কেন্দুয়াঃঃএকটি পরিযায়ী সম্পর্কের কাহিনীঃঃলেখা ও ছবিঃ রাকেশ সিংহ দেব

                     কেন্দুয়া
      একটি পরিযায়ী সম্পর্কের কাহিনী

লেখা ও ছবিঃ  রাকেশ সিংহ দেব

                                            

প্রকৃতি প্রেমের আরেক নাম।ভালোবাসার কোনও বাটখারা হয় না তা লেখকের সাথে না যাপন করলে বোঝা বড্ড দায়।মূলত রাকেশ একজন ছবিওয়ালা।আর তার চর্চার আধার সেই সব অবলা জীবজন্তু পশু পাখি।নিয়মিত লেখেন বিভিন্ন বানিজ্যিক পত্রিকায়।এই মুহূর্তে কাজ করছেন হাতি নিয়ে।বিভিন্ন “পরিবেশ বাঁচাও” সংস্থার সাথে জড়িয়ে ফেলেও তিনি নিরঙ্কুশ।একক।তিনি জানেন ভালোবাসতে ফেরৎ পেতে নয়।ইনি বাইফোকালিজমেরও অন্যতম সদস্য।


জ্যৈষ্ঠের শেষ পর্যায়ের প্রখর দাবদাহে ঝলসে যাচ্ছে চতুর্দিক। পশ্চিম মেদিনীপুর (তখন অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা) জেলার ঝাড়গ্রাম মহকুমার অন্তর্গত এক প্রান্তিক গ্রাম কেন্দুয়ায় উঠেছে ত্রাহি রব। কাঠফাটা রোদ্দুরে শুকনো পুকুর-ডোবা আর ফুটিফাটা মাঠের উপর দিয়ে বয়ে চলছে গা জ্বলানো গরম বাতাস। দহন জ্বালায় অস্থির গ্রামের গুটিকয়ের মাহাতো পরিবারে চলছে প্রাচীন লোকাচার মতে শিব আরাধনার প্রস্তুতি। তাদের বিশ্বাস দেবাদিদেব মহাদেবের মাথায় জল ঢাললেই মিলবে মুক্তি। নিষ্ঠামনে জল তর্পন করলেই জলেশ্বরের কৃপায় ধরিত্রী পুনরায় হবে শ্যামলা সুফলা। সেইমত গ্রামের যতীন্দ্রনাথ মাহাতো এর পরিবার তাদের বাড়ির থানে আয়োজন করল শিবের মাথায় জল ঢালবার সমস্ত উপাচারের। পূজা চলাকালীন উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দুপুরের রৌদ্রজ্জ্বল সূর্যকে নিজেদের বিশাল ডানায় প্রায় আড়াল করে কোথা থেকে মাহাতদের উঠোনের তেঁতুল গাছে এসে বসলো গোটাকয়েক বিশালকায় অচিন পাখি। তাদের সরু গলা, লম্বা চওড়া ঠোঁট,সরু পা আর ধবধবে সাদা পালকের ডানার প্রান্তে যেন কালো রঙের পাড় লাগানো। এই ঘটনার কয়েকদিন পর পাল্টাতে থাকল আবহাওয়া । আকাশে দেখা দিল কালো মেঘের রাশি। অচিরেই সব ছাপিয়ে নামল মুষলধারে বৃষ্টি। মাঠ, ঘাট, খানাখন্দ ভরে উঠল নতুন বর্ষার জলে। মাঠে হিল্লোল তুলল মরসুমের প্রথম সবুজের স্রোত। গ্রামবাসীদের মনে ধারনা হল এরা শুধুমাত্র পাখি নয়, এরা দেবদূত। স্বর্গ থেকে তেনারা মর্তে নেমে আসেন তাদের সুখ দুখের খবর নিতে। সেই শুরু। যেভাবে গ্রাম বাংলায় বিশ্বাস, ভক্তি আর কল্পনার মেলবন্ধনে তৈরি হয় নতুন নতুন অলৌকিক কাহিনীমন্ডিত দৈব মহিমার গাথা, ঠিক সেভাবেই এই ঘটনা জন্ম দিল এক নতুন কাহিনীর। এই কাহিনী এক অব্যক্ত ভালোবাসার, মেলবন্ধনের। এই কাহিনী সম্পর্কের। এই সম্পর্ক মানুষের সাথে পাখির। সেই গল্পই শুনছিলাম স্বর্গীয় যতীন্দ্রনাথ মাহাতো এর ছেলে বিধানচন্দ্র মাহাতোর মুখে। এলাকার মানুষের বিশ্বাস এই পাখিদের পরিযায়ী ডানায় ভর দিয়ে মরসুমের শুরুতে এলাকায় আসে সৌভাগ্য আর সমৃদ্ধির উপহার। আর আজও পশ্চিম মেদিনীপুরের ঝাড়গ্রাম মহকুমার (খুব শিগগির ঝাড়গ্রাম আলাদা জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে।) অন্তর্গত কেন্দুয়া গ্রামে সেই পরম্পরা সমানে চলছে।  
ঝাড়গ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্র পাঁচমাথার মোড় থেকে চিল্কীগড় যাওয়ার পথে পড়ে কেন্দুয়া গ্রাম। কালো পিচরাস্তার বুক চিরে দুপাশে ঘন শালের জঙ্গল পেরিয়ে গ্রামে ঢুকলেই কানে আসবে অচেনা এক সম্মিলিত ক্যাকাফোনি! কখনও জোরে আবার কখনও ধীরে। শব্দের উৎস অনুধাবন করে সামনের দিকে কিছুদূর এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে রাস্তার ধারে ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছের ডালে ডালে হাজার হাজার পাখির মেলা। কেন্দুয়াতে পাখি নিয়েই ওঠাবসা এলাকার কিংবদন্তী পক্ষীপ্রেমিক স্বর্গীয় যতীন্দ্রনাথ মাহাতোর পরিবারের৷ বংশপরম্পরায় চলছে এই রীতি৷ ঝাড়গ্রাম মহকুমার জামবনি ব্লকের কেন্দুয়া গ্রামের মাহাতো পরিবারে পাখি সব করে রব বছরে ছ’মাস৷ সারস প্রজাতির এই পরিযায়ীদের জন্য মাহাতোদের যত্নের অন্ত নেই৷ ঝাড়গ্রাম শহর থেকে জামবনি যাওয়ার পিচরাস্তা ধরে প্রায় ৯ কিলোমিটার গেলেই পড়বে কেন্দুয়া গাঁ৷ বড় রাস্তার বাঁ দিকে যতীন্দ্রনাথ মাহাত’র মাটির দোতলা বাড়ি৷ 

                        যতীন্দ্রনাথ মাহাতোর পরিবার

 কেন্দুয়ার মাহাতো পরিবারের তেঁতুল গাছে প্রতিবছর ছয় সাত মাসের জন্য সংসার পাততে আসা পাখিদের দেখতে অনেকটা বকের মতো। তবে আকারে সাধারন বকের চেয়ে অনেক বড়। পাখির নাম শামুকখোল। এদের গায়ের রং ধূসর সাদা। তবে বাসা বাঁধার সময় শরীর একদম সাদা হয়ে যায়। লেজ ও পাখার শেষভাগ কালো রংয়ের ঠিক যেন সাদা কাপড়ের উপর কালো পাড়। দুদিক প্রসারিত অবস্থায় এদের পাখার দৈর্ঘ্য চুয়াল্লিশ সেন্টিমিটার থেকে একাশি সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। শামুকখোল পাখিরা ঝাঁক বেঁধে চলে। একেক ঝাঁকে প্রায় চল্লিশ থেকে ষাটটি পাখি থাকে। এরা সাধারনত জলাভূমির পাখি। নদী, নিচু বিল, অগভীর জলাভূমি, মিষ্টিজলের জলাশয়, হ্রদ, ধানক্ষেত ও উপকূলীয় বনে বড় বড় গাছের উপর এদের দেখা যায়। এদের দেহের সবচেয়ে আকর্ষণী অংশ হলো এদের ইয়াবড় ভারী ঠোঁট। প্রায় চৌদ্দ সেন্টিমিটার লম্বা দুই ঠোঁটের মাঝখানে থাকে ফাঁক। 

এরা শামুক খেতে খুব ভালবাসে। একটা শামুক পেলে এরা প্রথমে এদের জাঁতির মত ঠোঁট দিয়ে শামুকের শক্ত খোল ভাঙে; তারপর সেটা ওপরে তুলে আকাশের দিকে মুখ করে গিলে ফেলে। এদের এইরূপ শামুকপ্রীতির জন্য নাম হয়েছে শামুকখোল। তবে এরা শুধু শামুকই খায় না, এরা মাছ, কাঁকড়া, ছোট ব্যাঙ ইত্যাদিও খেয়ে থাকে।

এরা যেসব এলাকায় থাকে সেসব এলাকায় এরা নিজেদের বিরাট একটা কলোনী গড়ে তোলে। একেকটা বড় গাছে একটা করে ঝাঁক বাস করে। তবে গাছ যদি আরও বড় হয় তবে ঝাঁকও অনেক বড় হয়। কলোনীতে বাস করার কারণ হলো বচ্চাদের নিরাপত্তা। চিল, বাজ, কাক কিংবা মানুষ এদের ছানাদের ক্ষতি করতে এলে ঝাঁকবেধে তেড়ে আসে। বড় পাখিদের বাসাও বড় হয়। শামুকখোলের বাসাও প্রকাণ্ড। গাছের শুকনো ডাল, কঞ্চি ও লতাপাতার সমন্বয়ে বাসা তৈরি করে শামুকখোল পাখি। স্ত্রী ও পুরষ পাখি মিলে দশ-বারোদিন ধরে বাসা তৈরি করে। জুলাই-অগাস্ট মাসে তিন থেকে পাঁচটি ডিম পাড়ে । ডিম মুরগির ডিমের চেয়ে বড়। স্ত্রী-পুরুষ দুজন মিলে ডিমে তা দেয়। পঁচিশ দিন লাগে ডিম ফুটে ছানা বের হতে। ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ দিন বয়স হলে ছানারা উড়তে শেখে। ছানারা উড়তে শিখলে পরিযায়ীরা উড়ে যার তাদের অচিন ঠিকানায়। 


২০০০ সালে চিত্র পরিচালক সুপ্রিয় সেন ‘দ্য নেস্ট’ (The Nest) নামে একটি তথ্যচিত্র বানিয়েছিলেন কেন্দুয়ার কিংবদন্তী পক্ষীপ্রেমিক যতীন্দ্রনাথ মাহাতোকে নিয়ে৷ ৪৮তম জাতীয় পুরস্কারের তথ্যচিত্র তালিকায় একটি রজতকমল পুরস্কার পেয়েছিল সেই ছবি। কিন্ত্ত তার পরেও মাহাতো পরিবারের পাখি-গাথা চোখে পড়েনি প্রশাসনের৷ ওঁরা তাই নিজেরাই আবাহন করেন পাখিদের৷ ছ’মাসের সংসার সাজিয়ে দেন, যত্ন করেন, বিদায় দেন৷ পাখিদের যাওয়া-আসা, স্রোতে ভাসাকে ঘিরেই আবর্তন কেন্দুয়ার। ২০০৭ সালে বন্ধু পরিযায়ীদের ডানায় ভর করে পরলোক গমন করেন পশ্চিম মেদিনীপুরের কিংবদন্তী পক্ষীপ্রেমিক যতীন্দ্রনাথ মাহাতো। এরপর সংসার আর অতিথি পরিযায়ীদের ভার এসে পড়ে তাঁর ছেলে বিধানবাবুর কাঁধে। হাজার প্রতিকূলতা আর অভাব তুচ্ছ করে ছাপোষা কৃষিজীবী বিধানবাবু পাখিদের দেখভাল করেন। বিধানবাবুর সাথে কথাপ্রসঙ্গে জানতে পারি যুবক অবস্থায় তাঁর মনে একবার সন্দেহ হয়েছিল যে প্রতিবছর একই পাখি তাদের বাড়িতে আসে না অন্য অন্য পাখি আসে। এটা দেখবার জন্য একবার তিনি এক পাখির পালকে আলতা লাগিয়ে দেন। পরের মরসুমে তাকে অবাক করে দিয়ে গাছে হাজির হয় এক লাল ডানার পাখি। সেদিন থেকে মজবুত হয় বিশ্বাস এবং আরও গভীর হয় পাখিদের প্রতি মমত্ববোধ। জঙ্গলমহলের সাঁওতাল, লোধা, শবর উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে শিকার করা ও শিকারের মাংসে মোচ্ছব এক নৈমিত্তিক ব্যাপার। এমনই এক পটভূমিতে দাঁড়িয়ে প্রতি বছর তাদের বাড়িতে আসা পরিযায়ী পাখিদের শত অভাবের মাঝেও বুক দিয়ে আগলে রাখেন কেন্দুয়ার বিধানচন্দ্র মাহাতোর পরিবার। বাবা যতীন্দ্রনাথ মাহাতোর পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি স্বপ্ন দেখেন দিনবদলের। স্বপ্ন দেখেন সেই দিনের যেদিন এলাকার সব শিকারী রত্নাকরেরা বাল্মীকি হয়ে বুকে আগলে রাখবে প্রকৃতির ধন ভার। বিধানবাবু চান তাদের এলাকাটা যদি ভালোভাবে বেড়া দিয়ে ঘেরে দেওয়া যায় তাহলে চোরাশিকারিদের হাত থেকে পাখিদের রক্ষা করা যাবে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও সাধ্যের অভাব। কোনমতে বাঁশের বেড়া দিলেও কয়েকদিন পর নিশাচর চোরাশিকারিরা রাতের অন্ধকারে তা ভেঙ্গে দিয়ে যায়। পাখির মরসুমে প্রতিদিন বহু মানুষ আসেন ছবি তুলতে পাখি দেখতে। বর্তমানে ঝাড়গ্রাম সার্কিটের পর্যটনের উন্নতিকল্পে অনেক প্রকল্প গৃহীত হলেও এখনো অবহেলা আর অনাদরে পড়ে আছে কেন্দুয়ার পাখিরা। বহু আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও তা আজও ফলপ্রসু হয়নি। এই অবস্থা বদলাতে দরকার দ্রুত সদর্থক পদক্ষেপ ও সহযোগিতার। দারিদ্র্য, অভাব ও প্রতিকূল পরিস্থিতির মাঝেও ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় এই সংরক্ষণ আমাদের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এক অনন্য নজির!


পরিযায়ীদের দেখবার সেরা সময় :  বছরের মে মাসের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের প্রথমদিক পর্যন্ত । 
আবেদন : কোনও সহৃদয় ব্যক্তি বা সংস্থা যদি বিধানবাবুর এই মহৎ প্রচেষ্টায় তাঁর পাশে দাঁড়াতে চান বা কোনরূপ সাহায্য করতে চান তাঁরা বিধানবাবুর সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন। 
বিধানচন্দ্র মাহাতো – ৯৬০৯৪৭৫৬৯৯ । 
তথ্যসূত্র : ২০১৭ সালের মে মাসের এক দুপুরে বিধানবাবুর বাড়িতে ঝাড়গ্রামের শিক্ষকবন্ধু সাধুচরন মাহাতো দাদাকে সঙ্গে নিয়ে বিধানবাবুর সাথে আমার কথোপকথন ও আড্ডা। 

 যতীন্দ্রনাথ মাহাতো (বাঁ দিক থেকে প্রথমজন)ও পরিবারবর্গ


কিভাবে যাবেনঃ

                 কেন্দুয়া আসতে হলে প্রথমে সোজা চলে আসতে হবে ঝাড়গ্রাম। প্রতিদিন হাওড়া থেকে দক্ষিণ পূর্ব রেলের ট্রেন যাচ্ছে খড়গপুর হয়ে ঝাড়গ্রাম । চাইলে ধর্মতলা বাস টার্মিনাস থেকে বাসেও চলে আসা যায় ঝাড়গ্রাম। এছাড়া হাওড়া – মেদিনীপুর লোকাল ধরে মেদিনীপুর পৌঁছে বাসে চেপে (ভায়া ধেড়ুয়া) চলুন ঝাড়গ্রাম (দূরত্ব প্রায় ৪০ কিমি )। 
মূলত ঝাড়গ্রাম থেকে কেন্দুয়া যাওয়াই ভাল এবং সুবিধাজনক। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে কেন্দুয়ার দূরত্ব প্রায় ৯ কিলোমিটার। সারাদিনের জন্য গাড়ি ভাড়া করে ঝাড়গ্রাম আর চিল্কিগড়ের বিভিন্ন পর্যটন স্থানের সাথে দেখে নিতে পারেন কেন্দুয়ার পরিযায়ীদের। ঝাড়গ্রাম থেকে গিধনি জাম্বনি রুটের অনেক ট্রেকার কেন্দুয়ার উপর দিয়ে চিল্কিগড় যায়।
ঝাড়গ্রামে রাত্রিবাস করে পারিপার্শ্বিক জঙ্গলের পরিবেশকে আরও ভালোভাবে অনুভব করতে চাইলে শহর জুড়ে সরকারী ও বেসরকারী অনেক লজ রয়েছে।

                                    ★★★

                                                                  

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *