নী লি ম   গ ঙ্গো পা ধ্যা য়-র ছোটগল্প “বিষয় ভাবনা”

পরিচিতিঃ নীলিম গঙ্গোপাধ্যায় পুরোপুরি লিটিল ম্যাগাজিনের লেখক। যিনি বাণিজ্যিক কাগজে একেবারেই লিখে উঠতে পারেননি। মূলতঃ গল্পকার। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘নীলিমের চার’ ১৯৮৭ সালে আসানসোলের রাঢ়পত্র থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৯২ সালে তিনি কলকাতায় বসবাস, এবং সেখানে কলেজ জীবনের পত্রিকা ঋত্বিক ফের শুরু করেন। দ্বিতীয় গল্পের বই অ্যানাকোণ্ডা ও অন্যান্য সাপগুলি প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ সালে ঋত্বিক প্রকাশনি থেকেই। তাঁর প্রথম উপন্যাস মাধুরী মালতী মেজবৌদি প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে। মাঝদুপুরের আঁধার আলো, ছয় অনেক কথা কয়, কালখণ্ডে কয়েকজন, বার্তা বহুবিধ, নামক আরো কয়েকটি উপন্যাস তাঁর রয়েছে। আসানসোল থেকে প্রকাশিত পশ্চিমবঙ্গের গল্প বিষয়ক বিশিষ্ট পত্রিকা ‘দেখা’-র নিয়মিত লেখক এবং সংগঠক। আসানসোলের কোলাজ পাবলিকেশন থেকে নীলিম গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘এক মুঠো খেজুর’ নামক একটি অনুবাদ গল্পগ্রন্থও আছে। আছে কবিতার চর্চা থেকে তিনটি কবিতার বই। মুদ্রিত কিন্তু অগ্রন্থিত আছে শতাধিক গল্প। সাহিত্যের সমসাময়িক নীলিম গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গীত রচনাও উল্লেখযোগ্য। কলকাতার ছাত্রাবস্থায় রানাঘাটের সঙ্গীতগুরু শিব কুমার চট্টোপাধ্যায়, পরবর্তীকালে আসানসোলের দিলীপ মণ্ডল দিলীপ দাস, এবং বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভাবে শ্রীমিহির সিংহরায়ের কাছে সঙ্গীত শিক্ষা করেন। উত্তরপাড়ার সঙ্গীত শিক্ষক শ্রী সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও তালিম নেন পরবর্তী দীর্ঘদিন। নিজের রচিত গান গাওয়া শুরু হয় আসানসোলে আশির দশকের অবস্থান কালেই। এই শিল্পাঞ্চলে নির্মিত তাঁর লিটিল ম্যাগাজিনের গান দিয়ে কলকাতায় সরকারি লিটিল ম্যাগাজিন মেলার উদ্বোধন হয়। মানবিক এবং অমানবিক কর্মকাণ্ডগুলির প্রতিফলন দেখা যায় তাঁর নির্মিত গানে। প্রতিবাদ গৌরব শোক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় বৈচিত্র নিয়ে তাঁর গানের সংখ্যা প্রায় পাঁচ শতাধিক। প্রত্যয়ী কর্তৃক ফেসবুকে পোস্ট করা আসানসোল নিয়ে লেখা তাঁর গানটি ইদানিং বেশ আদৃত হয়েছে। এছাড়া মাতৃভাষা, শিলচরের ১৯শে মে-র ভাষা দিবস, যুক্তিবাদীদের হত্যা, পরিযায়ী শ্রমিক, কৃষক আন্দোলন, ছা্ত্র আন্দোলন, প্রেম, ঋতু, আধুনিক সুর এবং রাগসঙ্গীত ইত্যাদির এক সমন্বয় নিয়ে তাঁর গানের ভাণ্ডার।

নী লি ম   গ ঙ্গো পা ধ্যা য়-র ছোটগল্প

 

বিষয় ভাবনা

 

ব্যক্তিগত খাপলা জালের একঘেয়ে কালোয়াতী থেকে বেরিয়ে কি ভাবে বড়ো পরিসর থেকে টানা জালে কিছু একটা অসামান্য অভিনব বিষয় টেনে ফাঁদা যায়, প্রতিবারই লেখার শুরুতে মহড়া নেয় পরিতোষ, আর ফেল করে যায়। সে মার্কেজ ভাবে কুন্দেরা ভাবে বিভূতিভূষণ অমিয়ভূষণও ভাবে। কিন্তু, ভাবতে পারে বড়জোর চার কি পাঁচ হাজার শব্দ লেখার সীমাবদ্ধতায়, বা ক্ষমতা সীমানায়। একরকম ভাবে তার মধ্যে দিয়ে নিজেকেই চ্যালেঞ্জ নিতে চায় সে। বিন্দুতে সিন্ধু চরিত্র থাকে না, কি? ইতালো ক্যালভিনো আর সাদাত হোসেন মান্টোকে ভেবে নেয় এই প্রেক্ষিতে। লিবিয়া ডেভিসকে ভাবেনা অতটা।

অমিয়ভূষণ বলতেন, আগে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসো ! তো পঞ্চমুণ্ডির আসনে, মানে রাতে চেয়ার টেবিলে ধ্যানস্থ হয়ে পরিতোষ ভিতর থেকে উমার সারাদিনের একঘেয়ে বিরক্তিকর কথাবার্তা মুছে ফ্যালে। ক্লোজ নেবার, ক্লোজ ফ্রেণ্ড সার্কেল, অফিসে নিয়মিত দেখা হওয়া কলিগ, পছন্দের রমণীকুল, সবাইকে তাড়িয়ে দিয়ে একটা ব্ল্যাঙ্ক স্পেস তৈরি করে মনের ভিতর, ওই পঞ্চমুন্ডি। সেখানে মনটাকে অবিচল স্থিত রেখে পৃথিবীর কথা ভাবে। হ্যাঁ, সংবাদপত্রের মাধ্যমে যে পৃথিবী ও তার ঘটনাস্রোত, সেই বয়ে যাওয়া থেকে ভাবে। প্রত্যেক দিনের এডিটোরয়াল, সিরিয়াল সিনেমার সুন্দরী, চাগিয়ে রাখা ক্রিকেট জগতের ছবি-কথা ভাবে। পাবলিক ভালোবাসে,খায়, কিন্তু পরিতোষের তা নয়। দেশে-বিদেশে ঝাড় খাওয়া মার খাওয়া নীচুতলার আম আদমি, আর ওপর তলার লুঠেরাদের কথা ধরতে চায় সে। লেখায় রিফ্লেকশন চায় সেই তৃতীয় বিশ্বের দুর্গতি ভবিতব্যের। বিশ্বের অন্য প্রান্তের ঘটনাস্রোতগুলিকে নিজের দেশ সমাজের সাথে রিলেট করা এবং না করার কৌশল কথাও ভেবে চলে তার একমুণ্ড, পঞ্চমুণ্ডিতে।

সেই সূত্রবাহী হয়ে নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত ভিন দেশে শরণাপন্ন হতে চাওয়া সুন্দর স্বাস্থল কুর্দিদের ছবি দেখার পরবর্তী সেই বিস্ময় ফিরে আসে পরিতোষের। বঙ্গজ ধারণার মাপে সে জানে বিতাড়িত আতঙ্কিত ধর্ষিত চালচুলো হীন মানুষ শুকিয়ে নরাধম কুৎসিত হয়ে যায়। তার নিজের পরিবারের গায়ে আঁচ লাগেনি কোনোদিন, ভৌগলিক কারণেই, কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যেকার পারস্পরিক বিদ্বেষে অগণিত পরিবারের মানুষ বারবার দুর্ভোগের শিকার হয়েছে, হচ্ছে। খুন ধর্ষন লুটপাট, ভিটেচ্যুত হয়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য মানুষের সারি। হাড়পাঁজরা বেরিয়ে কঙ্কাল সার অভুক্ত মানুষের কাতার। হিট গানের লাইনের মতো কবেকার সেই ‘একটু ফ্যান দাও মা’ ।

সর্বস্ব খোয়ানো নিয়ে লিখতে গেলে মিথ্যাচারই হবে। কোনো উৎখাত হওয়া পরিবারের একজন না হলে, নিজের মা বোন দিদি ধর্ষিতা না হলে, সে যন্ত্রণায় একাত্ম হওয়া অসম্ভব। পরিতোষ এও বোঝে, সে মন্বন্তরের সাথে দেশভাগের দাঙ্গা উৎখাত গুলিয়ে ফেলছে। সূর্যকে পাক দিয়ে ঘোরা গ্রহ নক্ষত্রগুলির মতো তার মগজকে পাক দিয়ে আবর্তিত ঘটনা ভরা সময় খণ্ডগুলি যেন এ ওর ট্র্যাকে চলে গিয়ে জটিলতা পাকিয়ে তুলেছে। না কোন অভিনব গঠন বিন্যাস বা ম্যাজিক রিয়েলিজম জাতিয় কোন কিছুর দিকে যাচ্ছে না। নিতান্তই নির্বোধের কাণ্ডকারখানা হয়ে উঠছে। পরিতোষ থামে, থেমে ভাবে, কলম পড়ে থাকে অপেক্ষায়।

ইতিহাসের ঘটনাগুলির নিজেদের মধ্যে জাপটাজাপটি তারই সীমাবদ্ধতায়। পরিতোষ নিজেকে ফের স্বাস্থোজ্জ্বল কুর্দিদের কাছে নিয়ে আসে, বা তার ভাবনা সেখানে যায়, এবং ফের ওরকম স্বচ্ছল চেহারার লোকেরা তাড়া খেয়ে সাধারণ নৌকায় সমুদ্র পেরোতে গিয়ে বাচ্চাদের হারালে, ওরকম রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবেশ তৈরি হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে বিস্মিত হয়, হতেই থাকে। কারণ তার দেশে ওই স্বাস্থ্য ওই পোশাকের শ্রেণি অনেক শক্তিশালী। তাদের মধ্য থেকেই শিক্ষায় চালাক চালকের দল নির্বাচিত হয়। কিন্তু ২০১৬ সালে অ্যাকাডেমিক ফর পিস এই শিরোনামে দুহাজারের অধিক শিক্ষাবিদের কুর্দিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ করে সমস্যা সমাধানের মতামত মেনে না নিয়ে তুর্কি সরকার ইতিহাস রিপিট করিয়ে দেয়। সন্দেহ, দেশদ্রোহী তকমা আর হত্যা। এমতাবস্থায় খবরকাগজসেবী পরিতোষের সমুদ্রের তীর ছোঁয়া বালুকাবেলায় নীল প্যান্ট লাল জামা পরা নিতান্ত বালক আয়লান এবং ওই বয়সি আরেকটি বালিকার কথা মনে পড়ে। আর এই সম্ভবকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ করে মনে পড়ে ইহুদী নিধন। মন যেন একটু আস্বস্ত হয় একটু সান্ত্বনা লাভ করে । ধুর, এসবের থেকে কতো ঢের বেশি দেখিয়ে দিয়েছে ইটালি জার্মানি আর তাদের সাঙ্গোপাঙ্গোরা। হিটলারের সময়কালের হলোকাস্ট, অন্তত ষাট লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। সংখ্যা আরো বেশিও হতে পারে। আর সেই হত্যা সময় নিয়ে অন্তত শতাধিক চলচিত্র তৈরি হয়েছে পরিতোষের অনুমান, যার মধ্যে বিশ-বাইশ খানা সে নিজে দেখেছে। তারপর আমেরিকা, সেও হিরোসিমা নাগাসাকি করে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল জাপানকে। এই দুই নিধন আয়োজনের মধ্যে বেশ তুলনা টানা যায়। একটার প্ল্যান প্রোগ্রাম বিস্তর। বেবাক লোককে বেছে ধরে আনা মেয়ে মরদ বাচ্চা আলাদা করা। লক্ষ লক্ষ মানুষকে খেদিয়ে ট্রেন বোঝাই করে ক্যাম্পে গ্যাস চেম্বারে নিয়ে যাওয়া। ধর্ষণ করা, গুলি করা, গ্যাস দেওয়া, লাশ ফেলা। সে সব করতে হাজার হাজার লোক লাগানো। হত্যার জন্য দেশ জুড়ে বিতিকিচ্ছিরি ইন্ডাস্ট্রি, প্ল্যান্টের পর প্ল্যান্ট গজিয়ে ওঠা ! আর অনেকটা সময়েরও গড়িয়ে চলা অপব্যয়। যার ফাঁকে দেশে কিছু লোক, বাইরে কিছু বিদেশ, বিরুদ্ধ মতামত চালাচালি করার সুযোগ পেয়ে যায়। বই লেখে নাটক সিনেমা করে। বিরুদ্ধ মতের দেশেরা দল পাকায়। নিরন্তর তার খোঁজ খবর আর বিরুদ্ধাচারণ করার জন্যও নেটওয়ার্ক লাগে, প্রচুর সহমতের লোক নিয়োগ করতে হয়। আর ওদিকে আমেরিকার আয়োজন বেশ সংক্ষিপ্ত। আকাশে উড়ে গিয়ে বিশ্বে প্রথম পরমাণু বোমা ফেলে দিয়ে ফিরে আসা। আর ফেলার ছবি তুলে রাখা। বাস ওই শ্রম। যাও প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিকলাঙ্গ হয়ে যাও। পাকিস্তানী সৈন্য বা রাজাকারদের তিরিশ লক্ষ বাঙালি নিধন, যা অতি অবশ্যই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের, আর যা পরিতোষ এই মুহূর্তে কিছুতেই ভাবতে চায়না ঠিক মগজের ভিতর এসে হাজির হয়। আর সেই সব ভাবনাগুলিকে গুছিয়ে খোপে খোপে রাখার কৌশল মুহূর্তেই সেগুলি ছিটকে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় বাইরের দরজার কড়া প্রবল ভাবে বেজে ওঠায়।
দরজায় নক হতে চল্লিশের ইহুদী বা সত্তরের বাঙলাভাষীর মতোই চমকে ওঠে পরিতোষ। কড়া নাড়ার তীব্রতায় গেস্টাপো খানসেনাদের বৈশিষ্ট। আর সময়টাও রাত সাড়ে দশটা।
— বসি কেন ? দেখ গে কে এসিছে ? পাশের ঘর থেকে উমার ঝাঁঝযুক্ত নির্দেশ, বাইরের দরজায় কড়ার তীব্রতর বেজে চলা। দরজা খুললে পরিতোষ তার তিন পুত্রকে দেখতে পায়, আর সামান্য মদের গন্ধ। — কী ব্যাপার একসাথে !!? হবার তো কথা নয়! কোন বিপদ ঘটেনি তো !?
— না আমরা বিপদ কাটাতে এসেছি। অনেকবার বলেছি শোনোনি। চলো ঘরে ঢুকতে দাও। আর যা কাগজ এনেছি সই করে দাও !
বড়ো ছেলে বলছে। বাকি দুজন চুপ করে আছে। প্রিপ্ল্যান্ড ! সবাই ঢুকলে ছোট দরজা বন্ধ করে দেয়। মদের গন্ধ তার মুখ থেকেই। উমা বেরিয়ে এসেছে কিন্তু তাকেও কেউ কুশল জিজ্ঞাসা করেনা। ছেলেরা একজোট দেখে পরিতোষ কৌতুক আর বিপদ বোধ করে।
— এই স্ট্যাম্প পেপারের নিচে আর পাশে দুজনে সইগুলো করে দাও দেখি। কাগজের তাড়া বের করে মেজপুত্র বলে। — অ-অ, সবকিছু নিজেদের নামে করিয়ে নিতে তৈরি হয়ে এয়েছিস দেখছি ! এক্ষুনি যদি না দিই, জোর করি নিবি ? উমার গলায় ঝাঁঝ থেকেই গেছে।
— জোরের কি আছে, তোমাদের নামে যা আছে, আমরাইতো পাবো। বারবার বলেছি বাটোয়ারা করে দাও, সময় থাকতে নিজেদের মতো গুছিয়েনি। শোনোনি। খাটনি কমিয়ে দিলাম, কাগজপত্র রেডি শুধু দস্তখত দাও। ভয়ের কিছু নেই, যেটা কিছুদিন পরে হবার,সেটা কিছুদিন আগে হয়ে যাচ্ছে। বড়ো ছেলে গুছিয়ে বলে। — কিন্তু তাই বলে আমার সাথে কোন পরামর্শ না করে ? রাত্রিবেলায় দলবেঁধে দলিলে সই করিয়ে নিতে এসেছ ? এরকম জুলুমের খবর তো কাগজে বেরয় ? পরিতোষ উত্তেজনা চাপতে পারেনা ।
— হ্যাঁ আমরা সেখান থেকেই শিক্ষে নিয়েছি। নাও টেবিলে বসো সই করো। মেজ বলে। শুধু বলে না বাবাকে ডানা ধরে তার লেখার টেবিলে নিয়ে যায়। জোর প্রয়োগ করে।
— না-না। তুমি কিছুতেই সই করবেনি, ওদের কথায় ! কি লিখি এনিছে না পড়ে কিছুতেই সই করবেনি ! সরাসরি চিৎকার করে ওঠে উমা।
— দিনের আলোয় কোনদিন মিলি মিশি থাকতে পারলোনি যারা, রাতের অন্ধকারে তারাই সম্পত্তি হাতাতে একজোট হয়েছে। উমা খানিক হাঁপায়।
— আচ্ছা তোরা রেখে যা। আমি একটু পড়ে নিই তারপর না-হয় সই দেব। পরিতোষ নরম করে নেয় নিজেকে এই বাধ্যবাধকতার মধ্যেই। কিছুটা সময় দরকার চিন্তা পরামর্শ করার। কিন্তু কলহ করে করে চড়া পড়ে যাওয়া উমা গলা তুলে দেয় যতটা সম্ভব। — সই করি দিবে মানে ?! তারপর কি গাছতলায় যেয়ি দাঁড়াবে ? ওদের হাতে পড়া মাত্র আমাদের বেঘর করবে ওরা। — এটা তোমাদের ভুল ধারণা! নিজেদের বাবা-মায়ের দেখাশোনা করবোনা খেয়াল রাখবোনা তাই কি হয় ? বড়ো ছেলে ভাইদের চোখের ওপর চোখ ফেলে বলে। মেজ সমর্থন করে বড়োকে, — আলোচনা হয়েছে, তোমাদের নিজস্ব রুম থাকবে বড়ো, তোমাদের বউমারা ছিল, তোমার মেজ বৌমা বলেছে, বাবা-মা-দের রুমে কমোড লাগানো অ্যাটাচড বাথ রাখতে হবে।
মেজছেলের কথায় পরিতোষ আর্দ্র হতে থাকে। যতটুকু কেন্দ্রাতিগ হয়ে পড়েছিল, তার দ্বিগুণ বেগে কেন্দ্রাভিগ হয় সে। সবকিছু যেন ঠিক হয়ে যাবে, নিটোল একটা উপন্যাসের পরিণতির মতো ভালো শান্তিময় হয়ে যাবে, এরকম ভাবনায় সিক্ত শিথিল হতে থাকে। — ওইসব বুজরুকি কথাবার্তা থামান দে ! খেয়োখেয়ি কামড়াকামড়ি করে নিজেরা ভাই-ভাই থাকতে পারলিনি কোনোদিন। আজ ঘরবাড়ি লিখিয়ে নেবার জন্যি এক হয়েছিস ? সব তোদের, কিন্তু যতক্ষণ না চোখ বুঝছি কিচ্ছু লেখাপড়া হবেনি।
উমার গলার উত্তরোত্তর আওয়াজ বৃদ্ধি যেন দরজা জানালার ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে পড়শীদের ঘরে ঘরে পৌঁছাচ্ছে। আর সেটা থামানো দরকার সেই মনোভাব থেকেই ছোটছেলে পিছনথেকে মায়ের গলা ডান হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে। — ঘরবাড়ি লিখে দেবে নাতো কি সঙ্গে নিয়ে চিতায় উঠবে! আজ তোমাদের সই করতেই হবে। নইলে লাঠালাঠি হবে, রক্তগঙ্গা বইবে।
পরিতোষ দেখে মদ্যপায়ী ছোট ছেলের মধ্যে মায়নামারের সেপাই ঢুকে পড়েছে। আর উমা যেন রোহিঙ্গা রমণীদের একজন। এক নগ্ন রোহীঙ্গা তরুণীকে মায়নামারের মিলিটারি এমনিভাবে পিছন থেকে ধরে গলায় ছুরি চালিয়ে হালাল করছে, ক্লিপিংস দেখেছিল পরিতোষ ফেসবুকে।
এই পারিবারিক সমস্যার বাস্তবে কেন যে আন্তর্জালের রোহিঙ্গা নামক এক জনজাতি নিপীড়নের ভিডিও ক্লিপিংস এখন এই মুহূর্তে সমচরিত্র হয়ে তার ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকে পড়তে চাইছে, ভেবে পরিতোষের ভাবনা ফের দুর্ভাবনায় পড়ে। তার লেখা-বিষয়ের, ব্যক্তিগত খাপলা থেকে বেরিয়ে আসা হয়না। সে আবার ফেল করে।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *