—————- ———————
ছবিঃ গৌতম মাহাতো
১.
পারি না যে
অনুপের ছোট্ট মেয়েটা বেশ পড়াশোনায় ভালো। বয়স বেশি নয়। সবেমাত্র নয় বছরের । বেশ চঞ্চল। বাড়ির সবাই তাকে তুলি বলে ডাকে।
তুলির মা তুলিকে চোখে চোখে রাখে। খাইয়ে দেয়, ব্রাশ করিয়ে দেয় , স্কুলের জামা পরিয়ে দেয় প্রভৃতি কাজ মা’ই করে। তুলি একা একা কিছুই করতে পারেনা। ইচ্ছে থাকলেও নিরূপায় ।
তবুও কথায় কথায় মা এসব শুনিয়েও দেয়। তুলির মনে মনে কিছু না পারার কষ্ট অনুভব করে।
স্কুলের বন্ধুরা এই নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করে। তুলি নিরুত্তর থাকে। স্কুলের বাৎসরিক খেলা প্রতিযোগিতায় তুলি নাম লেখায়। সারা মাঠে হৈ হৈ রব। তুলি ছুটবে। মনে মনে সমস্ত বিশ্বাস যেন শরীরে ঢেলে নিয়েছে। জেদ আর আশা নিয়ে মাঠে ছুটছে । সবাই মুহূর্মুহু হাত তালি দিচ্ছে। তুলি এগিয়ে। সারা মাঠ চিৎকার করে বলছে ‘তু-লি-তু-লি-তু-লি’
তুলির মধ্যে সেই মুহূর্তে যেন সমস্ত না পারার বেদনা সারা শরীরে ঢেউ তুলছে । সবার দৃষ্টি এড়িয়ে তুলি প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়।
তুলি বাড়ি যায়। বাবা – মায়ের সাথে শেয়ার করে। মা বিব্রত বোধ করে। তুলি করে। মা’য়ের চোখে মুখে অতৃপ্তির ছায়া। তুলি চোখ মুছতে মুছতে কাপ হাতে বাইরে বেরিয়ে যায়।
তুলি বাইরে কাপ ছুঁড়ে জোরে জোরে বলে ‘আমি পারি না যে’।
——————
২
পরিচয়
হঠাৎ একটা অজানা ফোন আসে অনির্বাণের কাছে । ফোনটা তুলতেই একটা মোটা গোলায় জিজ্ঞাসা করছেন “তুমি কি করো? ” “তুমি কোথায় থাকো?”
অনির্বাণ একটু সময় নিলো। তারপর ঠিকঠাক প্রশ্নের উত্তর দেতে লাগলো ।
কিছুতেই মেলাতে পারছে না গলাটিকে। সমানে ভদ্রলোকটি তাকে জেরা করতে লাগলো । অনির্বাণ একটু জল খায়। তারপর ঊনার পরিচয় জানতে গেলেই পেছন থেকে কে যেন বলেন “ঊনি তোমার বাবা।”
—————–
৩.
ছবি
“এবার তুমি তোমার ছবি দেবে বলে তুমি দিলে না কেন? সময় তো ছিলো ছবিটি খুব দরকার ছিলো “-প্রশ্নটি স্নেহের ভাইকে দাদার।
“- শুনো দাদা একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে তোমার সাথে। ”
-না না সামান্য জিনিসটাই মনে করে দিতে পারো না। তাহলে ভালোবাসা থাকবে কি করে?
-তুমি পারলে? আমাকে এই ভাবে বলতে। যাইহোক তুমি শোনো -অনুপদার ভাই অনুপদাকে রাস্তার ধারে বলেছিলো যে”তোমার একটা ছবি তুলবো? দেবে ছবি তুলতে?
সঙ্গে সঙ্গেই অনুপদা ছবি তুলে দিয়ে বলল “কি করবে এই ছবি?
সহজ সরল একটা মন নিয়ে বলে ” তুমি যখন কাছে থাকবে না, তখন এই ছবিটি প্রাণ ভরে দেখবো।”
-তাই তো আমার ছবি পাঠাই নি। ভয়ের সুরে করুনঘন গলায় ধীরে ধীরে ভাই দাদাকে বললো “আমায় একটা ছবি দেবে?ঠিক আমার দাদার মতো করে “।
দাদা নির্বাক!
—————
৪.
মায়ের ভালোবাসা
অজ পাড়াগাঁ । দারিদ্র্যতা বুকে নিয়ে আশিষ আর তার মা একটা ঝুপড়ি ঘরে থাকে।আশিষ মাকে নিয়ে বেশ গর্বিত । সারাদিন সবজির ঝুড়ি মাথায় নিয়ে বাজারে বাজারে ঘোরে আর বিক্রি করে। মায়ের চিন্তা বাড়ে।
আশিষ একটা স্কুলে পড়ে। পড়াশোনায় খুব ভালো । মায়ের কষ্ট সে অনুভব করে। মাঝে মাঝে মা কে সাহায্য করে। রাতে কখনো কখনো উপোস করে থাকে। মা ছেলের ভালোবাসায় কোনো শূন্যস্থান নেই ।
আশিষ বড়ো হলো । চাকরি পেল। মাকে নিয়ে চলে গেল।
আশিষের বিয়ে হলো । মায়ের আনন্দ বাড়তে থাকলো।
মায়ের ক্যান্সার । আশিষের বৌ মায়ের সেবা করে না। সে নীরবে সবার দায়িত্ব পালন করে ।
মা মৃত্যু শয্যায়। আশিষের মাথায় হাত রাখে। বাড়তি ভালোবাসায় আশিষের চোখে জল আসে। আর মাকে জড়িয়ে রাখে দুহাতে।
——————-
৫
স্নেহ
অনির্বাণ একটি গ্রামে বাসকরে।বয়স প্রায় ১০/১২ বছরের। অত্যন্ত গরীব পরিবারের । বাবা আর মায়ের সাথে কেটেছে তার দিন গুলি। ছয় ভাই বোনের মধ্যে ছোটো সে। তবে দাদাদের দারিদ্র্যতা ছিলো গভীর কিন্তু ভালোবাসার অভাব ছিল। মা ছিলো তার একমাত্র দর্শন ।
পরিশ্রম আর চেষ্টা অনির্বানের অন্য ভাইদের তুলনায় অনেক বেশি। তবে মনটা ছিলো তার সহজ সরল। তাই এর জন্য অনেক কষ্ট তাকে সহ্য করতে হয়েছে।
দীর্ঘ পরিশ্রম করে দুমুঠো সাদা ভাত খেয়ে মায়ের আশীর্বাদে সে এম. পাশ করে।
এই পাশের পেছনে অনেক বাধা আর বিঘ্ন ছিলো ।
শেষমেশ অনির্বাণ চাকরি পায়। বাবা ও মা মারা যায়। সবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়। দুঃখ তাকে আরো সময়ে নিয়ে যায়।
আসলে ছোটো থেকে অনির্বাণ অভাব যেমন পেয়েছে তেমনি স্নেহ কি তাও ঠিক বোঝে না।
এমনই ভাবে এক স্নেহ চক্করে পড়ে। ফলে স্নেহের পরিবর্তে মানসিক যন্ত্রণা পেয়ে আবার ফিরে আসে ।
কতজন তাকে কতভাবে নিয়ে খেলে তার সরলতার মন নিয়ে।
একদিন অনির্বাণ সত্যিকারের একজন পেলেন যে তার সমস্ত চাওয়া আর পাওয়ার সাথে সাথে পুত্র স্নেহ দিতে শুরু করে।
অনির্বাণ এতো বড়ো আকাশের নীচে সে একজনকেই পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে “আমি
আমার স্নেহময় বাবাকে পেয়েছি”। অনির্বাণের সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে তাকে সস্নেহে জড়িয়ে ধরে।
————–
৬.
প্রত্যাশা
গ্রামময় জলের হাহাকার। নানান অসুখে ঘিরে ফেলেছে গ্রাম।দেখালী গ্রামের একটা পরিবারের দুজন সদস্য মারা যায়। সেই বাড়ির ছেলে তার দুই ভাই বোন কে নিয়ে এখন বেঁচে আছে। ছেলেটির নাম মুকুন্দ।
মুকুন্দ নিজে পড়াশোনা করেনি । তবে ভাই ও বোনকে সে শত কষ্টের মধ্যে থেকেও ভালো স্কুলে পড়াশোনা করায়।
মুকুন্দ একদিন তার বোনের বিয়ে একটি সামান্য বাড়ির ছেলের সাথে দিলেন। তবে ভাই কে নিয়ে এক সমস্যায় পড়লে সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।
আর মুকুন্দ বাড়ি যায়না। সে একা একা খোলা আকাশের নীচে ঘুরে বেড়ায়। কিছুদিন যাওয়ার পর মুকুন্দ ভীষণ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।। হঠাৎ ফেসবুকে এক দাদার সাথে তার পরিচয় হয়। সে দাদা মুকুন্দের কাছে আসে।
ভাই, বোন কেউই যখন আর তার খবর নেয় না। তখন মুকুন্দের প্রত্যাশা বাড়তে থাকে। দাদার প্রতি অগাধ প্রত্যাশা জন্মায় তার। হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে মুকুন্দ যখন কাঁদছিল ঠি তখনই সেই দাদা তার কাছে আসে। মুকুন্দ আনন্দে দাদার কোলে মাথা রেখে সারা জীবনের মতো প্রত্যাশা কে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
★★★