দেবপ্রসাদ জানা-র গল্পগুচ্ছ

দেবপ্রসাদ  জানা-র গল্পগুচ্ছ

                                                   

                                                            ছবিঃ গৌতম মাহাতো

                      একটু হাসি

আজ তিন মাস যাবৎ আমি আম্বেলিক্যাল হার্নিয়ায় ভুগছি। পেট মেদ থাকার জন্য ডাক্তার আমাকে ভাত রুটি খেতে বারন করেছে। মেদ কমাতে কার্বোহাড্রেড যুক্ত খাবার খাওয়া ঠিক নয়। কারন ফ্যাট তৈরী করে। যাই হোক বেশ সেদ্ধ খাবার বেশ মজাদার,গোল মরিচ দিয়ে,বিট নুন দিয়ে। সঙ্গে ডাল ও দেয় আমার গিন্নী।
একদিন আমার ছোট মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাবে তাই সব কেটে কুটে রেখে দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি অফিস যাবো মা বলল ওগুলো সিদ্ধ দিয়ে দি কুকারে। আমি বললাম দাও।
আমি স্নান করে পুজো দিয়ে খাবার জন্য বসলাম। মা সে গুলো বেড়ে খেতে দিলো। গোটা মুগের ডাল দেওয়া বেশ ভালো ই লাগছে। কিন্তু দেখি সব যেন চোকলা চোকলা। এত চোকলা কি করে দেয়। মাকে বললাম। মা বলল বৌমা কেটে দিয়ে গেছে। ঠিক আছে খেতে শুরু করলাম। কেমন যেন লাগছে। মাকে ডাকলাম মা এ গুলো ফেলে দেওয়া চোকলা নয়তো? 
এখানে কাটা ছিল আমি ধুয়ে চাপিয়েছি। আমি কি জানি?
আমার সন্ধেহ যায় না। আমি উঠে রান্না ঘরে দেখি সবজি গুলি বড় গামলায় রয়েছে।

                          রাগ


মৌমির আজ ভিষণ মন খারাপ। কারণ তার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস ভেঙে ফেলেছে আজ। তার স্কুলে করা প্রজেক্ট। যেটা তার স্কুলের নাম্বার পাওয়ার একটা অংশ ছিল। খুব জরুরি বলা যায়।

মৌমি তখন সবেমাত্র থ্রীতে এ উঠেছে । এই প্রথম সে নিজেকে দিদি ভাবতে শুরু করেছে । ক্লাস ওয়ান এর বাচ্ছারা তাকে দিদি বলছে ।

ভেবেছিলো প্রজেক্টটা এক্সিভিসনে দেবে , সকলে দেখে বলবে এটা ঈপ্সা বানিয়েছে , কত আনন্দ হবে তার , কি আর করা যায় ?

মৌমির ক্ষেত্রে খুব একটা সুখকর হলো না ।
অনেকগুলো বন্ধু ছিল মৌমির। শ্রীতমা, তানিশা, দেবস্মিতা আরো বেশ কয়েক জন। তবে তাদের মধ্যে, সবচেয়ে ভালো লাগতো শ্রীতমা সঙ্গে কথা বলতে। মেয়েটি দেখতে বেশ সুন্দরী । একদম লক্ষী ঠাকুরের মতো। চুলগুলো কোঁকড়ানো। হাসলে গালের দুপাশে টোল পড়ে। আর সবচেয়ে ভালো লাগতো তার কথার ধরণ। ধীর কণ্ঠে। ভাষার বাঁধন কি সুন্দর। মন জয় করে নিয়েছিল মৌমির। অনুরুপ ভাবে মৌমিকে ও পছন্দ করতো শ্রীতমা ।

সে তার বন্ধুদের বলতো-

-জীবনে কোন দিন মৌমির মতো মেয়ে দেখে নি।

খুব একটা ভুল বলতো তাও নয়। সুন্দর দেখতে মৌমির মুখ চোখ । একটু চেহারা হালকা ঠিকই। কিন্তু গোল মুখশ্রী ভাসা ভাসা চোখ গুলো খুবই মোহিত করতো সকলকে । তবে মৌমি বেশি পড়তে ভালোবাসতো।

সে যখন রেগে যেত, চোখগুলো বড়ো হয়ে যেত। তখন নাকি ঠিক মা দূর্গার মতো দেখায় তাকে। কিন্তু মৌমি শ্রীতমার মতো ধীর স্থির ছিল না । অনেকে তো মুখ ফোশকে বলেই ফেলে-

– যা বলিস শ্রীতমা কে মৌমির অনেক বন্ধু আছে তাকে ছাড়া তার চলে যাবে ।

আর পায় কে ? সে কি রাগ শ্রীতমার ,

-মৌমির খাবার টা পড়ে গেছে বলে , এই কথা ?

মৌমি প্রসঙ্গ বদলে নানান কথা বলে। তবে কথায় এড়িয়ে গেলে ও শ্রীতমার থেকে সে রেহাই পায় নি । 
স্বরসতী পূজার দিন স্কুলেই তাকে যার পর নাই অপমান করে বসলো শ্রীতমা । মৌমির ও রাগ হলো , কথা বন্ধ-

অনেকেই অনেক কিছু দিয়ে দুজনের রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করলো কিন্তু সে রাগ গেলো না কিছুতেই ।

তাই দুজনের পথ বিপরীতে বয়ে গেল। সেদিন দুজনে কষ্ট পেয়েছিল খুব , কেঁদেছিল দুজনে । কিন্তু কথা হলো না কিছু ,তবে মেনে নেয়নি অভিভাবকেরা। 
সেই থেকেই তারা আলাদা। পাঁচ বছর পর বড়ো বাড়িতে দুজনের আবার দেখা হয়ে গেলো । এখন তারা ক্লাস এইটে পড়ে । এই সেই দুজন যাদের লেখা দেখে দিদিরা বলতো দেখা দেখি করে লেখা দিদিরা অনেক পরীক্ষা করেছে, কিন্তু তারা কিছুতেই ধরতে পারেনি কি করে হয়-

সরস্বতী পুজো ফল কাটতে গিয়ে শ্রীতমা হাত কেটে যায় , মৌমি এসে ওর হাতে রুমাল বাঁধে , খন্ড খন্ড হয়ে ভেঙে যায় দুজনে ।হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে তারা । সব ব্যথা জল হয়ে নেমে আসে। এতোদিন যা জমাট বেধেছিল বুকের ভিতটায়।

                               মর্মান্তিক

মেয়েটি বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল। নিজের টিভিএস স্কুটি বুথে পার্ক করে রেখে একটি ক্লিনিকে যায় সে। মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে , ফিরে এসে দেখে স্কুটির টায়ার পাংচার হয়ে গেছে। চারজন সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। কিন্তু দৃষ্টিপাত ও ব্যবহারে সন্দেহ হওয়ায় তার বোনকে ফোন করে মেয়েটি। জায়গার নাম এবং ঘটনা খুলে বলে। পরিবার জানায় তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসছে। পনেরো মিনিট পর ফোনে আর যোগাযোগ করা যায় নি।

বাড়ির লোক বুথে পৌঁছে তাকে খুঁজে না পেয়ে পুলিশে যোগাযোগ করে, কিন্তু পুলিশ অত রাতে কেস নিতে এবং কোনরকম অনুসন্ধান করতে রাজি হয় না । মেয়েটির বাবা পাগলের মতো ঘোরে -পুলিশ পরেরদিন সকালে বড় অফিসার থাকার সময় আসতে বলে ।

বাড়ির লোক নিজের মত করে কিছু খোঁজাখুঁজি শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত ফিরে যেতে বাধ্য হয়।

সকাল সাতটা- মেয়েটির সম্পূর্ণ দগ্ধ দেহ উদ্ধার করে পুলিশ কল্যাণী রোড থেকে অনতিদূরে মেয়েটি ধর্ষিত ও হয়েছিল ।

বাড়ির লোককে পুলিশ পাত্তা দিতে চায় না , লোকাল কাউন্সিলর আসে সঙ্গে চার জন ছেলে , তিনি মন্তব্য করেন –

-আমার মনে হয় এটা ত্রিকোণ প্রেমের ঘটনা , যান দেখুন আপনার মেয়ের কত গুলো ছেলে বন্ধু ছিল, এতো গুলোকে নিয়ে খেললে পরিণতি এই হয়-তা ছাড়া এতো রাতে বেরোনোর কি দরকার?

সঙ্গের চার জন হাসে –

মহামতি পুলিশবাহিনী আজও তল্লাশি চালিয়ে চারজন অভিযুক্তকে চিহ্নিত করতে পারে না ।  

                          সুন্দরবন

দশটা এখনো বাজেনি,সত্যি বলতে কি এত তাড়াতাড়ি ,ঘুমতে মন চায় না -কিন্তু শরীর খুব ক্লান্ত হাত পা প্রচন্ড ব্যাথা -জ্বরও আসছে বোধ হয় -জড়তা ধেয়ে আসছে শরীরের প্রতিটি প্রান্তে-সুন্দরবন -তিনদিন দু-রাত্রির অক্লান্ত পরিশ্রম-জল আর জঙ্গল -তিনদিনের নৌকাবাস-ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে ছুটে চলেছে তের জন ভ্রমন পিপাসু যাত্রী নিয়ে-চব্বিশ পঁচিশ ছাব্বিশ ডিসেম্বর দুহাজার উনিশ।এত উদ্দীপনার মধ্যেই সূর্যগ্রহন। নিঃস্থব্ধ পৃথিবীর আর এক অন্ধকারময় দিন -পঁচিশের রাত এক জায়গায় হল্ট করে রাত্রি বাস করতে গিয়ে বিপদ -লঞ্চ ছেড়ে জল অনেক নিচে চলে গেছে -কি হবে?যতক্ষন না জল আসছে লঞ্চ ছাড়ছে না -একদম কাদার মধ্যেই আটকে রয়েছে-অদুরে বাঘে নেওয়া জঙ্গল -গ্রহনের ফলে অন্ধকারময় -আলোহীন লঞ্চ -সোলার ব্যাটারিতে চার্য নেই –
কেউ নড়াচড়া করতে পারছি না। লঞ্চের ওপর নিচও না।বাঘ আসতে পারে। জল আর জঙ্গলের মধ্যে কাদা আর জঙ্গল –
লাল কাপড় বাঁধা জঙ্গলের একটা গাছে -রাতে ঘুমের মধ্যেই এই জায়গায় এনে ফেলেছে -কারন রাতে কালু আর সন্তু মিলে ড্রাইভারটাকে মদ খাইছে-তারা ভালো করে নোঙর করতে পারে নি। কি হবে তার কোনো উপায়ও নেই। আয়ুশমান পাঠক। সন্তুর একমাত্র ছেলে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সাত বছরের ছেলে,না বলে বাথরুমও যায় না। কোথায় গেল তাহলে? খোঁজ খোঁজ রব উঠে গেল।আমিও আমার মেয়ে দুটো আছে কিনা দেখে নিলাম।বাইরে কাদার ওপর বাঘের থাবার দাগ। কিশোর বলল কাল রাতে কি একটা আওয়াজ শুনেছি, আমি ভাবলাম দেবুদা নাক ডাকছে।কান্নাকাটির রোল পড়ে গেল।আয়ুশের মা দ্বিতীয়বার পেগনেন্ট বলে আসে  নি।
আমরা কিছুতেই ওখান থেকে বেরতে পারছি না। জোয়ার না এলে। তার ওপর আয়ুশ কে পাওয়া যাচ্ছে না। কালু উকিল ওখানকার থানায় ফোন করার জন্য তেরী হলো -সারা লঞ্চ খুঁজে যখন আয়ুশকে পাওয়া গেল না –
উমা বলল কাল রাতে ঘুমনোর আগে আয়ুশকে দেখেনি। আরো টেনশন বেড়ে গেল। তবে কি আয়ুশ কে বাঘে নিয়ে গেল। 
সকলে মিলে পুরো লঞ্চ তোলপাড় করে ফেললাম। কিন্তু আয়ুশ কে পাওয়া গেল না। ততক্ষনে জোয়ার এসে লঞ্চকে দোলাতে শুরু করেছে। সকলে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছি কি করা হবে? আয়ুশের মাসি ও বাবা কাঁদতে শুরু করেছে। দিদা প্রায় হার্ট ফেল করার উপক্রম। লঞ্চে ছটা বেডের ঢুকতে ডানদিকের প্রথম বেডের লাগেজের মাঝখানে কি যেন নড়া চড়া করছে মৌমি এসে খবর দিল। সবাই দৌড়ে গেলাম, বাঘের ভয়ও তখন হারিয়েছে। দেখি আয়ুশ উঠে বসে আছে। কাল লুকোচুরি খেলতে খেলতে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়ে আয়ুশ।

                             পাগলা ডাক্তার

বন্ধু বিপিনের ছেলের জন্মদিন। প্রথম বছরের জন্মদিন বিপিন খুব ঘটা করে করছে। বিপিন আমার ছোটবেলার বন্ধু। স্কুলের। তখনো আমি বিয়ে করিনি। সন্ধ্যায় নিমন্ত্রন। সবে চাকরিতে জয়েন্ট করেছি । হাতে প্রথম মাসের মাইনে। মাকে দিয়েছিলাম, মা বলল তোর প্রথম মাসের মাইনে,যা যা তোর ইচ্ছা নিজে মনের মতো খরচ কর। আনন্দে তখন আর কি খরচ করব ভেবে পাই নি। তাই বিপিনের ছেলের জন্য একটা ওয়াকার কিনে চললাম তার বাড়ি। আমি পাঞ্জাবী পরতে ভালোবাসি তাই একটা নতুন পাঞ্জাবী ও কিনে ফেললাম।
বেশ ফুলটুস্ বাবুটি সেজে তার বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। তখনো সবার হাতে মোবাইল আসেনি। হাতে একটা ঘড়ি ও পরলাম। সবে সবে আমার চোখের পাওয়ার এসেছে। বেশ ভালো ফ্রেমের একটা চশমা বানিয়েছিলাম সেটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে জীতেন্দ্র মনে হচ্ছিল। আমার বাড়ি থেকে বিপিনের বাড়ি বেশি দুরে নয়। তাই হাঁটা শুরু করলাম। এই ফুলটুস সেজে যাওয়ার কারন ছিল একটা তবে এই খানে তার প্রয়োজন নেই। বিপিনের বাড়ি কাছাকাছি আসতেই একটাও সোরগোল শোনা গেল না । থমথমে ভাব। সকলে যেন হঠাৎ চুপ মেরে গেছে। সমস্ত আলো যেন নিভে গেছে। কি হলো ভাবতে ভাবতে বিপিনের বাড়ি পৌঁছতেই কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেল। একজন পরিচিত মহিলা আমাকে দেখেই কেঁদে ফেললেন।
কি হয়েছে জানতে চাওয়ায় উনি কেঁদেকেটে যা বললেন,আমি তো একেবারে বোবা হয়ে গেলাম। যে ছেলেটাকে সকাল বেলা সুষ্থসবল দেখে গেলাম সে কি করে মারা যায়? বিপিন ছেলেকে নিয়ে ডাক্তার সেন এর কাছে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিল। আমি বললাম চল আমিও যাই। ডাক্তার সেন ডানলপ অঞ্চলের সেরা ডাক্তার। এফ আর সি এস। নানান রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর বললেন
-হি ইজ নো মোর।
বিপিন ও তার বউ সীমা একেবারে ভেঙ্গে পড়ল। আমি বিপিনকে স্বান্ত্বনা দিয়ে। জিঞ্জেস করলাম কি করে এমন হলো? বিপিন ঘটে যাওয়া ঘটনার পুনরায় বিবৃতি দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিল না। বিপিনের ছোট ভাই যতীন আমাকে যা বলল।
-দাদা সকাল বেলা বাজার করে আনতে গেলে। আমরা সবাই ওকে নিয়ে খেলা করছি। হঠাৎ যেন ওর স্বাসপ্রস্বাসে অসুবিধা হচ্ছিল। বৌদিকে বললাম। বৌদি বলল তোমরা ওকে নিয়ে নাচানাচি করছ তাই হয়তো ওর অসুবিধা হচ্ছে। আমরা ওকে শুইয়ে দিলাম। তার কিছুখন পরে দেখি আর নড়াচড়া করছে না। পাশের বাড়ি হোমিওপ্যাথি ডাক্তার শুধাংসু কে দেখালে সে বলল বড় ডাক্তার দেখাতে, মনে হয় ছেলেটার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।
সকলে মিলে আমরা ডাক্তারখানা দিয়ে বেরিয়ে আসব। কিন্তু ডাক্তার সেন বললেন চার ঘন্টা না হলে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া যাবে না। তাছাড়া এই কেসে পোষ্ট মর্টেম করতে লাগবে। আমরা ওই টুকু বাচ্ছার কাটাছেঁড়া চাইছি না। ডাক্তার সেনের সঙ্গে সেই নিয়ে কথা কাটাকাটি চলছে।
এই সময় মাতৃমন্দির লেনের ডাক্তার যাদব রায় এলেন ডাক্তার সেনের সঙ্গে কথা বলতে। উনি পাড়ার মেডিসিনের ভালো এম বি বি এস ডাক্তার। ডাক্তার সেনের মতো শিশু চিকিৎসক নয়। এত লোক দেখে তিনি বললেন কি হয়েছে? ডাক্তার সেন তাকে বললেন সব কথা। তিনি সব শুনে ডাক্তার সেনের সঙ্গে কি কথা বলে চলে যাচ্ছিলেন। বিপিনের বউ পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে ডাক্তার যাদব রায় কে বলল –
– ডাক্তার বাবু একটু দেখুন না আমার ছেলেটাকে।
– ডাক্তার সেন দেখেছেন আমি আর কি দেখব? ওকে তো মেরেই নিয়ে এসেছেন।
তবুও বিপিনের বউ সীমা তাকে ছাড়তে চাইল না। অত্যধিক পিড়াপিড়িতে ডাক্তার যাদব রায় ভাক্তার সেন কে জিঞ্জেস করল সে পেসেন্টটা দেখতে পারবে কিনা? ডাক্তার সেন বললেন দেখো ওনাদের ও স্বান্তনা হবে। তো ডাক্তার যাদব রায় অনেকখন পরীক্ষা করে বললেন- এক কাজ করুন গরম জল আর একটা গ্লাভস আমাকে দিন দেখি চেষ্টা করে। ডাক্তার সেন বললেন কি করতে চাইছ যাদব?
-দেখি যদি বাচ্ছাটাকে বাঁচাতে পারি। যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে।
-না না আমার আপত্তি কেন থাকবে? করো যা করার। বাচ্ছাটা বাঁচুক আমিও চাই।
গরম জল এল, গ্লাভস এল।
ডাক্তার যাদব রায় বললেন সর্সে তেল লাগবে।
এদিকে আমরা ভাবছি কি করবেরে বাবা? ওসুধ নয় বেসুধ নয় সর্ষে তেল ! তেল আনার পরে ডাক্তার বাবু গ্লাভস পরে তাতে তেল চবচবে করে মেখে ডান হাতের মধ্যমা টাকে বাচ্ছাটার পায়ু ছিদ্র দিয়ে জোর করে ঢুকিয়ে দিলেন।
আমরা সকলে ভাবছি যে ডাক্তার যাদব রায় কে সকলে পাগল বলতো তা আজ প্রমান হয়ে গেল। সদ্য মৃত বাচ্ছা ছেলেটার পায়ুছিদ্র দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়তে লাগল। সীমা কাঁদছে, বিপিন কাঁদছে, আমারও চোখে নিজের অজান্তে জল এল। লোকে লাকারন্য ডাক্তারখানা। সকলে ভাবছে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। বাচ্ছাটাতো মরেই গেছে সুধু সুধু এসব করে লাভ কি? আমি থাকতে না পেরে ডাক্তারবাবুকে বলেই ফেললাম থাক না স্যর। আর ওসব করে কি হবে? ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটে গেল। পটাস্ করে একটা আওয়াজ হলো, আর বাচ্ছা টা প্যাঁ করে কেঁদে উঠলো। সবাই চুপ। নিঃস্থব্ধ সব। যেন পৃথিবী তার আর্বতন গতি ভুলে গেছে। পাখিরা ডাকতে ভুলে গেছে। আকাশে মেঘ ভাসতে ভাসতে থেমে গেছে। বাতাস বইতে ভুলে গেছে। গাড়ি ঘোড়া সব চুপ মেরে গেছে। তারপর?

ডাক্তার বললেন ওর মল দ্বারে মল আটকে গেছিলো .

                                হেডফোন


টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। বর্ষাকাল। সাইকেল নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম অফিসের উদ্দেশ্যে। মাথা ভেজা থেকে বাঁচতে একটা ক্যারি ব্যাগ মাথায় গলিয়ে নিলাম। থানার পাশের রাস্তা দিয়ে বেরলাম বি টি রোডের মুখে। বরানগর থানা। কিছু পরিচিতি ও আছে অফিসারদের সঙ্গে। পালপাড়া স্টপিজে তখনো সিগন্যাল পোষ্ট হয় নি। আমি এক অফিসারের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছি। রাস্তা ওপারে আমার অফিস। পার হবো। একটা মেয়ে হাতে ফোন কানে হেডফোন নিয়ে হঠাৎ করে দ্রুত পার হতে যাবে, ঠিক সেই সময় একটি ট্যাক্সি মোটামুটি গতিতেই আসছিল। খুব জোরে একটা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল ঠিক ঐ মেয়েটার চার ইঞ্চি দূরে। ট্যাক্সি থেকে নেমে এলো এক চব্বিশ পঁচিশ বছরের যুবক ড্রাইভার। বেরিয়েই মেয়েটার গালে কষে একটা চড় মেরে তৎক্ষনাৎ দ্রুত গাড়ি চালিয়ে চলে গেল। আমরা সবাই হতবাক। ভাবছিলাম অ্যাকসিডেন্টটা হয়েই গেল বোধ হয়। কিন্তু এটা কোনো ভাবেই মাথায় আসে নি।
অফিসার কে বললাম -স্যর নম্বরটা নিলেন না?
অফিসার বললেন -এরকম আরো কতকগুলো লোক চাই যারা এই হেডফোনের বিরুদ্ধে এ রকম শাস্তি দিতে পারবে।
শুনে মেয়েটাও কিংকর্তব্যবিমুঢ়।

                           বেশ করেছি

ছেলেটার বয়স সবে একুশ। হঠাৎ করেই বিয়ে করে ফেলল আর্দশ নগরের প্রিয়াঙ্কা কে। রেললাইনের পাশে ঘর। কাঠপাতার বেড়া দেওয়া সুখের সংসার। সকালে বউকে আদর কোরে,রাতের বাসনটা মেজে দিয়ে, রাজমিস্ত্রীর কাজে চলে যায় সল্টলেকে। সারাদিন বউটাকে দেখতেও পায় না। কারন বউয়ের কাছে ফোন নেই। বড় খারাপ লাগে। কি করছে বউটা? খেয়েছে তো? নাকি একা বলে রান্নাও করেনি। কাজ থেকে ফেরার পথে একটা তিনশ গ্রামের ঢেলা মাছ কিনে বাড়ি আসে। বউটা বড় ভালোবাসে ঢেলা মাছ। নিজেই রান্না করে দুজন মিলে খায়।
একটা ফোন তাকে কিনে দিতেই হবে নইলে আর পারা যাচ্ছে না। মালিকের কাছে দশ হাজার টাকা ধার চাইল। মালিক বলল -কিরে এত টাকা কি করবি?
-বউকে একটা ফোন কিনে দেব। একা একা থাকে কখন কোন বিপদ হয়।
-ফোনতো এখন ইন্সটলমেন্টেও পাওয়া যায়।
– হ্যাঁ, কিন্তু আমাকে কে দেবে?
-দেবে। আধার কার্ড দিলেই দেবে।
মালিক তাকে দোকান বলে দিল। আমার চেনা দোকান আছে। দোকানে গিয়ে আমার নাম বলবি দিয়ে দেবে।
আজ ফোনটা নিয়েই সে বাড়ি ঢুকলো। কত আনন্দ বউ এর কত আদর করল তাকে। মনটা আনন্দে ভরে গেল ছেলেটার। খুব আনন্দে দিন কাটছে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই একটা বাচ্ছা তাদের ঘর আলো করে এলো। আনন্দ আর সুখ যেন তাদের ঐ কাঠপাতার ঘরে এসে বাসা বেঁধেছে। চাঁদের আলো তার ঘর সর্বদা আলো করে রাখে। দিন কোথা থেকে কেটে গেল ছেলেটা বুঝতেই পারল না। আজ তার মেয়ের তিন বছরের জন্মদিন। লোকজন শশুর শাশুড়ি। বন্ধু বান্ধব সব এক সাথে।
মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করে দিল ছেলেটা। নিজে স্কুলে দিয়ে কাজে চলে যায়,বউ আনতে যায়। কত বন্ধু হয়েছে বউ এর। তাদের সঙ্গে মেয়ের পড়া নিয়ে আলোচনা করে। কিভাবে পড়ায়? ঐ স্কুলেরই এক দিদিমনি টিউশন পড়ায়। সেখানে দিল মেয়েটাকে। স্কুলের পর টিউশন সেরে তবে বাড়ি আসে বউ প্রিয়াঙ্কা। আজ কাল বেশ সেজেগুজে থাকে প্রিয়াঙ্কা। আর সেই ফোন তাতে ফেসবুক, ম্যাসেন্জার সব। সারাদিনে সময় আর পায় না ছেলেটার সঙ্গে কথা বলার। বন্ধুদের সঙ্গে কথা। রাত একটা দুটো কিছুই না। কারো সঙ্গে আবার ভিডিও কল ও করে। ছেলেটা ও সব গুরুত্ব দেয়নি এত দিন। কিন্তু যেন অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে। কার সঙ্গে এত কথা।
কি যেন হয়েছে প্রিয়াঙ্কার। তার সাথে ঠিক করে কথাও বলে না। কথা বললেই ঝগড়া। আর টাকা। যাই টাকা দেয়, নেই। কি করে এত টাকা? একটা সন্দেহ দানা বাঁধে ছেলেটার মনে। কিন্তু কি তা বলতে পারে না ছেলেটা। ছেলেটা মন মরা হয়ে থাকে।
মালিক বলল কি হয়েছেরে?
সব খুলে বলল মালিককে। মালিক অনেক চিন্তা করে বলল -দেখ কোনো নতুন বন্ধু হয়েছে বোধ হয়।
                             
স্যার, খুব খিদে পেয়ে গেছে। জেলের একঘেয়ে খাবার তো রোজই খাই, ফিরে গিয়ে সেটাই জুটবে। আজ কচুরি-সিঙ্গাড়া খেতে খুব ইচ্ছে করছে, দিন না একটু ব্যবস্থা করে সামনের দোকান থেকে…
জর্জ বলল -কি ব্যপার বউকে খুন করেও কোনো অনুশোচনা নেই?
-বেশ করেছি। যাকে আমি প্রানের থেকেও বেশী ভালোবাসি সে কিনা অন্য লোকের সাথে একই বিছানায়। আমার ঘরে আমার মেয়েকে ঘুমের ওসুধ খাইয়ে।
-বেশ করেছি ।

                          তখন


যখন প্রথম স্কুলে যাই ভালো লাগত অঙ্কদিদি কে।
কোলে বসিয়ে হাতে শ্লেট নিয়ে কানে কাছে মুখটা এনে মধুর সুরে বলত -এক এক্কে এক।তার কোলের উষ্মা আজো-সে ছেড়ে গেল কি একটা কারণে।
আমি জানি না।বড় কান্না পেত তখন।পাশের বাড়ি গৌরিদি সবে ক্লাস নাইন। ভারি মিষ্টি তার মুখ।
কোলে করে ঘুরে পড়াতো।তার কোলে মাথা দিয়ে ঘুমাতামও রোজ।একদিন শুনি সেও আসবে না।
কোথায় যেন? জানি না।ক্লাস ফোর হলো।
শিবুদি -আমাদের বাড়িওলার বাড়িতে সকলকে পড়াত।আমিও গেলাম। কি জানি কেন? আমাকে ই বেশ আদর দিয়েই পড়াত, বোঝাতো। ভালো লাগত তার ভয় দেখানো। মারতো না কোনদিন। আমার স্বপ্নের মধ্যে আসতে লাগল। ঐ সেদিন থেকে স্বপ্ন দেখা শুরু আমার।একদিন কারা যেন তার মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারল।বিকৃত তার সেই মুখের আদল বড় ভয়ঙ্কর। আমি ভয় পেলাম।ক্লাস সিক্স দুনিয়া টা রঙিন লাগতে শুরু করল। ভালোবাসা নামে একটা বস্তু আছে মন বুঝতে লাগল।এ ভালোবাসা সে ভালোবাসা নয়।মনের ভিতর আশা সংক্রামক একটা রোগ।যে কোচিনে অনেক মেয়েরা পড়ে -সেখানেই ভর্তি হলাম। মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে।
বোন বলল -কি রে ওখানে মনিকা পড়ে তাই না?
আমি কোন কথা বলিনি।পড়া বাড়তে লাগল –
আমিও বেশ সর্তক। পাছে সকলের সামনে মাথা নিচু হয়ে যায়। মানে মনিকা।মাধ্যমিক এ তিনটে লেটার নিয়ে পাশ।বন্ধুদের কাছে বুকের ছাতিটা চওড়া হয়ে গেল। তিন মাস চুটিয়ে ঘুরেছি মনিকার সাথে। মনিকাকে কে বিদ্যুৎ নামে একটি ছেলে চিঠি দিয়েছে জানতে পেরে, একদিন রাস্তায় তাকে একটা চড় মেরে বসলাম। তার সাথে অনেকদিন রাগে কথাও বলিনি। কদিন পরে জানলাম মনিকার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আমি বললাম এটা কি রকম?
ওর মা বলল-মেদিনীপুরের ছেলেরা বউকে ধরে খুব মারে।
বুকে বড় খটকা লাগল। ঠিক কি তাই? 
মনিকাও জীবন থেকে চলে গেল। 
এবার মনে হলো আর নয়, ভালোবাসা টাসা। পড়াশোনা করে ভালো চাকরি বাকরি করি তার পর দেখা যাবে।
পড়াশোনা করতে করতে আমাদের সঙ্গে কৃষ্ণা বলে একটা মেয়ে পড়তো। বেশ মোটাসোটা। তারে ভালো লাগতে লাগলো। বলতে পারি নি। তার বিয়ের ঠিক হতেই সে বলল -জানিস আমার সিটি কলেজে প্রফেসারের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে। তার মাথায় টাঁক।
বললাম -করছিস কেন বিয়ে?
-তুই তো কিছুই বললি না। তাই।
রাগে দুঃখে আমিও মেয়ে দেখে একটা বিয়ে করে নিলাম। বউ বেশ ভালো। গ্রাম্মো মেয়ে। নরম শরম। 
দুখানা মেয়েও হয়ে গেল।
একদিন শুনতে পেলাম মনিকাকে শশুর বাড়ির লোক গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। বউকে নিয়ে সুখেই সংসার করছিলাম। কিন্তু একদিন জানলাম সেও তার এক বন্ধুর বরের সঙ্গে প্রেম করছে। আমি আমার ছোট শালীকে বলতে গিয়ে কেঁদেই ফেললাম। আসলে সব হারিয়ে বউকেই বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। এত সব কিছু হয়েছে ব্যথা অনুভব করিনি। কিন্তু এবার যেন আর পারলাম না সইতে। অনেক চেষ্টা করেও যখন মরতে পারলাম না। তখন…


                                ★★★

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *