‘গরীবের ঘোরা রোগ’-এ “শৈবতীর্থ”

পরিচিতিঃ রাকেশ সিংহদেব প্রকৃতি প্রেমের আরেক নাম।ভালোবাসার কোনও বাটখারা হয় না তা লেখকের সাথে না যাপন করলে বোঝা বড্ড দায়।মূলত রাকেশ একজন ছবিওয়ালা।আর তার চর্চার আধার সেই সব অবলা জীবজন্তু পশু পাখি।নিয়মিত লেখেন বিভিন্ন বানিজ্যিক পত্রিকায়।এই মুহূর্তে কাজ করছেন হাতি নিয়ে।বিভিন্ন “পরিবেশ বাঁচাও” সংস্থার সাথে জড়িয়ে ফেলেও তিনি নিরঙ্কুশ।একক।তিনি জানেন ভালোবাসতে ফেরৎ পেতে নয়।ইনি বাইফোকালিজম্-এর অন্যতম সদস্য।

শৈবতীর্থ পঞ্চলিঙ্গেশ্বর


লেখা ও ছবি রা কে শ সিং হ   দে ব


এক পাহাড়ি ফাটলের ভেতরে সফেন ঝরনার জলে অবস্থান করেন দেবতা। যিনি লিঙ্গ রূপে প্রতীকী কিন্তু বর্ননায় অসীম! তিনি আদিদেব, তিনি পঞ্চজনের আরাধ্য ঈশ্বর, তাই তিনি সাক্ষাৎ ‘পঞ্চলিঙ্গেশ্বর’। ভারতে প্রাচীনকাল থেকে পর্যটনে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আধ্যাত্মিকতার মিলনভূমি এই দেশে তীর্থযাত্রার এক অর্থই হল পর্যটন। বলা হয় তীর্থ যাত্রায় বাড়ে মনের উদারতা, বাড়ে জ্ঞাত জ্ঞানের গভীরতা ও বিশালতা, ঘটে বিভিন্ন সামাজিক এবং ধর্মীয় আচার-সংস্কারের সংমিশ্রন, লক্ষ্যনীয় ভাবে ব্যাক্তিগত ও জাতিগত স্তরে সহযোগিতা ও সমন্বয় বাড়ে। এই মহৎ উদ্দেশ্যে এদেশে একের পর এক তীর্থক্ষেত্রের আবিষ্কার হয়েছে। সপ্তাহান্তের ছুটিতে দেব মাহাত্ম্যের সাথে নিরালা-নিভৃতে সপরিবারে অবকাশ যাপনের এক দারুণ ঠিকানা ওড়িশার প্রসিদ্ধ শৈবতীর্থ পঞ্চলিঙ্গেশ্বর। পাহাড়, ঝরনা, দেবস্থানের পাশাপাশি এখানকার পাহাড়িয়া আরণ্যক পরিবেশে মেলে অপার্থিব শান্তির খোঁজ। পাহাড়ের গায়ের পান্নাসম জঙ্গল আর দিগন্তের নীল মিলেমিশে নীলাভ পঞ্চলিঙ্গেশ্বর জ্যোত্স্না রাতে মায়াবি রূপ ধরে। কিংবদন্তী অনুসারে এ হল মহাভারতের দেশ। এখানকার মানুষরা বিশ্বাস করেন পঞ্চলিঙ্গেশ্বরই হল মগধরাজ জরাসন্ধের জন্মস্থান। এখানেই কাছাকাছি কোথাও নাকি মধ্যম পাণ্ডব ভীম আর জরাসন্ধের সেই ভীষণ মল্লযুদ্ধ হয়েছিল। এই শিবলিঙ্গগুলি নাকি মহাভারতের প্রবল পরাক্রমী রাজা জরাসন্ধের প্রতিষ্ঠিত। তিনি এখানে তাঁর আরাধ্য মহাদেবের নিত্যপূজা করতেন। অপর মতে অথর্ববেদোক্ত অসুরগৌরব সাধক বেণ বা বাণ এই আরণ্যক পরিবেশে শিবপুজা শুরু করেন এবং পাহাড়ের ঝরনার মধ্যে এই সয়ম্ভূ লিঙ্গ আবিষ্কার করে। এই শৈবসাধকের নামে আকাশের একটি উজ্বল তারার নাম বাণ (RIGEL)।
ওড়িশার শৈবতীর্থগুলির মধ্যে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর অন্যতম।

অনুচ্চ পাহাড়ের খাদে ছোট্ট এক ফাটলে বহতা জলে দেবতা পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের অর্থাৎ পাঁচটি শিবলিঙ্গের অধিষ্ঠান। মিষ্টি মধুর তানে ঝরনার জল নামছে পাহাড় থেকে। সেই ঝরনার জল এসে জমছে নীচের একটি গর্তে। জলভর্তি এই গর্তের ভিতর রয়েছে পাঁচটি শিবলিঙ্গ। বাইরে থেকে দেখা যায়না। জলে হাত ডুবিয়ে শিবলিঙ্গগুলি স্পর্শ করা যায়। দেব দর্শনের জন্য চড়তে হবে টিলার মাথায়। চিন্তার কোনও কারণ নেই, দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে টিলার উপরে চড়বার জন্য রয়েছে সিঁড়ির ব্যবস্থা। এই টিলার চারপাশের গা ছমছমে পরিবেশ ঘিরে রয়েছে আম, শিরীষ, শাল, অর্জুন, অশোক, আকাশমণি ইত্যাদি গাছ। বসন্তে বুনো ফুলের গন্ধ ভেসে আসে বাতাসে। দুপুরেও শান্ত স্নিগ্ধ ছায়া ঢেকে রাখে চারদিক। এমনই মনোরম পরিবেশ যে, আপনার অন্দরের রোমান্টিক সত্তা জেগে উঠতে বাধ্য। একটু এগোলেই পঞ্চলিঙ্গেশ্বর ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি। এটা আসলে কুলডিহা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি-এর বর্ধিত অংশ। ঘন বনানীর ঠাস বুনোটে নানা জীবজন্তু রয়েছে এই পাহাড়ে। পঞ্চলিঙ্গেশ্বর মন্দির এলাকার প্রাচীরের বাইরের পাহাড়ি জঙ্গলে রয়েছে প্রচুর হাতি। প্রতিদিন গভীর রাতে তারা ঝর্ণার জল খেতে আসে। চেনা অচেনা নানান পাখির মেলা সারাবছর দেখা যায় চারপাশে। ময়না, টিয়া, হলুদ খঞ্জনা, নীলমাথা দামা, প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার, তইগা ফ্লাইক্যাচার, বুলবুল, কমলা দামা এর মতো নানা প্রজাতির পাখির কূজনে মুখরিত হয় পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের তীর্থক্ষেত্র। সীতের সময় পাহাড়ের নীচে জমিয়ে পিকনিক করতে আসেন হাজার হাজার মানুষ। গাড়ি এবং মানুষের কোলাহলে সেসময় রীতিমত মেলা বসে যায় পাহাড়ের নীচে।


তিনি অনন্ত, তিনি প্রাচীন। তিনি সময়ের অতীত, তিনি মহাকাল। সনাতন সংস্কৃতির আদিপর্ব থেকে তিনি পূজিত দেবাদিদেব হিসেবে। বেদ বলেছে, তিনি ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র এই চতুর্বর্ণের বাইরে অবস্থিত পঞ্চম বর্ণ। তিনি পঞ্চজনের ঈশ্বর। ভারতবর্ষের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে রয়েছে আদিযোগীর দৈবী আধ্যাত্মিকতার মহাত্ম। ভক্তের কাছে তিনি স্নেহশীল ভোলেবাবা, তাই তাঁর দর্শনলাভের জন্য দূরদুরান্ত থেকে ছুটে আসেন অগণিত ভক্তবৃন্দ। আজও তাই ‘ভোলেবাবা পার করেগা’ উচ্চারণ করতে করতে ঘর ছেড়ে দেবদর্শনে বেরিয়ে পড়ে ভক্তকুল। ভোলেবাবা কোথায় কীভাবে পার করেগা তা একমাত্র জানে বিশ্বাসীর হৃদয়। আসলে একথা প্রবলভাবে সত্য, এই ভারতভূমিতে আজও বিশ্বাসে মেলে ভগবান, আর অবিশ্বাসী ভ্রমণে পোড়ায় ক্যালোরি!

কীভাবে যাবেন: হাওড়া থেকে ধৌলি, ফলকনামা, ইস্টকোস্ট বা জনশতাব্দী ধরে নামতে হবে বালেশ্বর স্টেশনে। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর। বালেশ্বর স্টেশন থেকে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর-এর দূরত্ব প্রায় ২৮ কিমি দূরত্ব। কলকাতা থেকে দূরত্ব ২৯০ কিমি। গাড়িতে প্রায় পাঁচ-সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা মতো লাগে। নিকটবর্তী সমুদ্রসৈকত চাঁদিপুর থেকে দূরত্ব প্রায় ৪৪ কিমি।

খেয়াল রাখুন: পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের শিব লিঙ্গ দর্শণার্থীদের জন্য প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শক্তিশালী টর্চ, মশা তাড়াবার ধূপ বা ক্রিম সঙ্গে রাখুন। জঙ্গলের মধ্যে গাইড ছাড়া যাবেন না। স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে সদ্ভাব রাখবেন। জঙ্গল এলাকায় রাতে বাইরে না বেরানোই ভালো। পঞ্চলিঙ্গেশ্বর পাহাড়ের নীচের ছোট বাজার থেকে বাড়ির জন্য অবশ্যই সংগ্রহ করে নিয়ে যান এখানকার বিশেষ মিষ্টি ‘খাজা’। পিকনিক দলের জন্য স্বল্পমূল্যের কয়েকটি পিকনিক শেডের ব্যবস্থা রয়েছে। পানিয় জলের ব্যবস্থা রয়েছে। পিকনিকের জন্য শেড না পেলে খোলা আকাশের নীচেই জমে হুল্লোড় মৌতাত।

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *