নামকরণ
ধনঞ্জয় দেবসিংহ
ছবিঃ গৌতম মাহাতো
রাত বারোটা। গ্রামীণ হাসপাতালের ওয়েটিং রুম। হালকা শীত। কম্বল মুড়ি দিয়ে অনেকের সঙ্গে সুবল। একজন ষাটোর্ধ মহিলা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সোজা ওয়েটিং রুম।
– সুবল, ওঠ। তোর ছেলে হয়েছে।
মায়ের ডাকে হুড়মুড়িয়ে ওঠে সুবল।
কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর সুবলের মা হাসপাতালের ভেতরে চলে গেল। সুবলের আর সারা রাত ঘুম এল না। সুবল মাহাত। চাষি মানুষ। বয়স চল্লিশ পার। এতদিন বাবা হতে পারেন নি। অনেক জায়গায় ডাক্তার দেখানোর পর আজই বাবা হল।
একটু একটু পরিস্কার হচ্ছে চারপাশ। পাখিরা ডাকাডাকি শুরু করেছে। গ্রামের রাস্তায় বাস কম চলে। যে বাসটা সুবলদের গ্রাম হয়ে যাবে, সেটা আসবে সকাল ন’টায়। অতক্ষণ অপেক্ষা করলে দেরী হয়ে যাবে। সুতরাং হাঁটা শুরু করল সুবল।
গতকাল বিকেলে হাটে গেছল সে। তখনই ফোনটা যায়।
-তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আয়। বউমার ব্যথা উঠেছে।
বউমাকে নিয়ে সেন্টারের গাড়িতে হাসপাতাল যাচ্ছি। তুই বাসে চলে যাবি।
বাড়ি ফিরে সুবলকে এত তাড়াতাড়ি বাস ধরতে হল যে মোবাইলটা নিতে ভুলে গেছে, নাহলে ফোন করে নিত তন্ময়দাকে। ফোনেই কাজ হয়ে যেত। এত সকালে গ্রামে ফিরতে হত না। তন্ময়দাকে সুবলের খুব ভালো লাগে। তন্ময়দার লেখা গুলো যেন তার অন্তরে প্রবেশ করে। লেখাগুলো তো লেখা নয়,
গ্রাম বাংলার প্রাত্যহিক জীবন যাত্রার কাহিনীর বাংলা ভাষায় লিখিত রূপ। বাংলার মাঠে গরু চরা, পুকুরে জাল ফেলা, গাছের পাতা ঝরা, উঠোনে ধান শুকোতে দেওয়া, লাউমাচার তলায় মুরগী বাচ্চার খাবার সংগ্রহ, ধান লাগানো, ধান কাটা এই সব বিষয় নিয়ে লেখে তন্ময়দা। সুবল বোঝে, যেন তার কথায় লিখছে তন্ময়দা। এই সব শুনতে শুনতে সুবল অনেককদিন আগেই স্থির করে রেখেছিল, যদি তার কোনো ছেলেমেয়ে হয়, তবে তার নাম এমন রাখবে
যেন নামটা শুনলেই বাঙালী মনে হয়। কেননা, বাংলায় থেকে বাংলার ভাত খেয়ে আমরা যদি বাংলাকে ভুলে যাই, তবে তা হবে অকৃতজ্ঞতার কাজ। কিন্তু বর্তমানে বাবা মায়েরা প্রথমেই অর্থাৎ বাচ্চাদের নামকরণের সময়েই এমন সব নাম রাখে যে, সে সব নামের মধ্যে বাঙালীর গন্ধটুকুও থাকে না। আর তন্ময়দা যেহেতু বাংলা ভাষা নিয়ে চর্চা করে, তাই তাকেই বলবে ছেলের কী নাম রাখা যায়।
সুবল ছুটেছে গ্রামের দিকে, তন্ময়দার কাছে।
– এই নে তোর ছেলের বাঙালী নাম লিখে দিলাম কাগজে। এটা দিদিমণিকে দিবি যা।
সুবল আবার ছুটেছে। হাত পা ব্যথা করছে, তবু ছুটছে সুবল।
সোজা ছেলের কাছে। তার বউ বলল, কাউকে কিছু না বলে কোথায় গেছলে? ছেলের নাম রাখার জন্য দিদিমণিরা এসেছিল। আমরা আর কি নাম দেব, বললাম তোমরাই রেখে দাও। ওরা আমাদের ছেলের নাম দিয়েছে মাইকেল মাহাত। কি ভালো নাম না গো?
সুবলের পকেটে ছিল নাম লেখা কাগজটা। সুবল হাত ঢুকিয়ে দেখে কাগজটা ঘামে ভিজে জবজব করছে।
★★★