ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস–“চোরাবালি”(পর্ব-১৮)

পরিচিতিঃ ইন্দ্রনীল বক্সী, “জন্ম – নকশাল পিরিয়ডে ..৭৩ এ দুর্গাপুরে , উচ্চতা মাঝারি, গায়ের রঙ মাজা, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল টাইপ। লিখছি সেই কিশোরবেলা থেকে, দুর্গাপুর বেলা থেকে বর্তমান নিবাস – বর্ধমান। কি লিখছি ছাই নিজে তো জানিই না অন্যরাও জানে বলে মনে হয় না। হাবিজাবি করে চারটি বই প্রকাশিত।” বাইফোকালিজম্-এ তাঁর আজ ধারাবাহিক উপন্যাস ‘চোরাবালি‘-র ১৮তম পর্ব

ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সীর ধারাবাহিক উপন্যাস

চোরাবালি(পর্ব-১৮)

ফেসবুকে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করতেই দেবু পেয়ে গেলো “সবুজ পাঠ।” একটা গেরুয়া ব্যাকগ্রাউন্ডে সুন্দর কায়দা করে লেখা সবুজ পাঠ কথাটা, পাতার রঙের, পাতার মতোই ছাপ ছাপ। গ্রুপ মেম্বার ৪২০০ দেখাচ্ছে! বেশ চমকে যাওয়ার মতোই সংখ্যাটা। এরকম গ্রুপগুলোয় অবশ্য সংখ্যাটা এমন কিছু ব্যাপার নয়! খাবার দাবার বা সখের বাগানের গ্রুপে আরও বেশি সংখ্যায় মেম্বার থাকে। ফেসবুকের কোনো গ্রুপে মেম্বার হওয়া খুবই সহজ একটা ব্যাপার, হলেই হলো। দেবু স্ক্রল করে দেখতে থাকে নানান পোস্ট, কোথাও গাছ লাগানো হচ্ছে তো কোথাও জঞ্জাল পরিষ্কার করে এক জায়গায় পোড়ানো হচ্ছে! কিছুদিন আগের একটা পোস্টে দেখল জি টি রোড চওড়া করার জন্য রাস্তার দুধারে থাকা গাছ কাটার প্রতিবাদের ভিডিও। দেবু নিজের মনেই মুচকি হেসে উঠলো। এই ব্যাপারটা অন্তত ও জানে, বেশ বাওয়াল হয়েছিলো সেই সময়। রাস্তা চওড়া হবে খবর হতেই সবার আগে যা করা হয়েছিলো সেটা হচ্ছে নীলপুর মোড় থেকে উল্লাস মোড় পর্যন্ত রাস্তার দুধারে থাকা বড় বড় গাছে রাতারাতি কেটে সাফ করা হয়েছিলো। দেবু এটাও জানে সেই গাছের কিছু গুঁড়ি বন দপ্তর নিয়ে গেলেও আশেপাশের ছোটো মাঝারি নেতাদের বাড়িতে ফার্নিচার হয়েছে সেই কাঠে! এসব হয়তো নন্দিতা জানে না!
ফেসবুক বন্ধ করে দেবু ছাদে উঠে যায়। সকালটা ছাদে দাঁড়িয়ে দেখতে ভালো লাগে দেবুর। ঝকঝকে সকালটা ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওদের ছাদে। পাশের বাড়ির বাসবী বৌদির কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। ধর্মরাজ হেয়ার কাটিং এর ঝাপ এখনো ওঠেনি। এখনও দেবুদের গঞ্জ আড়মোড়া ভাঙছে, শহুরে অভ্যাসে শহরের কাছাকাছি গ্রামাঞ্চল ক্রমশ রপ্ত হয়ে উঠছে।
দুনিয়াটা এরকমই, নন্দিতারা জানে না! যাদের ক্ষমতা আছে তারা লুটে নেয়, দরকারে কেড়ে নেয়, চিরকালই তাই হয়ে এসেছে। কে জানে নন্দিতাদের এই সবুজ পাঠের পিছনেও কোনো বড় মাথা আছে , কোনো ছক আছে!
রোদটা একটু গায় লাগছে এবার, দেবু সরে আসে চিলেকোঠার ছায়াতে, একটা সিগারেট ধরাতেই ফোনটা বেজে ওঠে …রজত !…
“বল… সক্কাল বেলায় কল !”
“গুরু গুড লাক … আজ তো প্রথম দিন তাই ভাবলাম একটু উইশ করি …ভালো করিনি বল !”
“আরে …বাহ …তোর মনে আছে! থ্যাঙ্কস ইয়ার …আরে এমন বলছিস যেনো এস এস সি লাগিয়েছি!”
“ধুর বাল … এটা কম নাকি! …লাইন ধরে নিলে প্রচুর মাল কামাবি দেখে নিস , তখন রোজ পার্টি হবে পার্টি…”
“ব্যাস … হাল্কা দে …আগে তো শুরু করি“
“হবে হবে দেখে নিস …চল রাখছি, বেরোতে হবে…বাই ” রজত ফোনটা কেটে দেয়।
কি আশ্চর্য! আজ কাজের প্রথম দিন সেটা খুব একটা কাউকে বলেনি দেবু, শুধু একবার রজতের সামনে বলেছিলো, ওর ঠিক মনে আছে ! আজকের প্রথম উইশটা ওই করলো, অথচ দেবু একটু সমঝে মেশে রজতের সঙ্গে ।অন্য কোনো ব্যাপার নয়, কিন্তু রজতের চোখ ধাঁদানো বৈভবের সামনে একটু যেন ভিতরে ভিতরে কুঁকেড়ে থাকে দেবু! এলোমেলো চিন্তার মাঝে একটা অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজিয়ে সামনের রাস্তা দিয়ে ধুলো উড়িয়ে চলে যায়, দেবুর চিন্তার তারটা ছিন্ন হয়ে যায়। নাঃ এবার স্নান করে রেডি হতে হবে, আজ প্রথম দিন সদর ঘাট অফিসে এগারোটা নাগাদ যেতে হবে, পরে কবে কখন কাজের সময় হবে সেটা জানিয়ে দেওয়া হবে। দেবু ছাদ থেকে নেমে এসে সোজা বাথরুমে ঢুকে যায়।
বিছানার উপর মা একটা নিতুন জামা আর প্যান্ট বের করে রেখে দিয়েছে দেখে দেবু একটু থমকে যায়, একটা ভালো লাগাও ছড়িয়ে যায় গোটা শরীরে। সেইতো… ছেলে নতুন কাজে যাচ্ছে , প্রথম কাজে বলে কথা! মায়ের কাছে সেটাই যথেষ্ট , কি কাজ, কোথায় কাজ সেসব বিশেষ গুরুত্ব নেই। অন্তত মা দেবুর কথাটা বুঝেছে এটা ভেবে মনটা ভালো লাগে দেবুর। জামা প্যান্ট পরে বাইরে আসতেই দেখে মণি উঠোনে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
“কি রে হাসছিস কেন!”
“এমনি… কেন হাসতে পারিনা ?” মণি জবাব দেয় ।
“না শুধু শুধু কেউ হাসে নাকি!”
“শুধু শুধু কেন… আজ প্রথম দিন কাজে যাচ্ছিস সেজে গুজে তাই…”
“ও … তাই হাসতে হবে এমনি এমনি !”
এমনি যে নয় সে দেবুও জানে। গোটা ব্যাপারটা মণিরও যে বেশ ভালো লাগছে সেটা ও বলতে না পারলেও দেবু জানে।
মণির কাছে গিয়ে দাঁড়ায় দেবু, মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে, ভালোয় মন্দয় মণি সব সময়ে দেবুর দলেই থাকে চিরকাল, এবারেও তাই অন্য কিছু হওয়ার নেই! মণির মাথায় একটা আলতো চাঁটি মেরে রান্না ঘরের দিকে মুখ করে জোরে বলে ওঠে “মা আমি বেরোচ্ছি…”
বাবার সঙ্গে দেখা হলো না, বাবা নেই বাড়িতে , অবশ্য দেবু জানতো বাবা থাকবে না এই সময় বাড়িতে। স্কুল না থাকলেও কোনো কাজের অজুহাতে বেরিয়ে যেত!

সদর ঘাট পেরিয়ে তেলিপুকুর ব্রিজের এপাড়ে যখন দেবু নামল তখন প্রায় পৌনে এগারোটা। আরাম বাগ রোডে অন্যদিনের তুলনায় একটু কম জ্যাম মনে হলো! দেবু হাঁটা লাগালো দ্রুত অফিসের দিকে।
অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পিনু, দুর থেকে দেবু দেখতে পাচ্ছে। সঙ্গে আরও দুজন, তাদের সঙ্গে হা নেড়ে কথা বলছে। কাছাকাছি যেতেই দেবুকে দেখে কথা বলা থামিয়ে দেবুকে ইসারায় অফিসের ভিতরে যেতে বলল পিনু। আফিসে ঢুকতে ঢুকতে দেবু মনে মনে ভাবতে লাগল পিনুকে দাদা বলাই ঠিক হবে, বেশ খানিকটা বড় বয়সে এবং কাজের ব্যাপারেও সিনিয়ার! একটা বেশ বড় সাইজের ঘর, পাশে আর একটা ঘর আছে মনে হচ্ছে। একটা বড় টেবিল আর গোটা চারেক প্লাস্টিকের চেয়ার রাখা। একটা বেঞ্চও আছে। টেবিলের ওপাশে একটা ঘাড় উঁচু চেয়ারও রয়েছে। এটাতেই সেদিন গদাইবাবু বসে ছিলেন! একটা টিভি ঝুলছে দেওয়ালে।
পাশের জানালাটা দিয়ে ঘাটের রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে, দূরে দামোদর দেখা যাচ্ছে রাস্তার বরাবর। দেবুর একটা বিচিত্র অনুভুতি হচ্ছে! কেন হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছে না। কিছুটা নার্ভাস যে নয় ভিতরে ভিতরে এমনটা নিজেকে বলতে পারবে না। এমনিতে সেরকম জড়তা বা ভয় ওর কোনোকালেই ছিলো না, কিন্তু এ অন্য জগত একেবারে!
“কি বস… তাহলে জুটেই গেলে আমাদের অফিসে!ওয়েলকাম ওয়েলকাম…”
পিনুর গলায় একটু চমকে তাকায় দেবু। পিনু দরজা দিয়ে ঢুকে অফিসের একমাত্র কাঠের চেয়ারটা টেনে বসে ওর সামনে। হাতে জলন্ত সিগারেট। মুখে কিছু না বলে দেবু হেসে ঘাড় নাড়ে শুধু উত্তরে।
“বেশ… স্যার আমায় বলে দিয়েছে তোমায় কাজ ধীরে সুস্থে বুঝিয়ে দিতে, আমি আমার কাজ করব, তবে কি জানো বোঝানো একরকম আর বোঝা এক… নিজে কি আর কতটা বুঝে নিচ্ছ এটা তোমার উপর …”
“বুঝলাম…“
“দেখো … এটা ঘাট অফিস , এখানে আমরা বালি তুলি এবং লোড দিই , লোড দেওয়া বোঝো?”
“মানে ওই ট্রাকে লোড করা… তাই তো !”
“ট্রাকে লোড করাই তবে এখানে একটু অন্যভাবে… আমরা কাকে কতটা দেব সেটা আমরা ঠিক করি… কাস্টমার নয়… হিসেবটা একটু উলটো… যাইহোক বুঝে যাবে আস্তে আস্তে। আমাদের কাজ হচ্ছে জেসিবি ঠিকঠাক বালি বেড থেকে তুলছে কিনা, মেশিন ছাকনিতে কতটা বালি ছেঁকে নামালো এসবের হিসাব রাখা নজর রাখা।“
“এটাই …!”
“আরও আছে… ট্রাক এসে সকালে টোকেন কাটে, সে টোকেন ইস্যু করা, ট্রাক নাম্বর অনুযায়ী খাতায় এন্ট্রি করা। জানো তো এসব সরকারি খাদান, নদী, বালি সব সরকারের, আমরা শুধু লিজ নিয়েছি। পাড়ের জমি আমাদের অনেকটাই অবশ্য। তাই খাতায় হিসেব রাখতে হয় সরকারকে দেখাবার জন্য বুঝলে!”
দেবু মন দিয়ে শুনতে থাকে আর সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে। কাজটা বেশ গুরুতর এবং দায়ীত্বের জেনে মনে মনে খুশিই হয়।
“তা একটু চা খাবে নাকি… বলতে পারো, এখানে আমি তোমার সিনিয়ার কিন্তু বস নই… আমাদের সবার একটাই বস… গদাই ঘোষ।”
“না… ঠিক আছে… আমি কিছু খাবো না পিনুদা “
বেশ, আজ এই পর্যন্তই থাক, বাকি পরে , চলো একবার ঘাট থেকে ঘুরিয়ে আনি“ বলেই পিনু উঠে দাঁড়ায়।
মাটি বালি মেশানো যে রাস্তাটা নদীর দিকে নেমে গেছে সেটা দিয়ে দেবু আর পিনু হাঁটতে থাকে পাশাপাশি… বেলা বেশ চড়ে এসেছে আসেপাশের ঘুপচি ঘর গুলো থেকে রান্নার গন্ধ ভেসে আসছে। গজ পঞ্চাশেক হাঁটতেই ওরা নদীর চরে এসে দাঁড়ায়। পিনুর পিছু পিছু হাঁটতে থাকে দেবু বাঁদিকে একটু দূরে যেখানে মেশিন ছাকনিটা ঘর ঘর আওয়াজ করে বালি ছাঁকছে। এ যন্ত্রটা দেবু অনেকবার দেখেছে ব্রিজের উপর থেকে, কিন্তু এতো কাছে সে দেখেনি কখনও! একদিকে দুজন লেবার বালি ঢালছে আর লম্বা কনভেয়ার বেল্টে করে সে বালি উঠে যাচ্ছে উপরে, মিহি বালি একদিকে পড়ছে ছাকনির মধ্যে দিয়ে আর বেশির ভাগ জল বেরিয়ে যাচ্ছে আলাদা হয়ে। একটা বিরাট স্তুপ তৈরী হয়েছে বালির। পিনু কাছে গিয়ে একমুঠো বালি তুলে লেবারদের কিছু একটা বলে আবার দেবুর কাছে চলে আসে।
“বুঝলে দেবু… কি জেনো নাম তোমার পুরোটা!”
“দেবব্রত সানা…”
“ও … সানা… তা বুঝলে সানাবাবু এই হচ্ছে সেই বালি যা এই নদীর পাড়ে সোনা ফলায় !কত লোকের সংসার চলে… যত বিল্ডিং হয়ে তা এই বালি ছাড়া হবে না। নানান বালির কোয়ালিটি আছে আলাদা আলাদা… ছাকনি বালি তারমধ্যে সবথেকে দামী!”
দেবু শুনতে থাকে, বালি তো বালিই এটাই এতোদিন জেনে এসেছে দেবু, তার আবার কোয়ালিটি হয় এই প্রথম জানলো। দামোদরের দুধারে মাইলের পর মাইলে পড়ে থাকে এমনি, রোদে গনগনে হয়, বর্ষায় ভেজে, তার থেকে যে এতো বড় কারবার হয় জানাই ছিলো না!
রোদ যতই থাক নদীর পাড়ে বেশ একটা আরামদায়ক হাওয়া বইছে। চরে আরও অনেক লোক ঘুরে বেরাচ্ছে, কেউ ছিপ ফেলে বসে আছে তো কেউ পাড়ে লম্বা লম্বা করে কাপড় মেলে শুকোচ্ছে। একজন মহিলা এসে হাঁড়ি কড়াই মাজছে নদীর জলে। মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া দামোদরের ক্ষীণ ধারা চকচক করছে রোদ পড়ে। ধীরে,খুব ধীরে বয়ে চলে সেল্ট রঙের জল। ব্রিজের উপর থেকে দামোদর আর নিচে এখানে দাঁড়িয়ে দামোদর আর তার আসেপাশের এতো লোকের নদী নির্ভর বসবাস দেখা সম্পূর্ন আলাদা লাগে দেবুর কাছে।

পিং করে আওয়াজ হয় দেবুর মোবাইলে, মেসেজ ঢুকল। আলতো করে মোবাইলটা বের করতেই দেখল …নন্দিতা… “all the best”

ক্রমশঃ

লেখা পাঠাতে পারেন
আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন–

ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস–“চোরাবালি”(পর্ব-১৭)

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *