মৃণাল কান্তি মাহাত-র গল্প–“গাংদুয়ারির সোমবারি”

   মৃণাল কান্তি মাহাত-র গল্প

              গাংদুয়ারির সোমবারি সরেন


দমদম বিমানবন্দরের রানওয়ে ছেড়ে, বিমানটা যখন ক্রমশ উপরে উঠে যাচ্ছে, তখন খানিকক্ষনের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেলে সোমবারি। কোথায় গোপীবল্লভপুরের গাংদুয়ারি  গ্রাম, আর কোথায়েই বা দমদম, দিল্লী, ব্রাজিল। কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। মেলাতে পারে না কিছুতেই। কেমন যেন স্বপ্ন মনে হয়। সত্যিই, দিল্লী যাচ্ছে তো সোমবারি? 
— কিরে মুখটা অমন কাঁচুমাচু করে বসে আছিস কেন? 
ধ্যান ভেঙে যায় সোমবারির। পাশের সিট থেকে নবনীতা দি বলে ওঠেন। 
— তোর কি ভয় করছে প্লেনে?
— না, না ভয় কিসের। সোমবারি হেসে ওঠে। 
— কি জানি বাবা, আমার কিন্তু প্রথমবার বেশ ভয় করছিল। সেবার ন্যাশনাল খেলতে ব্যাঙ্গালোর গিয়েছিলাম প্লেনে। কি যে ভয় পেয়েছিলাম —  
সোমবারি ভয় পাচ্ছে না তেমন। তাদের মতো মেয়েদের ভয় পেলে চলবে না। উত্তেজনায় ফুটছে শরীরটা। স্বপ্নেও কি ভেবেছিল, কোনদিন প্লেনে উঠতে পারবে সে, ছোটবেলায় ছাগলবাগালি করতে করতে যখন মাঠের উপর দিয়ে উডে়াজাহার উডে় যেত, তখন হাঁ   করে চেয়ে থাকত সোমবারিরা। যারা প্লেনে উডে় তাদেরকে ভিনগ্রহের মানুষ বলে মনে হত। এই তো প্লেনে তাদের গ্রুপটা ছাড়াও অনেক সহযাত্রী রয়েছেন, তাদেরকে আলাদা করে কিছু মনে হচ্ছে না আজ।  সবাই সমান। বরুণদার কথাটা আজ খুব মনে পডে়। 
দিনটা  ছিল পোষপার্বনের। আদিবাসী সমাজের বড় উৎসব। পাশের গ্রামে সবর্ণরেখার চরে বিরাট মেলা বসে। সারাদিন টুসু গীত, সাঁওতালী নাচের, ভেজাবেধার প্রতিযোগিতা হয়। পুরষ্কার হিসেবে ধুতি, গেঞ্জি, কখনও ভেড়া পাঁঠা, বা নগদ অর্থ পুরষ্কার দেওয়া হয়। সোমবারিও গিয়েছিল মায়ের সঙ্গে  ভেজাবেঁধায় নাম দিতে। সোমবারির তখন ক্লাস সেভেন। তাদের সাঁওতাল সমাজের প্রতিটি মেয়ে-পুরুষের তীরধনুক চালতে পারাটা একটা রেওয়াজ, বছরের বিভিন্ন সময়ে তীরন্দাজী প্রতিযোগীতা হয় এই এলাকায়। যা এই এলাকায় `ভেজাবেঁধা’ নামে পরিচিত। সোমবারির বাড়ির প্রত্যেকেই তীরধনুক চালাতে পারে, বাবা বিভিন্ন প্রতিযোগীতায় নামও দিয়েছে। কিন্তু, কোনদিন প্রাইজ পায়নি। সোমবারির ইচ্ছে, সে এইবারে নাম দেবে ভেজাবেঁধায়। মায়ের হয়ে গেলে, সেই ধনুকটা নিয়ে তীর ছুঁড়বে সোমবারী। 
সুবর্ণ রখার চরে একটা কলাগাছ স্থাপন করা হয়েছিল। লক্ষ্যভেদের জন্য। দূরে দাঁড়িয়ে ছিল প্রতিযোগীরা তীর হাতে। প্রত্যেকেই তিনটি করে তীর ছুড়তে হবে, মা তীর ছুঁডে়ছিল কিন্তু, একটাও লক্ষ্যভেদ হয়নি। গামছাটা কোমরে বেঁধে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে দাঁড়ায়  সোমবারি। তাকে দেখে অনেকেই হেসে উঠেছিল। ভাবটা এমন, এতটুক মেয়ে ,ও আবার কি তীর ছুঁড়বে ।ওর তীর পেৌঁছবেই না। মা বলেছিল, ছুঁড়ুক না।  হপন কড়িগিদরো–ছুড়তে চাইছে। সোমবারী কারো কথায় কান না দিয়ে, তীর তুলে নিয়েছিল হাতে। প্রথম তীরটা ছোঁড়ার পরেই, কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল সোমবারি। চারিদিক শুধু উল্লাস আর হাততালি। মা চিৎকার চিৎকার করে উঠেছিল – ভাগে গে পুটু। সেদিনের সেই হাততালি আজও শুনতে পায় সোমবারি। পরের দুটো তীর আর লক্ষ্যভেদ করতে পারে নি। কাছাকাছি গিয়ে পড়েছিল । সেদিনের  প্রথম পুরষ্কার পাওয়া দুশো টাকা পেয়ে কি যে আনন্দ পেয়েছিল মা। 
ওই মেলাকমিটিরই একজন কমকর্তা ছিলেন বরুণ দা। স্থানীয় একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক । গ্রামের মানুষের বিদদে-আপদে পাশ দাঁড়ায়। পাশাপাশি গ্রামের সবাই চিনতেন বরুণ দা কে। সেই বরুণ দা একদিন হাজির বিকেলবেলায়। সোমবারি তখন শালপাতা সেলাই করছিল। 
— কি রে পুটি চেৎ এনামা?  কেমন আছিস? মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলে উঠেছিল বরুণ দা। 
— ভাগে গে। হাসিমুখে বলে উঠেছিল সোমবারি। 
— খুড়া কোথায়? 
— বাবা বাড়ির দিকে। 
বাবার সঙ্গে বরুণদার কি কোথা হয়েছিল জানা নেই। যাবার সময় শুধু বরুণদা বলেছিল, — আগামী রবিবার রেডি থাকিস, তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব। 
— কোথায়? সোমবারি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল ?
— চালামে । চল,  নিজেই দেখতে পাবি।
সুবর্ণরেখা পেরিয়ে ওরা চলে এসেছিল গোপীবল্লভপুরে। বরুণ দা ওকে ভর্তি করে দিয়েছিল আর্চারি এ্যাকাডেমিতে। তারপরই জীবনটা বদলে গিয়েছিল সোমবারির।  প্র্যাকটিশে নিজেকে উজাড় করে দিত। তীর ছুঁড়তে তার ভাল লাগত।সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যেত।  প্রথম প্রতিযোগীতায় নামা বারিপদা-তে। বরুনদাই নিয়ে গিয়েছিলেন। সব প্রতিযোগীদের দামী ধনুক, সাজপোষাক দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল সোমবারি, এদের সঙ্গে সে কি পারবে? বরুণ দা পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন — 
— ইখিনে ধনি গরিব নাই  রে, সবাই সমান। সবার ধনুকেরই এক মাপ। ভুইলে যা,  তুই গাঁয়ের গরীব বিটিছানা। এখানে সবাই রাজা।যার ক্ষমতা সেই রাজা, সেই রানীরে।  বরুণদার এই কথাটা মনের মধ্যে গেঁথে গেছে। যখনই মনটা খারাপ হয়ে যায়, হীনমন্যতা গ্রাস করে। বরুণদাকে মনে পডে় যায়। 
— জানিস পুটু , গরীব বলে নিজেকে কখনো ছোট করিস না, সব সময় নিজেকে রাজা ভাববি, দেখবি মনের মধ্যে অদ্ভূত এক শক্তি পাবি। মনে রাখিস, কোন কিছুর প্রতি ভালবাসা আর সাধনা থাকলে, সবকিছু করা সম্ভব হবেক । শুধুমাত্র অর্জুনরাই লক্ষ্যভেদ করে নাই রে।  ইচ্ছে থাকলে একলব্যরাও পারে। 
বরুণদার কথা সোমবারির কাছে বেদবাক্য। অদ্ভুদ এক শক্তি, ওই শক্তির জোরেই সোমবারি আজ ভারতসেরা, জীবনের লক্ষ্যপথ এখনও ঢের দূর। স্বপ্ন এখনও পূরণ হয়নি, সেই স্বপ্ন প্রতিটি মুহূর্ত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় তাকে। আজ আর্চারি বিশ্বকাপ। রিও ডি জেনিরোর মারকানা স্টেডিয়াম। গত কয়েকদিন ধরে নবনীতা দিরা অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছে ইন্ডিয়া কে। আজ ফাইনাল। সোমবারির উপরেই নির্ভর করছে দেশের ভাগ্য। সোমবারি জিতলে ইন্ডিয়া বিশ্বচাম্পিয়ন হবে। সোমবারির মধ্যে অদ্ভুত এক টেনশন। পারবে তো দেশকে চাম্পিয়ন করতে। আজ দক্ষিন কোরিয়ার সঙ্গে লড়াই। কোরিয়া গত দুবছরের চাম্পিয়ান। কাল সারারাত মারাংবুরু র কাছে প্রার্থনা করেছে সোমবারি। তার জন্য যেন দেশের সম্মান নষ্ট না হয়। ভোররাতে স্বপ্নে পায় বরুণদাকে, — পুটু, আলম টেনশনইয়া। আম বাডে়য়া দাম। পুটু টেনশন করিস না, তুই পারবি। সোমবারি ট্র্যাকে গিয়ে দাঁড়ায়। চোখটা বন্ধকরে কিছুক্ষণের জন্য। মুহূর্তের জন্য ভেসে ওঠে, গোপীবল্লভপুরের গাংদুয়ারি গ্রাম, বরুণ দা, মা-বাবা, তারপর মনের দৃষ্টি কোথায় যেন হারিয়ে যায়। চোখের সামনে জেগে থাকে তিনটি বৃত্ত। সোমবারির সামনে ভারত ছাড়িয়ে আজ বিশ্বচাম্পিয়ন হওয়ার সুযোগ, তার মুখ চেয়ে রয়েছে সারা দেশবাসী। ভাবতেই শরীরের মধ্যে অদ্ভুত এক শক্তি অনুভব করে।
মনে পড়ে গাঁয়ের মানুষগুলির কথা । রাজ্য চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরেই যারা চাঁদা করে তীরধনুক কিনে দিয়েছিল। – সোমবারি ,তুই পারবি । আম দাড়েয়া। তোকে হতেই হবে বড়।
সারা স্টেডিয়াম আজ লোকারণ্য। আজই টুর্নামেন্টের শেষ দিন। তাদের ইভেন্টের পরেই, পুরষ্কার বিতরণ হবে। মঞ্চে হাজির ইন্ডিয়ান অলিম্পিক এ্যাসোসিয়োশনের সভাপতি। ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি দিলমা রুশেফ সহ বিশ্বের তাবড় রাজনীতিবিদ, ক্রীড়াব্যক্তিত্ব । মনে পডে় গ্রামের মানুষগুলি কথা। সোমবারি রাজ্য চাম্পিয়ন হওয়ার পরই যারা চাঁদা করে একটা ধনুক দিয়েছিলেন।  বলেছিলেন, দেখিস, নিশ্চয় একদিন তুই চ্যাম্পিয়ন হবি।
সোমবারির সামনে এখন সবকিছু অন্ধকার। প্রত্যন্ত গ্রামের ফাঁকা প্রান্তর জুড়ে অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে যেমন দূর থেকে ভেসে আসা আলো শুধু চোখকে টানে। ঠিক তেমনি সোমবারির চোখের সামনে শুধু তিনটি বৃত্ত।  
-অনলি ওয়ান সোমবারি। ওনলি ওয়ান। মাত্র একটা তীর । গতকাল বলা কোচের কয়েকটা শব্দ। 
সোমবারি প্রস্তুত হয়। হাতে তুলে নেয় তীর। মাত্র কয়েকটা শব্দ। চোখের সামনে ভেসে ওঠে গাংদুয়ারির জাহের থান, মা বাবা, আর বরুন দা। তারপর থেকে সবকিছু অন্ধকার। শুধু চোখের সামনে ভেসে ওঠে লক্ক্যভেদের তিনটি তারা । গত দু বছরের কঠোর অনুশীলনের ফল এই মনসংযোগ। কে জানে মন বেইমানি করবে না তো? 
শুধুমাত্র তিনটি বৃত্ত। আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না সোমবারি। মারাংবুরু কে আরেকবার স্মরণ করে, আলগা করে দেয় ডানহাতের টিপ। কয়েকমুহূর্ত পিনড্রপ সাইলেন্স। তারপর শুধু শব্দ আর শব্দ। সোমবারি জানে না, এ কিসের শব্দ! উদযাপনের নাকি হেরে যাওয়ার!
ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে সোমবারি। বন্ধ চোখ। মন তখন গোপীবল্লভ পুরের গাংদুয়ারি গ্রামে।সেই পোষপার্বনের মেলা। সেই নদীর পাড়। সেই ভিড়। সেই ভেজাবেধা। অবিকল সেই শব্দ। যা সেদিন তার কানের ভেতর বেজেছিল আড়বাঁশির শব্দ হয়ে। 

                                    ★★★


Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *