পান্তা ভাতের কাহিনী
লিখছেনঃ সু ক ন্যা দ ত্ত
“পান্তা ভাত” শব্দটা শুনলে প্রথমেই অনেক বাঙালির জিভে জল আসে। জলে ভিজানো এই ভাত বাঙালির ঐতিহ্যকে দ্বিগুণ করে। মুঘল আমলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো,সেখানে আগত দর্শকরা এই ভাত খেতো। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ায় ” মাস্টার সেফ প্রতিযোগীতায় সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের কিশওয়ার চৌধুরী শেষ পর্বে পান্তা ভাত আর আলু ভর্তা রান্না করে বাঙালির ভোজনের ঐতিহ্য কে বিশ্ব দরবারে সম্মানিত করেছেন। গ্রাম বাংলার মাঠে- ঘাটে একটা গান প্রায়ই শোনা যায়, “পান্তাভাতে টাটকা বেগুন পোড়া”। বাংলাদেশে জল কে পানি বলে,সেই পানিতে সারারাত ভাত ভিজিয়ে রাখা হয় বলেই তার নাম পান্তা ভাত। এই ভাত শরীরকে ঠান্ডা করে। পান্তা ভাতের জল কে আমানি বলা হয়। এই ভাতের আরেক নাম কাঞ্জী। চন্ডীমঙ্গলে পান্তা ভাতের উল্লেখ আছে। ফুল্লরার বারোমাস্যায় চৈত্রের প্রচন্ড খরায় অভাবে সে পাথরবাটী পর্যন্ত বাঁধা দিতে হয়। দুঃখে ফুল্লরা বলে,
” দুঃখ কর অবধান দুঃখ কর অবধান।
আমানি খাবার গর্ত দেখ বিদ্যমান।”
বৈষ্ণবরা রাধাকৃষ্ণ কে পান্তা ভোগ দেয়। সাথে দই,চিনি,কলমি,শাক ভাজা এবং দুই একরকমের নিরামিষ তরকারি। অনেক জায়গায় মা দুর্গা কে দশমীতে পান্তা ভাত নিবেদন করা হয়।কোথাও কোথাও সরস্বতী পুজোর দিন শীতল ষষ্ঠীতে পান্তা ভাত ও গোটা সেদ্ধর প্রথা প্রচলিত আছে। অসমে এই ভাতের নাম” পৈত ভাত”, ওড়িশায় ” পাখালা ভাত”। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের ভোগ এ ” পাখালা ভাত ” নিবেদন করা হয়। অসমের ” বোহাগ বিহু” পরবে পান্তা ভাত ও হাত পাখা অপরিহার্য। যমশেরপুরের বাগচিদের বাড়ীতে একচালার কনকদুর্গা পুজোয় পান্তা ভাতের সাথে ইলিশ মাছ খাইয়ে উমাকে বিদায় জানান। বালুরঘাটের পাল বাড়ীর পুজোয় নবমী ও দশমীর ভোগে মা কে পান্তার সাথে বোয়াল মাছ ও রাইখোর মাছ ভোগ দেওয়া হয়। মা দুর্গা হলেন বাংলার ঘরের মেয়ে। তাই কন্যা বিদায়ের সময় সহজপাচ্য ও শরীর ঠান্ডা রাখার ভোগ দেওয়া হয়। শ্মশানবাসী মহাদেবের কাছে পুত্র কন্যা যাতে বাংলার ঐতিহ্যবাহী খাবারের পরিবর্তে সাধারণ খাবারের গল্প বলে, এই ভোগের উদ্দেশ্য অনেকটা তাই। এ পার বাংলা ও ওপার বাংলায় পান্তার সাথে অন্যান্য পদের রকম ফের আছে। পূর্ববঙ্গে পান্তার সাথে নানান ধরণের ভর্তা, শুটকি মাছের ঝুরো, ইলিশ মাছ ভাজা কুমড়া ফুলের বড়া, কাঁচা লঙ্কা, পেঁয়াজ খাওয়া হয়। এমনকি পান্তা – ভর্তা ও বিশেষ জনপ্রিয়। দরিদ্র মানুষ এতো সমারোহে অক্ষম। তাই পান্তার সাথে শাক ভাজা, শুকনো লঙ্কা পোড়া, নুন,সরষের তেল,কাঁচা মরিচ দিয়েই নিজেদের উদর পূর্তি করেন। এ পার বাংলার মানুষের পান্তার সাথে নানান ধরনের ডালের বড়া, কাসুন্দি, লেবু, কাঁচা লঙ্কা, আলুর চোখা, মাছ ভাজা উপাদেয় লাগে। বীরভূম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার মানুষ মাছের টক, পোস্তবাটা, কুড়তি কলাই বাটা দিয়ে পান্তা খেতে ভালো বাসেন। মনে আছে, উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরীর লেখা ” পান্তা বুড়ি” গল্পটা? বাঙালীর আবেগের সাথে জড়িয়ে থাকা এই পান্তা ভাতের জন্য জনৈক এক কবি লিখেছেন,
” সিদ্ধ ভাতকে পান্তা বানাই
চুবিয়ে রাখি জলে,
এটাই আজ মূল রেসিপি
তারেই পান্তা বলে।”
১৭৫৬ সালে সিরাজদৌল্লা কলকাতা আক্রমন করলেন। বহু ইংরেজ বন্দী হলেন। তবে ওলন্দাজ কুঠির প্রধান ভিনেট ওয়ারেন হেস্টিংস কে ছেড়ে দেওয়ার জন্য সিরাজদৌল্লা কে অনুরোধ করলেন। মুক্তি পেয়ে হেস্টিংস সোজা চলে আসলেন কাশিমবাজারে। ওয়ারেন হেস্টিংস গোপনে নবাবের তথ্য পাচার করছে জেনে সিরাজ আবার হেস্টিংস কে বন্দী করতে চাইলেন। এবার হেস্টিংস কান্তবাবুর দোকানে গিয়ে লুকিয়ে পড়লেন। এই কৃষ্ণ কান্ত নন্দী প্রথমদিন ওয়ারেন হেস্টিংস কে দোকানে লুকিয়ে রাখেন। আপ্যায়ন করেন পান্তা ভাত আর চিংড়ি মাছ দিয়ে। লোকমুখে একটি ছড়া ছড়িয়ে পড়লো,
“মুস্কিলে পড়িয়া কান্ত করে হায়
হায় হেস্টিংসে কি খেতে দিয়া প্রাণ রাখা যায়?
ঘরে ছিলো পান্তা ভাত আর চিংড়ি মাছ
কাঁচা লঙ্কা, বড়ি পোড়া কাছে কলাগাছ
সূর্যোদয় হল আজ পশ্চিম গগনে
হেস্টিংস ডিনার খান কান্তের ভবনে।”
বরিশাল জেলায় এই ভাত কে বলে ” পসুতি ভাত”।
রামায়ণে দেখা যায়, সীতা রামচন্দ্র কে পোলাও রান্না করে খাওয়াচ্ছেন। আবার সে যুগের মুনি ঋষিরা পোলাও, নানান ব্যঞ্জনের সাথে পান্তা ভাত ও আহার করতেন। তবে সেই সময় কাঁচা লঙ্কা না থাকায় চচ্চড়ি, মৌরলা মাছের ঝোল, বেগুন পোড়া পান্তা ভাতকে সঙ্গত দিতো। মধ্যবিত্ত বাঙালির রসনাতৃপ্তি, জ্বালানি বাঁচাতে এ খাবারের জুরি মেলা ভার। আমার মামাবাড়ি কোচবিহারের হলদিবাড়ি। সেখানে দেখেছি, কৃষকরা কাজের পর এক থালা জল ঢালা ভাতে কয়েকটা কাঁচা লঙ্কা আর পেঁয়াজ নিয়ে খেতে বসতো। এতো কাঁচা লঙ্কা খাওয়া নিয়ে উত্তর পাবনার লোক বলেন,
“এত মরিচ না খালি পরে চোইত মাসের এই রোদে গাও পুড়ি ছাই হয়য়া যাবিনি।”
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় জল ঢালা ভাত কে বলা হয় ” পোষ্টাই ভাত”। সেখানে দশমীতে মা দুর্গাকে পান্তার সাথে কচু শাক নিবেদন করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যতম প্রিয় ছিলো পান্তা ভাত। নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর হাতের পান্তা ভাত ও চিংড়ি মাছের চচ্চড়ি ভীষণ পছন্দ করতেন। জীবনস্মৃতিতে তিনি লিখেছেন,
” ইসকুল থেকে ফিরে এলেই রবির জন্য থাকে নতুন বউঠানের আপন হাতের প্রসাদ। আর যেদিন চিংড়ি মাছের চচ্চড়ির সঙ্গে নতুন বউঠান নিজে মেখে মেখে দেয় পান্তাভাত, অল্প একটু লঙ্কার আভাস দিয়ে সেদিন আর কথা থাকে না।”
অভাব অনটনের কারণে বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যা,জসীমউদ্দিন কিংবা শরৎচন্দ্র ছাত্রাবস্থায় বহু দিন পান্তা ভাত আর কাঁচা লঙ্কা খেয়ে কাটাতেন।
গ্রাম বাংলায় মনসা পুজোর সাথে পান্তা ভাতের যোগ আছে। জৈষ্ঠ মাস থেকে মনসা পুজো শুরু হয়ে আশ্বিনের শেষ দিন অবধি চলে। পুজোর পর অরন্ধন পালিত হয়। এদিন সকলে পান্তা ভাত খান। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী এদিন পান্তাভাত খেলে সাপের বিষ নাকি মাথায় ওঠে না। ” রামকানাইের নির্বুদ্ধিতা ” গল্পে ও পান্তা ভাতের কথা আছে। কথায় আছে ” নুন আনতে পান্তা ফুরোয়”। দরিদ্র বাঙালির চিত্রটা এভাবেই তুলে ধরা হয়। আবার সমাজের শ্রেণি বৈষম্য বোঝাতে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়,
” পান্তাভাতে কাঁচা লঙ্কা গরম ভাতে ঘি”।
একটা শিশু ছড়ায় আছে,
” পান্তা খেয়ে শান্ত শরীর কাপড় দিয়ে গায়
গরু চরাতে পাঁচন হাতে রাখাল ছেলে যায়।”
ওড়িশার একটি লোকগানে পান্তা বা পাখালা ভাতের উল্লেখ আছে।
” আশা জীবন ধন মোর পাখালা কানসা।”
গানটি গেয়েছেন পন্ডিত বলকৃষ্ণ কালীচরণ পট্টনায়ক। ওড়িশায় ভিন্ন ধরণের পাখালা ভাত দেখা যায়। দই পাখালা, চুংক পাখালা। সঙ্গে কারিপাতা, কাঁচা লঙ্কা, আদা, জিরে,তুলসী দিয়ে পাখালা ভাত পরিবেশিত হয়। মিঠা পাখালা চিনি, কমলালেবু, দই, আদার কুচি, ভাজা জিরে দিয়ে খাওয়া হয়। সাজ পাখালায় টাটকা ভাতে জল মিশিয়ে খাওয়া হয়। ওড়িশায় পাখালা ভাতের জল কে টাঙ্কা তোরানি বলে। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে পরিবেশিত ভোগের নাম সুবাস পাখালা। জুঁই, বেলি, কাঠগোলাপ ফুলের সাহায্যে সুবাসিত করে আদা মেশানো হয় এই পাখালায়। আসামের গ্রামাঞ্চলে গরমের সময় রাতে উনান নিভে যাওয়ার পর উনোনোর হালকা গরমে মাটির হাঁড়িতে বাসী ভাত জল দিয়ে রেখে দেওয়া হয়। সারারাত সেই ভাতে আলু সিদ্ধ ও পেঁয়াজ রেখে দেওয়া হয়। তারপর সকালে এই পৈতা ভাতের সাথে সামান্য কাঁচা সরষের তেল মিশিয়ে শুঁটকি মাছ দিয়ে খাওয়া হয়। আসামের বিবাহ অনুষ্ঠানে দুধ পান্তা অন্যতম বিখ্যাত একটি পদ। বিহারে পান্তাভাতের সাথে ছাতু মিশিয়ে খাওয়া হয়। আসামে সকালের খাবার কে বলে জলপান। সেই পদে ভাতের সাথে গুড়, মধু মিশিয়ে পরিবেশন করা হয়। কেরালার পান্তাভাত কে বলা হয় পাজম কাঞ্জী। মাছের ঝোল, আচার, চাটনি দিয়ে কেরালায় পাজম কাঞ্জী খাওয়ার প্রচলন আছে। তামিলনাড়ুতে এই ভাতের নাম পাজহেদু সাধম, যার অর্থ পুরোনো ভাত বা Old rice. উত্তর ভারতের মানুষের বিশ্বাস পান্তা ভাত খেলে তাদের গায়ে বাঘের মতো শক্তি হবে।
আর একটি লোককথায় পান্তার প্রসঙ্গ এসেছে,
” শাশুড়ী নাই ননদ নাই কার বা করি দর,
আগে খাই পান্তা ভাত শেষে লেপি ঘর।”
আবার আর একটি ছড়ায় পাই,
” কী কথা বলবো সই,
পান্তাভাতে টক দই।”
কিংবা,
” বন্দীর কামে যশ নাই,
পান্তাভাতে কষ নাই।”
পুষ্টিগুণে অনন্য পান্তা ভাত। পান্তাভাত কেবল গ্রামের মানুষের কাছেই নয়, বাঙালীর কাছে অত্যন্ত প্রিয়। রোদ ঝলসানো গরমে শরীরকে শীতলতা দান করে।
রাঢ় বাংলায় সান্তাড়রা বলে পান্তাকে বলে বাস্কি দাকা। তাদের প্রধান খাদ্যের মধ্যে এটি একটি। এমন কি হাঁড়িয়া তৈরিতেও ব্যবহৃত হয় পান্তা। এটা তাঁদের কাছে মাদক না বলে এনার্জি বুস্টার বা ডোপের মত ব্যবহার করে। এটা প্রখর রৌদ্রে শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রন করতে ও অধিক পরিশ্রম করতেও সহায়তা করে। এর সাথে কুর্কুট, পুদিনাপাতার বেঁটে দানাহুলি বা ধানলুলহি মাছ ভেজে তার সাথে খাওয়ার প্রচলন বেশি। তবে টিলা ছাতু, বালিছাতু, পুঁয়ালছাতু(খড়ছাতু), কুড়কুড়ে ছাতু বা পুটকাছাতুর পদের সাথেও বাস্কি দাকা/ পান্তাভাত খাওয়ার প্রচলন এখনও সমান ভাবেই চলে আসছে।
দিনাজপুরের ভুনজার আদিবাসীরা বৈশাখের প্রথমদিন সকালে সবাই মিলে পোনতা( পান্তা) খায়। পূর্বপুরুষের সময় থেকেই চৈত- বিসিমার অংশ রূপে কাঁচা লঙ্কা আর পেঁয়াজ দিয়ে সেরে নেয় পান্তা খাওয়া। পানহার উপজাতি পান্তার সাথে বারো রকম ভাজা ও বারো রকম তরকারী খায়। পান্তার ভালোবাসায় তারা গান গায়,
” হামে লাগে প্রথমে আদি বাসীই
পন্তা ভাত ভালোবাসি।”
রোদ ঝলসানো গরমে গ্রাম থেকে শহুরে জীবনে পান্তা ভাতকে দূরে সরিয়ে ফেলার কোনো উপায় নেই। পুষ্টিগুণে ভরপুর এই পান্তা ভাত উৎসব থেকে ঐতিহ্যে সকলকে ঘিরে রেখেছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় প্রচুর ধান উৎপাদন হওয়ায় পান্তা ভাত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তাদের কাছে। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় দেখা গেছে ১০০ গ্রাম পান্তা ভাতে ভরপুর আয়রন,পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ক্যালশিয়াম মজুত থাকে, এছাড়া শরীরে জলের ভারসাম্য বজায় রাখে এই পান্তা। তাই বৈজ্ঞানিক বা ভোজন রসিকরা পান্তাকে পাত থেকে বাদ দিতে পারেন না।