নী হা রু ল ই স লা ম-এর ছোটগল্প

পরিচিতিঃ আব্বা- রফিকুল ইসলাম। মা- আকরেমা বেগম। জন্ম- ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭, মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘী থানার হরহরি গ্রামে (মাতুলালয়)। শিক্ষা- স্নাতক (কলা বিভাগ), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। নব্বইয়ের দশকের প্রথমেই লেখালেখি শুরু। বহরমপুরের ‘রৌরব’ পত্রিকায় প্রথম গল্প ‘ফুলি’ প্রকাশ। তার আগে ‘দেশ’ পত্রিকায় কবিতা ‘জন্মান্তর বৃত্তান্ত’ প্রকাশের মধ্যে দিয়ে বৃহত্তর পাঠকসমাজে আত্মপ্রকাশ। এযাবৎ সাড়ে তিন শতাধিক গল্পের রচয়িতা। প্রকাশিত গ্রন্থঃ ১। পঞ্চব্যাধের শিকার পর্ব (গল্প) ১৯৯৬, দিবারাত্রির কাব্য প্রকাশনী-চম্পাহাটি; ২। জেনা (গল্প) ২০০০, প্রচ্ছায়া-বারাসাত ; ৩। আগুনদৃষ্টি ও কালোবিড়াল (গল্প) ২০০৪, আকাশ-বহরমপুর; ৪। ট্যাকের মাঠে মাধবী অপেরা (গল্প) ২০০৮, দীপ-কলকাতা ; ৫। মজনু হবার রূপকথা (দু’টি নভেলার সংকলন) ২০১২, খোঁজ-লালগোলা ; ৬। জনম দৌড় (উপন্যাস) ২০১২, করুণা-কলকাতা; ৭। ঘাট আঘাটের বৃত্তান্ত (গল্প) ২০১৪, অভিযান-কলকাতা; ৮। বাবরনামা (গল্প) ২০১৪; আকাশ-বহরমপুর; ৯। ট্যাকের মাঠে মাধবী অপেরা (গল্প) পুনর্মুদ্রণ ২০১৬, সৃষ্টিসুখ-কলকাতা। ১০। নস্‌রুদ্দিন খোজার কিস্‌সা ২০১৮, সৃষ্টিসুখ-কলকাতা। ১১। পিরনানার জ্বিন, আবিষ্কার প্রকাশনী-কলকাতা, ২০১৮। ১২। ‘ইঁদুর, ইঁদুরের গর্ত, ধান এবং লখিরাম’ – (২০১৮) সপ্তম গল্পসংকলন,‘আলকাপ’, বহরমপুর। ১৩। ‘জমিন আসমান’ – (২০১৮) অষ্টম গল্পসংকলন, ‘নিউ ভারত সাহিত্য কুটির’, কলকাতা। ১৪। ‘ইচ্ছাপুতুল’ – (২০১৮) তৃতীয় উপন্যাস, ‘সৃষ্টিসুখ’, কলকাতা। ১৫। ‘যাদুলাঠি’,- (২০১৯) নবম গল্পসংকলন, ‘নিউ ভারত সাহিত্য কুটির’ কলকাতা। ১৬। ‘পরিকথা’- (২০২০), চতুর্থ উপন্যাস, ‘সৃষ্টিসুখ’, কলকাতা। ১৭। ‘উলঙ্গ স্নানের পর’-(২০২১) কাব্যগ্রন্থ, ‘স্রোত পাবলিকেশন’, লালগোলা, মুর্শিদাবাদ ২০০০ থেকে ‘খোঁজ’ নামে একটি অনিয়মিত সাহিত্য সাময়িকী’র সম্পাদনা।

 

নী হা রু ল ই স লা ম-র ছোটগল্প

আনন্দ ভৈরব

হাসান আজিজুল হক নামের একজন লেখকের ‘শকুন’ নামে একটি গল্প পড়ে আমি রীতিমতো আলোড়িত। খোঁজ নিয়ে জানলাম লেখক থাকেন রাজশাহীতে। তিনি শুধু সেখানে থাকেন না, সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। দর্শনের অধ্যাপক তো বটেই সেই সঙ্গে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রধান তিনি।
কিন্তু রাজশাহী তো ওপার বাংলার বরেন্দ্রভূমি! সেখানে বসে একজন লেখক এপারের রাঢ়ভূমির গল্প লেখেন কী করে? চটজলদি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, আমি রাজশাহী যাব। লেখকের সঙ্গে দেখা করব।
বন্ধু আসমহম্মদকে বলি ব্যাপারটা। আসমহম্মদের বাড়ি সীমান্তগ্রাম লতিবের পাড়ায়। তাদের বাড়ির পাশেই বর্ডার। ওপারে তার অনেক আত্মীয়স্বজন রয়েছে। সেই সূত্রে ওপারের সঙ্গে তার নিত্য যোগাযোগ। স্বভাবতই সে আমার রাজশাহী যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। পরের দিন আমি সকাল সকাল রাজশাহীর উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ি।
আমাদের লালগোলা, তার পাশেই বিশাল পদ্মার চর। চরে একটিই মাত্র বাংলাদেশী গ্রাম। নাম কোদালকাটি। সেই কোদালকাটি গ্রাম পেরোলেই পদ্মা। আর পদ্মার অপর পাড়েই গোদাগাড়ির অবস্থান।
গোদাগাড়ি একটা ছোট গঞ্জ। ঘন জনবসতির মাঝে কিছু দোকানপাট, স্কুল, থানা, বিডিআর ক্যাম্প। সেসব পেরিয়ে আমি গিয়ে পৌঁছই বাসস্ট্যাণ্ডে। নবাবগঞ্জ-রাজশাহী পাকা সড়কের ভায়া স্টপেজ হল এই গোদাগাড়ি। অতএব ছোট গঞ্জ হলেও জায়গাটির বেশ গুরুত্ব আছে। নদীঘাট থেকে বাসস্ট্যাণ্ডে যেতে যেতে সেটা আমি টের পাই। বাসস্ট্যাণ্ডে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে বাস আসে, আমি উঠে পড়ি তাতে। পরের স্টপেজ রেলবাজার। সেখানে কোনও এক পিরবাবা মানুষের সেবায় মাজারে শুয়ে রয়েছেন দীর্ঘদিন। যাতে তিনি আরও আরও অনেকদিন মাজারে শুয়ে মানুষের সেবা করে যেতে পারেন তার জন্য সেই মাজার-কমিটির লোকেরা বাস ঘিরে ধরে ধরে চাঁদা আদায় করছে। যে যা পারছে, দিচ্ছে। সামর্থ্য মতো আমিও দিলাম। যাতে পিরবাবার রহমতে ভিনদেশে আমার কোনও রকম বিপদ না ঘটে। অথচ রাজশাহী পৌঁছে আমার চক্ষু চড়কগাছ! চারপাশে পুলিশ আর পুলিশ। আমি যাব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার কাছে পাসপোর্ট নেই। তাই ভয়ে ভয়ে একটা রিক্সা নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে পৌঁছনোর আগেই আমার দম বন্ধ অবস্থা হয়। সেখানে এত পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পাই যে ভয়ে দূর থেকে রিক্সা ফিরিয়ে আমাকে চলে আসতে হয় নিরাপদ দূরত্বে। বন্ধু আসমহম্মদ বলেছিল, “তেমন কোনও অসুবিধায় পড়লে একজনের ঠিকানা দিচ্ছি। সোজা তার কাছে চলে যাবি। আমার কথা বলবি। আমার বন্ধু লোক। খুব ভাল মানুষ। তোর সব অসুবিধা দূর করে দেবে।” আমি রিক্সাবালাকে সেই লোকের কথা বললাম। রিক্সাবালা নিমেষেই আমাকে তার কাছে পৌঁছে দিল। পৌঁছে দিল মানে, প্রথমে একটা কানাগলি- সেটা পেরিয়ে রিক্সাবালা আমাকে যেখানে নিয়ে এল সেটা বস্তি মতো একটা কিছু। অন্তত আমার তাই মনে হল। আমি অনেক বস্তি দেখেছি। দেশভাগ জনিত কারণে আমার বাড়ির চারপাশে ৪৭/৭১-এ ওপার বাংলা ছেড়ে আসা অসংখ্য মানুষের বাস। যাঁরা আজকের দিনেও খলপার টাটির ওপরে করগেট টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরে বসবাস করে। সেরকম বস্তির মাঝে এটা একটা রাজবাড়ি যেন। যদিও জরাজীর্ণ। সিংহ দরজা আছে ঠিকই, কিন্তু পাল্লা নেই। তাই বোধহয় রিক্সাবালা একেবারে বাড়ির মধ্যে রিক্সা প্রবেশ করিয়ে একটা ঘরে আমাকে নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। শুধু তাই না, কাকে যেন হাঁক ছেড়ে বলে- অ ওস্তাদভাই দ্যাখো- তোমার ঘরে কারে আনছি!
এরই মাঝে আমি ভাড়া দিতে গেলে রিক্সাবালা বলে ওঠে- ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ! কী কন কত্তা? আপনি হইলেন হারঘের ওস্তাদভায়ের কুটুম! আপনার থেক্যা ভাড়া লিমু ক্যামনে? বলেই সে আর দাঁড়ায় না, চলে যায়।

ঘরের ভেতরটা স্যাঁৎসেঁতে। কেমন বিদঘুটে গন্ধ! তাবাদেও সব কেমন এলোমেলো। অগোছালো। সেসবের মধ্যে একটা ছাপরখাটে চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা একজন মানুষ রিক্সাবালার ডাকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আমাকে যেভাবে আপ্যায়ন করে, আমি হতবাক হয়ে যায়! আমার সম্পর্কে কিছু না জেনেই নিজের শুয়ে থাকা ছাপরখাটের তেলচিটে বিছানা ঝেড়ে আমাকে বসার জায়গা করে দেয়। তারপর আমার সম্পর্কে সব জেনে মানুষটি যা বলে, তা অনেকটা এরকম- বছেন ভাই। একটুখানি জিরান ল্যান। ছরবত খান। আপনার চিন্তার কুনু কারণ নাই। হামি আপনার ছঙ্গে আসি। আছমহম্মদভায়ের দোছত আপনি, মানে হামারো দোছত। মুনে করেন, এই বাড়ি আপনার লিজের বাড়ি। যত সহজে এবং যে আন্তরিকতায় মানুষটি আমাকে তার দোস্ত বানিয়ে নেয়, আমার মাথায় কিছুই ঢোকে না। তবে সত্যিকারের মানুষটির ‘ওস্তাদ’ নাম সার্থক মনে হয়। আমি দাঁড়িয়েই রয়েছি। ইতিমধ্যে একজন মহিলা বড় একটা ফুলতোলা কাঁচের গেলাসে সরবত নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার উদ্দেশে বলছে- ল্যান ভাই ধরেন। ছরবত খান। মহিলা নিশ্চয় ওস্তাদের বউ। সরবতের গেলাস হাতে নিতে নিতে অনুমান করি। কিন্তু বুঝতে পারি না, মহিলা একজন অপরিচিত পুরুষের সামনে এত স্বাভাবিক হয় কী করে? আমার হাতে সরবতের গেলাস ধরিয়ে দিয়ে ড্যাবড্যাব করে আমাকে দেখছে। তার মধ্যে মহিলাকে ঘিরে ধরেছে একগোণ্ডা বালবাচ্চা। তারা কিলবিল করছে। বলছে- মা, ছরবত খাবো! মা, ছরবত খাবো! দে না গে মা, ছরবত! এই দৃশ্য দেখে আমার হাতের সরবতের গেলাস হাতেই থেকে যায়। মুখে তুলতে পারি না। বাচ্চাদের দিকে খেয়াল নেই মহিলার। মেহেমানকে নিয়েই ব্যস্ত সে। নাকি এর মধ্যে অন্য কোনও গল্প আছে? হয়ত আমার দেশেই এই মহিলার বাপের বাড়ি। হয়ত বর্ডার পেরিয়ে বহুদিন সে তার বাপের বাড়ি যেতে পারেনি। হয়ত তার সেই দুঃখ আমাকে শোনাতে চাইছে। কিংবা শুনতে চাইছে তার মা-বাবা কেমন আছে? কিন্তু মেহেমান সরবতের গেলাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে যে! বিছানায় স্বামী বসতে জায়গা করে দিলেও বসেনি। হয়ত নোংরা বিছানা বলেই! হঠাৎ সেটা খেয়াল হতেই শরমে আপন মনে ‘ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ!’ বলতে বলতে মহিলা ছুটে যায় ঘরের বাইরে। মেহেমানকে বসতে দেবার জন্য কিছু একটা আনতে বোধহয়।
ওস্তাদ মানুষটা এতক্ষণ ঘরে ছিল না, কথা বলতে বলতে কখন বাইরে বেরিয়ে গেছিল, আবার ফিরে আসতেই আমি তাকে খেয়াল করি। ঘরের কোনায় থাকা আলমারি থেকে কী বের করতে করতে বলছে- জলদি করেন ভাই। ভারছিটির ক্লাস শুরুর আগেই আপনার হাছানছাহেবেরে ধরতি হবে। নাকি খুব দরের মানুষ! ছময়ের দর বোঝেন। হামি খোঁজ লি আইলাম। আপনি জলদি জলদি ছরবতটা খাইয়া ল্যান। এবারে আমি আর সরবত হাতে ধরে রাখতে পারি না, এক চুমুকেই খতম করে ফেলি। আমার যে এত তেষ্টা লেগেছিল তা বুঝতে পারিনি। আসলে ধূ ধূ বালির চরের ওপর দিয়ে প্রায় ঘণ্টা খানেক হেঁটে আসা, ভুটভুটি নৌকায় পদ্মা পেরনো। তারপর গোদাগাড়ি থেকে বাসে রাজশাহী বাসস্ট্যাণ্ড। সেখান থেকে রিক্সা চড়ে ঘুরতে ঘুরতে এখানে। শুধুমাত্র হাসান আজিজুল হক নামের এক গল্পকারের সঙ্গে দেখা করার জন্য। যিনি বরেন্দ্রভূমির মানুষ হয়ে রাঢ়ভূমির পটভূমিতে ‘শকুন’ নামের গল্প লেখেন কী করে? বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া এমন গল্প লেখা কিছুতেই সম্ভব নয়। তাছাড়াও ওই গল্পের চরিত্রগুলির মধ্যে আমি নিজেও একজন। আমি পড়াশোনার পাশাপাশি রাখালিও করেছি। রাখালবালকদের সঙ্গে ঠিক ওই গল্পের মতোই শকুন মেরেছি। শুধু তাই না, গল্পের চরিত্র যে ভাষায় কথা বলছে, আমি নিজেও সেই ভাষায় কথা বলেছি আমার শৈশব-কৈশরে। অথচ ভাষার চরিত্র হচ্ছে প্রতি দশ কিমি অন্তর বদলে যাওয়া। তাহলে এটা সম্ভব হয় কী করে? এইসব প্রশ্ন নিয়ে বিনা পাসপোর্টে বন্ধু আসমহম্মদের সহায়তায় আমি ছুটে এসেছি এই বিদেশবিভুঁইয়ে। যে দেশটাই আবার গণতন্ত্র নেই। সামরিক শাসকের অধীন। যেখানে সেখানে পুলিশ। মিলিটারি। অগত্যা এই ওস্তাদ মানুষটির দ্বারস্থ হওয়া। এসবের মধ্যে হয়ত জলতেষ্টার ব্যাপারটা চাপা পড়ে গিয়েছিল। বাড়ি থেকে বেরোতেই আমার চোখ পড়ে সিংহ দরজার বাঁ-দিকের একটি পরিত্যক্ত জায়গার ওপর। ইটের প্রাচীর ঘেরা। প্রাচীর কোথাও এক ফুট দাঁড়িয়ে আছে তো কোথাও মটির সঙ্গে মিশে গেছে। মধ্যেখানে একটা শিবলিঙ্গ। পাশেই একটা বেলগাছ দাঁড়িয়ে। জায়গাটাকে ছায়া করে রেখেছে। কানাগলি পেরিয়ে আমরা আবার বড় রাস্তায় উঠেছি। ওস্তাদ একটা খালি রিক্সা দেখে হাঁক ছেড়ে ডাক দেয়। রিক্সাবালা তাঁর ডাক শুনে এসে দাঁড়ায় আমাদের পাশে। আমরা চড়ে বসি তাতে। রিক্সা চলতে শুরু করে। সেই সঙ্গে রিক্সাবালার বকবকানি শুরু হয়- কনে যাইবেন ওস্তাদভাই? ছঙ্গে মেহেমান দেখত্যাসি। ইন্ডিয়া থেইক্যা আইত্যাসে বোধায়। কে লাগে? ভাবীজানের ভাই নাকি? বকবক না কইর‍্যা রিক্সা টান। ভারছিটি যাওন লাগবো। তার আগে নিজাম হোটেলে লিয়া চল। ধমকের স্বরে বলে ওস্তাদ। কিন্তু রিক্সাবালার মুখে আমি এ কী শুনছি? একথা তো আমি একটু আগে সরবতের গেলাস হাতে নিয়ে ভাবছিলাম। আশ্চর্য! এর মধ্যে রিক্সাটা আমাদের নিয়ে এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়ায় যে আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে। জায়গাটা দেখে আমি অবাক না হয়ে পারি না। রাস্তার ধারে নয়নজুলির ওপর গোটা গোটা বাঁশের পাটাতন। তার ওপর সার সার খলপার টাটির ওপর করোগেটের টিন দেওয়া ঝুপড়ি ঘর। ঘরগুলি আবার এক একটা হোটেল। কোনটার নাম ‘আমিনা’, কোনটার নাম ‘কোহিনুর’, কোনটার নাম ‘নিজাম’। ওস্তাদ বলে- নামেন ভাই, চলেন এট্টু নাছতা কইর‍্যা লিই। বাড়িতে শুধু সরবত খাইয়ে রিক্সা চড়িয়ে হোটেলে নাস্তা খাওয়াবে ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে আমি কোনও কুলকিনারা পাই না। বেবাক দাঁড়িয়ে থাকি। তা দেখে ওস্তাদ আবার আমায় তাগাদা মারে। না, এর পর আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। অগত্যা আমাকেও একটি হোটেলে ঢুকতে হয় ওস্তাদের পিছু পিছু। ভিতরে দেখি বাঁশের পাটাতনের ওপর গজাল গেঁথে বেঞ্চ-হাই বেঞ্চ আটকানো। তাতে বসে অনেকেই খাচ্ছে হোটেল-কর্মী, খরিদ্দারের হাঁটাচলায় পাটাতন দোল খাচ্ছে, কিন্তু কারও কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। খরিদ্দাররা খেতে ব্যস্ত। হোটেল-কর্মীরা খাওয়াতে ব্যস্ত। মালিক ক্যাশ মেলাতে ব্যস্ত। অথচ পেটে খিদে থাকা সত্ত্বেও আমার রীতিমতো ভয় করছে। বাঁশের পাটাতনের নীচেই বিশাল খাল। খালে জল কাদা সমান সমান। তার মধ্যে অসংখ্য কাক আর কুকুরের দাপাদাপি। কোনও কারণে পাটাতন ভেঙে পড়লে আর দেখতে হবে না, কাক-কুকুরে আমাদেরও ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। ইতিমধ্যে আমাদের সামনে নাস্তা পরিবেশিত হয়েছে। আমি খেয়াল করিনি। ওস্তাদ যখন বলল, খাইয়্যা ল্যান ভাই। ঠাণ্ডা মারলে আর খাইতে পারবেন না, চর্বি জমে যাবে। তখন আমি দেখি আমার সামনে বড় একটা চিনামাটির প্লেটে তন্দুরি রুটি আর একটা বড় বাটিতে পায়চা। পায়চা দেখে আমার চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। গরুর গোটা ঠ্যাঙ সাজিয়ে দিয়েছে যেন! কিভাবে খাব? এতবড় হাড় মুখে লাগিয়ে মজ্জ্বা টানা যায় নাকি? না, টানা যায় না। তবে খাওয়া যায়। আমি ওস্তাদকে দেখি, ওস্তাদ তার বাঁ-হাতটা পায়চার বাটির ওপর রেখে ডানহাতে পায়চার বড় হাড়টা শক্ত করে ধরে বাড়ি মারছে। ওতেই মোটা হাড়ের ভিতর থেকে মজ্জ্বা খসে খসে পড়ছে বাটিতে। গল্পকারের খোঁজে এসে আমি যেন গল্পের খোঁজ পাচ্ছি। আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। হয়ত সেই আনন্দেই আমি ওস্তাদকে জিজ্ঞেস করে বসি- ভাই, বাড়ি ছেড়ে আপনি আমাকে এতদূরে হোটেলে নাস্তা করাতে নিয়ে এলেন কেন?
ওস্তাদ খাওয়া বন্ধ রেখে বলে, দ্যাখেন নি ভাই হামার বাড়ির দূয়ারে একটা ছিবমন্দির আসে! আছলে ওই বাড়িটা সিলো এক হিন্দু লোকের। হামার বাপের কাছে সেই লোক ওই বাড়ি বিক্রি কর‍্যা ইন্ডিয়ায় চলে যায়। হামার বাপেরে কহে যায়, “আর কিসু না পারো, ছম্ভব হলে মন্দিরটার মান রাখিও।”
তাই হামরা বাড়িতে গোমাংছ ঢুকায় না ভাই।
একথা শুনে শুধু আমি একা আনন্দিত হই না, দেখি পাটাতনের নীচের জল-কাদায় অগুনতি কুকুর আনন্দে লটাপটি খাচ্ছে। গলাগলি যাচ্ছে। কাকগুলি হোটেলের নীচের বদ্ধ হাওয়ায় মুক্ত মনে উড়ে বেড়াচ্ছে। ভেসে বেড়াচ্ছে। কেউ কারও সঙ্গে লড়ালড়ি করছে না। কাড়াকাড়ি করছে না। সেই সঙ্গে আমি এটাও দেখতে পাই, ওস্তাদের বাড়ির সিংহ দরজার পাশে পরিত্যক্ত শিবমন্দিরে শিবলিঙ্গের মাথায় বসন্ত বাতাসে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বেলগাছ থেকে একটা দু’টো বেলপাতা খসে খসে পড়ছে। জীব-প্রকৃতির সব আনন্দ উল্লাস ভেসে আসছে আমার কানে। আমার সব ভয় কেটে যাচ্ছে।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *