ছোটদের গল্প

পরিচিতিঃ
গল্পকার তরুণকুমার সরখেলের জন্ম পুরুলিয়ার এক গ্রামে। সেখানে নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ জীবন, উদোম প্রকৃতি তার শিল্পী হৃদয়ে ভাব সঞ্চার করে। ছোট থেকেই লেখালিখির চর্চায় নিজেকে নিজেকে সমর্পন কিশোরভারতী, শুকতারা, গণশক্তির মতো কাগজে তখনই মুদ্রিত হয় তাঁর ছড়া। ১৯৯৫ সালে শুরু করেন ‘সঞ্চিতা’ নামে একটি ছোটোদের পত্রিকা প্রকাশ করতে। আজও নিয়মিত প্রকাশিত হয় ওই পত্রিকা। পাশাপাশি আরো একটি ছোটোদের পত্রিকা -‘টুকলু’র তিনি সম্পাদক। তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে আনন্দবাজার, আনন্দমেলা, কিশোরভারতী, শুকতারা, সন্দেশ, চিরসবুজ লেখা প্রভৃতি পত্রিকায়।
ছোটদের জন্য শুধু ছড়া নয়, গল্পও লেখেন তিনি। রাজ্যের প্রায় সমস্ত শিশু ও কিশোর পত্রিকায় এবং বাংলাদেশের কয়েকটি কাগজে তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয়।
ছোটদের জন্য লেখা এই কবির বইগুলি পড়লেই তাঁর চরিত্রের স্বরূপ বোঝা যায়। তিনি অনাবিল আনন্দের দিশারী। শিশুমনের স্বপ্নলোকে অনায়াসে ঢুকে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন। অল্পসময়ের মধ্যেই তিনি পেয়েছেন অনেকগুলি সাহিত্য পুরস্কার। সংবর্ধনাও পেয়েছেন বহু জায়গায়। অন্যতম পুরস্কার হিসাবে পেয়েছেন পূর্ণেন্দু পত্রী স্মৃতি পুরস্কার (২০০২) ও সাহিত্য মন্দির পুরস্কার (২০১৯) ।

ত রু ণ কু মা র স র খে ল

ভাগলবার বাহাদুরি

ছোটমামা চারদিকটা বেশ ভালো করে দেখে বলল, “বাঃ ষ্টেশনটা কিন্তু চমৎকার জায়গায় !
পেছনে ছবির মতো পাহাড়ের সারি। সবুজ জঙ্গল।
ঠিক যেন একখানা খাতায় আঁকা ছবি।”
আমি বললাম, “মামা, পাহাড়কে পেছনে রেখে
তোমার একখানা ফটো তুললে কেমন হয় !” আমি
মোবাইল বের করে ছবি তোলার জন্য প্রস্তুত হলাম।
মামা বলল, “ট্রেন ছাড়তে মনে হয় একটু দেরি
আছে। চল কয়েকটা সেলফি তুলে ফেলি” এই বলে
আমাকে সঙ্গে নিয়ে মামা ট্রেন থেকে বেশ খানিকটা
দূরে যেখানে কয়েকটা জাম গাছ আছে সেখানে
চলে এল। আমাকে বলল, “তপু দেখেছিস, এখান
থেকে পাহাড়ের উপর কী সুন্দর একটা মন্দির দেখা
যাচ্ছে!”
আমি সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম সুন্দর একটা
সাদা রঙের মন্দির। মামাকে বললাম, “যে কোন
পাহাড়ের উপর মন্দির থাকবেই। এটা মাস্ট। আর
মন্দির যখন আছে তখন ওই মন্দির পর্যন্ত যাবার
জন্য একটা লম্বা সিঁড়িও আছে। প্রতিটি সিঁড়ির
জন্য কেউ না কেউ টাকা পয়সা দান করে। আর ওই
দানের টাকাতেই সিঁড়ি তৈরি হয়!”
মামা বলল, “এবার তোর লেকচার বন্ধ কর।”
এই বলে আমরা পাহাড় আর পাহাড়ের উপর যে
মন্দিরটা দেখা যাচ্ছিল তাকে পেছনে রেখে সেলফি
নিতে লাগলাম।
পর পর অনেকগুলো সেলফি তোলা হল। হঠা‌ৎ
দেখি সেলফির পেছনে কখন একটা শাখামৃগের
আবির্ভাব ঘটেছে। হনুমানের উপস্থিতির কারণে
মামার সেলফি উৎসাহে কিছুটা ভাটা পড়ল। কিন্তু ছোটমামা এবার ছবি তোলার অন্য সাবজেক্ট পেয়ে
গেল।
আমাকে বলল, “তপু হনুমানের কাছে চলে যা।
এবার তোর সাথে ওটার একটা ভালো শট নিতে
হবে। তোকেও তো আমি মাঝেমধ্যে ভালোবেসে
শাখামৃগ বলে থাকি। তাই দু-জনের একসঙ্গে
কয়েকটা ছবি নেওয়া দরকার !”
এরপর মামা সত্যি সত্যিই মুখপোড়া হনুমান
আর তার পাশে আমার ছবি তুলতে লাগল। হঠাৎ
আরো গোটা চারেক ধুমসো গোছের হনু
ফটো-সেশনে এসে যোগ দিল। এতগুলো গোদা
গোদা হনু দেখে আমি ভয় পেয়ে মামার কাছে চলে
এলাম।


ছোটমামা বলল, “ভয় কী ! চল আমিও বীর
হনুদের সাথে পোজ দিয়ে আসি।” মামা সামনে
পিছনে তাকিয়ে দেখল তেমন কাউকে পাওয়া যায়
কিনা। যে আমাদের দু-জনের একসঙ্গে দু-তিনটে
ছবি তুলে দেবে।
ষ্টেশনের পাশেই ছোট্ট একটা ঝোপড়পট্টি।
সেখান থেকে বেরিয়ে এল এগারো-বারো বছরের
একটি রোগা-পাতলা ছেলে।
ছেলেটির হাতে ছোট্ট একটা লাঠি। সে
অপেক্ষাকৃত ছোট একটা হনুমানকে লাঠি নিয়ে
তাড়া করতে করতে একেবারে আমাদের কাছে চলে
এল। আসলে ওই দুষ্টু হনুটা মাঝে মধ্যেই ঐ
ঝোপড়পট্টিতে গিয়ে উৎপাত করে আসে। তাই
ছেলেটি ওকে তাড়া করে এসেছে। কিন্তু হনুমানটা
এই পুচকে ছেলেটাকে তেমন পাত্তাই দিল না। বরং
দাঁত খিঁচিয়ে তেড়েও এল একবার।
মামা ছেলেটিকে কাছে ডেকে বলল, “অ্যাই তুই
এটা এইভাবে টিপে আমাদের ছবি তুলতে পারবি ?”
মামা ওকে মোবাইল ক্যামেরাটি দেখাল। ছেলেটি
সঙ্গে সঙ্গেই ফটো তুলতে রাজি হয়ে গেল।
আমি জানি ছেলেটা কিছুতেই ফটো তুলতে
পারবে না। আর তুলতে পারলেও হাত কেঁপে একটা
বিচ্ছিরি কাণ্ড হবে।
ছেলেটি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আমাদের ছবি
তুলবে বলে অনেকটা পিছিয়ে গেল।
মামা বলল, “আরে অত দূরে যাবার দরকার
নেই। ভালো করে দেখ পাঁচটা হনুমানই ছবিতে
আসছে তো?”
ছেলেটি বলল, “চারটে হনুজী আসছে।
আরেকটা ভাগলবা!”
আমরা পঞ্চম হনুকে লক্ষ্য করতে যাবো ঠিক
তখনই অঘটনটা ঘটে গেল। ছেলেটি যে
হনুমানটিকে লাঠি নিয়ে তাড়া করেছিল সেটা
ফাঁকতালে ছেলেটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত থেকে
মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে সোজা একটা ঝাপুড়-ঝুপুড়
গাছে চেপে গেল।
ওদিকে ট্রেনের যাত্রীরা জানালা দিয়ে ঘটনাটা
লক্ষ্য করছিল। তারাও মজা পেয়ে হৈ হৈ করে
উঠল। ছোটমামা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গাছের নীচে
এসে দাঁড়াল।
নীচ থেকে উপরে তাকিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেল,
হনুটা স্মার্টফোন স্ক্রোল করছে। মামা আমাকে
ডেকে নির্দেশ দিল, “তবু কুইক। ট্রেনের মধ্যে
দু-তিনটে ফলওয়ালা কলা বিক্রি করছিল দেখেছি।
তুই ওখানে গিয়ে ডজন খানেক কলা নিয়ে আয়।”
যে ছেলেটি ফটো তুলছিল সে আবার হু-স্-স্-স্
করে হনুমানটাকে তাড়া করতে যাচ্ছিল। মামা ওকে
থামিয়ে দিয়ে বলল, “এই ভাগলবা, একদম তাড়া
করবি না। তাড়া করলে ওটা ফোন সমেত দূরে চলে
যাবে। আমার অত দামি ফোন পড়ল কিনা বাঁদরের
হাতে ! ফোনটা শক্ত করে ধরে রাখতে পারলি না ?”
ছেলেটির নাম ‘ভাগলবা’ নয় মোটেই। মামা
ওকে ওই নামেই ডাকছে। ওর হাত থেকে ফোনটা
বদমাশ হনুমানটা কেড়ে নিয়েছে তাই মামা ওকে
দু-পেয়ে হনুমান বললেও ছেলেটা কিছুই বলবে না।
ভাগলবা গাছের দিকে তাকিয়ে নীচে চুপচাপ
দাঁড়িয়ে রইল। আর আমি ছুটলাম কলার খোঁজে।
কিন্তু খুঁজলেই কী সঙ্গে সঙ্গে কলা পাওয়া যায় !
হনুজী আঙুল চালিয়ে ফোন ঘাঁটছে তো
ঘাঁটছেই। কোনদিকে ওর নজর নেই। ভাগলবা
বিজ্ঞের মত বলল, “হনুদের দলটা টিশান চত্বরেই
ঘোরাফেরা করে। টেরেনের পিসাঞ্জররা যখন ফোন
করে তখন হনুরা মন দিয়ে সব শিখে লেয় !”
ওদিকে গাছের উপরে হনুটা হঠা‌ৎ ভিডিও তে
ঢুকে পড়েছে। একটা গান বাজতে শুরু করল হঠাৎ।
ব্যাস, হনুটার আর নীচে নামবার কোন ইচ্ছেই
থাকল না। চোখ দুটো স্ক্রিনে রেখে গাছের ডালে
ঠেস দিয়ে আরাম করে বসে পড়ল।
আমি এক ডজন কলা নিয়ে এসে ছোটমামার
হাতে ধরিয়ে দিলাম। মামা বলল, “দেখেছিস তপু,
হনুটা কেমন একমনে ফোন নিয়ে পড়ে আছে।
কলাগুলোর দিকে নজরই নেই।”
অন্য চারটে ধেড়ে হনু কলাগুলো হাতানোর চেষ্টা
চালাতে লাগল তা দেখে মামা সাবধান হয়ে গেল।
এদিকে ট্রেনের যাত্রীরা যারা প্লাটফর্মে
ঘোরাফেরা করছিল তারা সবাই ট্রেনের দরজা দিয়ে
উঠে পড়তে লাগল। ট্রেন কি ছাড়বে এবার ?
ভাগলবা বলল, “ইবার হুইশিল ছাড়বে। টেরেন
ছাড়ার আর দেরি নাই !”
আমি বললাম, “মামা আমার ফোন থেকে
একবার তোমার ফোনে ফোন করে দেখলে কেমন
হয়? হনুমানজী কলাগুলো রিসিভ না করলেও
আমার ফোন-কলটা রিসিভ করতে পারে। তখন না
হয় জোরে জোরে ‘জয় হনুমানজী কি’ বললে যদি
তার দয়া হয়।”
ওদিকে সত্যি সত্যিই ট্রেন ছাড়বার সিগন্যাল
দিয়ে দিয়েছে। অন্যান্য যাত্রীরা আমাকে ও
ছোটমামাকে ডাকতে শুরু করে দিয়েছে।
মামা করুণ চোখে গাছের উপরে তাকিয়ে বলল,
“যতক্ষণ ফোনে চার্জ আছে ততক্ষণই ফোনটা
বাজবে রে হনু। তারপর ওটা তোর আর কোন
কাজেই লাগবে না। তাই বলি এই কলাগুলো নে
আর ফোনটা দে !”
এই বলে মামা কলাগুলো এলোপাথাড়ি ছুড়ে
দিল। এদিকে জোরে হুইশেল বেজে উঠল ।
অন্যদিকে চারটে গদা হনুমান হুড়োহুড়ি করে
কলা করায়ত্ত করতে লেগে গেল।
আমি মামাকে টানতে টানতে নিয়ে এসে ট্রেনের
দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আমার ফোন থেকে
মামার ফোনে ফোন লাগালাম। দূর থেকে লক্ষ্য
রাখছি হনুর প্রতিক্রিয়া।
হনুমানটা হঠা‌ৎ ফোনটা ঝট করে হাত থেকে
ছেড়ে দিল। তারপর ঝাঁপ দিয়ে অন্য একটা গাছে
জোরে লাফ মারল। এদিকে ট্রেনও দুলে উঠেছে।
ভাগলবা ছেলেটি একেবারে ওস্তাদ ছেলে। ও
নীচে দাঁড়িয়ে একমনে হনুর দিকে তাকিয়ে ছিল।
হনু এক ঝটকায় ফোনটা ফেলে দিতেই ও দুর্দান্ত
একখানা ক্যাচ নিয়ে সেটা ধরে ফেলল।
ট্রেনের যাত্রীরা বিনি পয়সায় এমন সুন্দর
একখানা ক্যাচ দেখতে পেয়ে চটাপট চটাপট করে
হাত তালি দিয়ে ফেলল।
আর ভাগলবা ?
সে ক্যাচটা ধরে ফোন মুঠোয় করে ঝড়ের বেগে
চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়াতে লাগল।
তারপর দরজার কাছে এসে মামার হাতে ফোনটা
ধরিয়ে তবে শান্ত হল।
ফোনটা তখনও ভাইব্রেট হচ্ছিল।
হনুজীর ভালো ছেলের মতো ফোন ফেরত
দেওয়ার কারণটা এতক্ষণে পরিস্কার হয়ে গেল।
আসলে হনুজীর ঘাঁটা ঘাঁটির ফলে মামার
ফোনটা কোন সময় ভাইব্রেট মুডে চলে যায় আর
আমি ফোন করতেই ফোন কেঁপে ওঠে….।
যাই হোক, মামা দূর থেকেই ভাগলবাকে
একখানা সাবাশ দিল। আর আমি কপালে হাত
ঠেকিয়ে বলে উঠলাম “জয় হনুমান জী কি !”
ট্রেনের এই কামরার যাত্রীরা, যারা এই পুরো
ঘটনাটা স্বচক্ষে দেখেছ তারা এবার আমার সাথে
গলা মিলিয়ে বলে উঠল, “জয় !”

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *