ছোটদের গল্প — প্রসন্ন প্রভাত

  শেষাংশ

ছোটদের গল্প
  —————

                              প্রসন্ন প্রভাত

                                         মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

ক’দিন হল রূপসী বিদ্যালয়ে আসছে না। আমার তা নজর এড়ালো না। ক্লাস হচ্ছে কিন্তু রূপসী নেই বলে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মেয়েটা যে পড়াশোনাতেও তুখোড়। রূপসী আমাকে যতই হারাক তার অভাব দারুণভাবে অনুভব কূরতে লাগলাম। রূপসীর ভদ্রতা-নম্রতা সর্বোপরি তার অন্তরের সৌন্দর্য আমাকে অন্য এক ভালোলাগার স্তরে নিয়ে গেছে। দেখতে যতই কুত্সিত হোক-তার মায়াভরা মুখখানি, সরলতা ভরা চোখ দু’টি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। মনটা যেন কেমন কু-গাইছে – রূপসী ভালো নেই। তার কোনো বিপদ হয়েছে। সেদিন ক্লাসে ঢুকে সত্যেনবাবুও কথাটা তুললেন – কী ব্যাপার, রূপসী কেন ক্লাসে আসছে না? আমাদের জিজ্ঞেস করলেন – রূপসীর কোনো খবর জানি কিনা। 
   আমরা বললাম – স্যার, জানি না তো। 
   সত্যেনবাবু বললেন – সে কী! তোমরা তার এতগুলো বন্ধু, কেউ একজনও তার 
খবর রাখোনি? সময় করে খোঁজ নেবে। এটাও তো তোমাদের একটা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে নাকি?
   ক্লাস শেষ করে সত্যেনবাবু বেরিয়ে গেলে আমি ঈশিতাকে প্রশ্ন করলাম – সত্যিই তো ঈশিতা, রূপসী কেন স্কুলে আসছে না বলতো? 
   পিছনের বেঞ্চে বসেছিল দেবানন্দ। সে ফোঁড়ন কাটল – দেখ, তোকে তৃতীয়বার কীভাবে হারাবে সেই মতলবই হয়তো কোথাও আঁটছে বসে। নয়তো পরীক্ষায় তোর কাছে হেরে যাবার ভয়ে স্কুলেই আর আসতে চাইছে না। 
   দেবানন্দের কথা শুনে ঈশিতা, সোনালি, ব্যোমকেশ সবাই একসঙ্গে হো হো করে হেসে উঠল। 
  -যতসব ফাজিল অসভ্য ছেলে কোথাকার। ওদের হাসির বহর দেখে আমারও গা-পিত্তি জ্বলতে লাগল।

   সেদিনই বিকেলবেলা স্কুল ছুটির পর কাউকে কিছু না বলে, কাউকে সঙ্গে না নিয়ে ঠিকানা জোগাড় করে আমি রূপসীদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আমাকে জানতে হবে রূপসীর কী হয়েছে। 
   নদী-খাল পরিবেষ্টিত একটি প্রত্যন্ত গ্রামে রূপসীরা থাকে। পথের একজনকে জিজ্ঞেস করতেই সে রূপসীদের বাড়িটা দেখিয়ে দিল। 
   রূপসীদের বাড়ির চেহারাটা দেখে আমি তো অবাক। এটাকে কী বাড়ি বলা চলে? কেমন ভেঙেচুরে গেছে। চালের খড় পচে গিয়ে বাতা বেরিয়ে পড়েছে। একটা কালো ট্রিপল দিয়ে কোনরকমে ঢেকে রাখা হয়েছে। ত্রিপলটাও মনে হচ্ছে বহুকালের। হেথা-হোথা ছেঁড়া। কয়েকটা বাঁশের খুঁটি দিয়ে বাড়িটাকে দাঁড় করানো আছে। এমন হতশ্রী, ভাঙা একটা বাড়িতে কেউ যে থাকতে পারে – চোখে না দেখলে হয়তো বিশ্বাস করতে পারতাম না আমি। একটা ভাঙা-কুঁড়েঘরের মেয়ে রূপসী – অথচ তার বুদ্ধিটা কী অসাধারণ! আমার লাল সাইকেলটা ঠেলতে ঠেলতে একেবারে রূপসীর বাড়ির 


সামনে চলে এলাম। অদূরেই ডালপাতায় ভর্তি একটা ঝাঁকড়া আমগাছ। সেই আমগাছেরই তলায় একটা ছাগল বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আদর করছিল রূপসী। 
   আমি ডাকলাম – রূপসী। 
   রূপসী পিছন ফিরে তাকিয়ে আমাকে দেখেই চমকে উঠল। ছাগলছানা ছেড়ে দিয়েই তাড়াতাড়ি করে উঠে দাঁড়াল। 
  -সবিতা তুমি! আমার এখানে? তা কোথায় বসতে দিই বলতো? রূপসী আমার আসাতে হঠাত্‍ লজ্জা পেয়ে গেছে। 
   আমি বললাম – সে বসাটসা পড়ে হবে’খন। আগে তুই বল স্কুলে যাসনি কেন? তুই কী জানিস আমরা সবাই তোকে কত মিস করছি। কেন যাসনি স্কুলে?
   আমাকে দেখে রূপসী উচ্ছ্বসিত হয়েছিল। আমার প্রশ্নে তার সে উচ্ছ্বাস মুহূর্তের মধ্যে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। কচি মুখখানা কেমন বিবর্ণ-পাণ্ডুর রঙ ধারণ করল। মনে হল তার সারা মুখে কে যেন আচমকা কালি ছিটিয়ে দিয়েছে। তার চোখের কোণ দুটো চিক চিক করে উঠল। পাংশু মুখখানা নিয়ে কান্নাভেজা গলায় বলল – আমি আর স্কুলে যাব না সবিতা। 
  -স্কুলে যাবি না মানে! কেন কী হয়েছে তোর? বিস্ময়ের সঙ্গে আমি প্রশ্ন করলাম। 
   মাটিতে ডানপায়ের বুড়ো আঙুল ঘষতে ঘষতে মাথা নিচু করে রূপসী বলল – আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। বাবা পাত্র ঠিক করে ফেলেছে। ক’দিন পরেই আমার বিয়ে। 
  -বিয়ে! তোর! এ তুই কী বলছিস রূপসী? কথাটা শুনে মাথাটা আমার ঝাঁ করে উঠল। নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। না, এমন একটা দু:সংবাদ শোনার জন্য মোটেই আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমি রীতিমতো ধাক্কা খেলাম। আহত কন্ঠে বললাম – এই বয়সে তোর কী বিয়ে! তুই প্রতিবাদ করিস নি?
   রূপসী আড়ষ্ট গলায় বলল – আমি এতটুকু একটা মেয়ে। আমি কী এর প্রতিবাদ করবো? তাছাড়া এর প্রতিবাদ করেও লাভ নেই। আমাদের সমাজে কম বয়সে বিয়ের একটা চল আছে। 
   আমি আর কথা বাড়ালাম না। রূপসীর কথায় বুকটা আমার ভেঙে যাচ্ছে। যেমন হঠাত্‍ এসেছিলাম হঠাত্‍ করে ফিরেও এলাম। দু:খে-বেদনায় নিজেকে শান্ত-সংযত রাখাই কঠিন হয়ে পড়ছে।
   ঘুম এল না চোখে। সারারাত ধরে রূপসীর কথা খুব ভাবলাম। অনেক কথা। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। রূপসীর এই বয়সের বিয়ে মেনে নেওয়া যায় না। কিছুতেই না। রূপসীকে পরীক্ষায় হারাবো এই একটা জেদ মাথায় চেপেছিল আমার – এখন সেটা ভুলে গিয়ে রূপসীকে কীভাবে আসন্ন বন্দিদশার হাত থেকে উদ্ধার করে আনা যায় সেই চিন্তা আমাকে বেশি করে পেয়ে বসল। খুব করে ভাবিয়ে তুলল। 
   পরের দিন স্কুলে গিয়েই রূপসীর বিয়ের কথাটা আমার ক্লাসের বন্ধুদের বললাম। ঈশিতা করুণ মুখে বলল – ও ভেরি স্যাড! এতটুকু একটা মেয়ে – এখনো প্রায় দুধের বাচ্চাই বলা চলে তার বিয়ে! ভাবাই যায় না। 
   ব্যোমকেশ বলল – সবিতা তোর তো দু:খের কোনো কারণ নেই। একপ্রকার ভালোই তো হল। তোর পথ পরিষ্কার। ও না এলে তুই যেমন ক্লাসে ফার্স্ট ছিলি ফার্স্ট-ই থাকবি। তুই ওর কাছে ইংরেজি বানান লেখায় হেরেছিস, আবৃত্তিতে হেরেছিস। কে বলতে পারে ওই মেয়েটা তোকে পরীক্ষাতেও হারিয়ে দেবে না। 
  -চুপ কর, সবসময় বাঁদরামো করিস না তো। আমি রেগে উঠলাম। পরক্ষণেই বললাম – এটা হার-জিতের প্রশ্ন নয় ব্যোমকেশ। মজা করার কথাও নয়। সিরিয়াসলি একবার ভেবে দেখেছিস – মেয়েটার কতবড়ো একটা ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। রূপসীর বেড়ে ওঠার পথে, বিকশিত হওয়ার পথে বিয়েটা একটা কতবড়ো বাধা! যে মেয়েটা স্বপ্ন দেখতো সে বড়ো হবে, লেখাপড়া শিখে মানুষ হবে – তার বিয়ে হয়ে যাওয়া মানে তো হাঁড়িকাঠে বলি হয়ে যাওয়া। একটা কোমলমতি মনের মৃত্যু ঘটা। একটা গোলাপ কুঁড়ির পাপড়ি মেলার আগেই ঝরে পড়া! 
   সোনালি বলল – সবিতা ঠিক কথাই বলেছে। রূপসীর উপর অবিচার করা হচ্ছে – এটা মেনে নেওয়া যায় না। 
   দেবানন্দ বলল – রূপসীর বিয়ের ঠিক করেছে তার বাবা। কিন্তু এর জন্য আমরা কী করতে পারি? 
   আমি অস্থিরচিত্তে বললাম – আমাদের কিছু একটা করতেই হবে। এই জন্যই তো তোদের সবাইকে নিয়ে আলোচনা আমার। রূপসীর এই বিয়ে যেমন করে হোক বন্ধ করতেই হবে। 
   ব্যোমকেশ বলল – কিন্তু কী করে? পথ কোথায়?
   আমি বললাম – আমরা সবাই মিলে ওর বাড়িতে গিয়ে ওর বাবাকে বোঝাবো। বলবো – এখনই রূপসীর বিয়ে দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। 

   ঈশিতা বলল – শুধু আমরা গিয়ে বললে হয়তো তেমন গুরুত্ব পাবে না। আচ্ছা – এটা করলে কী হয়?
  -কী বল? সোনালি প্রশ্ন করলো। 
  -বিষয়টা আগে হেডমাস্টারমশাইকে গিয়ে বলি চল। উনি কী ব্যবস্থা নেন, পরামর্শ দেন দেখা যাক না।
   ঈশিতার প্রস্তাবটা আমাদের সকলেরই মনে ধরল। ব্যোমকেশ নেতার মতো ভাব করে টেবিল চাপড়ে বলল – খাসা প্রস্তাব। প্রয়োজনে আমরা আন্দোলোনে নামব। 
   সেদিন টিফিন আওয়ারে আমরা ক্লাসসুদ্ধ হেডমাস্টারমশাই-এর রুমে গেলাম। হেডমাস্টারমশাই তপনবাবু একসঙ্গে আমাদের এতজনকে দেখে যারপরনাই অবাক হলেন। বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন – কী ব্যাপার? তোমরা সবাই একসঙ্গে আমার কাছে? কোনো সমস্যা –
   আমি বললাম – সমস্যা – মানে, আমরা রূপসীর ব্যাপারে কিছু কথা বলতে এসেছিলাম। 
  -রূপসী! কোন রূপসী?
  -রূপসী মণ্ডল স্যার। এবছরই নতুন এসে ভর্তি হয়েছে। যে মেয়েটি এবারে আবৃত্তিতে প্রথম হল। আপনি যার হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন। 
  -ও হ্যাঁ–হ্যাঁ, মনে পড়েছে, খুব ভালো মেয়ে, সব বিষয়েই তো চোস্ত। ক’দিন হল বিদ্যালয়ে আসছে না। হ্যাঁ বলো, কী বলবে তার ব্যাপারে। 
   ব্যোমকেশের যেন তর সইছিল না। বলল – সর্বনাশ হয়ে গেছে স্যার। কাল সবিতা ওদের বাড়ি গিয়েছিল। সবিতা জেনে এসেছে রূপসীর নাকি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। 
   হেডমাস্টারমশাই তপনবাবু হাসলেন। বললেন – তা বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বেশ তো। এ আর এমন কী নতুন কথা? তাছাড়া সর্বনাশের কথাই বা আসছে কেন?
   দেবানন্দ ফুঁসে উঠল – বলেন কী স্যার? মেয়েটার বয়স কত একবার ভেবে দেখেছেন? একটা কচি মেয়ে তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে – এটা তার সর্বনাশ করা হচ্ছে না? একটা স্বপ্ন অকালেই ঝরে যাবে স্যার? আপনি একটু আগেই তার সম্বন্ধে বলছিলেন না – একটা ভালো মেয়ে, বুদ্ধিমতী মেয়ে। 
   দেবানন্দের মুখ থেকে এমন তরো কথা শুনে তপনবাবু হতভম্ব হয়ে গেলেন। তারপর বললেন – দাঁড়াও দাঁড়াও, তোমরা তো ঠিক কথাই বলেছ। আমি তো এতটা তলিয়ে দেখিনি। তা রূপসীর জন্য আমাকে কী করতে বলছো তোমরা? 
   আমি বললাম – এ বিয়ে আমাদের যেমন করে হোক রুখতেই হবে স্যার। 
   আমার সুরে সুর মিলিয়ে সবাই সমস্বরে বলে উঠল – এ বিয়ে আমাদের রুখতেই হবে, রুখতেই হবে।
   ব্যোমকেশ আরও জোর দিয়ে বলল – রূপসীর ব্যাপারে যদি কোনো পদক্ষেপ আপনি না নেন স্যার তবে আমরা সবাই ক্লাস বয়কট করবো। 
   আমাদের ছাত্রছাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন হেডমাস্টারমশাই তপনবাবু। বই-এর ব্যাগ থেকে বই চুরি করে নেওয়া, কারো সাদা জামায় কালির ছিটে দেওয়া, কাগজের গোল্লা পাকিয়ে মেয়েদের দিকে ছুঁড়ে মারা, অফ পিরিয়ডে চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চ ভাঙচুর করা এইসব সমস্যা-অভিযোগ নিয়েই ছাত্রছাত্রীরা তাঁর কাছে এসেছে এতদিন। তপনবাবু তা দক্ষতার সঙ্গে এতদিন মিটিয়েও                                                                     এসেছেন। তপনবাবু আজও ভেবেছিলেন সেরকমই একটা কিছু অভিযোগ নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা এসেছে। কিন্তু না – আজ ছাত্রছাত্রীরা তাঁর কাছে এসেছে এক অভিনব সমস্যা নিয়ে। যার সঙ্গে সামাজিকও একটা বিষয় জড়িত। অল্প বয়সে বিয়ে – জগদ্দল পাথরের মতো সমাজের বুকে চেপে বসে থাকা এই একটি সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াই করতে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা এগিয়ে এসেছে আজ। ছাত্রছাত্রীদের মধ্য থেকে শুভবোধগুলো তাহলে হারিয়ে যায়নি। নবম শ্রেণির এই সব ছাত্রছাত্রীগুলোর জন্য আজ তাঁর খুব গর্ব হচ্ছে, আনন্দ হচ্ছে। 
   তপনবাবু কিছুটা ভাবলেন। তারপর বললেন – না-না, ক্লাস তোমাদের বয়কট করতে হবে না। ভাবছি কাল আমরা কয়েকজন শিক্ষক রূপসীদের বাড়ি যাব, রূপসীর বাবাকে বোঝাবো॰ আর হ্যাঁ, আজ যেমন তোমরা দলবেঁধে আমার কাছে এসেছো, কাল এমনিভাবে তোমরাও যেও রূপসীদের বাড়ি। মনে রেখো-কাল সকালেই যাচ্ছি। 
   

   পরের দিন সকালেই আটটা নাগাদ আমরা সদলবলে রূপসীর বাড়িতে পৌঁছলাম। আমরা ক্লাসের সব ছাত্রছাত্রীরা প্রায় এসেছি। হেডমাস্টারমশাই তপনবাবু এসেছেন। এসেছেন অভিজ্ঞ শিক্ষক সত্যেনবাবু আর ধর্মদাসবাবু। 

   রূপসীর বাবা দিবাকর মণ্ডল একটা গাইগরুকে ঘাস-খোল খাওয়াচ্ছিলেন। একসঙ্গে এতগুলো মানুষকে তার বাড়িতে আসতে দেখে কেমন হকচকিয়ে গেলেন তিনি। ঘাসের বস্তা ফেলে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। 
   হেডমাস্টারমশাই তপনবাবু প্রথম কথা বললেন। -আপনিই তো রূপসীর বাবা? দিবাকরবাবু না?
  -আজ্ঞে হ্যাঁ। 
  -নমস্কার। 
  -আজ্ঞে, নমস্কার। ভয়ে কোনোরকমে হাতদু’টো জড়ো করে কপালে ঠেকালেন দিবাকরবাবু। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন – আপনারা কোত্থেকে আসছেন বাবু?
  -মাধবপুর হাইস্কুল থেকে আসছি। আমি হেডমাস্টারমশাই। এনারা আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষক আর এদের দেখছেন – এরা সব ছাত্রছাত্রী। আপনার রূপসীর বন্ধু সবাই এরা। 
  -কেন এসেছেন, জানতে পারি কী মাস্টারবাবু?
  -আপনার মেয়ে রূপসীর বিষয়ে আমরা কিছু কথা বলতে এসেছি। 
  -রূপসীর কথা! কেন কী করেছে রূপসী? কিছু কী অন্যায় করেছে ও? ভয়ে শিউরে উঠলেন যেন দিবাকরবাবু। 
   তপনবাবু বললেন – না, রূপসী অন্যায় কিছু করেনি। ওর মতো ভালো মেয়ে হয় না। যা কিছু অন্যায়-অপরাধ করতে চলেছেন আপনি। 
  -আমি অন্যায় করতে চলেছি? অপরাধ করতে চলেছি? কী বলেন বাবু আপনারা?
  -শুনলাম, আপনি নাকি রূপসীর বিয়ের ঠিক করেছেন একথা সত্যি?
   দিবাকরবাবু ঘাড় নাড়লেন। বললেন – হ্যাঁ বাবু, ভুল শোনেননি। গরিব-গুরবো মানুষ আমরা। একটা ভালো পাত্র পেয়ে গেলাম তাই বিয়েটা দেব ঠিক করেছি। 
   সত্যেনবাবু বললেন – সাময়িক একটা ভালো দেখতে গিয়ে আপনার মেয়ের জীবনের কতবড়ো ক্ষতি-সর্বনাশ ডেকে আনছেন একবার ভেবে দেখেছেন কী? দিবকরবাবু – আপনার মেয়ের বিয়ের বয়স তো এখনো হয়নি। তবু বিয়ের জন্য কেন এত তাড়া?
   তপনবাবু বললেন – দিবাকরবাবু, এত অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দেবেন না। আমরা যদি এই বিয়েটা মেনে নিই সমাজের কাছে যেমনি অপরাধী থাকবো, তেমনি অপরাধী থাকবো রূপসীর কাছে। দিবাকরবাবু, রূপসী একটি রত্ন। ওর মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে হয় না। ও অনেক বড়ো হবে। দেখবেন লেখাপড়া শিখে ও আপনার বংশের এবং আমাদের বিদ্যালয়ের মুখ উজ্জ্বল করবে। তাই একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি আপনার কাছে। আপনি আপনার মেয়ের এই বিয়ের সম্বন্ধটা ভেঙে দিন। বলে দিন পাত্রপক্ষকে মেয়ের এখনো বিয়ের বয়স হয়নি। ও পড়াশোনা করবে। 
  -বিয়েটা তাহলে ভেঙে দেব বলছেন? ভালো একটা সম্বন্ধ –
   ধর্মদাসবাবু এবার মুখ খুললেন। তিনি বোঝালেন – দেখুন দিবাকরবাবু, মেয়ে যদি আপনার লেখাপড়া শিখে মানুষ হয় তবে ভবিষ্যতে আরও অনেক-অনেক ভালো সম্বন্ধ আসবে আপনার মেয়ের জীবনে। রূপসীকে বেড়ে ওঠার সুযোগ দিন। ও তো এখন কুঁড়ি। ফুল হয়ে ফোটার আগেই আপনি তাকে নিজের হাতে বাবা হয়ে মেরে ফেলতে চান? 
   তপনবাবু বললেন – দিবাকরবাবু, আমরা শিক্ষকমশাইরা চাই আপনার মেয়ে রূপসী লেখাপড়া শিখুক। তারপর আমাদের দেখিয়ে বললেন – এই যে এতগুলো ছেলেমেয়ে রূপসীর বন্ধুরা এসেছে এরও চায় রূপসী লেখাপড়ার জগতে ফিরে আসুক। আমরা সকলেই বড়ো আশা নিয়ে এসেছি। আপনি আমাদের ফিরিয়ে দেবেন না।
   দিবাকরবাবু একবার হেডমাস্টারমশাই –এর দিকে, একবার সত্যেনবাবু, ধর্মদাসবাবুর দিকে, একবার আমাদের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন – না মাস্টারবাবু, আমি আপনাদের ফিরিয়ে দেবনি। আপনারা যা বলছেন তাই হবে। মেয়ে আমার স্কুলে যাবে আজ থেকেই। তার প্রতি যখন এত আপনাদের মায়া দরদ-
   হেডমাস্টারমশাই বাধা দিলেন – না-না, এটা দরদের কথা নয়। লেখাপড়া শেখাটা আপনার মেয়ের প্রাপ্য অধিকার। সেই অধিকার থেকে আমরা শিক্ষকমশাইরা যেমন তাকে বঞ্চিত করতে পারি না, তেমনি আপনি তার বাবা হয়েও পারেন না। 
   


   রূপসীর বাবা কথা দিয়েছে রূপসী আবার স্কুলে যাবে। আমরা তো এটাই চাইছিলাম। সোত্‍সাহে আনন্দে আমরা হাততালি দিয়ে উঠলাম। ধন্যবাদ জানিয়ে হেডমাস্টারমশাই, ধর্মদাসবাবু, সত্যেনবাবু ফিরে এলেন। ফিরে গেল আমার বন্ধুরা। খুশিতে আমার বন্ধুদের চোখগুলো সব জ্বলজ্বল করছিল। 
   আনন্দের আতিশজ্যে আমি এতটা বিহ্বল, বিমোহিত হয়ে পড়েছিলাম যে আমি আরও কিছুক্ষণ রূপসীদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। রূপসী একছুটে আমার কাছে এগিয়ে এল। সটান আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল – তুমি আমার জোর বাঁচিয়ে দিয়েছ সবিতা। আমি তো মরেই গিয়েছিলাম। যেদিন আমার বাবা এসে বলল – তোর বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে। তোকে আর স্কুলে আর স্কুলে যেতে হবে না – সেদিন থেকে আমি গুমরে গুমরে মরেছি। আমি পড়তে চাই – অনেক অনেক দূর পড়তে চাই। অন্ধকারের দুয়ার ভেঙে তুমি আমাকে আলোর ঠিকানায় পৌঁছবার পথ করে দিয়েছ। তোমার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ সবিতা। 
  -দূর পাগলী। এ আর এমন কী করেছি রে? আমি বললাম। 
   রূপসী বলে চলল – সবিতা, তুচ্ছ ইংরেজি বানান আর তুচ্ছ আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় তোমাকে আমি হারিয়েছিলাম। জীবনের সবচেয়ে বড়ো পরীক্ষাটায় তুমি জিতে গেলে, আমি হারলাম। এত বড়ো হৃদয় তুমি কোথা থেকে পেলে সবিতা? 
  -তুমি নয়, বল তুই। আমি তোর বন্ধু না? 
   রূপসী আমার বুকে মুখ গুঁজে বলল – তোর জন্য আজ আমি আবার নতুন করে খোলা বাতাসের ঘ্রাণ নিতে পারছি, মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলতে পারছি। তুই আমার বন্ধু, সত্যিকারের বড়ো বন্ধু। 
   রূপসীর বাঁধভাঙা আনন্দের অশ্রুতে আমার বুক ভেসে যাচ্ছে। ততোধিক আনন্দে আমার চোখের জলও বাধা মানছে না। অদূরে দাঁড়িয়ে চোখ মুচছে রূপসীর মা-বাবা দুজনেই। আনন্দ করার দিন যে আজ তাদেরও। 
   প্রসন্ন প্রভাত আলোয় আলোময়। ঝলমল করছে চারদিক। ওদিকে দূর দিগন্তে ডানা মেলে ভাসছে একটা স্বপ্নের পাখি। 

                                ★★★

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *