্দার বেড়ে যাওয়ার ধুম পড়ে যায়। চোমস্কি সবিনয়ে স্বীকার করেন যে তিনি ফুকোর কথা কিছু বুঝতে পারেন না)।
দর্শনে সহমত একটা বিরল দর্শন। নিধন যজ্ঞ একটা লেগেই থাকে।
দর্শন ও শিল্প সাহিত্যের ভাষা সম্ভ্রান্ত মানুষের তৈরী করে নেওয়া কৃত্রিম নাগরিক ভাষা, গ্রামীণ ও প্রান্তিক মানুষের বোধ্য ভাষা নয়, তারা সেই অর্বাচীন ভাষা শুনে ঋদ্ধও হয় না। প্রাচীন ভারতের মুনিঋষিরা তাদের প্রচারিত উচ্চমার্গ দর্শনকে জনপদবাসী মানুষের কাছ থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার উদ্দেশ্যে তারা তা সংস্কৃত ভাষায় চর্চা করত (থুতু বললে যাতে সাধারণ মানুষ বুঝে যায়, তারা নিজেদের মধ্যে থুতুকে ’নিষ্ঠিবন’ বলত), শাস্ত্র রচনা করত, ব্রাহ্মণরা একই উদ্দেশ্যে সংস্কৃত ভাষায় যজ্ঞ ও পূজার্চনা করত। নৈতিকতার সঙ্কটে রামায়ণে না কি কোনো ক্ষমা নাই। তাই? তার নৈতিকতার প্রকৃত ভিত্তিটা কী ও কোথায় তা জানতে পারলে অন্ততঃ কিছুটা নীতিশিক্ষা পাওয়া যেত। সেটা কি সত্যিই রামরাজ্য ছিল? মহাভারতেও কি ছিল? এই ধোঁয়াশা সমস্যা নিয়েই ভারতীয় দর্শনের অবতার-তত্ত্ব – এই দর্শন কখনই মাথা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি, মাথার মধ্যেই ঢুকে ছিল, এবং তাও ছিল গুরুকুল ব্যবস্থার মধ্যে ঘাঁটি গেড়ে (হ্যাঁ, স্বীকার করতেই হয় যে তারই মধ্যে এই ধোঁয়াশা কাটিয়ে বেরিয়ে আসার প্রয়াসও ছিল – কিন্তু তা নিয়ে তেমন বিশেষ যুক্তিগর্ভ আলোচনা হয় না)। এতেই কিছুটা আন্দাজ করে নেওয়া যায় যে সামাজিক আধিপত্য ও উচ্চাবচতা আগেও ছিল এখন যেমন আছে. সেখান থেকেই বিভেদটা আরও প্রসারিত হয়েছে। শুরু থেকেই যার সবকিছু অব্যাহত, তার শুরুর ধারা চলতেই থাকে।
ভারতের প্রাচীন দর্শন নিয়ে সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর শিক্ষিত মানুষরা যতই পঞ্চমুখ হোক না তাতে এই সহজ সত্যকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে তার মধ্যে শাসন ও ক্ষমতার দাপটের একটা অবভাসিক ইঙ্গিত ছিলই। উত্তর-প্রাচীন যুগের ইতিহাস যেমন রাজ-পরাক্রমের ইতিবৃত্ত, প্রাক-ইতিহাস যুগের শাস্ত্র ও পুরাকথার অন্তর্বৃত্তও তাই। সবকিছুর নেপথ্যেই ছিল রাজনীতি ও ক্ষমতা, এবং তার প্রচার ও প্রসার হয় ভাষা দিয়েই। শাস্ত্র ও পুরাণকথায় তার প্রমাণ আছে। অন্ধতার দম্ভ কাটিয়ে নয়নে নয়ন মেলালে খুব সহজেই কোনটা কী তার পরিচয় মিলে যাবে। বিদ্যাসাগর অন্ধ ছিলেন না।
ভাষা খুব সহজ মানুষ নয় – যা বলে তার চেয়ে অনেক বেশী তার আস্তিনে ছুপিয়ে রাখে। ছুপিয়ে রাখলেও তার সীমাবদ্ধতাটা চোখ ফুটিয়ে দেয়।
এইভাবে অলক্ষ্যে মানুষের চাহিদার সীমানায় ভাষার নিরস্ত্র অনুপ্রবেশ ঘটে (কেন না মানুষকে কখনই সশস্ত্র করে রাখা হয় না) ভাষা তার নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে যায়, তার সীমান্ত লঙ্ঘন করে তাকে নিজের কবলে নিয়ে আসে আর মানুষ চুপটি করে তার উপনিবেশের প্রত্যঙ্গ হয়ে পড়ে, মানুষের নিজস্ব ভাষার বলয়ে তখন থেকেই বিদেশী নাগরিক (শুধু পরদেশী অর্থে নয়) ভাষার অবাধ অধিবাস ও বিচরণ শুরু হয়ে যায়, প্রচলিত ভাষাগুলো তার ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সবদিক দিয়ে তাদের নিজস্বতা খুইয়ে বসে ক্রমশঃ অবলুপ্ত হোয়েও যায় (linguicide) – এখানেও সেই আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির রাজনীতি। ডেভিড শারিয়াত মাদারি বলেছেন: Linguistic decline is the cultural equivalent of the boy who cried wolf – নাগরিক সংস্কৃতির ক্ষমতায়ন ও বিশ্বায়নের দাপট জনপদ মানুষের সীমান্ত লঙ্ঘন করেছে অবাধে – সেটা এমন কিছু অপরাধ নয়!
শুধু মানুষ নিজের মুখের ভাষায় নিজের নিজের কথা বলতে চাইলেই যত গর্হিত অপরাধ, অবমাননা।
কার যে কি বিচার তার তা বুঝতে গিয়ে রীতিমত হিমসিম খেয়ে যেতে হয়, সমাধানের চেয়ে সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে, একটা সমস্যাকে আরও একাধিক সমস্যায় বাড়িয়ে দেয়। এখানেও সেই ভাষার কৃতি ও বিকৃতির দায় এসে পড়ে।
ভাষার অভিজাতায়ন ঘটে যায় যখন থেকে অভিজাত মানুষরা মুখের ভাষাকে জোর করে তার গা’য়ে উচ্চকোটি কোটপ্যান্ট চড়িয়ে লিখিত ভাষার মঞ্চে উঠিয়ে দেয় যেখানে স্বভাবতঃই সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ যার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে সক্রেটিস বলেছেন যে এর পরিণামে মানুষের স্মৃতি ও চিন্তা করার ক্ষমতা শিথিল হোয়ে আসে। অনেক ভারতীয় শাস্ত্র স্মৃতি ও শ্রুতি বলে পরিচিত। সক্রেটিস ও সংশয়বাদী পিরো ইচ্ছা করেই কিছু লিখে রেখে যাননি। ভাষার অভিজাতায়ন ও লেখ্যায়ন ঘটার মাধ্যমেই সাংস্কৃাতিক উচ্চাবচতা ও বিভেদের জয়যাত্রা শুরু – এটা ভাষার বাস্তুচ্যুতিও বটে।
পাঠক,আমি এখানে ভাষা বলতে ভাষার বিশেষ স্মারকের কথা বোঝাতে চাইছি না, ভাষা বলতে নির্বিশেষে আমি তার অষ্টাঙ্গের প্রতিটি ধ্বনি বর্ণ শব্দ বাক্য পদান্বয় সহ তার উচ্চারণ-বিধি ও ভঙ্গী. তার শারীরক ভাষা, নির্ভাষ ভাষা, ইঙ্গিত ভাষা, অভিব্যক্তি, প্রান্তিক মানুষের ব্যবহৃত আঞ্চলিক ও অবর ভাষা (dialect বা patois বা slang), এমনকি চিত্রের ভাষা, মূর্ত্তির ভাষা এবং যুগান্ত ধরে চলে আসা তার মৌখিক ইতিহাসের ঐতিহ্যে বিধৃত তার কৌম ভাষার পূর্ণাঙ্গ রূপ-সংগঠনের কথা বলতে চাইছি (প্রকতিও কিছু বলতে চায়, তার নিজস্ব বিশ্বজনীন ভাষায়, আমরা তা বুঝি বা না-বুঝি), কারণ এই সবকিছুর যথাযথ প্রকার-প্রকরণ নিয়েই ভাষা, একটা কিছুর ঘাটতি হলে ভাষার ব্যাকরণ বিধি ও বিন্যাসের অঙ্গহানি ঘটার সম্ভাবনা (তা হলেও তার অর্থায়নে তেমন বিশেষ জটীলতা না-সৃষ্টি হওয়ারই কথা)। এমন অনেক বিলুপ্ত ও বিলুপ্ত-প্রায় ভাষা আছে যাদের নির্দ্দিষ্ট ব্যাকরণ-বিধি নাই এবং ভাষা প্রকাশের মধ্যে সেই কঠোর সামরিক শৃঙ্খলাও মেনে চলা হয়না, তাদের অর্থপূর্ণ স্বরভঙ্গীই (morphene) তাদের ভাষার একমাত্র সংযোগ মাধ্যম: উঃ ভারতে মুন্দারি জনজাতির মানুষ রিবুই-টিবুই বলে একটা কথা বলে তারা যা বলতে চায় তা হল বিশাল পাছার একজন হোঁৎকা মানুষের দৃশ্য, চলার গতি ও আওয়াজ; tawakiqarpiit একটি ইনুতিতুত ভাষার শব্দ যার অর্থ তোমার কাছে বেচার মতো তামাক আছে? এগুলো শব্দ নয়, এক একটা স্বরধ্বনি যা দিয়ে একটা সম্পূর্ণ ধারণা গড়ে তোলা হয় (ideophone); এমন কি এখনও বিশ্বের অনেক অঞ্চলে শিস দিয়ে ভাব বা বার্তা বিনিময় করা হয়। ভাষার কাজই তাই – এগুলো প্রচলিত অর্থে ঠিক ভাষা নয়, অ-ভাষা। সীমিতার্থে অভাষা দিয়েও ভাষার কাজ মিটিয়ে নেওয়া যায়।
ঠিক এই প্রস্থানবিন্দু থেকেই ভাষার রাজনীতির যত কারবার শুরু। ক্ষমতার খেলটা নিছকই একটা রূপক নয়, কেন না রূপক বললে বোধহয় সেটা মিথ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা – আসলে এটাই প্রকৃত বাস্তব, মিথের পর্য্যুদস্ত রূপ, ধারণার সংহতিতে বাস্তবায়িত বাস্তব রূপ। রাজনীতির একান্তই দরকার ভাষা – লিপিকার ও কথাকার। তা না হলে রাজনীতির চলে না। বহুকিছুর মধ্যে ভাষাতে রাজনীতি থাকে। ক্ষমতার আধিপত্য থাকে। উচ্চবচতাও থাকে। বলতে গেলে, রাজনীতি/ক্ষমতা ভাষাকে তার ময়ূরবাহন করে রাখে। ইস্রায়েলি ইতিহাসবিদ জুভাল নোয়া হারারি বলেছেন: Humans think in stotries, and we try to make sense of the world by telling stories. একটু অন্যভাবে বললে, মানুষকে গল্প শুনিয়েই শাসনের রাজনীতি চলে। এর বহু শতাব্দী আগেই প্লেটো বলে গিয়েছেন যে জগতে শাসন-ত্রাসন করার জন্য গল্প-কইয়েদের দরকার হয়, গল্প উৎপাদন করার দরকার হয়, সেই উপলক্ষ্যে বিদূষকের অভাব হয় না। সেইসঙ্গে প্রেক্ষিত মেপে যুদ্ধের তৎপরতায় খুড়োর কল থেকে প্রেক্ষিত-উপযুক্ত নিত্যনতুন শব্দও রচনা করে নিতে হয় (neologism)। কী সেইসব গল্প ও শব্দ তা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না: মেরা ভারত মহানের সাথে (তুলনীয়: Make America Great Again) ভেবে নিতে হয় প্রাচীন ভারতে কসমেটিক সার্জ্জারি ছিল, আকাশে পুষ্পক বিমান উড়ত, এমন কি না কি ইন্টারনটে মাধ্যমে সবকিছু মন-কি-বাত জেনে নেওয়া যেত ভারতে। মূর্খ না হলে এমন গল্প শুনে কারুর মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা নয়, কিন্তু কারুরই মাথা খারাপ হয় না – মানে, মানুষ কি গরুর মত মূর্খ, গোমূর্খ? আমেন!
তাই অতিমারী (কথাটা একটা নূতন নামশব্দ, বোধহয় নিজস্বীর বহুদিন পর এর আমদানি) কথাটার অতি-প্রচারে সর্বক্ষণ আতঙ্কে রাখা ও থাকা সব মানুষের আতঙ্কের পেটে আরও একটা ভুঁইফোঁড় আতঙ্ক খাইয়ে দিয়ে মানুষকে আরও আতঙ্কিত করে তোলার আরও একটা সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যায় শাসনের রাজনীতি, ক্ষমতার রাজনীতি – আতঙ্কে রাখতে পারলে মানুষকে শাসন করতে সুবিধে হয়। মানুষ আর ক্যা ক্যা করতে পারে না। ’মাস্ক’, ’লকডাউন’, ’সোশ্যাল ডিসটান্স’-এর ফরমান জারি করে বন্দী মানুষকে আরও একবার বন্দী করার নৈতিক সিদ্ধতা পেয়ে যায় (এই প্রসঙ্গে কামুর ’দি প্লেগ’ উপন্যাসের ডাঃ রিউয়ের মন্তব্য আমাদের বিরুদ্ধ ভাবনাকে উস্কিয়ে দিয়ে যায়: “Orders!” he said scornfully. “When what is needed is imagination.”) – যেন মানুষ কোনোকালে মুখোশ-পরা মানুষ হয়ে থাকেনি, পণবন্দী হয়ে থাকেনি, কোনোকালে মানুষের সঙ্গে মানুষের সামাজিক বিভেদ ছিল না – আর ছড়ানো সেই আতঙ্কে কোয়ারেন্টিনে আটক থাকা মানুষের কাছে তার নিজের জীবনটাই সব হয়ে ওঠে (তার জীবন কী এমন মহামূল্য, কী এমন অপরিহার্য্য তা সে নিজেও জানে না) – পেটের দায়ে বাইরে বাইরে কাজ করতে যাওয়া মানুষদের জীবনকে ব্রাত্য বলে ভাবতে শেখা মানুষ তাদের ’পরিযায়ী’ মুটে-মজুর নামশব্দ দিয়ে আত্মশ্লাঘা বোধ করে। সওয়াল উঠতেই পারে, প্লেগই কি শুধু মহামারী? প্রতিদিন কত কত মানুষ বিনা চিকিৎসায় অচিকিৎসায় মারা যায়, কত কত মানুষ সুযোগ ও সুবিধার অভাবে মরার মতো বেঁচে থাকে, এবং আরও কত আর্থ-সামাজিক সমাজ-সাংস্কৃতিক অসমতায় বিবিক্ত মানুষ – এটা কি মহামারী নয়? ডোল দিয়ে ঘোল খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখাটা কি মানুষের বাঁচার মতো বাঁচা?
মানুষ যেমন দ্বিচারী, মানুষের হাতে পড়ে ভাষাও তেমন দ্বিচারী – (আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়/আমার আঙিনা দিয়া) – সুখের কথা মুখে বলে, দুঃখে দ্বিরাগমন চলে – সাহসের ডগায় তুলে মই কেড়ে নিয়ে আসে পড়ে যাওয়ার আতঙ্ক। একদিক চাইলে অন্যদিক বিনষ্ট হয় – অন চাহন্তে আন বিন ঠা।
সব মিলিয়ে ভাষায় এমন একটা মিথ থাকে যাকে ভাঙতে পারলে তবেই তা থেকে অন্ততঃ একটা আপতিক সত্য বেরিয়েও আসতে পারে বা। নতুবা অন্তঃসত্য ভাষা চাপা হয়ে পড়ে থাকে, এবং রাজনীতি ও ক্ষমতা ঠিক এটাই চায়। সত্যের মুখ ঘুরিয়ে চলাতেই ক্ষমতার আনন্দ। এটা ভাষার তাত্ত্বিক খুঁত বা ত্রুটি নয়, ভাষা প্রয়োগের অপজাত তথ্য উপাত্য, ভাষার অপপ্রয়োগজনিত শঠতা। ফলে ভাষা আর মানুষের সত্যান্বেষী হয়ে থাকে না। বার্তা বিনিময় ও সংযোগ মাধ্যম হিসাবে ভাষার ক্ষমতা ক্ষমতার রাজ্যপাটে একচ্ছত্র প্রতিষ্ঠা পায়। মানুষের কাছ-ছাড়া ও হাতছাড়া হয়ে সেই বিশ্বজনীন ভাষা হয়ে ওঠে মুষ্টিমেয় মানুষের ক্ষমতার অলিন্দ-পথ। একসময় যা ছিল সমষ্টি মানুষের সৃষ্টি ও সম্পদ, সমাজের ক্রম-সভ্যতায়নে তথা লাগামছাড়া আধুনিকায়ন ও প্রাযুক্তিকায়নে তা ব্যষ্টি মানুষের কুক্ষিগত হয়ে পড়ে, এবং সমষ্টি মানুষের হালও ক্রমশঃ তাই হয়ে পড়ে। তার মুখপ্রসূত ভাষাধ্বনি এখন রাজ-দরবারে দরবারী কানাড়া বাজিয়ে শোনায় – এটা কোনো বানানো তথ্য নয়, একদা সমস্ত শিল্প-সাহিত্য ইতিহাস দর্শনের সূতিকাগার ছিল রাজ-দরবার বা জমিদার-কুঠি যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না, তাদের এক ও একমাত্র পৃষ্ঠপোষক ছিল রাজা-বাদশা নবাব জমিদার প্রমুখরা – আর এখন রাষ্ট্র ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। ফলে তাদের সৃষ্টির কী দশা হয় সেটা বুঝে নেওয়া যায়। সব দেশে সব যুগে এটা ঘটেছে, এখনও ঘটে বা ঘটছে – তবে অনেকটা বকলমে, হরেক কিসমের গণতন্ত্র এর হিস্যাদার। গণতন্ত্রের গঙ্গাজলে সবকিছুই গ্রাহ্য। ফুল-বাতাসা দিয়ে পূজো।
সাধে কি আর তারা বুলবুলি বাতাসে খই মুড়কি ছড়ায়? কুড়িয়ে খাওয়ার মতো বাঁধাধরা কিছু লোক আছে, কুড়িয়ে খেতে যাদের একটুও লজ্জা হয় না। আমআঁটি চুষে খেয়ে তারা ভেঁপু বাজিয়ে শোনায়। রাজা শোনে, প্রজারাও বাকি থাকে না। প্রজাদের ধরে রাখতে পারলে গণতন্ত্র গণতন্ত্রই থেকে যায়!
পয়সা ছড়ানোর পিছনে ফয়দার রাজনীতি থাকে। ক্ষমতা পয়দার সম্ভাবনাও থাকে।
শোনা যায় ফারসি কবি ফেরদৌস ’শাহনামা’ লেখার জন্য গজনভির সুলতানের কাছ থোকে ৬০ হাজার সোনার মোহর বরাত পেয়েছিলেন।
হাছন রাজা জমিদার ছিলেন, লালন ফকির আদতে ছিলেন ফকির – সেই নিরিখে তাঁদের গানের ভাব-ভাষ্যে লক্ষ্যণীয় পার্থক্য ছিল।
’জয় মাতাজী বোলো, জোর সে বোলো, জয় মাতাজী’ বারবার হাজারবার শুনিয়ে মানুষের মাথা খাওয়ার ব্যবস্থাটা পাকা হয়ে যায় না কি?
ভাষা মানুষকে এইভাবে কোথা থেকে কোথা টেনে নিয়ে যায়। ভাষা ও চিন্তা প্রক্রিয়ার ফারাকটা স্পষ্ট বলে মনে হলেও এবং ভাষা দিয়েই চিন্তাক্রিয়া শুরু হলেও, ভাষাই ক্রমশঃ আমাদের চিন্তার নিয়ন্তা হয়ে ওঠে, ভাষাই আমাদের চিন্তাকে যুক্তি ও অযুক্তির দিকে ভাবিয়ে নিয়ে যায় – এখানে মনে রাখা দরকার যে অযুক্তি কুযুক্তি হলেও তা যুক্তিই, যুক্তির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র প্রকল্পিত যুক্তি – তা হলেও যার যেমন রাজনীতি সংস্কৃতি সংস্কার ও নীতি-চেতনা, সে তেমন করেই ভাবে, এবং ভাষা তাকে তেমন করেই ভাবায় – ভাষার সহযোগে তার সারস্বত চেতনার জগতটা তেমন কৃষ্টিতেই গড়ে ওঠে।