“মা এখন তখন” লিখছেন-প্রদীপ ভট্টাচার্য্য

প্রদীপ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৫২ সালে কোচবিহার জেলার দিনহাটায় ।দিনহাটায় স্কুল জীবন শেষ করে শিলিগুড়িতে কলেজ জীবন শুরু।বর্তমান বাসস্থান শিলিগুড়ি পুরসভার 31নং ওয়ার্ডে সুকান্তপল্লীতে । ৭০ এর দশকের শুরু থেকেই নাট্যকার, অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। পরবর্তী কালে গল্প , কবিতা ও প্রবন্ধ উত্তরের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই করোণা আবহে ঘরে বন্দি । ছোটবেলার বিভিন্ন স্মৃতি বিশেষ করে এবারের পূজোর পরিমণ্ডলে নিজের ছোটবেলার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।

মা এখন তখন

প্র দী প   ভ ট্টা চা র্য্য

কদিন আগে সকাল ১১টা নাগাদ পোষ্ট অফিসে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম ছেলেদের স্কুলের সামনে তিনটে বকুল গাছের তলায়, বিদ্যালয়ের ঠিক উল্টো দিকে জেলা গ্রন্থাগারের বেশ লম্বা তিন ধাপ সিড়ির সবটাই মহিলাদের দখলে। গাছতলায় অনেকগুলাে মাদুর পেতে মহিলারা বসে বেশ খােশ-গল্প করছে। হঠাৎ এত মহিলাকে বসে থাকতে দেখে একটু ঘাবড়ে গেলাম। ভাবলাম স্কুলে কিছু হল নাকি। স্কুলের গেট দিয়ে ভেতরে উঁকি মেরে দেখে মনে হল না স্কুলে কিছু হয়েছে। ঠিক এরকম সময় এদিকে বহুদিন আসিনা। স্কুলের পরেই পােষ্ট অফিস। চোদ্দ বছর আগে কয়েকটা সঞ্চয়ে সার্টিফিকেট ভাঙতে যাচ্ছি। তাছাড়া এখন পােষ্ট অফিসে তাে আসার দরকার পড়ে না। চিঠি লেখা বা টেলিগ্রাম করার পাঠ কবেই উঠে গেছে। এখন হাতে একটা ভাল মােবাইল ফোন থাকলে প্রয়ােজনের প্রায় সব কাজই মােবাইলেই হয়ে যায়।

আছেও প্রত্যেক বাড়িতেই কারাে না কারাে একটা স্মার্টফোন আছে। আমার ছােটবেলায় পােষ্ট অফিস আমাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়েছিল। আর এখন A.G. Gardianer ঠিকই বলেছেন। চিঠি লেখা একটি হারিয়ে যাওয়া শিল্প (Art), সে যাই হােক পােষ্ট অফিস প্রায় আমাদের জীবনের এখন খুবই গুরুত্বহীন বিষয়। এসব কারণেই এদিকে বহুদিন মানে বেশ কয়েক বছর আসা হয়না। প্রায় ‘শ’দুয়েক মহিলাকে এখানে বসে থাকতে দেখে কৌতুহল হল। বলা যায় না কোনও মহিলা সংগঠনের সভা হতে পারে। আর আজকাল সভা সমিতি মানেই যে কোন মুহূর্তে একটা গণ্ডগোল বেঁধে যেতে পারে। স্কুলের সামনেই রিক্সা ভ্যানের উপরে চা-সহ বিভিন্ন ফাস্ট ফুডের দোকান। চায়ের দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলে হয়তাে কারণটা জানা যেতে পারে। দোকানে বেশ কয়েকজন খরিদ্দার দাঁড়িয়ে। এখন সমস্ত শহরেই ভ্যানের উপর চায়ের দোকান। আমার ছােটবেলায় চা মিষ্টির দেকান একটাই ছিল বড় জায়গা নিয়ে দেকান। টেবিল চেয়ার পাতা।সবাই বসেই চা খেতাে। দোকানদারকে কথাটা জিজ্ঞেস করতেই বললাে। ছেলেকে স্কুলে নিয়ে এসেছে। তিন-সাড়ে তিন ঘন্টা পর ছুটি হলে আবার ছেলেকে নিয়ে যাবে। শুনে অবাক হলাম। অবশ্য এই সুযােগে মায়েদের পাঁচজনের সাথে মেশার বা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার সুযােগ হয়। তাছাড়া এখন তাে বেশীর ভাগ পরিবার হয় ছােট স্বামী-স্ত্রী ও একটি সন্তান। খুব বেশী হলে দুটি সন্তান। শিবরাত্রির সলতের মত তাদের নিয়ে মায়েদের সর্বক্ষণ চিন্তা। সব থেকে মজার ব্যাপার হল সন্তানদের লেখা-পড়া নিয়ে। আমার ছােটবেলায় কোন বাবা-মাকেই দেখিনি ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে এত ব্যস্ততা, এত উদ্বেগ। এত প্রতিযােগিতাও ছিল না। এখন যে প্রতিযােগিতা শুরু হয়েছে তা তাে বাস্তব বােধহীন প্রতিযােগিতা। সব মা-বাবাই চাইছে তার সন্তান ১০০তে ১০০+ পাবে। সামান্য কম পেলেও চলবেনা। আমার মনে আছে পরীক্ষায় প্রথম হওয়াটা এমন কিছু জরুরী না। তুমি পনেরাে জনের মধ্যে থাকলেই আমি খুশী হবাে। প্রথম হওয়ার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল- ভালাে মনের মানুষ হওয়া। সৌভ্রাতৃত্ববােধ নিয়ে বড় হওয়া। মানুষকে তার জাত-ধর্ম দিয়ে নয় মানুষ হিসাবে ভালবাসতে শেখা। আমাদের ছােটবেলায় মা-রা ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে এত উতলা বা ব্যতিব্যস্ত ছিলেন না। আমার তাে মনে আছে পরীক্ষা দিতে যাবার দিন মা কপালে একটা দই-এর ফোঁটা দিয়ে দিত। পরীক্ষা দিয়ে এসে আর পাঁচটা দিনের মতােই খাবার খেতাম। বাবা এসে কোয়েশ্চেনটা দেখতে দেখতে দু-একটা প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইতাে।

