জ য় ন্ত কু মা র ম ল্লি ক-র একটি ধারাবাহিক গদ্য(সপ্তম পর্ব)
অথ নেকড়ে-মানব-মানবী কথাঃ গল্প বনাম সত্যি ঘটনা
সপ্তম পর্ব
পশু ও মানব সত্তা
আমিই শুধু হারিয়ে গেলেম হারিয়ে-যাওয়ার বনে।।- ‘পিছু-ডাক’, কাজী নজরুল ইসলাম
পশুরা জন্ম থেকেই পশুসত্তার সব স্বপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যই পেয়ে থাকে, আলাদাভাবে অর্জন করে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তাই কখনোই তাদের সত্তার বৈশিষ্ট্যের উল্লেখযোগ্য রদবদল ঘটে না। তাদের নিয়মতান্ত্রিক জীবন একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তরুলতা ও পশুপাখির মত মানুষও একই স্রষ্টার সৃষ্টি। তবে জন্মসূত্রে মানুষ হওয়া যায় না বা মানুষের পেটে জন্ম নিলেই মানবীয় সত্তাকে ধারণ করা যায় না। মানুষের মধ্যে যে পশুসত্তা লুকিয়ে আছে মাঝেমধ্যে তারই নখ-দন্ত বেরিয়ে আসে৷ মানুষের সেই পশুসত্তা থেকে মনুষ্যসত্তার উত্তরণ অর্থাৎ তার স্পিনোজা কথিত Social animal হয়ে ওঠার পথ দুর্গম। যার মাঝে পশুসত্তা মানবসত্তার সাথে পেরে উঠে না, সে আর মানুষ থাকে না, হয়ে উঠে অমানুষ, হিংস্র নেকড়ের মতো। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়-‘তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপাখি সহজেই পশুপাখি, কিন্তু মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায় তবে মানুষ।’
পৃথিবীতে এমন অনেক অনাথ মানব শিশু আছে যারা পিতা-মাতা, পরিবারবর্গ কিংবা অন্য মানুষের সংস্পর্শ ছাড়াই বন-জঙ্গলে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে উঠছে, কখনোবা বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে থেকেই বড় হচ্ছে এই শিশুরা এবং এইভাবে বছরের পর বছর তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে থাকতে থাকতে সেইসব প্রাণীদের ভাষায় কথা বলতে শিখে গেছে ও তাদের মতই আচার-আচরণ করছে। এই ভাবেই মানব শিশুদের মধ্যে পশু সত্তার বিকাশ ঘটার সঙ্গে সঙ্গে জন্মগত মানবিক গুণগুলো সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে গেছে, যেমন দেখা গেছে শুধু কমলা-অমলার ক্ষেত্রে নয় অন্য অনেকের বেলায়, যাদের কথা বলবো এখানে। এরা হল এদেশের অনামী একটি ছেলে, শামদেও ও অনামী একটি মেয়ে, আর বিদেশের দুই বোন ক্যারিকো এবং ক্যারোলিনা, মেরিনা চ্যাপম্যান ও জন স্যাসেবুনিয়া। কাহিনীতে যাবার আগে এসবের জৈবিক ব্যাখ্যা একটু দিয়ে রাখি তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে।
প্রাণী দেহকোষে বিদ্যমান অণুর একক হিসেবে পরিচিতি ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড)-তে স্থিত জিন যে কোন জীবের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। জিন প্রাণী প্রজাতির দেহে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রজন্মব্যাপী নানা ধরনের বিচিত্র বিঘটন ঘটিয়ে থাকে। জৈব প্রজাতির ডিএনএর অন্তর্গত জিনের স্বার্থপরায়ণতার এক নতুন ব্যাখ্যা জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠে যখন ডারউইনবাদের ‘ন্যাচার্যাল সিলেকশন’ অভিধার ঐতিহ্য অনুযায়ী জীব দেহের বিকাশ ও বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে প্রচলিত ধারণায় রিচার্ড ডকিন্স নতুন মাত্রা যোগ করেন। ‘দ্য সেলফিশ জিন’ বা স্বার্থপর জিন বইতে রিচার্ড ডকিন্সের দৃষ্টিভঙ্গি হল প্রাথমিক পর্যায়ে একদল নেকড়ের মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য পূরণের ক্ষেত্রে একাত্বতা ও সংশ্লিষ্টতা থাকলেও সেটি খুবই তুচ্ছ হয়ে যায় যখন আমরা কোন একক নেকড়ের শরীরের গঠন ও উদ্দেশ্যের একাত্বতা লক্ষ্য করি।
প্রকৃতিতে এককভাবে প্রাণীর (মানুষসহ) জ্ঞাতিত্ব সম্পর্কহেতু সাদৃশ্যের কারণে আলট্রুইজম বা পরহিতকর শুভবোধের লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়। যখন কোন প্রজাতির নিজ কোন আত্মীয় বা সদস্য তার পরিবার বা আত্মীয়ের প্রাণরক্ষায় নিজের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়, সে এটা নিজ ‘জিন’-এর স্বার্থে বা প্ররোচনায় করে থাকে। ‘জিন’-এ ধরনের কাজ করতে তাকে প্রবুদ্ধ করে। ভাল অনুগত জিন এর কারণে মানব প্রজাতির দেহকোষে এমন পুনরাবৃত্তি হতে পারে, যা ভবিষ্যত বংশধরকে আপাত-সুন্দর এক কল্যাণময় জগতে বসবাসের স্থান করে দিতে পারে। ডকিন্সের ‘সেলফিশ জিন’-এর এই মতবাদ অনেকেই মেনে নিতে পারেনি। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখব বাস্তবে এই জিন কিভাবে প্রাণী ও মানব জগতকে প্রভাবিত করে।
যেমন আমাদের আলোচ্য দ্বৈত চরিত্র কমলা-অমলা। তাদের বংশ পরিচয় আমাদের কাছে অজানা। গ্রাম সংলগ্ন জঙ্গলে তাদেরকে পাওয়া গিছল, তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে যে সেই সব কোন গ্রামেই তাদের বংশ পরিচয় লুকিয়ে আছে। কমলা-অমলা দুই বোন একথা জোর দিয়ে বলা যাবে না কারণ দু’জনের মধ্যে শারীরিক অমিল প্রকট এবং ব্যবহারিক তফাতও রয়েছে। যেহেতু দু’জনের বয়সের মধ্যে আনুমানিক বছর দেড়েকের তফাত, ধরে নেওয়া যেতে পারে ওরা কোন ভাবে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কোন ভাবে নেকড়েদের জঙ্গলে এসে পড়ে। কিন্তু তারা কোন বাবা-মার সন্তান বা তারা কোন গ্রাম থেকে ওই জঙ্গলে এসে হারিয়ে গিছল সেটা বলা সম্ভব নয়। তবে হতেও পারে নেকড়েরা তাদের লোকালয় থেকে তুলে এনেছিল, তারপর না খেয়ে তাদের ছানাদের সঙ্গেই রেখে দিয়েছিল। এমনও হতে পারে তাদেরকে জঙ্গলে ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছিল, তার সম্ভাবনাই বেশি। সবটাই অনুমান।
দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করলে বোঝা যায় অর্থনীতির অব্যাহত পতন ঘটছে বলে নূন্যতম পুষ্টিমানের খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন গরীব মানুষেরা। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে অনেকে জন্মনিরোধ কিনতে পারেন না, ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের বিষয়টিও অনেকটা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পিছিয়ে পড়া এলাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ব্যবহারের মূল দায়িত্ব নারীরাই পালন করে, পুরুষরা ওসবের ধার ধারে না। ভ্যাসেকটমির করার হারও খুব কম। গর্ভপাত বিরোধী আইনের কড়াকড়ির কারণে নারীদের সামনে বিকল্পও খুব কম। ফলে শিশুদের পরিত্যাগ করা বহু গুণ বেড়ে গেছে। সদ্যোজাত সন্তান ‘অবৈধ’ বলে ঝোপঝাড়ে ফেলে দেওয়ার সংখ্যাও কম নয়। তার সঙ্গে বাড়ছে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, মেয়ে পাচার৷ এর আগেও কন্যা সন্তান হত্যা করা হত। জন্মের পরই অনেক কন্যাসন্তানকে মেরে ফেলত বাড়ির লোকজনরাই৷ জলে চুবিয়ে, বালিস চাপা দিয়ে৷
প্রসঙ্গক্রমে সুন্দরবনে সন্তান ফেলে দেওয়ার দু’টি লৌকিক কাহিনীর কথা বলব। যেমন বনবিবির উৎপত্তি নিয়ে নানা কিংবদন্তি শোনা যায়। ইতিহাসবিদ সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’ বই থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, রাজা দক্ষিণ রায়, বণিক ধোনাই ও মোনাই এবং গাজী পীর প্রায় একই সময়ে বিরাজমান ছিলেন। ১৫০০ সালের কাছাকাছি সময়ে মক্কা থেকে আসা ইব্রাহিম (মতান্তরে বেরাহিম) ফকিরের মেয়ে হলেন বনবিবি। ইব্রাহিমের প্রথম স্ত্রী ফুলবিবি যখন তাঁকে কোনও সন্তান দিতে পারেন না, তখন ফুলবিবির অনুরোধে ইব্রাহিম গোলাবিবি বা গুলালবিবিকে বিয়ে করেন। কিন্তু ফুলবিবি তাঁকে একটি শর্ত দিয়েছিলেন। সেই শর্ত হল, সন্তানসম্ভবা হলে গুলাল বিবিকে গভীর জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে এবং জঙ্গলের মধ্যেই তাঁর সন্তান জন্মাবে। শর্ত অনুসারে গুলালবিবি যখন সন্তানসম্ভবা হলেন, তখন ইব্রাহিম তাঁকে সুন্দরবনে ছেড়ে আসেন। জঙ্গলের মধ্যে গুলালবিবি যমজ পুত্র-কন্যার জন্ম দিয়ে প্রসব বেদনা সহ্য না করতে পেরে মারা গেলেন। সদ্যোজাত শিশু দু’টির কান্না শুনে বনের সমস্ত পশুপাখি ছুটে আসে তাদের কাছে। তারাই দুই ভাই-বোনকে লালন-পালন করে বড় করে তোলে। শিশু দু’টি একটু বড় হলে শুধু ছেলে শাহ জঙ্গলীকেই ঘরে নিয়ে যান ইব্রাহিম। একা মেয়ে বড় হয় এক হরিণ মায়ের কাছে। আস্তে আস্তে জঙ্গলের ভালো-খারাপ তাঁর নখদর্পণে চলে আসে। বাঘের হাত থেকে সেই মেয়ে অনেক মানুষকে বাঁচাতে থাকে। এই মেয়েটিই বনবিবি নামে পরিচিত হয়।
বনবিবিকে নিয়ে সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনী ধনা-দুখে কাহিনী। বহু বছর আগে সুন্দরবনের এক গ্রামে বাস করত এক গরীব বিধবা। দুখে নামে তার এক ছেলে ছিল। দুখেকে সুন্দরবনে চাক ভাঙতে নিয়ে যায় তার কাকা, ধনা আর মনা। ছেলেকে বনে ছাড়তে নারাজ দুখের মা দুখেকে বলে, “বনে আমার মতো তোর আর এক মা আছেন। যখন কোনও বিপদে পড়বি তাঁকে ডাকবি। তিনি তোকে রক্ষা করবেন”। সুন্দরবনে সে সময় বাস করতেন গাজী নামে এক আউলিয়া। আর জঙ্গলে বাঘরূপী দক্ষিণ রায় বা রায়মনি। অরণ্যের অধিকার ছিল তার দখলে।
দুখুর ওপর নজর পড়ল তার। সে রাতে ধনা-মনাকে স্বপ্ন দিয়ে বলল, ‘দুখেকে তার কাছে ছেড়ে যেতে। বদলে সপ্তডিঙা ধন দেবে তাকে‘। সম্পদের লোভে ধনা-মনা দুখেকে বনের মধ্যে ছেড়ে ডিঙা ভাসিয়ে দেয় নদীতে। গহীন বনে বাঘের ছদ্মবেশে দক্ষিণ রায় দুখেকে হত্যা করতে গেলে অসহায় দুখুর হঠাৎ মনে পড়ে তার মায়ের কথা। সে শরণ নেয় তার আরেক মায়ের। দুখের প্রার্থনা শুনে বনবিবি ও তাঁর ভাই জঙ্গলী এসে উপস্থিত হন। দক্ষিণরায়কে পরাজিত করেন জঙ্গলী। পরাজিত দক্ষিণরায় খান গাজীর (গাজী পীর) আশ্রয় নেন। বনবিবি ও শাহ জঙ্গলী দক্ষিণরায়কে ধাওয়া করে খান গাজীর কাছে উপস্থিত হন। অবশেষে গাজী দক্ষিণরায়ের ক্ষতি না করার জন্য বনবিবিকে রাজি করান। পরিবর্তে গাজী দুখেকে সাতটি মূল্যবান কার্টুলি দিয়েছিলেন এবং দক্ষিণরায় তাকে দিয়েছিলেন প্রচুর মো ও মধু। বনবিবির আদেশে তাঁর পোষাক মুরগিরা দুখেকে তার গ্রামে রেখে আসে। গ্রামে ফিরে দুখে বনবিবির পূজাকে জনপ্রিয় করে তোলে।
বনবিবির দু’রকম মুর্তি দেখা যায়। একটি মূর্তিতে দেখা যায় বিবির মাথায় টুপি, চুল বিনুনি করা, কপালে টিকলি, গলায় হার, পরনে পাজামা, পায়ে জুতো, কোলে একটি বালক। কোথাও বাঘের পিঠে, আবার কোথাও মুরগির পিঠে। ভক্তজনের বিশ্বাস কোলের ছেলেটি সেই দুখে। অন্য একটি মূর্তিতে দেখা যায়, মাথায় মুকুট, গলায় হার ও বনফুলের মালা, সর্বাঙ্গে নানা অলংকার এবং কোলে বা পাশে দুখে।
এবার বিভিন্ন দেশের জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া বা বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে বেড়ে ওঠা কিছু ছেলে-মেয়েদের কয়েকটি গল্প বলব যাদের সঙ্গে আপনারা হয়ত কমলা-অমলার বন্য জীবনের অনেক মিল খুঁজে পাবেন।
বেকার ১৯১২ সালে আসামের কাছে উত্তর কাছাড় পাহাড়ে দেখতে পাওয়া একটি চিতাবাঘের বাচ্চা সম্পর্কে একটি প্রতিবেদনও লিখেছিলেন বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি (বিএনএইচএস)-এর জার্নালে। স্থানীয় গ্রামবাসীরা চিতাবাঘের বাচ্চাগুলোকে মেরে ফেলার পর সেই চিতাবাঘিনী গ্রামের এক বাচ্চাকে মুখে করে ধরে নিয়ে যায়, যখন বাচ্চাটির মা মাঠে কাজ করছিল। তখন ছেলেটির বয়স ছিল দু’বছর। তিন বছর পরে, একটি শিকারি চিতাবাঘকে হত্যা করে এবং তিনটি বাচ্চা খুঁজে পায়, যার মধ্যে একটি ছিল ৫ বছরের সেই মানব শিশু। তাকে গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল, সেই ছোট্ট গ্রামে যেখানে তার পরিবারের কাছে তাকে হস্তান্তর করে দেওয়া হয়। যখন সে প্রথম ধরা পড়েছিল, তখন সে কেবল উবু হয়ে বা হাঁটু গেড়ে বসে একজন পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তির থেকে দ্রুত চারদিকে দৌড়ে যেত। তার হাঁটু, পদপৃষ্ঠ, অঙ্গুলি ও তালুগুলো কড়া পড়া শক্ত, শৃঙ্গাকার চামড়া দিয়ে আবৃত ছিল। প্রথমে তার কাছে আসা প্রত্যেকের সাথে লড়াই করেছিল, কামড়ে দিচ্ছিল এবং উপরন্তু, তার ঘ্রাণশক্তি এতই তীব্র ছিল যে সে এমনকি কোনও পাখীকে খুঁজে পেলে তাকে তৎপরতার সংগে ধরে ছিঁড়ে ফেলে কাঁচা চিবিয়ে খেত। সে কথা বলতে পারত না, কেবল ঘোঁৎ ঘোঁৎ এবং গোঁগোঁ আওয়াজ করত। পরে সে কথা বলতে শিখেছিল এবং আরও সোজা হয়ে চলতে পেরেছিল। দুঃখের কথা ধীরে ধীরে চোখে ছানি পড়ে সে অন্ধ হয়ে গিছল। তবে জঙ্গলে থাকার কারণে এটি ঘটেনি, তার পরিবারে এরকম অসুস্থতা আগে থেকেই ছিল।
দু’টি অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল মেক্সিকোতে। ১৮৪৫ সালে, সেখানে নেকড়েদের একটি পাল একটি তৃণভূমিতে চরানো ছাগলের একটি দলকে আক্রমণ করেছিল, যার সাথে একটি ছোট মেয়েও চারদিকে দৌড়েছিল। ধরা পড়ে গেলেও কিছুক্ষণ পর সে পালিয়ে যায়। ১৮৫২ সালে, একটি মেয়েকে বনে দুটি নেকড়ে শাবককে খাওয়াতে দেখা গিয়েছিল। লোকজন এগিয়ে এলে সে সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে যায়। পরে অন্য কেউ তাকে দেখেনি।
এক নেকড়ে বালককে ১৯৭২ সালে উত্তর প্রদেশের একটি জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয়। তাকে নেকড়ের সঙ্গে খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া অবস্থায় পাওয়া যায়। সে সময় তার বয়স ছিল মাত্র চার বছর। পরবর্তীতে শামদেও নামে হারিয়ে যাওয়া এক শিশুর সঙ্গে মিল পাওয়ায় তাকে শামদেও হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাকে যখন খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল তখন তার গায়ের রং খুব কালো ছিল এবং তার দাঁতগুলি নেকড়ের মতোই লম্বা ও ধারালো, দীর্ঘ না কাটা নখ, জটাওলা চুল এবং হাতের তালু, কনুই এবং হাঁটুতে বড় বড় কড়া পড়া ছিল। নেকড়েদের খেলার সঙ্গী ছিল এই শিশুটি এবং আচরণও করতো তাদের মতো। সে মুরগী শিকার করতো, নেকড়েদের সঙ্গে খাদ্যের জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতো এবং রক্তের স্বাদ পেতে চাইতো। উদ্ধার করে আনার পর থেকে সে কথা বলতে পারেনি কোনোদিন। কেবল ইশারার মাধ্যমে যোগাযোগ করতো। ১৯৭৮ সালে উদ্ধারের পর তার চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়। আস্তে আস্তে কাঁচা মাংস খাওয়া ছেড়ে দিলেও কোনদিন মুখ খোলেনি সে। তাকে লক্ষৌতে মাদার টেরেসার হোম ফর দ্য ডেসটিউট অ্যান্ড ডাইং-এ ভর্তি করে দেওয়া হয়, যেখানে তার পুনরায় নামকরণ করা হয় পাস্কাল। কিছু সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করেতে শিখলেও মানুষের ভাষা শিখতে পারেনি সে। ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তার মৃত্যু হয়।
২০১৯ সালের মার্চ মাসে লিয়া ক্যারিকো এবং ক্যারোলিনা নামের ৮ ও ৫ বছরের দু’টি শিশু ঠান্ডা আবহাওয়ায় বৃষ্টির মধ্যে হাকলবেরির পাতা থেকে জল পান করে এবং সঙ্গে নিয়ে যাওয়া সেরিয়াল বার খেয়ে বেঁচে ছিল। বিবিসি জানায়, তাদেরকে উদ্ধার করতে পারাকে পুলিশ ‘অলৌকিক’বলে বর্ণনা করেছে। শিশু দু’টির মা জানান, অনেক খুঁজেও মেয়েদের না পেয়ে তিনি স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানান। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এবং উদ্ধারকর্মীরা হেলিকপ্টার ও কুকুর নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। দু’দিন বাদে বাড়ি থেকে বনের প্রায় দেড় মাইল ভেতরে একটি ঝোপের নিচে তাদের খুঁজে পাওয়া যায়। দু’জনকে উদ্ধারের পরপরই এলাকাটিতে তুমুল ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়। উদ্ধারকর্মীদেরকে শিশু দু’টি জানিয়েছে, হরিণের চলার পথ অনুসরণ করতে গিয়ে তারা একসময় পথ হারিয়ে ফেলে। বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে না পাওয়ায় তারা আর না হেঁটে সেখানেই অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। শিশু দু’টিকে চিকিৎসকরা পরীক্ষা করেছেন। তারা জলশূন্যতা এবং ঠান্ডাজনিত সমস্যায় ভুগছে। তাদের বাবা-মা তাদের সঙ্গে দেখা করেছে।
মেরিনা চ্যাপম্যানকে ১৯৫৪ সালে প্রত্যন্ত দক্ষিণ আমেরিকায় কলম্বিয়ার একটি গ্রাম থেকে ৫ বছর বয়সে অপহরণ করা হয়েছিল এবং অপহরণকারীরা তাকে জঙ্গলে ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছিল। সেখানে মেরিনা পাঁচ বছর ধরে একটি ছোট ক্যাপচিন বানর পরিবারের সাথে থাকত। সে বানরদের ফেলে দেওয়া ফলপাকুড়, শিকড় এবং কলা খেত; গাছের গর্তে শুয়ে থাকত এবং বানরের মতো সমস্ত জঙ্গলে লাফিয়ে দাপিয়ে বেড়াত। একসময়, সে বিষ খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে একজন প্রবীণ বানর তাকে জলের পুলের দিকে নিয়ে গেল এবং তাকে জলপান করতে বাধ্য করল, সে বমি করে বিষ উগড়ে তারপর সুস্থ হতে শুরু করে। নব্য বানরদের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়েছিল এবং তাদের কাছ থেকে সে গাছে চড়তে এবং কী কী খাদ্য খাওয়া নিরাপদ তা শিখেছিল। সে গাছে বসে তাদের সংগে খেলত।
পরে শিকারিরা যখন তাকে উদ্ধার করে সেই সময়ে মেরিনা তার মানুষের ভাষা পুরোপুরি ভুলে গিছল। তাকে শিকারিরা পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়। সেখান থেকে সে পালিয়ে গিয়ে রাস্তার ভবঘুরের মতো জীবনযাপন করত। এরপরে প্রতিবেশীরা তাকে রক্ষা করার আগে একটি মাফিয়া ধাঁচের পরিবার তাকে দাস করে রেখেছিল। উদ্ধারকর্তা তাকে মেয়ে এবং জামাইয়ের সাথে থাকার জন্য বোগোটায় পাঠিয়েছিলেন। তারা তাদের পাঁচটি প্রাকৃতিক সন্তানের পাশাপাশি মেরিনাকেও দত্তক নিয়েছিল। মেরিনা যখন তার কৈশোর বয়সে পৌঁছেছিল, তখন অন্য এক গৃহকর্মী আয়ার কাজের প্রস্তাব দিয়েছিল। মেরিনার সাথে পরিবারটি ১৯৭৭ সালে যুক্তরাজ্যের ইয়র্কশায়ার ব্র্যাডফোর্ডে চলে যায়, সেখানে সে থিতু হয়, বিবাহ করে এবং তার সন্তানও হয়েছিল। মেরিনা এবং তার ছোট মেয়ে ভেনেসা জেমস তাঁর যৌবনের অভিজ্ঞতা ‘দ্য গার্ল উইথ নো নেম’ নিয়ে একটি বই রচনা করেছিল।
উগান্ডার জন স্যাসেবুনিয়া (দ্য মঙ্কি বয়), বিগত শতাব্দীতে বাবা ও মাকে খুন করার পরে তিন বছর বয়সে ছিলেন বাড়ি থেকে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। যেখানে সে বানরদের সাথে থাকত। সে প্রায় ছয় বছর বয়সে ১৯৯১ সালে বন্দী হয়ে এক এতিমখানায় ছিল। সে যখন পরিষ্কার হয়ে গেল তখন দেখা গেল তাঁর পুরো শরীর চুলে ঢাকা ছিল। তার ডায়েটে মূলত শিকড়, বাদাম, মিষ্টি আলু এবং কাসাভা ছিল। বাঁদরের মতো হাঁটতে হাঁটতে ডাক দিত সে। তারপর জন কথা বলতে এবং মানুষের মত অন্য আচার আচরণও রপ্ত করেছে। সে খুব ভাল গান গাইতে পারত এবং আফ্রিকার শিশুদের কয়ারের সাথে দেশে দেশে গান ও ভ্রমণ করত।
ছবিঃ জুলিয়া ফুলারটন-ব্যাটেন
২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে উত্তরপ্রদেশের একটি জঙ্গল থেকে প্রায় ১০ বছরের একটি মেয়েকে উদ্ধার করা হয়। তার আচার আচরণে ধারণা করা হয়, জন্মের পর থেকে সে জঙ্গলে বানরদের সঙ্গেই বড় হয়েছে। ফলে তার আচরণও বদলে গেছে। সে বানরের মতো আওয়াজ করতো। এমনকি তার হাঁটা-চলাও ছিলো চার হাত-পায়ে। প্রথমে স্থানীয় কয়েকজন গ্রামবাসী বরাইচে কাটরানিয়াঘাট অরণ্যে কাঠ কাটতে গিয়ে একটি দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে যান। একটি বছর দশেকের মেয়েকে ঘিরে রয়েছে এক দল বানর। সম্পূর্ণ নগ্ন, বড় বড় চুল, অনেকটা পশুর মতোই দেখতে লাগছিল মেয়েটিকে। সে নির্বিকারে ওই বানরের দলের সঙ্গে হুপহাপ করে কথা বলছে! গভীর অরণ্যে এ রকম অবস্থায় একটি বাচ্চা মেয়েকে দেখে সবাই অবাক এবং বানরগুলোর কাছ থেকে তারা মেয়েটিকে উদ্ধারের চেষ্টা করতেই বানরগুলো তেড়ে আসে তাদের দিকে। কয়েকজনকে আক্রমণও করে। মেয়েটিকে আনতে গিয়ে বানরের তাড়া খেয়ে কয়েকবার ফিরে আসে গ্রামবাসীরা।
অবশেষে গ্রামবাসী স্থানীয় থানায় বিষয়টি জানালে, পুলিশের একটি দল মেয়েটির খোঁজে বের হলেও ফিরে আসে তারা। এক দিন পুলিশের ১০০ সদস্যের একটি টহলরত গাড়ি কাটরানিয়াঘাট অরণ্যের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশকর্মীরা মেয়েটিকে বানরের দলের সঙ্গে দেখতে পায়। মেয়েটিকে বানরের দলের কাছ থেকে কোনো রকমে উদ্ধার করে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র নিয়ে যাওয়া হয়। এক পুলিশকর্মী জানান, মেয়েটিকে আনার সময় বানরের দল গাড়ির পেছন পেছন তাড়া করে। মেয়েটির গায়ে ও হাতে ক্ষত ছিল। মনে হচ্ছিল অনেক দিন খেতে পায়নি। হাসপাতালেও সে চার হাত-পায়ে হাঁটছিল। খেতে চাইছিল না। নখ, চুল বিশাল বড় হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটি কথা বলে না, শুধু আওয়াজ করতে পারে। পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়ায় মেয়েটিকে একটি আশ্রয় কেন্দ্রে রাখা হয়।
পোষ্যপ্রাণী
কয়েক হাজার বছর ধরে বিভিন্ন পশুপাখি পোষ মানিয়ে আসছে মানুষ। ‘পোষ মানা’র গুণ ছাড়াও আরও কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে এদের। পোষা প্রাণীদের লেজ তাদের বুনো পূর্বপুরুষদের লেজের চেয়ে বেশি বাঁকানো। এছাড়াও পোষা প্রাণীদের চোয়াল ও দাঁত তুলনামূলক ছোট, এদের পশম বেশিরভাগ সময়ই সাদা হয় এবং পোষা প্রাণীরা বাচ্চার জন্মও দেয় বেশি। ধারণা করা হয়, পোষ মানানোর জন্য মানুষ এমন প্রাণী বেছে নেয় যেগুলোর অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি সুগঠিত নয়। ‘পালাবো? নাকি লড়াই করব?’—এই সিদ্ধান্ত আসে অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি থেকে। ছোট অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিওয়ালা প্রাণীরা একটু কম হিংস্র হয়। বনে-জঙ্গলে থাকলে নানা ধরনের বিপদ থেকে বাঁচার জন্য বিস্তর শারীরিক শক্তি যেমন খাটাতে হয়, তেমনি খাটাতে হয় বুদ্ধিও। অন্যদিকে, পোষ্যদের যেহেতু এত বিপদ-আপদ থাকে না, তাই এই বেঁচে যাওয়া শক্তি এরা শরীর ও বংশবৃদ্ধিতে ব্যয় করে। এ কারণেই পোষা প্রাণীরা আকারে তুলনামূলক বড় হয় এবং বাচ্চার জন্ম দেয় বেশি। লোকালয় সন্নিহিত জঙ্গলে যে সব প্রাণীরা বাস করে তাদের মনে মানুষের প্রতি ভয়ডর থাকে না। খাবার সংগ্রহের জন্য এদেরকে মানবভীতি জয় করতে হয়েছে। এর ফলে পরিবর্তন এসেছে এই প্রাণীগুলোর শারীরিক গঠন এবং স্বভাব-চরিত্রে।
ক্রমশঃ
আগের পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকে