রী না ভৌ মি ক -র কবিতাগুচ্ছ

পরিচিতিঃ রীনা ভৌমিক। জন্ম ষাটের দশকে। শুদ্ধ ঝাড়খন্ডী। পেশায় শিক্ষকতা। ভালোবাসা মাতৃভাষার নামে কলম ছুঁয়ে থাকা। লেখালেখির হাতেখড়ি আশির দশকে। ছোট্ট একটা কাজ বাংলাভাষাকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে “নীলাকাশ” নামে নিজের আবাসে ফ্রী বাংলা স্কুল চালানো। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ “স্ফুলিঙ্গ, ঝাড়খন্ডের মেয়ে, পুটুশ ফুল কেমন আছো।” গল্পসংকলন “পত্রবন্ধু চাই “। “নীলাকাশ” নামের এক পত্রিকার সম্পাদক।

রী না   ভৌ মি ক -র কবিতাগুচ্ছ

স্পিরিচুয়াল

 

রুট চক্রের লালে বুঁদ পৃথিবীতত্ব
সমস্ত স্বপ্ন আর ইচ্ছেয় লাগাম কসে
দারুণ ছুটিয়ে নিচ্ছে ঘোড়া

আমরা শতরঞ্জ খেলতে বসে
কুটিল ভাবছি খেলাটা আমরাই খেলছি

দুই ভ্রুর ভেতর খোশমেজাজে বসে
পিটিউটারি
থার্ড আই
বিন্দুতে নাচাচ্ছে
জ্ঞান ও গোসা

অঙ্ক অঙ্ক অঙ্ক
কামড়ে খাচ্ছি আঁকড়ে ধরছি
জীবন্ত কোষেরা বুকে সময়ঘড়ি বেঁধে
ভীষন ইতিহাসে তুলকালাম

ঈশ্বর শব্দটা ব্যাকডেটেড এবং আমরা হোঁশিয়ার
বলেই গায়ে নাস্তিক পোশাক চড়াচ্ছি আর খুলছি

আমরা আর কিছু পারি বা না-পারি
বাঁদর ডিগবাজি
অবশ্যই পারি
জানে কোষেরা

জানে অনন্ত ঈশ্বরেরা…

ঈশ্বর এক বক‌ওয়াস বলে ধূলোয় হেসে কুটোকুটি হতেই, আমার দিকে আঙুল উঁচিয়ে হেসে উঠলো ধূলোমুঠি। আমার জ্ঞানের বহর ও অজ্ঞানের বোঝা থতমত মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। ভেতরের কিছু প্রতিবাদী তরঙ্গ উশখুশ জেহাদে বাঙময় হলো। এতকালের চেনা পথ অন্য বাঁকে পাড়ি দিল। আমি খুঁজতে লাগলাম ছায়া। এক বটবৃক্ষ ইশারায় ডেকে মাথার ওপর ছায়া মেলে ধরলো। আমি গাছের গুঁড়ি হেলান দিয়ে বসলাম। আশ্চর্য, আমার শরীরকোষেরা বৃক্ষকোষেদের সাথে কোরাস জুড়ে দিল আমার পারমিশন ছাড়াই। বৃক্ষশাখে পাখিকোষেরা স্পর্শে উন্মনা হলো। এভাবেই দেহকোষেরা মগডালের পাতা বেয়ে ছুঁয়ে ফেললো আকাশতত্ব। জেগে উঠলো সহস্রা ক্রাউন। দু পা শেকড় স্পর্শ করতেই পৃথিবীতত্বে একাকার হলো। খুলে গেলো রুটচক্রের দ্বার। আমার জন্য সেই বিস্ময় সিংহদ্বার খুলে ধরলো যা একমাত্র মানুষের বোধগম্য। দেখলাম, আমি আর আমি নেই , কখন অসীম প্রকৃতি হয়ে গেছি…

স্পিরিচুয়াল-১

 

অ-সুখ ঘাপটি মেরে চিলেকোঠায়

ছেলেবেলা মেয়েবেলা এবং আসন্ন সন্ধ্যাপথে
থৈ থৈ বিছানো জট

একটা জীবন ধীরে হেঁটে চলেছে

আয়না গুছিয়ে নিচ্ছে টুকরোয় লেগে থাকা
গুঁড়ো স্বপ্ন ও জলীয় বোধ

একটা না পড়া চিঠির বুকে
ঘন হয়ে বসে আছি…
…আজ ও…

একটা অচিন আলো তিরছা ঢুকে পড়েছে ঘুলঘুলি ছাপিয়ে। আমার অন্ধ কুঠুরি কেমন মায়ায় ছয়ালাপ। যে সব শব্দেরা কান্না কুড়াচ্ছিল বিষন্ন নিঃশ্বাস বিছাচ্ছিল তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে নিজের দিকে। নিজস্ব মনে করে ছুট দিচ্ছিল যে দৃশ্য ও দৃশ্যাতীতে, স্পষ্ট হচ্ছে সেসব ধোঁয়াশা। বহির্মুখ যখন ফিরছে ভেতরে নিজের জন্য কষ্ট হচ্ছে। এই যে কিছু সময়ের জন্য পাওয়া জীবন, নিজেকেই দেখা হয়নি আদৌ। কতো স্বপ্ন আকাঙ্খা পাথর চাপা পড়ে র‌ইলো। জমে থাকা দিকহারা উচ্ছ্বাস গুমরে গুমনামি হলো। ছোট ছোট জাফরানি ভালোলাগারা আকাশ পেলো না। সমস্ত ক্ষয়ক্ষতি ভুলে তবু একবার ফিরতে চাইছি… একবার… নিজের কাছে… নিজের মতো করে….

স্পিরিচুয়াল -৩

 

সারাজীবন কারণে অকারণে
নিজেকে উইথড্র করে নিই

এ এক অভ্যস্থ খেলা… একা একাই খেলি…
সাপ-লুডো

সিঁড়ি বেয়ে মগে চড়ে যেই দেখি
চেনা হাত আর চোখ খুব ডাকছে
ঝুপ করে ঢুকে পড়ি
সাপের মুখে

সাপতো তাই কেউ ঘাঁটায় না

এইভাবে দীর্ঘ সুড়ঙ্গপথ অন্ধকার ময়
আমায় অন্ধ করে রাখে

গানহীন ভ্যাপসা বাতাসে
একটা টানটান কান্না ওড়ে

রবিশঙ্কর আর্ট অফ লিভিং খুলে বসেন…
“আজ্ঞাচক্রে যাবার আগে তোমার শরীরের
প্রতিটি কণাকে সম্মান জানাও
তোমার ক্ষণকালের শরীর, প্রকৃতির অপার বিস্ময়…”

সমস্ত খেলার সেরা খেলা ছেলেবেলা। দিদিমার ঠাকুরঘরে জপের মালা থেকে উঠে আসা ধ্যান ও ধারণা। শ্যাম কীর্তনিয়ার রাধে রাধে বিরহ বাখান থেকে চুঁয়ানো ব্যাথা ছেলেমানুষী দুই ভ্রুর মাঝে হলচল মন্থন। কে জানতো ডি.এন.এ সমস্ত সামটে বসেছিল সময়ের আশায়। এখন তুমি আমি, কাদা ক্লেশ, বিষয় আশয়, ক্ষীর‌ ও খিদে ভেসে যাচ্ছে জলপ্লাবনে। ধ্রুব বলে আঁকড়ে ধরা অচলায়তন হুড়মুড় ধ্বসে পড়ছে অনিবার্য ইশারায়। আমার জন্য যেন এই ভ্রমণ সুনির্দিষ্ট ছিল, এভাবেই ধরা দিচ্ছে অনুসঙ্গ। নিভে যাবার আগে প্রদীপ নিজের কাছে রেখে যেতে চাইছে কিছু গান’। হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া এক আদুরে অনুভবে অর্বুদ শরীরকোষে জন্ম নিচ্ছে আহা আনন্দ…আমি ভেসে যাচ্ছি ঈশ্বরে…

 

স্পিরিচুয়াল-৫

 

সেইসব এলোমেলো ভাবনারা
যাদের কাছে গচ্ছিত
ইহজন্মের গ্রীষ্মবোধ
বৃষ্টিবোধ

শীত ও বসন্ত বোধ টুপটাপ ছুঁই

শরীরের ট্রিলিয়ন কোষদের
ডেকে গল্প জুড়ি

জানো , যতটা সংঘর্ষ
ঠিক ততটাই জীবন

যতটুকু ছোঁয়া যায়
বেশিটাই অধরা অসীম

পিটিউটারির দরজা হাট করে
এসো বুঝে নিই

জন্ম সময় এবং সময়াতীত

স্রোতোস্বিনীর স্রোতের ক্ষুরধারে ফুলেলা বাগান। ডুবকি মারতে মারতে আছাড়ি পিছাড়ির বিড়ম্বনায় গন্ধ পাই। ঘ্রাণ শব্দের এহসাসে লেগে থাকে যে ধাঁধা তাকে নাম দিই নিজস্বী। প্রত্যেকের‌ই আলাদা নিজস্বী আলাদা স্রোতভাষা। আনাড়ীর মাছ ধরতে নেমে গলায় বড়শির টান। ফুলের গন্ধে মাছ আঁকি। বড়শি আঁকি। মাছের গায়ে স্বপ্ন ভিড় করে। বড়শির কাঁটা উপেক্ষা করে সে স্বপ্নে মাথা চাড়া দেয় মৎস্যকন্যার ঘন রহস্য। তবুও কোথাও যেন দানা বাঁধে জ্বর। সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়িয়ে সেই জ্বর গুটিগুটি সন্ধ্যার দিকে। একটা একলা গাছ শেকড়বাকড় গুটিয়ে বিষন্ন দ্যাখে কিভাবে আকাশের আলো ধীরপায়ে অস্তগামী…

 

স্পিরিচুয়াল-৬

 

একটা ফুড়ুৎ এসে পাখনা দিয়ে যায়
পাখায় আলো
পাখায় উড়ান
আমি মহাশূণ্যের সিঁড়িতে চুপচাপ
গালে হাত

ঘোর কাটে না… রা সরে না…
কে যেন ভেতরে খামচায়
“মূর্খ, কি আছে পুঁথিতে? শব্দ?
নৈঃশব্দের রূপ দ্যাখ!”

আমি রুদ্ধশ্বাস অস্তিত্বে
আকন্ঠ
ভয়ার্ত বিশাল দেখি…

এক নিবিড় নৈঃশব্দে কতো রিমঝিম। একটা রজঃস্বলা রাত চাঁদমুখে বসে আছে। আমি রাত হতে চেয়ে আকাঙ্খা বুনি। এই যে আছি, এই যে থাকা। মহাবিশ্বে যে পৃথিবী বিন্দুবৎ সেই তুচ্ছাতিতুচ্ছে যে বিশালতা, আমায় মুগ্ধ স্থবির করে দেয়। আমি স্থবির চলনে একরাশ বিষ্ময় রেখে কিছু একটা আঁকড়াতে চাই। মুঠোময় শৃণ্য দোল দেয়। আমিও দুলতে থাকি অপার শৃণ্যতায়। দুলতে দুলতে একসময় গলে গলে শূণ্য হয়ে যাই…

 

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *