কলকাতার কথকতা (১ম পর্ব)
কলমেঃ প্রা ন্তি কা স র কা র
গড়িয়ার ইতিবৃত্ত
ভেবে দেখলে অবাক হতে হয়, না জানি কত প্রাচীন কাহিনী, গল্প, ইতিকথা ছড়িয়ে আছে আমাদের চারপাশে। আমরা প্রতিনিয়তই হেঁটে চলি সেই সুগভীর পুরাবৃত্তের ওপর দিয়ে নতুনের খোঁজে। আজ যা কিছু ঘটমান বর্তমান, কাল তাই ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত থাকবে অতীতের মোড়কে। হয়তো এমন কিছু তথ্য ছড়িয়ে আছে আমাদের চির পরিচিত জন্মস্থানকে কেন্দ্র করে। হতে পারে তার সবটা আমাদের জানা নেই কিংবা কখনো খুঁজে দেখা হয়নি তার ইতিহাস বা অতীত বৃত্তান্তকে। আজ এরকমই কিছু ইতিহাস বা প্রাচীন কাহিনীকে তুলে ধরার চেষ্টা করবো এই লেখায়, যা হয়তো মিশে আছে বর্তমানের অন্তরালে অথবা রয়ে গেছে উন্নত সভ্যতার পেছনের কাহিনী হয়ে।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কলকাতা সংলগ্ন গড়িয়া অঞ্চলটি আমাদের কাছে একটি অতি পরিচিত নাম। কিন্তু কখনো কি সেভাবে ভেবে দেখেছি এই গড়িয়ার ‘গড়িয়া’ হয়ে ওঠার পেছনের গল্প বা কাহিনীটা ঠিক কি ছিল? তবে চলুন লেখার শুরুতেই জেনে নিই গড়িয়ার উত্থান সম্পর্কে। অতীতে শহরের উপকন্ঠে একটি বর্ধিষ্ণু অঞ্চল হিসেবে এটি পরিচিত হলেও ,জানা যায় একদা এই অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ গোত্রীয় গুড়িয়া গাছের আধিক্য লক্ষ্য করা যেত অন্তত একসময়ে শিয়ালদহ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকা সুন্দরবন তার ই ইঙ্গিত বহন করে। ইংরেজিতে গুড়িয়া গাছকে ‘Kendelia Candel’ বলা হয়ে থাকে। এই গুড়িয়া নামটির থেকেই সম্ভবত এই অঞ্চলটির আত্মপ্রকাশ ঘটে গড়িয়া হিসেবে। আবার অন্যমতে এই অঞ্চলে গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের আধিক্য থাকায় এটি গড়িয়া নামে পরিচিতি লাভ করে।
গড়িয়ার ইতিহাস খুঁজতে গেলে প্রথমেই যে দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ হয় তা হলো আদিগঙ্গা, যা বর্তমানে মজে যাওয়া জরাজীর্ণ এক খালে পর্যবসিত হয়েছে। আর এটিকেই আদিগঙ্গার অংশ বিশেষ বলে অনেকেই মনে করেন। গড়িয়ার নিকটবর্তী কামডহরি (কামদা হরি) একই ইতিহাস সূত্রে আবদ্ধ। এতো হল কিছু চাক্ষুষ বর্ণনার কথা। কিন্তু এর সাথে যে প্রাচীন কাহিনী গল্প আকারে বয়ে চলেছে এই শহরটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে এবার বলবো সেরকমই কিছু কথা।
জানা যায় গড়িয়া নামটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জুড়ে আছে মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেবের স্মৃতি। আনুমানিক পাঁচশো বছর আগেও গঙ্গার মূল স্রোত বইতো আদিগঙ্গা দিয়ে। যা কালীঘাট, গড়িয়া, বারুইপুর, মজিলপুর, ছত্রভোগ হয়ে মিশতো গঙ্গাসাগরে। দেড় দুশো বছর আগেও নাকি হরিদ্বার থেকে তীর্থ যাত্রীরা গঙ্গার ধার ধরে হাঁটাপথে কালীঘাট, গড়িয়া, বারুইপুর হয়ে পৌঁছাতো আদিগঙ্গার বিখ্যাত বন্দর ছত্রভোগে। সেখান থেকেই নৌকায় গঙ্গাসাগর যাত্রা। লোকমুখে এই যাত্রাপথটি দ্বারির পথ বা বাঁধ নামে পরিচিত ছিল। শোনা যায় এই বন্দর অঞ্চলটি প্রাচীন পৌন্ড্র সভ্যতার অংশ ছিল। আদিগঙ্গার সাথে সাথে ছত্রভোগ বন্দরটিও কালের গর্ভে নিমজ্জিত হয়ে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেয়। সেকালের এই বিখ্যাত বন্দরটি আজ মথুরাপুরের অন্তর্গত একটি গ্রাম হয়েই রয়ে গেছে।
১৫১০ সালে শ্রী চৈতন্যদেব শান্তিপুর থেকে যখন রওনা হয়েছিলেন নীলাচলের (পুরী) উদ্দেশ্যে তখন তাঁর যাত্রাপথটি ছিল এই আদিগঙ্গার তীর ধরে। এখানে বলে রাখি নীলপর্বতের নামেই এই নীলাচলের নামকরণ হয়েছিল বলেই জানা যায়। শবর রাজ বিশ্বাবসু জগন্নাথদেবের আদিরূপ নীলমাধবকে নীল পর্বতের কোন একটি গুহায় অত্যন্ত গোপনে পূজা করতেন বলে লোকমুখে শোনা যায়। পরবর্তীকালে তৎকালীন রাজা ইন্দ্রদ্যুন্যর তত্ত্বাবধানে জগন্নাথদেব দারুব্রহ্ম রূপে জগৎবাসীর কাছে পূজিত হন। শোনা যায় এই নীলাচলে যাত্রাকালেই গড়িয়া ও পদ্মশ্রীর মাঝামাঝি কোন এক বিশাল পুকুরের পাড়ে তাঁবু পড়েছিল চৈতন্যদেবের। সেখান থেকে রথতলায় এসে নদী বক্ষে স্নান সেরেছিলেন তিনি। সেখানে নদীর তীরেই নাকি এক মহাশ্মশানের অস্তিত্ব ছিল, যা আজ কালের গর্ভে বিলুপ্ত। তবে গড়িয়ার বোড়ালে বর্তমানে একটি মহাশ্মশান আছে, যার কথা অন্য কোন পর্বে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
এছাড়াও জানা যায়, মুঘল সম্রাট আকবরের সচিব টোডরমল বাংলার জরিপ করার সময় ভাগীরথী নদীর পূর্বতীর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত এই বিশাল অঞ্চলকে চব্বিশটি পরগণায় বিভক্ত করেছিলেন। সেই মেদনমল্ল পরগণার অন্তর্ভুক্ত ছিল গড়িয়া, মহামায়াপুর ও কামালগাজী। অতীতে এই অঞ্চলগুলোতে বৈষ্ণব প্রভাব ছিল লক্ষ্যনীয়।মধ্যযুগে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ এ বণিক ধনপতির পুত্র শ্রীমন্ত সওদাগরের বানিজ্য যাত্রার বর্ণনায় বৈষ্ণবঘাটার নাম লক্ষ্য করা যায়। আবুল ফজলের আইন ই আকবরীতে এই অঞ্চলের খোঁজ পাওয়া যায়।এইরকমই সুপ্রাচীন ইতিহাসে সমৃদ্ধ হয়ে আছে গড়িয়া ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহ। ইতিহাসের এই অবাধ চলন দেখলে সত্যি অবাক হতে হয়। পরের পর্বগুলোতে চেষ্টা করবো গড়িয়ার কয়েকটি প্রাচীন মন্দির ও কিছু দ্রষ্টব্য স্থানের কথা তুলে ধরার।