মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি-র গল্প ঃ সিধু মাস্টার

  মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি-র গল্প 

                                                                                                ছবিঃ গৌতম মাহাতো

                              সিধু মাস্টার

   মাঝরাত থেকে বাতাস বইতে শুরু করেছিল। ভোরের দিকে সে বাতাস ঝড়ো হাওয়ার রূপ নিল। আর সকালের দিকে সে ঝড়ো হাওয়া আরো ভীষণ – ভীষণ আকার ধারণ করল। একই সঙ্গে সারা আকাশজুড়ে তুমুল মেঘের দাপাদাপি আর প্রবল বৃষ্টি। বৃষ্টির সঙ্গে দমকে দমকে বাতাস আছড়ে পড়তে লাগল প্রকৃতির বুকে। রীতিমতো দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশ। এতটাই ভয়াল-ভয়ঙ্কর যে ঘরের বাইরে বের হওয়াই মুশকিল। সিধু মাস্টারের তাতে কিছু এসে গেল না। তিনি ঝড়-জলকে উপেক্ষা করেই বেরিয়ে পড়লেন তাঁর স্কুলের উদ্দেশ্যে। তাঁর বাড়ির লোকজন অনেক নিষেধ করলেন আজকের দিনটা স্কুলে আর না যেতে। কিন্তু তিনি সে কথায় কানই দিলেন না। প্রকৃতির ভয়াল রূপ দেখে তাঁর স্ত্রী সাতসকালেই জিজ্ঞেস করেছিল – হ্যাঁগো, আমি কী তোমার স্কুলের জন্য ভাত চড়াব? 
  -কেন, ভাত চড়াবে না কেন?
  -না মানে, এই তো দুর্যোগ, তুমি কী আর স্কুলে যেতে পারবে? 
  -সে হোক, স্কুলে আমাকে যেতেই হবে। আজ ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা, আমি না গেলে খুব অসুবিধায় পড়বে ছাত্রছাত্রীরা।
  -তোমার ছাত্রছাত্রীরাই তো আজ স্কুলে আসতে পারবে না। তাঁর স্ত্রী বলে। 
   সিধু মাস্টার বলেন – সবাই না আসতে পারলেও কিছুজন তো আসবে। তাদের কী হবে? তাদের তো বুঝিয়ে বাড়ি পাঠাতে হবে। এই কর্তব্যটা রাখতেও তো আমাকে স্কুলে যেতে হবে। 
   আর কথা বাড়ায়নি সিধু মাস্টারের স্ত্রী। সুড়সুড় করে গিয়ে স্বামীর জন্য রান্না চড়িয়ে দেয়। সেই ভাত খেয়েই সিধু মাস্টার স্কুলে রওনা হয়ে যান। প্রকৃতি যে ক্ষেপে উঠেছে সেদিকে গুরুত্বই নেই তাঁর। আসলে সিধু মাস্টার এমনই। নিজের কর্তব্য পালনে সবসময় অটল-অনড়। কেউ সামান্যতমও বদনাম দিতে পারবে না সিধু মাস্টার তাঁর কর্তব্যে গাফিলতি করেছেন। কী ঝড়-জল-বৃষ্টি রোদের অসহ্য তাপ সবকিছুকেই উপেক্ষা করে ঠিক তিনি বিদ্যালয়ে উপস্থিত হন। সিধু মাস্টারের আসল নাম সিদ্ধেশ্বর পড়িয়া। স্কুলের প্রতি এতটাই তিনি দায়িত্বশীল এবং কর্তব্যপরায়ণ যে তাঁর এই কাজের জন্য এলাকার মানুষই ভালোবেসে তাঁকে সিধু মাস্টার বলেই ডাকে। এলাকায় তিনি একটা উদাহরণ হয়ে উঠেছেন। কেউ কিছু কাজে ঢিলেমি দিলে, বা কর্তব্য পালন না করলে সিধু মাস্টারের নাম আপনা থেকেই তাদের চলে আসে। তারা বলে কর্তব্য পালন করা কাকে বলে, দায়িত্ববোধ কী তা যদি শিখতে হয় তবে সিধু মাস্টারকে দেখে শিখ। 
   সেই সিধু মাস্টার ওরফে সিদ্ধেশ্বর পড়িয়া একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পঁচিশ বছরের বেশি হয়ে গেল তাঁর এই শিক্ষকতার জীবন। যে কোনও চাকরিতেই একটু বেশিদিন চাকরি হয়ে গেলেই যে কারুরই একটা আলসেমি ভাব চলে আসে, অলসতা গ্রাস করে। সিদ্ধেশ্বরবাবুর ক্ষেত্রে এই সুত্র খাটে না। তিনি যেন চির তরুণ,  চির যুবক। বয়স তাঁর পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে, কিন্তু কাজের বেলায় এখনো সেই আগের তারুণ্য, যৌবনের ছোঁয়া। যে কোনো তরুণ এখনো তাঁর কাছে বুঝি হার মানে। মনে প্রচণ্ড জোর সিদ্ধেশ্বরবাবুর। সেই মনের জোরকে সম্বল করেই তিনি এখন স্কুলের পথে। কিন্তু পথ এগোতে তাঁর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ঝড়টা এত তীব্র বেগে বইছে যে সাইকেল তাঁর এগোতেই চাইছে না। সিদ্ধেশ্বরবাবুর মনে হচ্ছে ঝড়টা তাঁর সাইকেলসুদ্ধ নিয়ে তাঁকে বুঝি উড়িয়ে নিয়ে অন্য কোথাও দূরে ফেলে দেবে। আজ ছাতা নেননি সিদ্ধেশ্বরবাবু। কারণ যে ঝড় দিচ্ছে তাতে করে ছাতা ধরা যাবে না। তাই অবস্থা বুঝে তিনি আজ রেনকোট পরে বেরিয়েছেন। সেই রেনকোটেও বৃষ্টির ফোঁটা বাগ মানছে না। শরীর তাঁর ভিজে যাচ্ছে। চোখে-মুখে এসে লাগছে বৃষ্টি সহ ঝড়ের ঝাপটা। বাধ্য হয়ে কখনো কখনো তাঁকে সাইকেল থেকে নেমে পড়তে হচ্ছে, ঠেলে ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছেন। 
   এইভাবে প্রচণ্ড ঝড়-জলের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে সাত কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে বিদ্যালয়ে অবশেষে পৌঁছলেন সিদ্ধেশ্বরবাবু। ভিজে একেবারে একসা হয়ে গেছেন। ঠাণ্ডাও বেশ করছে। পোশাক ভিজে গেছে তো কী হয়েছে? এর জন্য চিন্তিত নন তিনি। স্কুলে এক সেট পোশাক রেখেছেন। সেটা পরে নিলেই হল। ভিজে যাওয়ার কথা ভেবেই এই পোশাক 
রেখেছেন তিনি। স্কুলে পৌঁছে দেখলেন তিনি যা ভেবেছিলেন তাই হয়েছে। এই ঝড়-জলের মধ্যেও দু’জন ছাত্র এসে গেছে। অন্য ছাত্রছাত্রীরা আর আসেনি। না আসেনি যাক ভালোই হয়েছে। পরীক্ষার থেকেও জীবন আগে। যে দুজন ছাত্র এসেছে তাদের কাছে এগিয়ে গেলেন সিদ্ধেশ্বরবাবু। দেখলেন – চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র কুন্তল আর তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র 

                                   ২

অভিষেক। জলের ঝাপটায় দুজনেই ভিজে গেছে, ঠান্ডায় কাঁপছে তারা। প্রকৃতির রূপ দেখে রীতিমতো ভয় পেয়েছে, কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। তাদের মাস্টারমশাইকে দেখে তারা কিছুটা আশ্বস্ত হল। 
   সিদ্ধেশ্বরবাবু বললেন –কিরে বাবা, তোরা চলে এসেছিস? এমন দুর্যোগে বাড়ি থেকে বের হয় বাবা? 
   কুন্তল আর অভিষেক দুজনেই বলল – বাবা বলল, যা স্কুলে চলে যা, ঝড় তো কি হয়েছে। পরীক্ষা আছে, স্কুল বন্ধ করলে হবে না। 
   সিদ্ধেশ্বরবাবু হাসলেন। বললেন – ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে। এসেছিস ভালোই হয়েছে। তবে মনে হচ্ছে আজ আর পরীক্ষা নেওয়া যাবে না। কারণ তোরা দু’জন ছাড়া তো আর কেউ আসেনি। পরীক্ষাটা তাই আজ বন্ধই রাখতে হবে মনে হচ্ছে।
   অভিষেক বলল – মাস্টারমশাই আজ পরীক্ষা হবে না? তবে আমরা বাড়ি চলে যাই? 
  -বাড়ি চলে যাবি মানে! এই দুর্যোগের মধ্যে একারা বাড়ি ফিরবি? তাতো হতে পারে না। দেখছিস ঝড়ের ঝাপটা কেমন। আমি তোদের নিজে গিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবো। বুঝতে পারছি তোদের কষ্ট হচ্ছে আর একটুখানি অপেক্ষা কর। যদি আর কেউ স্কুলে এসে পড়ে। 
   কুন্তল আর অভিষেক দুজনেই তাদের মাস্টারমশাইয়ের কথায় আশ্বস্ত হল। সেই সঙ্গে তাদের চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক খেলে গেল। তারা ভাবছিল চলে তো এসেছে স্কুলে, কিন্তু ফিরবে কি করে? সেই ভাবনা কেটে গেল তাদের।
   সিদ্ধেশ্বরবাবু আর পোশাক পাল্টালেন না। ভিজে পোশাকেই আরো আধঘণ্টা অপেক্ষা করলেন। না, আর কোনো ছাত্রছাত্রী বিদ্যালয়ে এল না। তখন একপ্রকার নিশ্চিত হয়েই কুন্তল ও অভিষেককে বললেন – চল বাবা চল, তোদের বাড়িতে পৌঁছে দিই আগে। তারপর আমি বাড়ি ফিরব। ঝড় তখনও সমানে বইছে, বৃষ্টিও ঝরছে অঝোরধারায়। তারই মধ্যে কুন্তল আর অভিষেককে নিয়ে চলেছেন। প্রথমে অভিষেকের বাড়ি পৌঁছলেন সিদ্ধেশ্বরবাবু। অভিষেকের বাবার নাম অবনী ঘোষ। ডাকলেন – অবনীবাবু, অবনীবাবু, একটিবার বেরিয়ে আসুন। 
   অবনীবাবু বেরিয়ে এলেন। এসেই অবাক। -মাস্টারমশাই, আপনি!
   সিদ্ধেশ্বরবাবু বললেন – হ্যাঁ, আমি এসেছি। আপনার ছেলে অভিষেককে দিয়ে গেলাম। এই ঝড়-জলের মধ্যে ছেলেকে কেউ পাঠায় অবনীবাবু? 
   অবনীবাবু বললেন – কিন্তু মাস্টারমশাই, আপনিও তো সেই কতদূর থেকে এসেছেন। আপনি যদি আসতে পারেন, ছেলেরা কেন যাবে না? 
  -আমরা হলাম গিয়ে বড়ো। আর ওরা সব বাচ্চা, আমাদের সঙ্গে কী ওদের তুলনা করা চলে? যাক বেশি কথায় কাজ নেই। ছেলেকে ভিতরে নিয়ে যান। দেখছেন তো ভিজে একাকার হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি করে পোশাকটা পালটে দিন, গা-হাত-পা ভালো করে শুকনো কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দিন, নইলে সর্দি লেগে শরীর খারাপ করতে পারে।
   অবনীবাবু বললেন – মাস্টারমশাই, আপনিও ভিতরে আসুন না, একটু চা খেয়ে যান। 
   – না-না, এখন আর চা খেলে চলবে না, দেখছেন তো এখনো এই কুন্তল আছে। ওকেও ওর বাড়ি পৌঁছে দিই। -বলে কুন্তলকে নিয়ে রাস্তায় নেমে এলেন সিদ্ধেশ্বরবাবু। আসার সময় সিদ্ধেশ্বরবাবু শুনতে পেলেন অবনীবাবু তার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলছেন, দেখো –অভিষেকের মা দেখো, সিধু মাস্টারের দায়িত্বজ্ঞানটা একবার দেখো। যেমন স্কুলের প্রতি দরদ, তেমনি ছাত্রছাত্রীদের প্রতি। ওনাকে শতবার প্রণাম জানাতে ইচ্ছে করে। এই নাহলে সিধু মাস্টার। শুধু মুখে বলে নয়, তিনি কাজে করে দেখান কর্তব্য কাকে বলে।

                                   ★★★

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *