বিশ্বমিথের দরবার(১০ম পর্ব)
কলমে-দে ব লী না রা য় চৌ ধু রী ব্যা না র্জি
ছবিঃ সু নি পা ব্যা না র্জি
ইনুইৎ মিথলজির ভূমিকার পর আজ আসি তাদের দেব দেবী ও তাদের কেন্দ্র করে মানুষের বিশ্বাস ও বৈশিষ্ট্যের আলোচনায়। এই সভ্যতার মানুষের ইতিহাসে আছে সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে, ভালো-মন্দ নিয়ে বিশ্বাস। প্রাচীন এই সভ্যতার প্রতিটি ভাঁজে লুকিয়ে আছে প্রেম , শ্রদ্ধা, শিকার করা , সাহায্য করা, থেকে বহুবিবাহ , অজাচার, শিশুহত্যা ও মৃত্যুর মতো বিষয়গুলি। শুভ ও অশুভ শক্তির সহাবস্থান, পুনর্জন্মে বিশ্বাস, পাপ ও শাস্তি প্রভৃতির প্রকাশ দেখা যায় ইনুইৎ লোকবিশ্বাসে। দেব-দেবীদের প্রকৃতি যে মানুষের জীবনচর্যার সাথেই একাত্ম হয়েই ছিল তা বোঝা যায়। আসলে সেভাবেই প্রকৃতি বেঁচে থাকে মানুষের বিশ্বাসে। হ্যাঁ , এস্কিমোদের প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসে প্রকৃতিপূজাই মান্যতা লাভ করেছিল। পরবর্তীকালে খ্রীষ্টধর্মের প্রভাবে তা অবলুপ্ত হয়ে যায়।প্রাচীন ইনুইৎ সভ্যতায় অনেক দেব-দেবীদের কথা পাওয়া যায়। এই সমস্ত দেব দেবীদের শক্তি, চারিত্রিক গঠন প্রভৃতির অনেকটাই দৈবিক নয় , মানবিক। আগলুলিক ও আইপালোভিক পরস্পরবিরোধী দুই দেবতা। প্রথমজনকে ইনুইৎ সভ্যতায় মানব হিতৈষী বলে মনে করা হতো। বরফাকীর্ণ ভূমির গভীরে লুকিয়ে থাকেন ইনি। বরফের মধ্যে মানুষ বিভিন্ন রকম সমস্যায় পড়লে ইনি তাদের বাঁচাতেন। আবার আইপ্যালভিক মানুষের সমুদ্রযাত্রার সময় তাদের নৌপরিবহনে নানা রকম সমস্যা সৃষ্টি করতেন বলে ভাবা হয়। আঙ্গুতা নামে এক দেবতা ছিলেন ইনুইৎদের মৃতলোকের দেবতা। এই আঙ্গুতা বা আগুতা অনেকটাই গ্রিকদের চ্যারনের মতো। মৃত্যুর পর উনি আত্মাকে পারাপার করেন। এই আঙ্গুতার সাথে যুক্ত রয়েছে শিশুহত্যার এক রোমহর্ষক মিথ।ইনি নাকি নিজের কন্যা সেডনার আঙ্গুল কেটে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছিলেন। প্রাচীন টেক্সটগুলিতে দুটি কারন পাওয়া যায়। এক হলো , সেডনার ভয়ংকর খিদে। একবার উনি নিজের মা বাবাকেই খেতে উদ্যত হলে , আঙ্গুতা তাকে কায়াক থেকে জলে ফেলে দেন। আবার অন্য এক মতে বলে, পিতার আনা কোন সম্বন্ধই সেডনার পছন্দ না হওয়ায় তিনি এক পশুর (সম্ভবত কুকুর ) সাথে লিপ্ত হন। ক্রুদ্ধ পিতা তাই সেডনাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করেন।
দুটি ক্ষেত্রেই সেডনা বাঁচার জন্য কায়াকের ধার ধরে ওঠার চেষ্টা করলে , আঙ্গুতা তার আঙ্গুলগুলি কেটে দেন যার থেকে শীল মাছ , তিমি প্রভৃতি অতিকায় সামুদ্রিক প্রাণীর সৃষ্টি হয়। সেডনা নিজে হয়ে ওদের জলের দেবী। এই মিথের গভীরে লুকিয়ে থাকা শিশুহত্যা এবং জুফিলিয়া বা পশ্বাচারের বিষয়টি লক্ষণীয়। সেডনা যেখানকার মানুষের দেবতা ছিলেন না, সেই আলাস্কাতে মানুষ চাঁদের দেবতা আন্নিঙ্গানকে মানতেন। গ্রীনল্যান্ড বা কানাডাতে এনার প্রভাব বিশেষ ছিল না। তিনি ছিলেন চন্দ্র দেবতা। লোকমতে ইনি ঝড়, নিন্মচাপ, ভূমিকম্প, গ্রহণ – এসব কিছুর দায়িত্ব এই দেবতার। ইনি উর্বরাশক্তির দেবতা।অন্যদিকে সেডনার কোপ মানেই বন্ধ্যাত্ব, সন্তানহীনতা। এই দেবতার সাথে দিন রাতের চক্র এবং তার সাথে অজাচারের সম্পর্ক আছে। আন্নিঙ্গানের বোন মালিনা হলেন সূর্যের দেবী। আন্নিঙ্গান অনুরক্ত হয়ে পড়েন মালিনার প্রতি এবং তাকে বলপূর্বক গ্রহণ করেন। এতে মালিনা ক্ষুব্ধ হয়ে আকাশে উঠে পালানোর চেষ্টা করেন এবং আন্নিঙ্গান তার পিছনে ধাওয়া করেন। মালিনাকে মাঝে মধ্যে আকাশে দেখতে পেলেও দুজনের সহাবস্থান আর সম্ভব হয় না। মালিনার প্রতি আকর্ষণ চাঁদের দেবতার ছিল এতই বেশি যে তিনি কখনো কখনো খাওয়াও ছেড়ে দেন। তাতে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন আর মাসে একবার অমাবস্যা হয়। ইনুইৎদের মধ্যে উর্বরাশক্তির পুজো প্রচলিত ছিল। আকনা ছিলেন মাতৃশক্তি ও উর্বরতার দেবী এবং পিঙ্গা শিকার , ঔষধি ও উর্বরতার দেবী। সেক্ষেত্রে বোঝাই যায় যে এই আঙ্গিকটি কতটা গুরুত্ব পেয়েছেন। নানুক ছিলেন মেরু ভল্লুকের দেবতা এবং আমারক হলেন নেকড়েদের দেবতা এবং কাইলেরটেটাং এস্কিমোদের আবহাওয়ার দেবতা।
এই ভাবেই তুষারের দেশের প্রায় ভুলে যাওয়া ইতিহাসের মধ্যেও লুকিয়ে আছে এক প্রাচীন পৃথিবীর প্রকৃতিনির্ভর সভ্যতা, জীবনচর্যা ও লোকবিশ্বাস।