ছোটগল্প;”মাটিতে যখন বৃষ্টি” লিখছেন-মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

গল্পকার হলেও কবিতার প্রতি তাঁর টান অন্তরের।এপার বাংলা ওপার বাংলা জুড়ে তিনি লিখে চলেছেন বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনসহ বানিজ্যিক পত্রিকাতেও।শিক্ষাশ্রী ও রাষ্ট্রপতি সম্মানে ভূষিত এবং তিনি সকলের বড্ড কাছের মানুষ।

মাটিতে যখন বৃষ্টি


মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

শেষ বোশেখের তপ্ত দুপুর। প্রচণ্ড দাবদহে পৃথিবীটা যেন জ্বলছে। তীব্র জ্বলুনিধরা ভ্যাপসা এক গরমে প্রাণ বেরিয়ে যাবার জোগাড়। এবার গরমটা যেন একটু বেশিমাত্রায় পড়েছে। পড়ারই কথা। কবে সেই কার্তিকের শেষ বৃষ্টি হয়েছিল – তারপর থেকে আজ বোশেখের শেষ সপ্তাহ হতে চলল – বৃষ্টি তো দূরের কোথা – এক চিলতে মেঘও আকাশের গায়ে ভেসে বেড়াতে দেখা যায়নি। মাঠজুড়ে আলের সব ঘাস শুকিয়ে একেবারে সাদা। পাকা শনদড়ির মতো দেখাচ্ছে। দেশলাই কাঠি মেরে দিলেই হল – জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাবে। দূরের-কাছের হেথা-হোথা বাঁশঝাড়ের মাথাগুলো সব ঝলসে গেছে। কেমন সাদা-ফ্যাকাশে-ন্যাড়া মতন দেখাচ্ছে। ঠিক যেন পাণ্ডুর রোগে দীর্ণ-জীর্ণ-ক্লিষ্ট এক একটা রোগী ঝিমোচ্ছে। একফোঁটা বৃষ্টির আশায়। উর্ধ্বপানে তাকিয়ে। সূর্যের বুক বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসা জ্বালাময়ী রশ্মি এ মুহূর্তে সাপের জিহ্বার মতন লকলক করছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না।
এই কাঠফাটা রোদ্দুর মাথায় নিয়েই পুড়ে-তেতে-ভেপে সাইকেল করে আসছিল প্রবীর। মাসিবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে সে। মা অনেক করে বলল – না করতে পারেনি প্রবীর। তবে মাসিবাড়ি আসার শখ তার এখন বেরিয়ে যাচ্ছে। গরমে এত কষ্ট পেতে হবে জানলে কোনোমতেই বের হতো না। কি ঝকমারিটাই না করেছে। তবে অনেকটা পথই চলে এসেছে। আর সামান্য পথ বাকি। সামনের যে গ্রামটা চোখে পড়ছে ওখানেই মাসিবাড়ি।
সরকারি অনুদানে তৈরি সদ্য মোরাম বিছানো রাস্তাটা ছেড়ে ঘোষালদের পুকুরপাড়ের সরু পথটায় উঠল প্রবীর। ঘোষালদের পুকুরের এই একটা বৈশিষ্ট্য – শত গ্রীষ্মেও জল একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে না। তাই প্রচণ্ড খরার দাপটে যখন সর্বত্র শুকিয়ে ফুটিফাটা – তখনও দিব্যি এই পুকুরে জল থৈ থৈ করছে। তবে গ্রাম থেকে বেশ খানিকটা দূরে বলে সচরাচর লোকজন বড়ো একটা আসে না এখানে। পুকুরের এই পাড়টা বেশ গাছ-গাছালিতে ভরা। কয়েকটা মস্তবড়ো মোটা আমগাছ তাদের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে দাঁড়িয়ে। আম ছাড়াও কয়েকটা হিজল, কত্‍বেল, আর জামগাছও মেলে ধরেছে তাদের সবুজ ডালপালা। রীতিমতো ছায়াঘন পরিবেশ।
প্রবীরের রোদে পোড়া ঘর্মাক্ত দেহটা এখানে এসেই কেমন যেন জুড়িয়ে গেল। সেই আরামেই বুঝি সাইকেল থেকে নেমে পড়ল সে। তারপর সাইকেলটাকে একটা গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে একটা রুমাল বের করে মুখটা মুছল। আ: দেহ-মনে কি প্রশান্তি এনে দিচ্ছে গাছের এই সুশীতল ছায়া। নড়তে যেন ইচ্ছে করে না। মায়ের বুকের স্নেহের মতোই এ ছায়া যেমন মধুর – তেমনই মমতামাখানো। অনায়াসে চোখ বন্ধ করে দু’দণ্ড ঘুমিয়ে নেওয়া যায়।
সেই খানিক দাঁড়িয়েছে প্রবীর। এমন সময় সামনের আম গাছটা থেকে টুক করে একটা আম খসে পড়ল। গাছে পাকা টুকটুকে রসালো আম। পেকে একেবারে টুসটুস করছে। লোভ সামলাতে পারে না প্রবীর। কুড়োবার জন্য ছুটে গেল। কিন্তু কুড়োবার আগেই আমটা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়বি তো পড় – একেবারে পুকুরের জলে পড়ে গিয়ে ডুবে গেল। ঐ জায়গার জল বেশ গভীর। হাতের নাগাল পাওয়া মুশকিল। আন্দোলিত জলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে শেষ নিরাশ হয়ে ফিরে আসছিল প্রবীর । আচমকা একটা মেয়ের সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর তার কানে এসে ধাক্কা মারল।
-কী হল? আমটা কুড়োতে পারলেন না তো?
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে প্রবীর। দেখলো ওপাশের ঘাটে একটি কুড়ি-বাইশ বছরের মেয়ে বসে আছে। তার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে। মেয়েটিকে এতক্ষণ খেয়ালই করেনি প্রবীর। হঠাত্‍ দেখে থতমত খেয়ে গেল। এমনটা যে ঘটবে ভাবতেই পারেনি সে।

জামা কাপড়ে সাবান দিচ্ছিল মেয়েটি। সে সব ফেলে উঠে দাঁড়াল। বলল – দাঁড়ান, আমি যাচ্ছি। আমটা আপনাকে কুড়িয়ে দেব।
প্রবীরের বড়ো লজ্জা হল। শুধু লজ্জা নয় – ঘাবড়েও গেল খানিকটা। নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিল। ইস-কি কুক্ষণেই যে আমটা কুড়োতে গিয়েছিল!
এদিকে বলতে না বলতেই মেয়েটি প্রায় ছুটে এসেছে প্রবীরের কাছে।
প্রবীর লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে বলল – না, থাক, কুড়োতে হবে না।
-থাক আবার কি! এমন সুন্দর পাকা আমটা জলে পড়ে মিছিমিছি নষ্ট হবে? বলে আমটা কুড়োবার জন্য জলের দিকে পা বাড়ালো মেয়েটি।
প্রবীর বাধা দিতে চাইল – না না, নামবেন না, অনেকটা জল, আপনার পোশাক ভিজে যাবে।
-ভিজলই বা। আমি তো স্নান করতেই এসেছি। কথা শুনলো না মেয়েটি। বেশ কুশলতার সঙ্গে জলে নেমে পড়ল। তার বুক পর্যন্ত ছুঁয়ে গেছে জল। আমটা খুঁজে পেতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। জলের তলা থেকে আমটা কুড়িয়ে প্রবীরের দিকে হাত বাড়ায়।
-এই নিন, ধরুণ।
-আপনি এত কষ্ট করে কুড়োলেন। আর আমি কিনা – প্রবীর আমতা আমতা করে। নেবে কি নেবে না ঠিক করতে পারছে না। একটা অজানা জায়গায় এসে একটি অচেনা মেয়ের হাত থেকে আমটা নেওয়া কী শোভনীয় হবে?
মেয়েটি তাড়া দেয়। -আগে নিন তো। তারপর কথা। জলে না পড়ে গেলে তো এতক্ষণে আমটা উদরসাত করে ফেলতেন। কই – নিন ধরুণ। খেয়েই দেখুন না। কি সুন্দর-মিষ্টি, মধুর মতো লাগবে। একবার খেলে আর ভুলতে পারবেন না। বলে একপ্রকার জোর করে প্রবীরের হাতে আমটা গুঁজে দিয়ে মেয়েটি ছুটে পালাল। যে ঘাটে বসে কাজ করছিল সেই ঘাটের দিকে।
নি:স্বার্থ–অমলিন প্রেমের দান ফেলে দেওয়া যায় না। সেটা যদি আবার কোনো যুবতী মেয়ের দেওয়া কোনো দান হয় – তবে তো কথাই নেই।
আমটা হাতে নিয়ে সাইকেলে চড়ে বসল প্রবীর। কামড় বসাবে কি বুকের গভীরে তখন শুরু হয়ে গেছে সামুদ্রিক হিল্লোল। হাজারো ঢেউয়ের দোলা ফুল ফোটাতে শুরু করেছে মনের কন্দরে। অপার এক ভালোলাগায় দেহের প্রতিটি বিন্দু যেন আনন্দে উদ্বেল হতে চাইছে। সাইকেলে প্যাডেল করছে প্রবীর – কোনরকম পরিশ্রমই বোধ হচ্ছে না। প্রখর সূর্যতাপে মাটি তেতে ব্যোম, বাতাস নয় – যেন আগুনের হলকা বইছে – সেসব কিছু এখন আর অনুভূতিতে আসছে না। হৃদয়ের মধ্যে ভালোবাসা জাগলে কী এরকমই হয়? কে জানে!
রাত্রে ভালো ঘুম হল না প্রবীরের। বারে বারে দুপুরে পুকুর পাড়ে দেখা তন্বী তনু যুবতী মেয়েটার মুখটাই ভেসে উঠছে। অনুভূতিতে শুরু হয়ে গেছে তারই নি:শব্দ পদচারণা। চোখের আড়াল হলে কী হবে – মনের দরজা ঠেলে মেয়েটি যেন দাঁড়িয়ে। অনেক না বলা কথার মালা সাজিয়ে। হাত থেকে আমটা নেওয়ার সময় মেয়েটির সঙ্গে একপ্রস্থ চোখাচোখি হয়ে যায় প্রবীরের। কি মায়াময় আবেগঘন দৃষ্টি নিয়ে মেয়েটি তার দিকে তাকিয়েছিল। প্রবীরের মনে হল – চোখ তো নয় যেন স্বচ্ছ সরোবর। অনন্ত জলরাশি নিয়ে টলটল করছে। সাঁতার কাটার জন্য তাকে ডাকছে। মেয়েটির সমস্ত শরীরজুড়ে খেলে যাচ্ছে অফুরন্ত যৌবন। জামাটা জলে ভিজে গিয়ে দেহের সঙ্গে সেঁটে গেছে। নিটোল-সুগঠিত-উঁচু দু’টো স্তন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে গভীর এক রহস্য নিয়ে। আবরণ ভেদ করে বলগাহীন হতে চাইছে যেন। অন্তর্বাস যে পরা ছিল না সেটা পরিষ্কার। এত কাছে থেকে এমন করে কোনো যুবতী মেয়ের বুক প্রবীর কী এর আগে কখনো লক্ষ্য করেছে? মনে হয় না। মেয়েটি কাছে – অতি কাছে দাঁড়িয়েছিল। কেমন একটা আবেশ করা সুঘ্রাণ নাকে এসে ঢুকেছিল তার। কোনও সুগন্ধি সাবানের নাকি মেয়েটির গায়ের গন্ধ বুঝতে পারেনি প্রবীর। প্রত্যেক যুবতী মেয়ের গা থেকেই কী এমন মাতাল করা গন্ধ বের হয়? জানে না প্রবীর। পৃথিবীতে তো কতজনই আছে। তবু কারো কারো বিশেষ কাউকে দেখার পর এমনটা হয়। কাছে পেতে ইচ্ছে করে। সঙ্গ লাভের সুখস্পর্শ পেতে সাধ জাগে। অচেনা গাঁয়ের এই মেয়েটিকে দেখার পর প্রবীরের এখন তাই হচ্ছে। তা না হলে এর আগে কলেজ –ইউনিভার্সিটি চত্বরে কত মেয়েই তো সে দেখেছে – ঘুরেছে। এমনটা তো হয়নি কখনো।
সকালবেলা প্রবীর চা খেয়েই বেরিয়ে পড়ল গ্রামের পথে। একা একা। উদ্দেশ্য গ্রামটা একটু ঘুরে দেখা। সাথে অবশ্য আর একটা উদ্দেশ্যও কাজ করছিল তা হল গতকাল পুকুরপাড়ের সেই মেয়েটির সাথে যদি কোনোভাবে আর একবার


দেখা হয়ে যায়। মেয়েটি তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তাকে দেখার প্রত্যাশায় তার মন এখন বড়োই ব্যাকুল উন্মনা-অস্থির। প্রবীর নিশ্চিত – মেয়েটি এই গ্রামেরই কোনো না কোনো বাড়ির হবে।
এই নিয়ে এই গ্রামে দুবার এল প্রবীর। প্রথমবার এসেছিল মায়ের সাথে সেই কোন ছোটবেলায়। প্রথম শ্রেণিতে সবে ভর্তি হয়েছে। তারপর এম. এসসি পাস করে দু’বছর চাকরি করা হয়ে গেল। দীর্ঘ এতগুলো বছরের ব্যবধান। স্বাভাবিকভাবেই এখনকার পথঘাট ঠিকমতন চেনা নেই তার। চিনলেও সে কবে ভুলে গেছে।
গাঁয়ের ছায়াঘেরা পথ ধরে হাঁটছিল প্রবীর। ধীর পায়ে। গ্রামটা বেশ শান্ত। ফাঁকা ফাঁকা। কোলাহল বলতে কিছু নেই – একমাত্র পাখিদের কলকাকলি ছাড়া। এমন উন্মুক্ত পরিবেশে নিজেও মুক্ত-উদাস হয়ে থাকা যায়। আম-জাম-তেঁতুল-কাঁঠাল-বাঁশঝাড় এসবের যেন আড়ত এখানে। ডোবা কিছু চোখে পড়ছে কিন্তু কোনোটাতেই এক বিন্দু জল নেই। প্রখর খরতাপে সবই শুকনো-খটখটে। আনমনাভাবে বেশ কয়েকটা ঘর পেরিয়ে এসেছে প্রবীর। এরপর কিছুটা ফাঁকা জায়গা। সেটা পেরোতেই একটা ডোবা ঘেঁষে একটা পাকা বাড়ি নজরে পড়ল। তাল-খেজুর ছাড়াও বেশকিছু নারকেল গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে বাড়িটার পিছনে। সামনে একটা গেট। সেটাও বাঁশ কঞ্চি দিয়ে তৈরি।
সেদিকে তাকাতেই সামনে যাকে দেখতে পেল তাতে চোখ আটকে গেল প্রবীরের। খুশিতে ছলছলিয়ে উঠল মুখমণ্ডল। পরীক্ষা দেওয়ার পর রেজাল্ট সিটে নিজের নাম দেখতে পেয়ে কোনো সফল পরীক্ষার্থীর চোখ-মুখ যেমন আনন্দে ঝলমল করে উঠে – তেমনি প্রবীরের চোখের কোণেও খুশির ঝিলিক খেলে গেল।
-আরে, এই তো সেই মেয়ে! যাকে দেখার জন্য মন তার ছটপট করেছে সারারাত। শ্লথ হয়ে গেল প্রবীরের চলার গতি। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
এদিকে মেয়েটির অবস্থাও তথৈবচ। প্রবীরকে যে এমনভাবে তার বাড়ির সামনে দেখবে তা তার কল্পনার মধ্যেই ছিল না। খানিকটা ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। চোখের পাতা তার পড়ছে না যেন। সে জল আনতে যাচ্ছিল। কলসিটা কাঁখে। বেমালুম ভুলে ভাবতে শুরু করল – এই ছেলেটিকেই না গতকাল দুপুরে ঘোষালদের পুকুর পাড়ে আম কুড়িয়ে দিয়েছিল জলের থেকে।
প্রথম কথা বলল প্রবীরই। কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়া ছেলে। সাহস তার যথেষ্টই আছে। গতকাল অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল – তাই তেমন কথা বলতে পারেনি। এখন তার সেরকম কোনো লজ্জা হচ্ছে না। তাই কোনোরকম সঙ্কোচ না করেই জিজ্ঞেস করল – কিছু মনে করবেন না। আপনার কী এখানেই বাড়ি?
মেয়েটি এতক্ষণ একটা ঘোরে ছিল। প্রবীরের প্রশ্নে সজাগ-সচকিত হয়ে উত্তর দিল
-অ্যাঁ, হ্যাঁ, এখানেই তো। এই যে বাড়িটা দেখছেন – এটাই আমাদের।
-আপনি কিন্তু কাল আমায় আম কুড়িয়ে দিয়েছিলেন। মনে আছে?
মেয়েটি হাসল। সে হাসির কী গভীর ব্যাপ্তি! হাসি তো নয় যেন ভোরের প্রসন্ন সূর্যালোক ঝরে পড়ল। মেয়েটি বলল- কেন মনে থাকবে না। আপনি তো প্রথমে নিতেই চাচ্ছিলেন না। আমিই তো জোর করে গুঁজে দিয়েছি।
-তা অবশ্য বটে।
-আচ্ছা, গতকাল আর আজ – এই দু’দিন ছাড়া এর আগে আপনাকে দেখেছি বলে তো মনে হয় না। কোথায় এসেছেন আপনি?
-আপনাদের গ্রামেই তো এসেছি। প্রবীর বলল।
-কাদের বাড়ি?
-ওই যে ও পাড়ায় রমেশ মণ্ডল আছে না?
-রমেশ মণ্ডল। ও – বুঝেছি, আপনি শম্ভুদের বাড়ি এসেছেন?
-হ্যাঁ। প্রবীর ঘাড় নাড়ল।
-তা সম্পর্ক?
-ওটা আমার মাসিবাড়ি। ছোট মাসির। একেবারে নিজের। আর আমার নাম হচ্ছে প্রবীর।
কথাটা বলা তখনো শেষ হয়নি – একেবারে প্রবীরের মুখের থেকে কথাটা নিয়ে বলল – ও। আপনি প্রবীরদা! আরে আগে বলবেন তো। আনন্দে চঞ্চল হয়ে উঠল মেয়েটি।
প্রবীর অবাক হয়ে জানতে চাইল – আপনি কী আগে থেকে আমার নামটা জানতেন?
একমুখ স্নিগ্ধ হাসি ছড়িয়ে মেয়েটি বলল – বারে! কেন জানব না। আপনার কথা আমি শুনেছি লতা মাসির মুখে। শম্ভুর মা যেমন আপনার মাসিমা – তেমনি উনিও আমার লতা মাসি। আপনি এখন শিক্ষকতা করেন-না? গতবারই তো এস এসসি দিয়ে পেলেন?

প্রবীর ঘাড় নাড়ল।
মুখটা ফ্যাকাশে করে মেয়েটি বলল – দেখুন তো, কী অন্যায়টাই না করে ফেলেছি আমি।
-অন্যায়টা কিসের শুনি?
আপনাকে এতক্ষণ বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছি – এটা অন্যায় নয়? –আসুন বাড়ির ভিতরে আসুন।
-আপনি জল আনতে যাচ্ছিলেন না?
-সে পরে আনবো’খন। আগে আসুন তো বাড়ির ভিতরে। আর একটা কথা। আমাকে আপনি ‘আপনি’ ‘আপনি’ করবেন না। কানে বড়ো খটকা লাগছে। আমি শম্ভুর বয়সী। একই সঙ্গে পড়তাম। বুঝতেই পারছেন – বেশ ছোটো। আমার নাম রিমা। ওই নামেই ডাকবেন – কেমন?
সামনে এক চিলতে বারান্দা। তারই এক পাশে একটা তক্তপোশ পাতা রয়েছে। তার উপরে মাদুর বিছিয়ে রিমা প্রবীরকে বসতে দিল। প্রবীর দেখল চারিদিক বেশ ঝকঝকে-তকতকে। পরিপাটি করে সাজানো-গোছানো। রিমার মতো অসাধারণ সুন্দরী মেয়েকে এ বাড়িতেই যেন ঠিক মানায়। মুগ্ধনেত্রে বাড়ির সবকিছু দেখছিল প্রবীর। এখনও পর্যন্ত তার বিশ্বাস হচ্ছে না – যাকে দেখার জন্য তার মন এত তোলপাড় হচ্ছে – সত্যি সত্যি সেই মেয়েটিই এখন তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু দাঁড়িয়ে থাকা নয় – তার বাড়ি পর্যন্ত এসে উপস্থিত হয়েছে।
প্রবীরকে বসিয়েই রিমা ছোটো কচি খুকির মতো চিত্‍কার শুরু করে দিল – মা-মা, কী করছো? কোথায় গেলে তুমি?
ভদ্রমহিলা ঘরের ভিতরে কি যেন করছিলেন, সেখান থেকেই উত্তর দিলেন – এই যে রে আমি এখানে। কী হয়েছে? এটি চিত্‍কার করছিস কেন?
আনন্দে একেবারে বিগলিত হয়ে রিমা বলল – কী করছো? বেরিয়ে আসবে তো আগে। কাকে এনেছি দেখবে এসো না।
রিমার মা বেরিয়ে এলেন মেয়ের ডাকে। ভদ্রমহিলাকে দেখেই চমকে উঠলো প্রবীর। ভদ্রমহিলা রিমার মতোই দেখতে। বয়স হয়েছে এই যা। প্রবীর বুঝল রিমা তার মায়েরই আদল পেয়েছে।
রিমা পরিচয় করিয়ে দিল – প্রবীরদা, এই আমার মা। আর মা, ইনি হচ্ছেন প্রবীরদা, প্রবীর সামন্ত। শম্ভুর মাসতুতো দাদা। হাইস্কুলের শিক্ষক, পদার্থবিদ্যার।
প্রবীর উঠে রিমার মাকে প্রণাম করল।
দুহাত তুলে ভদ্রমহিলা আশীর্বাদ করলেন। – বেঁচে থাকো বাবা-বেঁচে থাকো। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। তা বাবা, হঠাত্‍ এখানে চলে এলে যে বড়ো?
-অনেকদিন আসিনি। মাসিমা ডেকেছিলেন। তাই চলে এলাম। গ্রীষ্মের ছুটিটাও পড়ে গেল। ভাবলাম দু’পাঁচদিন ঘুরেই আসি। প্রবীর বলল।
-ভালো করেছ বাবা, খুব ভালো করেছ।
রিমা এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। বলল – প্রবীরদা, মায়ের সঙ্গে গল্প করুন। আমি ততক্ষণে জলটা নিয়ে চলে আসি। রিমা বেরিয়ে গেল।
এটা-সেটা গল্প করতে করতে প্রবীর রিমাদের বাড়ির সংক্ষিপ্ত একটা ইতিহাস জেনে নিল। রিমার বাবা তিনবছর হল গত হয়েছেন। দর্শনের শিক্ষক ছিলেন। সময় হয়নি মানুষটার – তবু চলে গেলেন। রিমার এক দাদা আছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কে চাকরি করে। বিয়ে করে শহরেই থাকে। বড়ো একটা আর আসে না। রিমা পড়ছিল ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে। একবছর হল কলেজ যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
এরই মধ্যে রিমা জল নিয়ে ফিরে এসেছিল। এসেই বলল – প্রবীরদা, কী খাবেন এখন? চা করি –
প্রবীর বাধা দিল – না-না, চা আর খাবো না। এইমাত্র মাসিমার করা চা খেয়েই বেরিয়ে এসেছি। আর খাবো না।
-তাহলে মুড়ি খান নারকেল দিয়ে। গাছের পাকা নারকেল আছে।
-শুনেই তো খাবার লোভ হচ্ছে। সত্যি বলতে কি নারকেল মুড়ি আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার। কিন্তু এখানে খেয়ে গেলে মাসিমা যদি কিছু ভাবেন?
-না, কিছু ভাববেন না উনি। আমার কথা বলবেন। বলবেন – রিমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম – ওখানেই খেয়ে এসেছি। দেখবেন মাসিমা আর কিছু বলবেন না। বলেই আর দেরি না করে প্রবীরের জন্য খাবার তৈরির কাজে মন দিল রিমা।

মুড়ি দিল। সঙ্গে শশাকুচি আর চানাচুর। একটা গোটা নারকেল কেটে টুকরো টুকরো করে কেটে বাটিভরে সামনে ধরে দিল। নারকেল নাড়ু ছিল ঘরে, তাও এনে দিল।
নারকেলের একটা টুকরো চিবোতে চিবোতে প্রবীর বলল – গাছের নারকেল খেয়ে কি মজা! আমাদের ওখানে তো নারকেল পাওয়া যায় না এরকম। কিনে খেতে হয়। ক’দিন আর কিনে খাওয়া যায় বলো?
রিমা হাসতে হাসতে বলল – এবার থেকে যখনই আপনার নারকেল খাবার ইচ্ছে হবে, চলে আসবেন। পেটপুরে নারকেল খেয়ে যাবেন। আপনি এলে আমরা খুশিই হব।
প্রবীর মুখে কিছু বলল না ঠিকই – তবে মনে মনে বলল – আসবো রিমা, নিশ্চয়ই আসবো। যাতে করে সবদিনের জন্যই এখানে আসা যায় তার পথই তৈরি করে যাব। অবশ্য তুমি সম্মত হলে।

ঘন্টাদেড়েক পড়ে প্রবীর ফিরতেই মাসিমা জিজ্ঞেস করলেন – কিরে, রিমাদের বাড়ি গিয়েছিলি?
কথাটা শুনে কেমন যেন লজ্জায় পড়ে গেল প্রবীর। এরই মধ্যে মাসিমা সব জেনে ফেলেছে। থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলো – আপনি জানলেন কী করে মাসিমা?
মাসিমা হেসে জবাব দিলেন – ওরে বোকা ছেলে, রিমা যে নিজে এসে একথা বলে গেছে আমাকে।
রিমা এখানে এসেছিল! প্রবীর অবাক হল। তারপর ভাবল – হতে পারে হয়তো। জল আনতে গিয়েছিল তো। ঐ সময়েই হয়তো টুক করে মাসির কাছে এসেছিল। আচ্ছা বিচ্ছু মেয়েরে বাবা। আমাকে সে কথাটা জানালো না!
প্রবীর যেন কি ভাবছিল। মাসিমা জিজ্ঞেস করলেন – হ্যাঁরে, রিমাকে তো দেখলি। খুব ভালো মেয়ে না রে?
-ভালো কি মন্দ বুঝবো কী করে? এই তো সবে একঘন্টার পরিচয়। গতকালের কথাটা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেল। একটু থেমে আবার বলল – অত খোঁজে আমার দরকার কী মাসিমা? ডাকল – তাই গিয়েছিলাম। মুড়ি খেতে দিল, খেলাম। ব্যবহারটা অবশ্য খারাপ করেনি।
-তোর পছন্দ হয়েছে?
-কেন আমার পছন্দ অপছন্দে কী যায় আসে? বেশ সপ্রতিভভাবেই জানতে চাইল প্রবীর।
মাসিমা রাখ-ঢাক না করেই বলে ফেললেন – ভাবছি ওকে আমাদের বৌমা করলে কেমন হয়? অবশ্য তোর মত থাকলে তবেই কথাটা পাড়তে পারি।
কথাটা শোনামাত্র আরক্তিম লজ্জায় ঘিরে ধরল প্রবীরকে। লজ্জাবনত স্বরে বলল – ধ্যেত্‍ ওকে আমার বিয়ে করতে বয়েই গেছে। বলেই মাসিমার সামনে থেকে দ্রুত সরে পড়ল। রিমাকে সে ভালোবেসে ফেলেছে – এটা সে এত তাড়াতাড়ি প্রকাশ করতে চায় না।

মাসিবাড়িতে পাঁচদিন ছিল প্রবীর। এই সময়ের মধ্যে সে বেশ কয়েকবার ছল-ছুতো করে এসেছে রিমার কাছে। ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে দু’জনের। অপরিচিতের সীমা টপকে প্রণয়মুগ্ধ দুটি হৃদয় একে অন্যের কাছাকাছি এসেছে। ক্ষণিকের ভালোলাগা কখন পর্যবসিত হয়ে গেছে শাশ্বত ভালোবাসায়। চিরকালীন প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হবার স্বপ্নজাল রচনা করেছে। একদিন দু’জনে বেড়াতে বেড়াতে কাঁসাই নদীর ধার পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। নিরিবিলিতে গিয়ে বসেছিল দু’জনে। কত কথা-গল্প-গান যেন ফুরোতেই চায় না। পাখি-গাছপালা- নদী এসব নিয়ে কথা বলতে বলতে হঠাত্‍-ই প্রবীর জানতে চেয়েছিল – রিমা, তুমি আর পড়াশোনা করলে না কেন?
প্রশ্নটা শুনে চঞ্চলা-উচ্ছলা রিমা কেমন যেন মিইয়ে গেল। বেদনায় আর্দ্র হয়ে উঠল তার দু’চোখের কোণা। বিষন্নতা গ্রাস করল রিমাকে। আড়ষ্ট গলায় বলল – কী করে পড়াশোনা করবো? পয়সা কোথায়? মায়ের মুখে তো শুনেইছেন – দাদা আর মোটেই টাকা-পয়সা পাঠান না। বৌ-এর শাড়ি-গয়না কিনে দিতে আর স্ট্যাটাস বজায় রাখতেই নাকি রোজগারের সবটাই খরচ হয়ে যায়। বাবাও কিছু রেখে যেতে পারেননি। অকালে চলে গেলেন। মা কদ্দিন আর সামলাবেন। পড়াশোনা তাই ছাড়তে হল।
রিমার কথা বলা শেষ হতেই প্রবীর বলল – রিমা, ধরো তোমাকে যদি কেউ পড়ায় তুমি পড়বে?
-এত সৌভাগ্য কী আমার হবে? পড়াবেটা কে শুনি?
সহসা রিমার দুটি হাত নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে প্রবীর বলল – ধরো না আমি, এই আমি যদি তোমাকে পড়াই?
রিমা মুগ্ধনেত্রে প্রবীরের মুখের দিকে তাকাল। প্রথমটায় তার মনে হল প্রবল উচ্ছ্বাসে সাগরের ঢেউয়ের মতো প্রবীরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। পরক্ষণেই বিচলিত হয়ে উঠল। প্রবীরের হাতের মুঠো থেকে নিজের হাতদুটো প্রায়

ছিনিয়ে নিয়ে রিমা বলে উঠল – আপনি আমায় পড়াবেন! কেন শুনি? আপনি আমার কে? আপনার সঙ্গে আমার কিসের সম্পর্ক? না – কারো দয়া আমি চাই না। বুক উথলে বেরিয়ে আসা কান্নাটাকে চেপে ছুটে পালিয়ে গেল রিমা। প্রবীরের সাধ্য হল না যে ধরে রাখে।
যেদিন মাসিবাড়ি ছেড়ে চলে আসবে প্রবীর তার আগের দিন বিকেলে রিমার সঙ্গে দেখা করতে এল প্রবীর। শেষবারের মতো। রিমাকে চোখের আড়ালে রাখতে হবে – ভাবতেই বুকটা তার ব্যথায় টনটন করছে। কেমন যেন একটা অসম্ভব কষ্ট বোধ হচ্ছে। কিন্তু তা প্রকাশ হতে দিতে চায় না প্রবীর। এখান থেকে তো তাকে যেতে হবেই। না গেলে তো কোনো ব্যবস্থাও সে নিতে পারছে না।
রিমা তক্তপোশে বসে শাড়িতে ফলসপাড় বসাচ্ছিল। প্রবীরকে দেখে উঠে দাঁড়াল। ছুঁচ-সুতো পাশে ঠেলে প্রবীরকে বসার জায়গা করে দিল।
প্রবীর দেখল – রিমা আজ শাড়ি পরেছে॰ শাড়িতে রিমাকে আরো সুন্দরী লাগছে। একটা বাড়তি সৌন্দর্য যেন এনে দিয়েছে। মাথাভর্তি ঘন কালো চুল। সাবান দেওয়ার দরুণ বাতাসে ফুরফুর করে উড়ছে তার কতক। তবে অন্য দিনের থেকে আজ রিমার উচ্ছ্বাস যেন বেশ কম। মুখের হাসিটাও মলিন। প্রদীপের তেল শেষ হয়ে গেলে নিভে যাবার আগে যেমন মিজিমিজি জ্বলে – রিমাকেও সেরকম দেখাচ্ছে। একটা গাম্ভীর্যভাব এসে রিমার মুখে যেন ছায়া ফেলেছে।
প্রবীর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই বলল – রিমা, কাল কিন্তু আমি চলে যাচ্ছি।
রিমা কিছু বলল না। যেমন দাঁড়িয়েছিল তেমনি দাঁড়িয়ে রইল। এমন একটা ভাব দেখাল যেন প্রবীরের কথাটা তার কানেই যায়নি।
প্রবীর অবাক হল। বলল – রিমা, কী হয়েছে তোমার আজ? কথা বলছ না যে বড়ো? মন খারাপ?
আঙুলে শাড়ির আঁচল জড়াতে জড়াতে রিমা বলল – মন খারাপ করবে কেন? আপনি যাবেন এতে মন খারাপ হওয়ার কী আছে? ক’দিনের আর পরিচয় বলুন? দু’দিনের বন্ধু এসেছেন – চলে যাবেন, এটাই তো স্বাভাবিক।
-কিন্তু রিমা, আমার যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তোমাকে ছেড়ে যেতে।
-হতে পারে। রিমা হাসল। হাসিতে সেই আগের ঝিলিক নেই। শেষ বেলার সূর্যের অস্ত যাওয়ার আলোর মতোই ধূসর-ম্লান।
-হতে পারে কী? হচ্ছে। তোমাকে বলে বোঝাতে হয়তো পারছি না আমি।
রিমা এবার একটু জোর করেই হেসে উঠল – আচ্ছা বাবা তাই। হচ্ছে। স্বীকার করলাম।
প্রবীরের যদি তৃতীয় আর একটা চোখ থাকতো – তবে বুঝতে পারত – এই মুহূর্তে রিমার বুকেও কি হাহাকার চলছে। প্রবীরকে ভুলে থাকতে হবে – এই কথাটা তাকে কি মরমেই না মেরে দিচ্ছে।
-মাসিমাকে দেখতে পাচ্ছি না, কোথায় গেলেন?
-আজ রবিবার না? টিভিতে ভালো বই হচ্ছে। তাই রাস্তার ওপাশে একটা বাড়িতে গেছে। সন্ধের আগে ফিরছে না। তারপর একটু হেসে রিমা বলল – কাল তো চলে যাচ্ছেন। আর কবে আসবেন কি আসবেন না ঠিক নেই। শেষবারের মতো চা খাইয়ে দিই কী বলেন?
কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে প্রবীর বলল – চা করবে? ঠিক আছে করো।
রিমা রান্নাঘরে ঢুকে গেল। চা ফুটে গেছে কেটলিতে। ছেঁকে কাপে ঢালতে যাবে রিমা দেখে প্রবীর কখন চুপিসারে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
-একি! আপনি রান্নাঘরে চলে এসেছেন?
প্রবীর ফিসফিসিয়ে বলল – হ্যাঁ, এসেছিই তো। এই ক’দিনে অনেকগুলো দোষ তুমি করেছ আমার কাছে। তার শাস্তি বুঝি পেতে হবে না? এই নির্জন রান্নাঘর ছাড়া সেই শাস্তি দেবার মোক্ষম জায়গা আর কোথায় পাব শুনি? – বলেই দু’হাত বাড়িয়ে রিমাকে জাপটে ধরল। তারপর রিমার মুখে মুখ রেখে চুমু খাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল।
রিমা বলল – আ: – করেন কী? ছাড়ুন-ছাড়ুন। দুষ্টুমি করবেন না। এখন আমায় ছুঁতে নেই।
-ছুঁতে নেই! প্রবীরের বাহুবন্ধন আচমকা শিথিল হয়ে গেল। বলল – ছুঁতে নেই! ছুঁতে নেই কেন শুনি?
গভীর রহস্যের মায়া সৃষ্টি করে রিমা বলল – বোকা ছেলে, ওটাও বলে দিতে হবে। মেয়েদের কী হয় জানেন না? এই চারটে দিন পুরুষের সংস্রব এড়িয়ে থাকতে হয়, বুঝেছেন?
-বুঝলাম, প্রবীর বলল। -তবে কিন্তু শাস্তির মাত্রা তোমার আরো বেড়ে গেল। একদিন কড়ায়-গণ্ডায় পুষিয়ে নেব – এই বলে রাখলাম। সব তোলা রইল।

চায়ের কাপটা দিতে দিতে রিমা বলল – দেখবেন, শাস্তিটা যেন একটু লঘু হয়।
-গুরু পাপ করে লঘু শাস্তির কথা ভাবো কী করে?
-আচ্ছা, বাবা বেশ। না – হয় আমাকে মেরেই ফেলবেন সেদিন। তাহলে হবে তো? আগের মতোই হাসিতে সেই দ্যুতি ছড়ানো। মনোরম-সুন্দর-প্রসন্ন!
চা খাওয়া শেষ করে রান্নাঘর থেকে যখন দু’জন বেরিয়ে এল দেখল কেমন যেন একটা অন্ধকার নেমে এসেছে চারপাশে। এ সন্ধের অন্ধকার নয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে রিমা চিত্‍কার করে উঠল – প্রবীরদা, দেখুন দেখুন, পশ্চিম আকাশের দিক থেকে কী প্রচণ্ড একটা মেঘ ধেয়ে আসছে! সাদা বক উড়ছে কত! আজ আর বৃষ্টি না হয়ে যাবে না।
প্রবীর বলল – ভালোই তো। কতদিন বৃষ্টি হয়নি। মাটি ভিজে নরম তুলতুলে হবে। ঠাণ্ডা-শীতল হবে। এই যেমন তুমি এসেছো আমার জীবনে – আমার তপ্ত বুককে ঠাণ্ডা করতে।
-ধ্যেত্‍, অসভ্য কোথাকার। সবেতেই আমাকে টেনে আনা। লাজুক চোখে স্বপ্নময় ইঙ্গিত রিমার।
-না, আমি যাই।
-যান, তাড়াতাড়ি যান। ঝড় উঠবে মনে হচ্ছে। নাহলে বরং আসুন, বৃষ্টি থমলে যাবেন।
প্রবীর মাথা ঝাঁকাল – না, যাই। ব্যাগ গোছাতে হবে।
প্রবীর রাস্তায় নেমে দৌড়তে শুরু করে দিল।


এরপর দিন সাতেক কেটে গেছে। তারপর এক দুপুরে প্রবীরের মাসি হঠাত্‍-ই রিমাদের বাড়ি ছুটে এল। উঠোনে পা দিয়েই ডাকতে শুরু করল – সরমাদি – সরমাদি, কি করছো? ও সরমাদি –
দুপুরের খাওয়া শেষ করে রিমার মা সরমাদেবী সবে বিশ্রাম নেবেন বলে ঠিক করেছেন – এমন সময় বাইরে কার ডাক শুনে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। দেখলেন প্রবীরের মাসি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।
-ও-মা-লতা! তুমি এসেছো? কি ব্যাপার? এই পোড়া রোদে ছুটে এসেছো?
তক্তপোশে বসতে বসতে প্রবীরের মাসি বললেন – ভালো খবর আছে দিদি। সুসংবাদ বোলতে পার।
-কিসের সুসংবাদ?
-আমার বড়দি মানে প্রবীরের মা চিঠি দিয়েছে।
-কী লিখেছে?
-পড়েই দেখো না। সব জানতে পারবে। খোলা চিঠিটা সরমাদেবীর দিকে বাড়িয়ে দিলেন লতাদেবী।
এদিকে রিমা গল্পবই পড়ছিল। প্রবীর চলে যাওয়ার পর থেকে মনটা তারও ভালো নেই। কেমন আনচান করছে সর্বদা। সেসব কষ্ট ভুলতেই গল্পবই নিয়ে বসেছিল সে। লতা মাসির হাঁকাহাঁকি আর ডাকাডাকিতে সেও বই ফেলে ছুটে এসেছে।
সরমাদেবী চিঠিটা রিমার হাতে দিয়ে বললেন – পড় তো মা রিমা। প্রবীরের মা কি লিখেছে শুনি। এখন ভালো পড়তে পারিনা। চোখে কেমন ঝাপসা মতন দেখি।
রিমা ছোঁ মেরে চিঠিটা নিয়ে খুলে পড়তে শুরু করল। সবার থেকে তারই যেন বেশি আগ্রহ জানার – প্রবীরের মা কি লিখেছেন। মন তর সইছে না।
প্রবীরের মা লিখেছেন –
কল্যাণীয়া –
লতা, তুই আমার স্নেহ, আদর ও ভালোবাসা নিস। আশা করি তোরা সবাই একপ্রকার ভালোই আছিস। পরে লিখি যে – প্রবীর তোদের গ্রামে গিয়েছিল। কে রিমা নামে একটি মেয়ে আছে তোদের ওখানে – প্রবীরের তাকে পছন্দ হয়েছে। এবার তোদের পছন্দ থাকলে সেই রিমাকে আমাদের পুত্রবধূ করতে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। যত শীঘ্র পারিস – মতামত জানিয়ে চিঠি দিস।

                                                            ইতি-                                                         তোর বড়দি


চিঠিটা পড়া শেষ করেই চলে যাচ্ছিল রিমা। বুকে তার বাজছে খুশির সানাই। বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে কাঁপছে তার দেহ-মন সব। এ সময়ে একটু একা না থাকতে পারলে মনের এই আনন্দটাকে পুরোপুরি যেন উপভোগ করা যাবে না। লতাদেবী ডাকলেন – চলে যাচ্ছ যে রিমা। তোমার মতটা বলে যাও। আজকালকার আধুনিক যুগের মেয়ে তোমরা। তোমারও একটা নিজস্ব মত আছে। একতরফা ছেলেদের মতেই তো চলতে পারেনা। আমাদের প্রবীরকে তোমার মনে ধরেছে তো?
-যাও তোমরা – বলে ঘরে ঢুকে বালিশে মুখ গুঁজে দিল রিমা। এখন তার আনন্দে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। তার চোখের জল দিয়ে প্রবীরের মায়ের পা দু’টো ধুইয়ে দিলে বুঝি সে শান্ত হবে।

ফুলশয্যার মধুর রাত। এ ঘরে এখন ওরা দু’জন – প্রবীর আর রিমা। প্রবীর যেমন তেমনই কিন্তু রিমা সেজেছে। চন্দনচর্চিত কপাল, গলায় ফুলের মালা, সিঁথিতে জ্বলজ্বল করছে লাল সিঁদুরের টিপ, খোঁপায় করবীর গুচ্ছ, জরির পাড় বসানো বেনারসী শাড়ি। অপরূপ রূপে রাঙা হয়ে উঠেছে রিমা। আলোর রোশনাই – ফিকে নীল বেগুনি-হলদে রঙের ফুল হয়ে ঝরছে। সবে মিলে এক নয়নাভিরাম ছবি। সৌন্দর্য যেন লুটোপুটি খাচ্ছে এখন এসময়।
প্রবীর কথা বলল – কি রিমা, আর তো পালাবার উপায় নেই। এখন যদি আমার পাওনাটা সুদে-আসলে মিটিয়ে নিই, কী করবে এবার?
রিমা কিছু বলল না। আসলে বলতে পারল না। এখন সে বাকহারা। এখানকার এই মোহনীয় পরিবেশ যেন তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের এক জগতে। সে হারিয়ে যাচ্ছে।
প্রবীর উঠে গিয়ে রিমাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর তার কামনাচঞ্চল ঠোঁটদুটি রাখল রিমার ঠোঁটের উপর। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিল। মুখ-চোখ-কপাল-বুক-পেট-নাভি-জঙ্ঘা কোনো জায়গাটাই বাদ রাখল না।
এক অভূতপূর্ব সুখের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে রিমা পড়ে রইল। চোখ তার বন্ধ অপার-অসীম ভালোলাগায়। তার মনে হতে লাগল এই শুভক্ষণে এমন ভালোবাসার মানুষকেই তো এইভাবে সবকিছু নিংড়ে দেওয়া যায়। স্বচ্ছন্দে তুলে দেওয়া যায় দেহ-মন-মনের কামনা-বাসনা, শরীরের যাবতীয় গোপনীয়তাটুকু। রিমার আরো মনে হল – সে যেন এই মুহূর্তে নরম একটা কাদার ডেলা। প্রবীর একে নিয়ে যা খুশি করুক। আজ আর বাধা দেবে না।

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *