বিশ্বজিৎ রায়-এর কবিতা গুচ্ছ

কবিতাগুচ্ছ

                                                                                               ছবিঃ গৌতম মাহাতো

বিশ্বজিৎ রায়-এর কবিতা গুচ্ছ

                                           

মূলত লিটল ম্যাগাজিনেই তাঁর লেখালিখি।রাজ্যে তথা বহির্রাজ্যের লিটল ম্যাগজিনগুলিতে তাঁর লেখা সমাদৃত।কবিতায় তার অন্তর উদ্ভাসিত হলেও মাঝে মাঝে গদ্যের আঙ্গিকও কবিকে বেশ টানে।তাই গদ্যেও তাঁর সমান ভালোবাসা।

স্পন্দিত জীবন

বহুদূরে কোথায় যেন আনন্দ বেজে উঠল, 
আর সেই অভিঘাতে আমার ভেতর খুলে গেল
গােপন এক আলমারি, আলমারির ভেতর থরে থরে
সাজিয়ে রাখা ফুল, একটা ধূসর বাঁশি, একটুকরাে ছায়াপথ…

আনন্দের খোঁজ পেতে বন্ধ খাঁচা থেকে মুখ তুলে।
অনেক দূরে তাকিয়ে থাকলাম
স্তব্ধ চরাচর, ক্লান্ত রাজপথ, তন্দ্রাচ্ছন্ন আলাে,
কেউ কোনাে ইশারা জাগাতে পারল না… 

একটা গানের ঝিরি বেজে যেতে থাকল বুকের ভেতর 
কেউ শুনতে পেল না, মাঝে মাঝে শুধু 
বেজে উঠল আমার গত জন্মের ঘাের লাগা কানে…

ঐ বেজে ওঠা আনন্দকে রূপকথা মনে হবে
মনে হবে, পাখির চকিত উড়ে যাওয়ার মতাে       
                                    স্পন্দিত জীবন…

বলাে, ইবলিশ 


 রম্য গল্পগুলি থেকে মাঝে মাঝে ঝরে পড়ে বিষ — এরকম তাে কথা ছিলনা, তাহলে 
এমন কথা কেন বলাে, ইবলিশ ?

ছৌ-কথা, নৌ-কথা, সারিগান-জারিগান নিয়ে 
বেশ ছিল দুনিয়া তখন, 
সেই যে কারা এসে গেঁথে দিয়ে গেল ল্যাম্পপােস্ট, বিম — 
সেই থেকে কেমন বদলে গেল সব 
রূপকথার মতন … 

শরীরের থেকে রক্ত চুয়ে নামে,
 চিল-শকুনরা খুবলে নিয়ে যায় মাংসপিন্ড
 চারপাশে ড্যাংকুড়াকুড় বাদ্যি বাজে খুব। 
হেমন্ত-বিষাদে ডুবে থাকে হৃদপিন্ড — 

বদ্যি এসে আলাে ফেলে ঢুকে পড়ে শরীরের ভেতর তন্নতন্ন করে খোঁজে কীট-বিষ, 
কিছুই মেলেনা দেখে বসন্ত হি-হি করে হাসে-
প্রশ্নচিহ্নগুলি মাথার চারপাশে ঘােরে অহর্নিশ …

আবার তুমি


বসন্ত এসে গেছে
আবার তুমি চিলেকোঠা থেকে ছড়িয়ে দেবে। সাতরঙা ফাগ, 
আমি পলাশ কুড়াতে কুড়াতে পৌছে যাব। 
তােমার ঠিকানায় 

ঝরাপাতাদের সাবধানবানী উপেক্ষা করে 
তুমি আমাকে হাত ধরে নিয়ে যাবে 
অস্তগামী সূর্যের এঁকে দিয়ে যাওয়া চিলেকোঠার ঘরে, 
সেখানে সারারাত আমরা পূর্ণিমা মাখবাে,
ভােরের আলাে ফুটলে, বাতাসে ফাগ উড়িয়ে 
দুজনে গেয়ে উঠবাে 
“নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগলাে, লাগলাে…

মাছ ও আমি 


জলময় এই শরীরের ভেতর একটা মাছ খলবল করে সাঁতার কাটে, 
সাঁতার কাটতে কাটতে সে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
কখনােবা আমাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তাকে 
এ এক অদ্ভূত খেলা, সেই চৈতন্যবেলা থেকে চলছে, কখনাে সে হারে, আমি জিতি, 
কখনাে আমি হেরে গেলে সে আমাকে বাঁচায় — 

কত উথালপাথাল বাহারী দিন পার করে দিলাম একসঙ্গে 
রকমারী খাবার খেয়ে, নামীদামী ঘাটে ঘুরে,
জলের গভীরে ওঠানামা করে, অজস্র ঋতুবদল করে 
আর, এরমধ্যে যে ব্যাপারটা আমাদের সম্পর্ককে সুদৃঢ় করেছে। 
সেটা হল টোপ, 
নিরামিষ, আমিষ, নানান লােভনীয় টোপ এসে দোল খায় চোখের সামনে 
তখন ওই মাছ তার কেরামতি দেখায়, সঠিক মুহূর্তে
সে ওই লুকানাে বরশিগাঁথা লােভের টোপগুলি থেকে সরিয়ে আনে আমাকে 
বারবার এভাবেই আমাকে প্রলােভনের টোপগুলি থেকে 
সরিয়ে এনে এতকাল বাঁচিয়ে রেখেছে আমাকে …

হায় 


আকাশকে বললাম, আমাকে নিয়ে কিছু লেখাে, 
সে লিখলাে -” তুমি একটা মুখ, অপোগণ্ড “
মাটিকে বললাম কিছু লিখতে, 
সে লিখলাে –“তুমি ঝড়বাদলের অশুভ রাত” .. 

চেনা গাছগুলােকে বললাম, তােমরা কিছু বলাে,
তারা বললাে –“ তােমার শত-সহস্র মুখােশ,
কোনটা নিয়ে বলব ? বলতে গেলে কুপােকাত 

চেনা, কালাে মানুষগুলােকে বললাম 
আমকে নিয়ে তােমারাই পারবে কিছু বলতে”, 
ওরা সমস্বরে বলল – “ সব বলব, 
  আগে দাও একথালা ভাত !

আপনার ‘আমি
(উৎসর্গঃ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)

হাইওয়ে ধরে আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে আপনি কী ভাবছেন, সুনীলদা ? কবিতার জন্য অমরত্ব তুচ্ছ করে উড়িয়ে দিয়ে আপনি পাড়ি দিয়েছিলেন যে দিকশূন্যপুরের দিকে, সেখান থেকে পিছন ফিরে একবার দেখুন। অমরত্ব কেমন গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে আপনার দিকে … 

পরজন্মের বিশ্বাস আপনার কোনকালেই ছিলনা, কিন্তু থরে থরে ফুটে থাকা শিমূল-পলাশ-চন্দ্রমল্লিকারা আজও হা-পিত্যেশ করে বসে থাকে আপনার ফিরে আসার অপেক্ষায়, নীরার ছায়াগুলাে নীরবে বিরহমালা বােনে চন্দন বনের নির্মোহ বাগানে .. 

আপনি ঘুমাতে ভালবাসতেন, অথচ ঘুমাননি কোনদিন ঘুমের ঘােরেও আপনি কলমের ভেতর নিজেকে ভরে ভেসে যেতেন আকাশ-পাতাল-মহাশূন্যে, যেখানে বরুনার সঙ্গে দেখা হতাে, বরুণার মুঠোয় আপনি চাক্ষুষ করতেন অদেখা অনন্ত, ঘরে ফেরার বেলায় নদীঘাটে আপনাকে দেখে হাঁক পাড়ত নাদের আলি,যে আপনাকে তিনপ্রহরের বিল দেখতে নিয়ে যাবে বলেছিল

আপনি বলেছিলেন, ” যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবাে, আমি বিষপান করে মরে যাব “—- আপনাকে বিষপান করতে হয়নি, বিষই আপনাকে পান করে টেনে নিয়ে গেছে। আপনার সাড়ে তিন হাত ভূমি থেকে সেখানে বসে বসে আপনি দেখেন, আপনার ভিতর থেকে আমিটুকু বেরিয়ে। কেমন বসে আছে ভিখারীর পাশে ভিখারীর মতাে, মানুষের পাশে কুকুরের মতাে, অন্ধকারে স্ত্রীলােকের পাশে অন্ধকার মেখে অনেক দূরের দীর্ঘ নিরালায়, — 

কোনাে একদিন এই সুবর্ণ শহরে ফিরে স্বপ্নের কবিতা লিখবেন বলে …

তারা

 যারা বলেছিল, মধ্যরাতে বাঁশিবাজলে…
পায়ে পায়ে এসে দাঁড়াতে জগন্নাথ ঘাটে
শেষপর্যন্ত তারা কেউ আসেনি,
বহুবছর পর তাদের একদিন খুঁজে পেয়েছিলাম 
মৃত মানুষের মত, পড়ে আছে ঘুনধরা খাটে …

আমাকে দেখে তারা চমকে উঠেছিল, 
ভেবেছিল, আমি হয়তাে হারিয়ে গেছি 
বহুদূরের কোনাে প্রত্ন জীবনে…
যখন তাদের সব এলবাম খুলে দেখালাম 
বুঝতে পারল, অজান্তে তারা আগুন জ্বেলে দিয়েছিল আমার গভীর গোপনে…

                                ★★★

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *