“ট্রাপিজের খেলা”- ভাবার গদ্য

পরিচিতিঃ পূর্ব বর্ধমানের প্রত্যন্ত গাঁয়ের ধুলোমাটিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর। পায়ের তলার সরষেকে গড়িয়ে যেতে না দিয়ে জোর করে পিষে ফেলে ঘরে আটকে থাকা। কলমের কাছে মুক্তি চেয়ে নিয়েছিলেন। প্রকাশিত কবিতার বই কয়েকটি। একটি গদ্যের। এখন গদ্য দ্বিতীয় প্রেম।

ট্রাপিজের খেলা

কৃ ষ্ণা   মা লি ক

পাঁক-লালায় পিচ্ছিল হয়ে আছে জায়গাটা। প্লাসেন্টার পর প্লাসেন্টা জমছে। শূয়োরীর প্রসব বেদনার চিৎকারে চমকে যাচ্ছে মর্মদেশ। ভয়াল সেই আর্তনাদ। শুনলে বোবায় পায়, অথচ আতঙ্ক লাগে। পিচ্ছিল খন্দমতো জায়গাটির কিনারা ঘেঁষে শুয়োরী পড়ে আছে। বাচ্চাগুলোর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণাকাতর সে, করুণাপ্রার্থী চেহারা। বাচ্চাগুলোর যন্ন্তুত্রণাও কম নয়। ভয়ঙ্কর লাগে তাদের, কিন্তু তা কয়েক মুহূর্তের জন্যই।
বাচ্চাগুলো জন্মাচ্ছে আর সড়াৎ সড়াৎ চলে যাচ্ছে খন্দের মধ্যে। “গা চেটে পরিষ্কার করার আগেই মায়ের নাগাল ছাড়া” – বললো প্রথম দর্শক।
দ্বিতীয় দর্শক মন্তব্য করলো, “মায়ের দুধ না, শালুকের ডাঁটা না, ঘাস-পাতা না। তারা এসব কিছুই খাচ্ছে না, বা পাচ্ছে না। – পাওয়াটা নির্ঘাত আগে প্রয়োজন। এটা তো মানতেই হবে।’
প্রথম দর্শক কথাটা স্বীকার করে নেয় এবং মূল্যবান একটি বক্তব্য রাখে , “বিরিয়ানী না পেলে ডাঁটা চচ্চড়ি। তা-ও না পেলে পিঁপড়ের ডিম। হ্যাঁ, শখ বলে একটা ব্যাপার আছে ঠিকই।”
“ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখটাকার স্বপ্ন দেখার হক মানুষের আছে বইকি!”


       “স্বপ্ন একমাত্র মানুষই দেখতে পারে।শুয়োর নিশ্চয় তা পারে না। আমি হলফ করে বলতে পারি। তবে মানুষকে আগে কাঁথাটা সংগ্রহ করতে হবে।”
দুই দর্শকের মধ্যে কথার চাপান-উতোর চলতে থাকে। তারা আরও কিছুটা এগিয়ে গেলে দেখতে পায় অন্য দৃশ্য। মায়ের কাছ থেকে, মায়ের নাড়ি ছিঁড়ে জল রক্ত আর গর্ভফুলসহ বাচ্চাগুলো যেখানে যাচ্ছে সেখানে আছে শুধু মুদ্রা। তার যথেষ্ট ওম আছে। তাতেই শুয়োরের বাচ্চাগুলো নাক দিয়ে ঘোঁৎ ঘোঁৎ শুঁকে তার উপর বসছে চেপে, মায়ের কোল ভেবেই হয়তো। বাচ্চাগুলো খিদে নিয়ে জন্মায় বটে! মায়ের স্তনের বোঁটা খুঁজবে কি, মুদ্রার তাপের বড় আরাম। ব্যাদানে গিলে নিচ্ছে কোঁৎ করে। আর ফুলে জয়ঢাক সঙ্গে সঙ্গে। গায়ে-গতরে একেবারে মস্ত চেহারা – যেন কমপ্লান বয়। অনেক বেশি পুষ্টি নিয়ে, অনেক টেঁপি-খেঁদি-ফুটোদের ছাড়িয়ে অতিরিক্ত কয়েক সেন্টিমিটার বেড়ে যাওয়ার বিজ্ঞাপন। এক্ষেত্রে সেটিমিটারের হিসেব নয়, একেবারে মাসলম্যান। এবার উঠে আসছে গর্ত থেকে। বিরাট কালো, আঁশটে গন্ধ। হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। মা পড়েছিল একইভাবে। সে মরলো কি বাঁচলো তাতে কিছু যায় আসে না।
কিনারার ধার দিয়ে হেঁটে চলেছে শুয়োরে মানুষে। গর্তের ভিতর অশেষ মুদ্রা। দ্বিতীয় দর্শক প্রথম দর্শককে জিগ্যেস করলো,”ব্যোম ভোলা শিবের গাজন দেখেছ তো? মানত করা সন্ন্যাসীর বাড়ির মেয়েরা ডালা ধরে রাখে?” গর্তের বাইরের দিকে ইঙ্গিত করলে দেখা গেলো দালালেরা ডালা ধরে রাখার মতো ডানা ধরে আছে দু-হাতে। দালালদের কাছ থেকে পাওয়া ডানা লাগিয়ে উঠে আসছে মুদ্রাখেকোরা। কিনারা দিয়ে হাঁটার সময় খন্দ মাধ্যাকর্ষণ পাঠাচ্ছে। টাল সামলানোটাই একটা ব্যাপার।ট্রাপিজের ওস্তাদ ওধারের শুকনো ডাঙা থেকে লাফিয়ে উঠলো খেলা দেখাতে। কত বড়ো ওস্তাদ তুমি সেটাই দেখার।
হাততালি দিয়ে উঠলো দর্শকেরা।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *