আ কা শ নে রু দা-র তিনটি গদ্য
হাসি
‘হাসি ছাড়া জীবন বৃথা!’ আমার কথা নয়। নাকের নিচে এক ইঞ্চি মোচ ঝুলিয়ে রাখা চার্লি চ্যাপলিন বলে গিয়েছেন।
‘হাসি জীবনকে অবসাদ মুক্ত করে তোলে!’ এটাও আমার কথা নয়। নিজে সারা জীবন ছবিতে গম্ভীর মুখে বসে থাকতে থাকতে আইনস্টাইন বলে গিয়েছেন।
‘হাসি মানুষের সরলতার প্রতীক!’ এটাও আমার ঝুলি থেকে নয়। তীরের মতো ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকা মার্ক টোয়েনের কথা ঝেঁপে দিলাম।
ঝাঁপ মারতে মারতে আসল কথা থেকে সরে আসতে চাই না। তা এই হাসি নিয়ে এত কোটেশন উল্লেখ করার পশ্চাদে একটাই কারণ। হাসুন , হাসুন এবং হাসুন। জীবনে ব্যর্থতা, অপ্রাপ্তি, সমস্যা, সব ভুলে শুধু একটু হাসুন। ক্ষুদিরাম হাসতে হাসতে গলায় ফাঁসি পরেছিলেন। মৃত্যু ভয় তাকে বিচলিত করেনি। মৃত্যুর আগেও সে হাসতে হাসতে গলায় ফাঁসি পরেছিলেন! আপনি তো আর সেই পরিস্থিতিতে নেই। আপনার গলার সামনে ফাঁসির দড়ি আর এক পাশে কালো কিম্ভুতকিমাকার জল্লাদ দাঁড়িয়ে নেই। তাই হাসি থেকে বিরত থাকার আপনার কোনো পর্যাপ্ত কারণ নেই।
কারণ নেই বলে আপনি হাসুন। তবে লক্ষ্য রাখবেন, হাসিটা যেন অসংলগ্ন না হয়। অসংলগ্ন হয়ে পড়লে সেই হাসি আপনাকে পাগলের তকমা দিয়ে দিতে পারে। তাই জীবনে হাসির কারণের সংযোগ ঘটলেই আপনি গলা খুলে হাসুন। ডাক্তার বাবুরা বলেন, হাসলে মুখের মাংস পেশী মজবুত হয়। শরীরে উত্সাহবর্ধক হরমোনের উত্পত্তি হয়।
লক্ষ্য রাখবেন হাসির জন্য অন্যকে আপনার হাসির উপাদান বানিয়ে ফেলবেন না। আনন্দ প্রাপ্তির জন্য দিশেহারা হয়ে হাসবেন না। লক্ষ্য রাখবেন অন্যের কষ্ট যেন আপনার হাসির উৎস না হয়ে ওঠে I বরং আপনার হাসি যেন অন্যের সুখের মুহূর্ত হয়ে ওঠে। আপনার হাসির কারণে কাউকে যেন কাঁদতে না হয় সে বিষয়ে খেয়াল রেখে হাসুন।
হাসুন , হাসুন আর হাসুন। হাসতে ভুলে গেলে চলবে না। হাসতে হাসতে জীবন পার করে ফেলুন। আপনাকে সুস্থ রাখতে লাল কৌপনী পরে রামদেব বাবা যোগ চর্চার শেষ এক্সারসাইজে হাসবার ড্রিল ফলো করেন। আপনি যোগ বিয়োগ এর মধ্যে যেতে যদি নাও চান তবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখ দেখুন। দেখবেন নিজের মুখ নিজে দেখেই অজান্তে হেসে ফেলছেন। ছোট বেলায় হাসির ফোয়ারার ঘরে ঢুকে বিভিন্ন লেন্সের সামনে নিজের চ্যাপ্টা মুখ দেখে যেমন হাসতেন ঠিক সেইভাবেই মাঝে মাঝে নিজের মধ্যে নিজেকে শিশুর মতো দেখুন। নিজের ভেতরে শৈশবকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেই হাসিটা আপনার বারবার ফিরে আসবে। দেখবেন আপনি তখন কাউকে বকতে গেলেও হাসবেন। কেউ আপনাকে বকলেও আপনি তখন হেসে পাশ কাটিয়ে চলে যাবেন।
জীবনে এই হাসি বাঁচিয়ে রাখতে চাইলে আপনাকে মাঝে মাঝে অন্যমনস্কও হতে হবে I শিশু মন অন্যমনস্ক হয় বলেই শিশুরা ঘুমের মধ্যেও হাসতে থাকে। আর পরিণত বয়েসে আপনি যদি অন্যমনস্ক হয়ে পাঁচ কিলো আলু আর দুই কিলো পেয়াজের পরিবর্তে পাঁচ কিলো পেয়াজ আর দুই কিলো আলু কিনে নিয়ে ঘরে ঢুকে ঝাড় খেয়েও হেসে ফেলেন তবে জানবেন আপনি সঠিকভাবে বেঁচে আছেন। হাসি যদি গুল হয়ে যায় তবে সেই জীবন টিউবলাইট হয়ে যাবে। তাই হাসুন , হাসুন আর হাসুন। বত্রিশ পাটি দাঁত বার করে হাসুন। খুলকর হাসিয়ে। যদি আপনি পুরুষ হন তবে হাঃ হাঃ হাঃ অথবা মহিলা হলে মিহি গলায় হিঃ হিঃ হিঃ করে হেসে জীবনকে উপভোগ করুন। যেমন ভাবেই হোক না কেন আপনাকে শুধু এটাই মনে রাখতে হবে এই জীবনটা ব্যাজার মুখে পার করা চলবে না। হাসতে হাসতে জীবনের চড়াই উৎরাই পার করতে হবে। যদি আপনার ডাক শুনে কেউ নাও আসে তবুও হাসতে হাসতে একলা এগিয়ে চলুন। দেখবেন জীবনটা অনেক সহজ সরল হয়ে গিয়েছে।
মনে রাখবেন জীবন বড়ো অনিশ্চিত। হাসতে হাসতে জীবন পার না করে চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো মুখ করে কতদিন বাঁচবেন? গম্ভীর বাবুর মতো জীবন কাটিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে এলুমিনিয়ামের তেবড়ানো বাটির মতো মুখ করে শুয়ে থাকবেন না কি?
খোয়াথং …মনিপুর …২৭/১০/২০২২
অ্যাগোরাফোবিয়া
‘ইটস এ কেস অফ মেন্টাল ডিসঅর্ডার!’ নয় বছরের ঐশীকে চেম্বার থেকে বার করে টেবিলের উপরে ঝুঁকে স্নিগ্ধা আর সৌহার্দ’র দিকে তাকিয়ে কথাটা বললেন সাইক্রিয়াটিক ডক্টর আকাশ নেরুদা।
‘মানে!’ স্নিগ্ধা উদ্বেগের সুরে জিজ্ঞেস করলেন!
‘মানে আপনাদের মেয়ে যে সারাক্ষণ একটা পুতুলের সাথে নিজের মনে নিজেই কথা বলে সেটা একটা মানসিক রোগ! আপনাদের ফ্যামেলি ডিটেলস থেকে জানতে পেরেছি যে আপনারা দুজনেই আইটি সেক্টরে। ঐশী ছাড়া আর কোনো ইস্যু নেই! আপনারাও সারাদিন ওর জন্য সময় দিতে পারেন না। আর এই জায়গা থেকেই ও দিনে দিনে ইন্ট্রোভার্ট হয়ে গিয়েছে। নিঃসঙ্গতা কাটাতে ও পুতুলের মধ্যেই মনের মানুষ খুঁজে নিয়েছে!’
সৌহার্দ একটা ঢোক গিলে ভাঙ্গা গলায় বলে উঠলেন, ‘তাহলে এর চিকিৎসা কীভাবে হবে!’
‘দেখুন , এর জন্য স্পেসিফিক কোনো ট্রিটমেন্ট নেই। ওর জন্য আপনাদের সময় দিতে হবে। পারলে মেডিটেশন করান। ট্রাই টু গ্রো হার গুড হ্যাবিট! নিয়মিত আউট ডোর গেমের প্রতি ওর রুচি বাড়ান! আশা করি ধীরে ধীরে আপনাদের মেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে!’
স্নিগ্ধা আর সৌহার্দ দুজন দুজনের দিকে তাকালেন। ডক্টরের ফিস দিয়ে চেম্বার থেকে বার হয়ে ঐশীকে আদর করতে করতে সৌহার্দ বলে উঠলেন, ‘চলো বাবু, আজ আমরা সবাই মিলে জগদ্ধাত্রী পুজোর মেলা ঘুরতে যাই!’
চেম্বার থেকে স্নিগ্ধা আর সৌহার্দ বার হয়ে যেতেই ডক্টর আকাশের এসিস্ট্যান্ট সুমন বলে উঠলেন, ‘সত্যি স্যার আজকাল বাচ্চারা যে কিভাবে মানসিক অবসাদে চলে যাচ্ছে!’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিগারেট ধরাতে ধরাতে আকাশ বলে উঠলেন, ‘সবই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির কুপ্রভাব! মানুষের এই একা হয়ে যাওয়া নিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা পড়েছ?’
‘কোন কবিতা স্যার!’
‘ওই যে , মানুষ বড়ো একা হয়ে যাচ্ছে!’
খোয়াথং …মনিপুর …
কালো হাত
‘শোষকের কালো হাত ভেঙ্গে দাও গুঁড়িয়ে দাও’ সত্তরের দশকের পরিচিত এই শ্লোগান হামেশাই রাস্তা ঘাটে শুনতে পেতাম। ধুতি পাঞ্জাবি আর কালো কার্বন ফ্রেমের চশমা পরে সেইসব লোকেরা সে কী ভীষণ উদ্দীপনায় এইসব শ্লোগান তুলে তুলে পাড়ার রাস্তায় রাস্তায় মহড়া দিত। শুনেছিলাম এইসব শ্লোগানের আমদানি হয়েছিল সোভিয়েত রাশিয়া, ভিয়েতনাম আর গণপ্রজাতন্ত্রী চীন থেকে। তারপরে একদিন সেই হাত কালো থেকে সাদা হয়ে গেল। সাদা হয়ে গেলেও সেই হাতে এসে পড়ল ক্ষমতাI ক্ষমতার চাপে হাতের উপরের আলো আড়ালে চলে যেতে থাকলোI কালোয় ভর্তি কালো হাতI সেই কালো হাত কিছুতেই আর সাদা হয়ে উঠতে পারছে নাI শোষকের মুখ পাল্টেছে শুধুI কিন্তু হাতগুলো একে অপরের সাথে করমর্দন করে করে কালোর ছোঁয়াচে রোগ লাগিয়ে ফেলেছেI
রোগ লাগিয়ে যেসব হাত কালো রোগগ্রস্ত হয়ে উঠেছে সেইসব হাতের মালিকরা তাদের কালো হাত সারা মুখে শরীরে ঘষে ঘষে সর্বাঙ্গ কালো করে তুলেছে I এই কালো হাতের কালো স্পর্শে দেখা দিল আবার সংকট I জাতির সংকট I সভ্যতার সংকট I ঠিক যেন মেঘের যাওয়া আসা I অবশ্য এই সংকট সত্যদ্রষ্টা কবি ঠাকুর অনেক আগেই দেখে ফেলেছিলেন I লিখে ফেলেছিলেন তাঁর সর্বশেষ প্রবন্ধ ‘সভ্যতার সংকট !’ যদিও বহু যুগ আগে থেকেই দেশে বিদেশে এই কালো হাতের বিস্তার ছিল I এই কালো হাতের মালিকেরা নানা রকম পন্থায় একেকটা দেশের জাতিকে ধ্বংস করতে থাকে I কিন্তু সেই সময়ের মানুষেরা ছিলেন প্রতিবাদী , অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে তাঁরা রাস্তায় নামতেন I আঠারো শতাব্দীর মধ্যভাগে চীনের অহিফেন যুদ্ধ যদি তার উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকে তবে পনেরো শতাব্দীর মধ্যভাগে পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে কর্ণাটকের রানী অবাক্কা’র বিদ্রোহ জ্বলন্ত উদাহরণ I
উদাহরণ থেকে উত্সারিত আগুন প্রবাহিত হতে থাকে সভ্যতার ইতিহাসের পাতায় পাতায় I বড়ো সংকট ছেয়ে আসলে মানুষ রাস্তায় নামে I মানুষ নামে রাস্তায় I কিন্তু সেই রাস্তাও এখন আর সুপ্রশস্ত নয় আর মানুষও আর সেই প্রতিবাদী মানুষ নেই I একবিংশ শতাব্দিতে পুঁজিবাদীদের ভ্রষ্টাচার , জাতিবাদ , সংরক্ষণ নীতি সেই কালো হাতের স্পর্শে ফুলে ফেঁপে ওঠা সব থেকে বড়ো সংকট হিসেবে মেনে নিলেও সেই সংকটের বিরুদ্ধে বিরোধিতা করতে থাকা মুষ্টিবদ্ধ হাতগুলো সময়ের অন্তরালে কালো হাতের সাথে আপোষ সেরে আবার হয়ে ওঠে কালো হাত I
‘কালো হাত নিপাত যাক ! কালো হাতের মালিকেরা নিপাত যাক ! শোষকের কালো হাত ভেঙ্গে দাও গুঁড়িয়ে দাও !’ শ্লোগানগুলো এখন আর শোনা যায় না I এখন অল্প বিস্তর সবার হাতই যে হয়ে উঠেছে কালো ! ‘ অধর্মেণৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি ’ শ্লোকের সত্যতা কি তবে উপনিষদের পাতায় মুখ লুকিয়ে থাকবে ! না কি এই উক্তির সত্যতা আরও একবার প্রমাণিত হবে ? অচিরেই কি কালের নিয়মে ধুয়ে মুছে যাবে হৈহল্লা করতে থাকা কালো হাতের মালিকেরা !
খোয়াথং …মনিপুর ...০৭/১১/২০২২