ব্যাস্ এইটুকুই। ছেলেমেয়েদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া, সেখানে গিয়ে স্কুল ছুটি না হওয়া পর্যন্ত বসে থাকা এই সব তাে কল্পনারও অতীত। আমি কখনাে কোন বাবা অথবা মাকে ছেলে-মেয়েদের স্কুলে নিয়ে আসতে দেখিনি। অবশ্য গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে দিনহাটার মতাে জায়গায় যানবাহন এতই কম ছিল যে, পথে বিপদের সম্ভাবনা খুবই কম ছিল। এখন অবশ্য একটা রাস্তা পার হওয়া খুবই কঠিন। সামান্যতম অসতর্ক হলেই জীবন সংশয়। আমার বা আমাদের স্কুলে যাওয়ার কথা মনে হলে খুব হাসি পায়। বেশীরভাগ দিনই বাড়ির পূকুরে (বড় ডােবা, পানা, শাপলা হতে দিতাম না। প্রায় ১০ ফুট গভীর স্বচ্ছ টলটলে জল)। ডুব মেরে আধ ভেজা গায়ে খেতে বসে গাে-গ্রাসে খেয়ে উঠে বই নিয়ে তিন-চার জন বন্ধু, খেলার সাথী একসাথে স্কুলে যেতাম। আমাদের কোন ব্যাগ ছিল না। আবার এত বইয়ের বােঝাও বহন করতে হত না। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত কাঠ পেন্সিল দিয়েই লেখার কাজ করতাম। কপিন পেনসিল বলে একটা কাঠ পেন্দিল পাওয়া যেত তাতে লেখাটা একটু বেগুনি রং-এর লেখা পড়তাে। এখন এ-ধরণের কোন পেন্সিল পাওয়া যায় কিনা জানিনা। তবে ক্লাস ফোরে পরীক্ষা দেবার সময় মনে আছে একটা কালি ভর্তি দোয়াত, ব্লটিং পেপার, নিবের কলম নিয়ে যেতাম। সুলেখা কোম্পানির ছােট ট্যাবলেটের মতাে কালিবড়ি জলে গুলে কাপড় দিয়ে ছেঁকে দোয়াতে ভরতাম। পরীক্ষা দিয়ে আসার পর দেখতাম আমাদের হাত ঠোট মুখ সব জায়গায় কালি লেগে আছে। পরে যখন ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করতাম তখন পেনের মধ্যে কালি ভরার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু নিবের অংশটা প্যাঁচ দিয়ে লাগানাের পরও কালি প্রায়শই লিক করত এবং হাতের আঙ্গুল কালিতে ভরে যেত। এখন অবশ্য সে সবের বালাই নেই। এখন উড পেন, কোল পেন আরাে কত ধরণের সুযােগ পড়াশুনা করার জন্য। আই.টি.সি.-র খাতা ছাড়া অন্যখাতায় লিখলে নাকি লেখা খারাপ হয়ে যাবে। আমার অবশ্য তা মনে হয়না। সাদা দিস্তা কাগজ কিনে সেলাই করে খাতা বানাতাম। আজ অবশ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় বর্তমান প্রজন্ম অনেক সমৃদ্ধির মধ্যেই বড় হচ্ছে। এটা খুবই আনন্দের। কিন্তু বর্তমান সময়ের ছাত্ররা অথবা তাদের অভিভাবকরা একদিকে অপচয় সন্তানের অন্যান্য আবদার পালনেই ব্যস্ত। আমি লক্ষ করেছি এখন প্রতিটি খাতার ত্রিশ শতাংশ পৃষ্ঠা নষ্ট হয়। আমার মনে আছে প্রতিটা খাতার প্রতিটা পৃষ্ঠা প্রতিটা লাইন আমরা সঠিক ব্যবহার করতাম। বিলাসিতা বা অপচয় করার সুযােগ কোনটাই আমার ছিল না। তাছাড়া যে কোন কারণেই হােক অপচয়ের মানসিকতাই আমাদের ছিলনা যা আজকের ছেলেদের মধ্যে প্রায়শই দেখি। আমরা চার ভাই দুই বােন। আমার বন্ধু বান্ধবরাও কেউ একমাত্র সন্তান ছিলনা। স্বভাবতই মায়েদের পক্ষে কোন এক সন্তানকে নিয়ে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকা সম্ভব ছিল না। অবশ্য অসুখ-বিসুখ হলে আলাদা কথা। কিন্তু বর্তমান সময়ে মায়েদের একটাই চাহিদা আর তা হল তার সন্তান প্রতিযােগিতার মূলক যে কোন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করুকনা কেন সেখানেই তাকে ফার্স্ট হতে হবে। কোন কোন সময় মায়ের এই প্রত্যাশা সন্তানের জীবনকে বিষময় করে তােলে। দুঃখ একটাই কোন মা এখন সম্তানকে বলেন না যে ফাস্ট হওয়ার থেকেও বড় কথা
— ভাল মানুষ হও।

 

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *