স্মৃতির সাম্পানে কবি/সম্পাদকঃ শ ম্ভু র ক্ষি ত-স্বয়ম্ভু রক্ষিত

কবি অলক জানা প্রসঙ্গে না হয় অন্য কোনও দিন লেখা যাবে।আজ বরং পাতাটুকু থাক আমাদের প্রিয় কবি, সম্পাদক শম্ভু রক্ষিতের জন্য।যাঁকে কম বেশি অনেকেই চিনেছেন জেনেছেন নিজের মত করে।আজ তাই কবি অলক জানার স্মৃতির পাতায় সেই প্রিয় মানুষটি। শম্ভুদা।যেখানেই থাকুন উনি ভাল থাকুন।
জন্ম ১৬ আগস্ট ১৯৪৮, হাওড়া শহরে। শিক্ষা মেদিনীপুর ও হাওড়া স্কুল-কলেজে। ১৯৬৪-তে প্রথম মুদ্রিত কবিতা স্কুল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। ১৯৬৮-তে হাংরি। জেনারেশন আন্দোলনে যুক্ত হলে, কবিকে আত্মদর্শনের সুযোগ করে দেয়। ১৯৭০-এ তার সম্পাদিত কবিতার ত্রৈমাসিক। মহাপৃথিবীর প্রথম আত্নপ্রকাশ। ১৯৭৩-এ দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না কাব্যগ্রন্থের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ জুন জরুরি অবস্থা। জারি হলে চালু হয়েছিল সেন্সরশিপ । আইন। এই সময় কলকাতা’ পত্রিকার যে যা রাজনীতি সংখ্যা প্রকাশিত হয়, তার সহ-সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৫-তে ‘রাজনীতি’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায় বাংলা ভাষায় নতুন এক রাজনৈতিক কাব্যগ্রন্থ। ১৯৭৬-এ টানা ২১ দিন জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে পাঠানো হয় প্রেসিডেন্সি জেলে। কারারুদ্ধ ছমাস। ২০০৪-এ ৪০জন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পীর সম্মান ও ২০১২-তে মহাপৃথিবী সম্পাদনা-কর্মের জন্য পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি-মধুপর্ণী’ পুরস্কার পান।
প্রয়াণঃ ২৯শে মে ২০২০

এক পৃথিবী কবিতা,

তবেই না মহাপৃথিবী

অ ল ক জা না

প্রথম লিখতে এসে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার কবিতার ইতিবৃত্ত যৎকিঞ্চিত হলেও জানাটা খুব জরুরি মনে হল। তাই প্রথম প্রথম দূর থেকে দেখা এবং পরে আলাপচারীতায় কাছাকাছি পৌঁছানো আমার একধরণের স্বভাবও বলা যায়। সেই ইতিহাসের প্রারম্ভিক কয়েকজন কবির মধ্যে কবি শম্ভু রক্ষিতের সঙ্গে পরিচয় নতুন এক দিগন্তস্বরূপ।
তারপর শম্ভুদা সম্পাদিত মহাপৃথিবী পত্রিকায় লেখা পাঠানো ব্যাপারটাও বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বময়। কারণ ভয় এই ভেবে, মহাপৃথিবী পত্রিকায় লেখার জন্য নিজেকে মোটকথা তৈরি করতে হয়। নচেৎ একটা কিছু লিখে ফেললাম আর তড়িৎ গতিতে পাঠিয়ে দিলাম ছাপাও হলো, তেমন কাগজ মহাপৃথিবী নয় বলেই ধীরে ধীরে সম্পাদক শম্ভুদার প্রতিও শ্রদ্ধা অনেকটাই বেড়ে গেল। এটা বুঝতে বেশি সময় লাগল না যে মহাপৃথিবী কবিতা বেছে এবং ছেঁকে নেয়।

হরপ্রসাদদা কবি হরপ্রসাদ সাউ-এর বৈকালিক ঘরোয়া কবি সম্মেলনে প্রথম কবি শম্ভুদার পা ছুঁয়ে প্রণাম। তারপর কবি তমালিকা পণ্ডাশেঠ প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত আপনজন পত্রিকায় কাজের সুবাদে তাঁর নিকটে পৌঁছানো। অনেকটা সময় তাঁর সান্নিধ্যে আসা সত্যিই প্রাণিত করেছিল। আজ হঠাৎই তাঁর প্রয়াণে ইন্দ্রপতনের শূন্যতা সর্বাধিক অনুভব করছি। সেই আটপৌরে অনাড়ম্বর ময়লা ঢিলেঢালা সুট জামা, হাঁটু অবধি ধুলোর আশ্রয় বড় মায়াবী লাগত। সেই সঙ্গে প্রায়শই ক্ষেত্রে দেখেছি শম্ভুদা ফুলহাতা জামার হাতার বোতাম খুলেই রেখেছেন। খাওয়ার সময় জবুথুবু কুনুই পর্যন্ত গুটিয়েই খেতে বসে যেতেন কোনরকম হাতে একটু জল নিয়েই। আবার চেয়ারে দু-পা তুলে বসার কায়দাও ছিল বেশ আকর্ষণীয়। শুধু তাই নয় ভাতের সঙ্গে সবজি কিংবা মাছ-মাংস বিস্তৃত তালুর ভঙ্গিতে মেখে তবেই মুখে তুলতেন। এক টেবিলেই নৈশভোজে বসেছি আশিস মিশ্র কমল বিষয়ী দেবাশিস প্রধান হাঁকরে শম্ভুদার অভিনব খাদ্য গ্রহণ দেখতাম।

কবি ও সম্পাদকঃশম্ভু রক্ষিত তাঁর স্বমেজাজে

শম্ভুদা আপনজনে আজ আসবেন এবং রাতে থাকবেন এটাই আমাদের কাছে এক অপার আনন্দ সঞ্জীবনীর মতো ছিল। কারণ মহাপৃথিবীর কবির অনুজ্জ্বল ধূসর চেহারায় এক অনবদ্য মায়া জড়ানো থাকতো। মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি উসকোখুসকো মাথার চুল গলায় ঝোলা ব্যাগ সব মিলিয়ে কবিতার যথার্থ ঋষি। আপ্লুত না হয়ে উপায় ছিল না। কয়েকবার শম্ভুদার সঙ্গে একত্র রাত কাটানোর সৌভাগ্যও হয়েছিল। শীতের রাত। বাইরে হিমশীতল শিশির আর উত্তরের হাওয়ায় থরহরি কম্পমান। হঠাৎ মধ্যরাতে দেখি শম্ভুদা আঢাকা শরীর নিয়ে বিছানায় বসে কি সব অস্ফুট ভাষায় বলে চলেছেন। কারণ জানতে চাইলে বললেন : কত আর ঘুমোই বল্। এ কথার মানে মধ্যরাতে না খুঁজলেও পরে জানলাম, কোনকিছু না করাও যে ঘুমের পর্যায়ে পড়ে সেটাই বলতে চেয়েছিলেন। তো তিনি কবিতার জ্বরে মধ্যরাতেও জেগে আছেন।

শম্ভুদার সঙ্গে কয়েকবার মদ খাওয়ার অভিনবত্ব বেশ মনে পড়ে।—– জানিস মদ ঠকায় না, বলেই হাতে মুখে মেখে নিচ্ছেন। তারপর গ্লাস গলায় ঢাললেন। জানতে চাইলে বললেন, গায়ের ব্যথা সারালাম। কত কথা কত স্মৃতি। সত্যিই না ভোলারই সম্পদ। কবিতা কয়েকবার চেয়েই নিয়েছেন। ছাপাও হয়েছে। আনন্দ পেয়েছি হাতে পত্রিকা পেয়ে। কিন্তু সরল সাদাসিধে এই মিতভাষী মানুষটি কখনো নিজের দৈন্যতার কথা বলেননি। কেবল কবিতার কথা, কবিতার ইতিহাসের কথা বলতেন। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে যেতাম তাঁর স্মৃতির নানার চড়াই উৎরাই। বিশেষত হাংরি আন্দোলনের কথা। রাত জেগে শাসক বিরোধী লেখা প্রস্তুত ও প্রকাশের নানান অভিজ্ঞতা এখনো মনে পড়লে শিহরিত হতে হয় বৈকি।

শম্ভুদা কবিতার সন্ন্যাসী। সংসার পরিবার জানিনা কতখানি মনে রাখতেন যতখানি কবিতার জন্য ত্যাগ তিতিক্ষা ঢেলেছেন। চুপিচুপি গুটিপায়ে তাঁর চলন কবিতায় সেই অবস্থান কিন্তু বিপরীতধর্মী। কারণ বাস্তব পরাবাস্তব ম্যাজিক কল্পবিজ্ঞানের নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা তাঁর কবিতার প্রাণবায়ু। জীবনানন্দ শক্তি বিনয়ের মতোই কবিতায় তাঁর স্বকীয় উচ্চারণ। বাংলাভাষার মানুষদের কবিতার নতুন দিশার সাক্ষর রেখেছেন বলে আমার মতো অনেকেই এ কথা স্বীকার করেন। মুস্কিল অন্য জায়গায়। সংস্কৃতি জগৎ আসলে পরশ্রীকারকতায় আক্রান্ত। তাই হয়ত এমন শক্তিশালী কবির বরাতে বড় সম্মান আসেনি। সময় সব কিছুর সঠিক ও যথার্থ মূল্যায়ন করে। তবে প্রিয়ধ্বনির জন্য যে কান্না নিয়ে মহাপৃথিবীর কবি চির অস্তাচলে গেলেন তাঁর যোগ্য পুরষ্কার তিনি পাবেন বলেই আমার স্থির বিশ্বাস।

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *