মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি
ঋত্বিক, শ্যামল, সুমিতা, দীপক এবং মীনা – সবাই শিমুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা। ঋত্বিক, সুমিতা এবং দীপক অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। শ্যামল আর মীনা সপ্তম শ্রেণির। সকলেই পাশের মালবান্দি আশুতোষ বিদ্যামন্দিরে পড়াশোনা করে। গতকাল থেকে বিদ্যালয়ে গরমের ছুটি পড়ে গেছে। ছুটি চলবে টানা একমাস। সেদিন বিকালে সবাই খেলার মাঠে উপস্থিত হয়েছিল। এটা–সেটা আলোচনা করতে করতে ঋত্বিক হঠাত্ বলে উঠল – ‘দীপক দেখ, খেলার মাঠের চারপাশটা কী নোংরা। যেন একটা অবর্জনার স্তুপ। যতরকম কাগজের টুকরো পড়ে রয়েছে, পড়ে রয়েছে যত্রতত্র পলিথিন আর প্লাস্টিকের বোতল। যে যা পারছে খাচ্ছে আর ছুঁড়ে ফেলছে।’
সুমিতা বলে উঠল – ‘এভাবেই তো পরিবেশটা আমাদের দূষিত হচ্ছে। কারুর কোনরকম সচেতনতা নেই।’
মীনা বলল – ‘আসলে নির্দিষ্ট করে ফেলার জায়গা নেইতো তাই এমনটা করছে। আবর্জনা ফেলার কয়েকটা জায়গা যদি মাঠের চারপাশে থাকতো তাহলে ভালো হত। আর সবাইকে ঘোষণা করে জানিয়ে দিলেই হত যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা না ফেলে ওই নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলতে। যেমনটা আমরা বিদ্যালয়ে করি।’
শ্যামলের সঙ্গে সঙ্গে চটজলদি উত্তর – ‘মীনা ঠিক কথাই বলেছে। এটা করলে সত্যি মন্দ হবে না। এর ব্যবস্থাটা যদি আমরাই করে ফেলি তাহলে কেমন হয়?’
ঋত্বিক বলল – ‘ঠিক আছে, কালকেই আমি কয়েকটা আবর্জনা ফেলার পাত্র নিয়ে আসব। আমাদের বাড়িতে কয়েকটা ডিমের খালি পেটি আছে। সেগুলো নিয়ে আসব।’
শ্যামল বলল – ‘আমাদের বাড়িতে একটা খুব বড়ো অ্যালুমিনিয়ামের বালতি আছে। সেরকম কোনো কাজে লাগেনি। এখানে নিয়ে এসেই কাজে লাগাব।’
দীপকের সবেতেই একটুখানি বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব। সে বিজ্ঞের মতোই বলল – ‘আচ্ছা ঋত্বিক, এই ভাবনাটা যদি বড়ো কাজে লাগাই কেমন হবে?’
ঋত্বিক বলল – ‘ভাবনার কথাটা আগে বল শুনি।’
দীপক বলল – ‘সত্যিই তো আমরা বিদ্যালয়ে যখন থাকি তখন মিশন নির্মল বাংলা কিংবা স্বচ্ছ ভারত অভিযানের স্বপক্ষে মিছিল দিই, শ্লোগান দিই এই নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি বিদ্যালয়ে পালিত হয়। তাতে আমরা সামিল হই। কিন্তু বাড়ি এসে বেমালুম ভুলে যাই। কিন্তু এটা যদি না ভুলে আমাদের গ্রামে ফিরে সেই ভাবনাটা কাজে লাগাই মনে হয় একটা কাজের কাজ হবে। আমরা যেটা চাইছি, আমাদের দেশ যেটা চাইছে আমরা সেটা গড়ে তুলতে পারব। আমরা তো আমাদের নিজের গ্রামকে আমরা সোনার গ্রাম হিসাবে গড়ে তুলতেই পারি। কী পারি না?’
সুমিতা বলল – ‘তাতো পারিই, কিন্তু আমাদের সময় কোথায়?’
মীনা বলল – ‘শোন সুমিতা, সময় আমরা পেয়ে যাব। আমাদের স্কুলে গরমের ছুটি পড়ে গেছে না? এ সময়টাকে আমরা কাজে লাগাতেই পারি। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে ওই একটু-আধটু সময় বের করে নেওয়া যেতেই পারে। এখন শুধু প্রয়োজন আমাদের বসে ঠিকমতো একটা পরিকল্পনা নেওয়া।’
দীপক বলল –‘ঠিক আছে, আজ রাতে আমরা সবাই ভাবব, কিভাবে কী করা যায়। কাল এমনি সময়ে এসে সবাই সবার মতামত দিস। আপাতত আমরা আজকে একটা কাজ করতে পারি তা হল এই মাঠের আবর্জনাগুলো এক জায়গায় জড়ো করা। চল আজ থেকেই কাজে লেগে পড়া যাক।’
২
দীপকের কথায় সবাই উঠে পড়ল। তারপর মাঠের চারপাশে যত ছেঁড়া কাগজ, পলিথিন, জলের বোতল পড়েছিল তা একটা জায়গায় জড়ো করে ফেলল। ওদের দেখাদেখি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে সব ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে তারাও এসে হাত লাগাল। মুহূর্তের মধ্যে মাঠের চারপাশ পরিষ্কার।
পরের দিন বিকালে যথারীতি ঋত্বিকরা আবার সবাই মাঠের মধ্যে উপস্থিত হয়েছে। ঋত্বিক তার কথা রেখেছে। সে নিয়ে এসেছে বড়ো বড়ো চারটা ডিমের খালি পেটি। তাতে লাল কালি দিয়ে লিখে দিয়েছে ‘আমি ডাস্টবিন, আমাকে ব্যবহার করো’। মাঠের চারপ্রান্তে চারটা বসিয়ে দেওয়া হল। সত্যি সত্যিই কাজ হল তাতে। যারা মাঠে এসেছিল তারা সবাই ওই নির্দিষ্ট জায়গাতেই আবর্জনা ফেলতে লাগল। এরপর ওরা কে কি পরিকল্পনার কথা ভেবেছে তার ব্যাখ্যা দিতে লাগল।
সুমিতা বলল – ‘আমি ভেবেছি, শুধু আমার খেলার মাঠের চারপাশ না আমরা পুরো গ্রামটাকেই নির্মল মিশন বাংলার আওতায় নিয়ে আসবো। এর জন্য যা যা করা দরকার আমাদের করতে হবে।’
দীপক বলল – ‘আমারও এই ইচ্ছা। গরমের ছুটির পুরো মাসটা যদি আমাদের ইচ্ছাটা প্রয়োগ করি তবে ভালো কিছু হবেই হবে।’
ঋত্বিক, মীনা, শ্যামলও এক বাক্যে দীপকের কথায় সায় দিল। মীনা বলল – ‘তাহলে এরজন্য আমাদের একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। আমার মনে হয় এই ব্যাপারে গ্রামের মানুষজনকে নিয়ে একটা আলোচনা সভা করলেই হয়। আমরা কি কি করতে যাচ্ছি সেকথা গ্রামবাসীদের জানালে কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। আমি এই স্বচ্ছ ভারত অভিযান নিয়ে কয়েকটা ভালো গান লিখেছি সেগুলো ওই আলোচনা সভায় শুনিয়ে দেব।’
ঋত্বিক হাততালি দিয়ে বলে উঠল – ‘ বা, খুব ভালো আইডিয়া। তাহলে তাই হোক।’
পরেরদিনই গ্রামের বিদ্যালয় সংলগ্ন মাঠে তাদের শিমুলিয়া গ্রামকে নির্মল গ্রাম, সোনার গ্রাম গড়ার লক্ষ্যে একটা মিটিং-এর আয়োজন করে ফেলল এ ক’টি ছাত্রছাত্রী। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারাই গ্রামবাসীদের ডেকে আনল। দীপকের বাড়িতে মাইক আছে। সে অনুষ্ঠানের জন্য মাইকের ব্যবস্থা করে ফেলল। মীনা সত্যিই ভালো গান করে। সে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে গান ধরল – মিশন নির্মল বাংলা অভিযানের গান।
গান শেষের পর মিটিং ডাকার উদ্দেশ্যটা কি তা নিয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যা করল ঋত্বিক। সারমর্ম এই তারা তাদের গ্রামকে নতুনভাবে সাজবে। নির্মল গ্রাম হিসাবে গড়ে তুলবে। শৌচাগারের ব্যবহার, যাদের শৌচাগার নেই অবিলম্বে তাদের শৌচাগার বানানো ইত্যাদির কথাও তুলে ধরল। অনেকের বাড়িতে শৌচাগার থাকা সত্ত্বেও তা ব্যবহার করে না। পুকুর পাড়, নদীধারে ছুটে যায় প্রাত:কৃত্য সারতে। সভায় দাবি জানানো হল – এটা বন্ধ করতেই হবে। ঋত্বিকদের পরিকল্পনার কথা শুনে গ্রামবাসীরা সবাই খুশি। তাদের উদ্যোগকে সবাই সাধুবাদ জানাল।
ব্যস, ঋত্বিকরা পুরোদমে লেগে পড়ল কাজে। সোনার গ্রাম বানানোর কাজে। সবাই মিলে তারা দিনের একটা সময়কে বেছে নিল এই কাজ করতে। গ্রামের রাস্তায় মাঝে মাঝে ডাস্টবিন রাখার ব্যবস্থা করল নিজেরাই। তার সাথে পাশে পাশে নিজেরাই হাতে লিখে পোস্টার বানিয়ে গাছে কিংবা খুঁটিতে সেঁটে দিল। এমন কি নদীধার, পুকুরপাড় সেখানেও লাগিয়ে দিল এই পোস্টার। যাদের মধ্যে একটুখানি কিন্তুবোধ ছিল তারাও লজ্জা পেয়ে শেষপর্যন্ত ঋত্বিক-শ্যামলদের কাজকে সমর্থন জানাল। পনেরো দিনেই মধ্যেই গ্রামের রাস্তাঘাটের চেহারাটাই পালটে গেল। একটা সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশ। সব ঝকঝকে-তকতকে। প্রথমদিকে ঋত্বিকরা পাঁচজন মিলে কাজে লেগেছিল। কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের সংখ্যা পঁচিশজন ছাড়িয়ে গেল।
কিছুদিন পরেই ভোট। পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে। শিমুলিয়া গ্রামেও একটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্র আছে। এই ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের হাল-হকিকত সরেজমিনে তদন্ত করার জন্য শিমুলিয়া গ্রামে এলেন স্থানীয় বিডিও সাহেব এবং জেলার ইলেকশন কমিশনের রিটার্নিং অফিসার। তাঁরা শিমুলিয়া গ্রামে পা দেওয়া মাত্রই চমকে উঠলেন। একটা গ্রাম যে এত সুন্দর হতে পারে এটা তাঁদের ভাবনার মধ্যেই ছিল না। মিশন নির্মল বাংলা এবং স্বচ্ছ ভারত অভিযান যে এখানে দারুণভাবে সফল তা তাঁরা নিজের চোখে দেখলেন। হলেন মুগ্ধ। স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যকে ডেকে বললেন – ‘আপনারা তো মশাই দারুণ কাজ করেছেন। আপনারা তো আপনাদের গ্রামকে সোনার গ্রাম করে তুলেছেন।’
পঞ্চায়েত সদস্য বলল – ‘না স্যার, আমাদের কৃতিত্ব কিছুই নেই।’
বিডিও সাহেব খানিকটা অবাক হয়ে বিস্ময়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন – ‘আপনি বলছেন আপনাদের কোনো কৃতিত্ব নেই। তাহলে এই সাফল্যের উত্স কী?’
পঞ্চায়েত সদস্য তখন রাখঢাক না করেই বলে ফেলল – ‘স্যার, আমাদের গ্রামে কয়েকজন পাগল ছেলেমেয়ে আছে। তারাই এতসব করেছে। তারা সকলেই আবার ছাত্রছাত্রী। গরমের ছুটি পড়েছে। কী করবে? তাই ভাবনা-চিন্তা করে এই
৩
কাজে নেমেছে। নিজেদের গ্রামকে তারা নিজেরাই এরকম সুন্দরভাবে সাজিয়েছে। আমরা শুধু তাদের সহযোগিতা করেছি মাত্র।’ বলে পঞ্চায়েত সদস্য ঋত্বিক, শ্যামল, মীনা, সুমিতা এবং দীপকের কথা বলল। তারা কিভাবে কাজটা করেছে সেটাও সবিস্তারে জানাল।
সব শুনে রিটার্নিং অফিসার সঙ্গে সঙ্গে বললেন – ‘এই ছাত্রছাত্রীরা তো অসাধ্য সাধন করেছে। উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এদের তো সবার আগে পুরস্কৃত করা উচিত। যাতে করে এদের দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাশের গ্রামের ছাত্রছাত্রীরাও কাজে নামতে পারে।’ বলে সামনের বিডিও সাহেবকে বললেন – ‘স্যার, খুব তাড়াতাড়ি আপনার ব্লক থেকে উদ্যোগ নিয়ে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করুন এই গ্রামে। এই পাঁচ ছাত্রছাত্রীকে সম্মান জানানোর ব্যবস্থা করুন, সম্বর্ধিত করুন।’
বিডিও সাহেব খুব তাড়াতাড়ি সে উদ্যোগ নিয়ে নিলেন। স্থানীয় পঞ্চায়েতকে নিয়ে বিরাট এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। সেখানে মিশন নির্মল বাংলা এবং স্বচ্ছ ভারত অভিযানের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষরা এলেন। এল মিডিয়ার লোকজন। সেই অনুষ্ঠানে সম্বর্ধিত করা হল ঋত্বিকদের। আনন্দে ওদের সবার চোখে জল এসে গিয়েছিল। ঋত্বিক আবেগতাড়িত কন্ঠে বলল – ‘এবার গরমের ছুটিতে আমরা এই উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এই উদ্যোগ আমাদের চিরজাগরূক থাকবে। আমাদের গ্রামকে আমরা সোনায় সোনাময় করে তুলতে চাই।’ অনুষ্ঠানে আগত শ্রোতামণ্ডলী হাততালিতে ফেটে পড়ল।